সপ্তম মাস্আলা
দেনিজলি কারাগারে থাকাকালীন এক শুক্রবারের ফল
অসীম করুনাময় ও পরম দয়ালূ আল্লাহর নামে
“আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহরই এবং কিয়ামতের ব্যাপার কেবল চোখের পলকের মত, বরং তার চেয়েও তাড়াতাড়ি” (১৬-সূরা আন্ নাহল ৭৭)
‘তোমাদের সকলের সৃষ্টি ও পুনরুত্থান একটি প্রাণীর সৃষ্টি ও পুনরুত্থানেরই অনুরূপ ” (৩১-সূরা লোকমান ঃ ২৮)
আল্লাহর অনুগ্রহের ফলাফল সম্পর্কে চিন্তা কর, কিভাবে তিনি ভূমিকে জীবিত করেন এর মৃত্যুর পর। এভাবেই আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান” (৩০-সূরা রূম ঃ ৫০)।
একদিন আমি কাস্তামনোতে কিছু সংখ্যক হাইস্কুল ছাত্রের নিকট একাডেমিক বিজ্ঞানের দারস্ পেশ করেছিলাম, যারা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আমাদেরকে আমাদের স্রষ্টার পরিচয় কি তা ব্যখ্যা করুন’, যেমনটি ইতোমধ্যে উল্লিখিত ‘ষষ্ঠ মাসআলা’তে বর্ণিত হয়েছে। দেনিজ্লি কারাগারে অবস্থানরত বন্দিদের মধ্যে যারা আমার সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিল তারা এই ‘ষষ্ঠ মাসআলা’ পাঠ করেছিল এবং এর ফলে তাদের মধ্যে ঈমানী দৃঢ়তার পূর্ণ পরিতুষ্টি অর্জিত হয়েছিল, যা তাদের মধ্যে আখিরাতের প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। তাই তারা আমাকে এই মর্মে অনুরোধ করল, “আমাদেরকে আখিরাতের বিষয়েও পুরোপুরি শিক্ষা দান করুন যাতে এরপরে আমাদের নাফ্স (প্রবৃত্তি) ও যুগের শয়তানরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে না পারে এবং আমাদেরকে এ ধরনের কারাগারে নিক্ষেপ করতে না পারে” সুতরাং দেনিজ্লি কারাগারের ‘রাসাঈলে নূর’-এর শিক্ষার্থীবৃন্দের দাবীর প্রেক্ষিতে ও ‘ষষ্ঠ মাসআলার’ পাঠকদের প্রবল আগ্রহের কারণে গুরুত্বপূর্ণ ঈমানী রূকন ‘আখিরাত’ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ বর্ণনা করার আবশ্যকতা অনুভব করলাম।
তাই রাসাঈলে নূর থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে বলছিঃ ‘ষষ্ঠ মাসআলাতে’ যেমনভাবে আমরা পৃথিবীকে ও আকাশসমূহকে আমাদের পবিত্র ও মহান স্রষ্টা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছি এবং তারা আমাদেরকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় জবাব দিয়েছে এবং আমাদেরকে সূর্যের স্পষ্টতার মত আমাদের দয়াময় স্রষ্টার স্পষ্ট পরিচয় প্রকাশ করেছে। এমনিভাবে এখন আমরা প্রথমে আমাদের প্রতিপালককে জিজ্ঞাসা করব যাকে আমরা নিশ্চিতভাবে চিনেছি, এরপর জিজ্ঞাসা করব আমাদের মহান রাসূলকে এরপর আমাদের কুরআনুল কারীমকে এরপর অন্য সকল নবী রাসূলদেরকে এবং পবিত্র গ্রন্থসমূহকে এরপর ফেরেশতাদেরকে এরপর সৃষ্টিজগতকে।
প্রথম পর্যায়ে আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে ‘আখিরাত’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি। তিনি তাঁর সকল নির্দেশাবলী ও সকল সম্মানিত রাসূল, তাঁর সুন্দরতম নামসমূহ ও মর্যাদাপূর্ণ গুণবাচক নামসমূহের মাধ্যমে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে জবাব দিচ্ছেন ঃ ‘আখিরাত সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই এবং তোমাদরেকে অবশ্যই সেদিকে চালিত করা হবে। ‘দশম বাণী’ বারটি অকাট্য ও স্পষ্ট সত্যের মাধ্যমে আখিরাতকে প্রমাণ করেছে এবং আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর নামসমূহের মর্ম ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে একে স্পষ্ট করেছে। একারণে ঐ ব্যাখ্যাকে যথেষ্ট মনে করে আমরা এখানে ঐ ব্যখ্যার দিকে সংক্ষিপ্তভাবে ইঙ্গিত দিব ।
হ্যাঁ, এমন কোন সম্রাট নেই, যে তার অনুগতদেরকে পুরস্কৃত করে না এবং বিদ্রোহীদেরকে শাস্তি দেয় না। সুতরাং চিরন্তন সম্রাট, যিনি চুড়ান্ত ও সর্বোচ্চ প্রভূত্বের অধিকারী, অবশ্যই তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন যারা ঈমানের মাধ্যমে তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে এবং আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর নির্দেশাবলী পালন করে এবং অবশ্যই তাদেরকে শাস্তি দিবেন যারা কুফরী ও পাপাচারের মাধ্যমে তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতাকে অস্বীকার করে। আর এই পুরস্কার অবশ্যই তাঁর দয়া ও সৌন্দর্যের সাথে মানানসই হবে এবং এই শাস্তিও তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা ও প্রতাপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
এর মাধ্যমে ‘আস্ সুলতানুদ্দাইয়্যান’ (ন্যয়পরায়ন সুলতান) ও ‘রাব্বুল আলামিন’ (জগতসমূহের প্রতিপালক) এই নামসমূহ আখিরাত সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞাসার জবাব দিচ্ছে। এরপর আমরা সূর্যের স্পষ্টতার ন্যায় স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি যে, সর্বব্যাপী দয়া, সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী করুনা এবং ব্যাপক বদান্যতা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে। যখনই বসন্তকাল আসে তখন তুমি দেখবে তাঁর দয়া ফলবান গাছ-পালা ও তৃণলতাকে নতুন রূপে সজ্জিত করছে এবং এগুলোকে সবুজ-শ্যামল পোষাক পরিয়ে দিচ্ছে যেন তা জান্নাতের হুর এবং এদের হাতে বিভিন্ন জাতের ও বিভিন্ন ধরনের ফল-ফলাদি ধরিয়ে দিচ্ছে এবং এরা এগুলোকে আমাদের নিকট পেশ করছে এই বলে যে, ‘এগুলো তোমাদেরই জন্য, তোমরা খাও ও আনন্দ কর ...’ এবং তুমি দেখবে তা (অর্থাৎ তাঁর দয়া) আমাদেরকে বিষাক্ত মৌমাছির মাধ্যমে খাঁটি ও প্রতিষেধক মধু খেতে দিচ্ছে এবং আমাদেরকে হস্তবিহীন পোকার মাধ্যমে কোমল রেশমের পোষাক পরিধান করাচ্ছে। এবং এক মুঠো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীজ ও দানার মধ্যে হাজার হাজার পাউন্ড খাবার মজুদ করে রাখছে এবং এগুলোকে আমাদের জন্য সংরক্ষিত ভান্ডারে রূপান্তরিত করছে ... সুতরাং যিনি এই ব্যাপক দয়ার মালিক, যিনি সর্বব্যাপী করুনা ও বদান্যতার মালিক, সন্দেহ নেই যে, তিনি কখনো তার প্রিয় মুমিন বান্দাদেরকে নিঃশেষ করে দিবেন না, বিলীন করে দিবেন না। তাদেরকে তিনিই প্রতিপালন করেছেন, তাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন এবং তাদেরকে মমত্ব, দয়া ও তত্ত্বাবধানের এই পর্যায়ে এনে সম্মানিত করেছেন। উপরন্তু শীঘ্রই তিনি দুনিয়ার জীবনে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের ইতি টানবেন এবং তাদেরকে তার চেয়ে আরও ব্যাপকতর ও বৃহত্তর দয়া দানের জন্য প্রস্তুত করবেন।
এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত নাম ‘আর রাহমান’ ও ‘আল-কারীম’ আখিরাত সম্পর্কে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে এবং বলছেÑ ’الجنة حق‘ জান্নাত সত্য।
তদুপরি আমরা লক্ষ্য করি যে, সৃষ্টি জগতের কাজ-কর্ম ‘হিকমত’-এর পথ-পদ্ধতি অনুসারে বুননকৃত এবং ‘ন্যায়বিচারের’ মানদন্ড দ্বারা পরিমাপকৃত। এ দু’টি বিষয় এতটাই সুক্ষ ও সংবেদনশীল যে, মানুষ এ দু’টির চেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ কিছু কল্পনা করতে পারে না .. উদাহরণস্বরূপ, আমরা লক্ষ্য করি, ‘চিরন্তন হিকমত’ মানুষের জন্য স্মরণশক্তি উৎকীর্ণ করেছে, যা আকারে সরিষার দানার মত এবং এতে তার জীবনের বিস্তারিত বর্ণনা এবং তার জীবনে যে অসংখ্য ঘটনাবলী ঘটবে তা লিপিবদ্ধ করেছে, মনে হয় যেন এটি অতি ছোট একটি ডকুমেন্টারী লাইব্রেরী, এবং এটিকে তার মনের কোনে স্থাপন করেছে যাতে তা সর্বদা তাকে হিসাবের দিন সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়, যেদিন মানুষের কর্মকাণ্ডের রেজিস্ট্রারে যা লিখিত হয়েছে তা সবই প্রকাশ করা হবে।
এবং আমরা দেখি চিরন্তন ন্যায়বিচার সৃষ্টজীবের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে সুক্ষ ও নিপুণ ভারসাম্যের সাথে বিদ্যমান রয়েছে- ক্ষুদ্র অনুজীব (গরপৎড়নব) থেকে বিশালাকার গন্ডার পর্যন্ত, দুর্বল মৌমাছি থেকে ভয়ঙ্কর শুকুন পর্যন্ত এবং একটি মনোজ্ঞ ফুল থেকে কোটি কোটি ফুল সজ্জিত বসন্ত পর্যন্ত ... এবং আমরা এগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করি, প্রতিটি সদস্যের মধ্যে নিপুনতা রয়েছে যার মধ্যে কোন অনর্থক কিছু নেই, ভারসাম্য রয়েছে যার মধ্যে কোন ত্র“টি নেই এবং শৃঙ্খলা রয়েছে যাতে সৃষ্টিশীলতা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না। এই প্রতিটিই উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় সৌন্দর্যের অন্তর্ভুক্ত। এভাবে সৃষ্টিসমূহ সৃষ্টিশীলতা, নিপূণতা ও সৌন্দর্যের মডেলে পরিণত হয়... বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তাঁর দয়া প্রতিটি জীবের জন্য জীবনের অধিকার দেয় এবং তার জন্য জীবনের পথচলা সহজ করে, তার জন্য সর্বোচ্চ ন্যায় বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করে; সুতরাং উত্তম কাজের প্রতিদান অনুরূপ উত্তম এবং মন্দকাজের প্রতিদান অনুরূপ মন্দ... একই সময়ে তা (চিরন্তন ন্যায়বিচার) মানুষকে তার সৃষ্টিসমূহের শক্তি ও স্থায়িত্ব অনুভব করায় যার কারণে আদম (আ.)-এর যুগ থেকে বিদ্রোহী ও জালিমদের উপর ধ্বংসাত্মক শাস্তি অবতীর্ণ হয়। যেমনভাবে দিন ছাড়া সূর্য হয় না তেমনি এই ‘চিরন্তন হিকমত’ ও এই ‘চিরন্তন ন্যায়বিচার’ আরেকটি স্থায়ী জীবন ছাড়া কখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না। একারণে এ দু’টি কখনো এমন একটি অবস্থার উপর কখনো সন্তুষ্ট হবে না এবং তা কোন অবস্থায়ই অনুমোদন করবে না যেখানে কোন ন্যায় বিচার নেই, হেকমত নেই এবং কোন অধিকারের বাস্তবায়ন নেই, যখন এটি হবে এমন মৃত্যু যার পরে পূনর্জীবন নেই, যেখানে জালিমরা বঞ্চিত মাজলুমদের সমানরূপে গণ্য হয়! সুতরাং এর পেছনে অবশ্যই এমন একটি স্থায়ী জীবন থাকতে হবে যাতে হেকমত ও ন্যায় বিচারের বাস্তবতা পরিপূর্ণ হয়।
এর মাধ্যমে আমসাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আল্লাহ তা‘আলার নাম ‘আল-হাকীম’ ও ‘আল-হুকম’ এবং ‘আল-আদলু’ ও ‘ আল-আদিল’ আখিরাতের বিষয়ে আমাদের প্রশ্নের জবাব দেয়।
এরপর আমরা দেখি প্রতিটি সৃষ্টজীবের এমন অনেক প্রয়োজন দেখা দেয় যা অর্জন করতে তারা নিজেরা সক্ষম নয় এবং তাদের সকল যাচনাকৃত দাবী Ñ কোন এক ধরনের দু’আর মাধ্যমে Ñ কবুল করা হয়, হোক তা তার আবশ্যকীয় প্রয়োজনের ভাষায় অথবা তার স্বভাবগত চাহিদার ভাষায়, এবং তার নিকট ‘ব্যাপক দয়াশীল’, ‘সর্বশ্রোতা’ ও ‘ব্যাপক মমতার মালিক’-এর হাত থেকে তা উপযুক্ত ও উত্তম সময়ে হস্তান্তর করা হয়... এবং মানুষে অধিকাংশ ইচ্ছাকৃত দু‘আও কবুল করা হয়, বিশেষ করে সুফীদের দু‘আ এবং বিশেষ করে নবীদের (আ.) দু‘আ, যার বেশীরভাগ অস্বাভাবিকভাবে হলেও কবুল করা হয়। এই কবুল হওয়ার বিষয়টি আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, পর্দার অন্তরালে একজন ‘‘সর্বশ্রোতা’’ ও ‘‘দু‘আ কবুলকারী’ রয়েছেন যিনি প্রত্যেক বিপদান্নের দীর্ঘশ্বাস ও প্রত্যেক রোগাক্রান্তের আর্তনাদ শুনতে পান এবং প্রত্যেক অভাবীর আহ্বানে সাড়া দেন এবং ক্ষুদ্রতম সৃষ্টির সামান্য প্রয়োজনও দেখেন, দুর্বলতম সৃষ্টির অতি গোপন হাহাকারও শুনতে পান এবং তাকে তাঁর করুণার মধ্যে শামিল করেন এবং তার সাহায্যে দ্রুতবেগে এগিয়ে আসেন এবং তাকে সন্তুষ্ট করেন ... ব্যাপারটি যখন এমনই সুতরাং আখিরাতের সৌভাগ্য ও স্থায়ীত্বের জন্য দু‘আ করা Ñ এই দু’আই হল সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ব্যাপক দু’আ যা সকল সৃষ্টিকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং তা সকল আসমাউল হুসনা ও সকল মহিমান্বিত গুণবাচক নামের সাথে সম্পর্কিত, এই প্রার্থনা করে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ এবং এই দু’আকে স্বীয় দু‘আসমূহের মধ্যে অন্তভূক্ত করেন আল্লাহ তা‘আলার সবচেয়ে বড় ও প্রিয় বান্দা। তিনি হলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল (সা.), তিনি হলেন সেই নবীদের (আ.) ঈমাম যারা মানবতার সূর্যসন্তান ও তাদের অগ্রদূত। তারা তাঁর দু‘আর সাথে ‘আমিন’ ‘আমিন’ বলে বরং তাঁর উম্মতের প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তি প্রতিদিন কমপক্ষে কয়েকবার তাঁর উপর দরুদ পাঠসহ তার দু‘আর সাথে ‘আমিন’ ‘আমিন’ বলে। বরং সকল সৃষ্টি তার দু’আর সাথে শরীক হয় এবং বলেঃ ‘‘হে আমাদের প্রতিপালক আপনি তার দু‘আ কবুল করুন, আমরাও তোমার নিকট তার মত অনুনয় প্রার্থনা করছি’’ .. সন্দেহ নেই, এরূপ প্রিয় রাসূলের পক্ষ থেকে, যার দু’আ প্রত্যাখ্যান করা হয় না, আখিরাতের স্থায়ীত্ব ও স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এই ধরনের সমন্বিত দু’আই স্থায়ী জান্নাতের অস্তিত্ব ও আখিরাত সৃষ্টির পেছনে যথেষ্ট কারণ। এটি আখিরাতের অস্তিত্বকে অত্যাবশ্যকীয় করে তোলার পেছনে বিদ্যমান অসংখ্য কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম কারণ।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জান্নাত ও আখিরাতের সৃষ্টি বসন্তকালের সৃষ্টির মতই আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের পক্ষে অত্যন্ত সহজ একটি বিষয়।
এভাবেই আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আল্লাহ তা‘আলার নাম ‘সাড়াদানকারী’ ‘সর্বশ্রোতা’ ও ‘অসীম দয়ালু’ আখিরাত সম্পর্কে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে।
তদুপরি ঋতুর পরিবর্তনে সারা পৃথিবীতে যে মৃত্যু ও পুনর্জীবনের দৃশ্য লক্ষ্য করা যায় তা দিনের আলোতে সূর্য যেমন দৃশ্যমান তেমনি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে যে, পর্দার অন্তরালে একজন ‘রব’ রয়েছেন তিনি ছোট্ট একটি বাগান বরং ছোট্ট একটি গাছকে পরিচালনার মত অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ও অতিসহজে এই বিশাল পৃথিবী পরিচালনা করছেন।
এবং একটি ছোট্ট ফুলকে পরিচালনা করার সহজতা ও একটি ফুলের ভারসাম্যপূর্ণ সৌন্দর্য দ্বারা তিনি খুব সহজেই মনোরম বসন্তকালকে পরিচালনা করেন এবং একে চাকচিক্যপূর্ণ করেন এবং পৃথিবীর বুকে তিন লক্ষ প্রজাতির গাছ-পালা ও জীবজন্তু সৃষ্টি করেনÑ যা তিন লক্ষ কিতাবের (পুস্তকের) অনুরূপ- হাশর ও পুনরুত্থানের নমুনা উপস্থাপন করে।
ইনিই সেই সর্বশক্তিমাল ‘রব’ যিনি কোন ক্লান্তি, দ্বিধা-দ্বন্দ, বিভ্রান্তি ও ভুল-ত্র“টি ছাড়াই নিপুণতা ও শৃঙ্খলার সাথে এবং অর্থপূর্ণভাবে এই নমুনাসমূহ লিখেন- এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা ও সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও। তিনি তাঁর মহত্বের মধ্যে দয়াপূর্ণ ও বিজ্ঞানময় কার্যকর কুদরত প্রকাশ করেন। তিনি সৃষ্টিকে তাঁর রহমত ও হেকমতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং মানুষের জন্য উন্নত মর্যাদার ব্যবস্থা করেন এবং তার জন্য বিরাট জগতকে অধীন করে দেন এবং একে তার জন্য অবস্থানস্থল ও বিশ্রামস্থল বানিয়ে দেন, এরপর তাকে পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তাকে সেই বিরাট আমানতের বহনকারী বানান যা বহন করতে অস্বীকার করেছিল আসমান, যমীন ও পর্বতমালা। এভাবে তিনি সকল সৃষ্টির উপর মানুষকে প্রাধান্য দেন এবং তিনি তাঁর রাব্বানী বাণী ও সম্বোধনের মাধ্যমে তাকে সম্মান দান করেন। এছাড়াও তিনি তাঁর নিজের উপর দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন এবং সকল অবতীর্ণ কিতাবে এই মানুষকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন যে, তিনি তাকে স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আখিরাতের স্থায়িত্ব দ্বারা তাকে চিরস্থায়ী করবেন .. সন্দেহ নেই যে, তিনি তার জন্য স্থায়ী সৌভাগ্যের দরজা খুলে দিবেন এবং অবশ্যই তিনি হাশর ও কিয়ামত সংঘটিত করবেন, যা তাঁর পক্ষে বসন্তকাল সৃষ্টি করার চেয়ে সহজ।
এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নাম, ‘জীবনদনাকারী’, ‘মৃত্যুদানকারী’, ‘চিরঞ্জীব’, ‘আল-কাইয়্যুম’, ‘সর্বশক্তিমান’ ও ‘মহাজ্ঞানী’ আমাদেরকে আখিরাত-সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দেয়।
কেউ যদি মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত ও মুসা (আ.)-এর উম্মত যে হাজার বছর পার করে এসেছে তার দিকে লক্ষ্য করে এবং তা তাদের কল্পনার জগতে অঙ্কন করে তাহলে বুঝতে পারবে যে, সত্যিকার ভাবে ইলাহী কুদরতই বসন্তকালে সকল গাছপালা ও তৃণলতার শেকড়সমূহকে জীবিত করেন এবং পুরো প্রাণীজগত ও তরুলতার মধ্যে তিন লক্ষ ধরনের হাশর ও নশরের নমুনা তৈরি করেন বরং দুই হাজার বসন্তে এক হাজার হাশর ও নশরের দৃষ্টান্ত এবং এক হাজার প্রমাণ প্রদর্শন করেন।
সুতরাং মানবদেহের পুনরুত্থান ও দৈহিক হাশর এই অসীম কুদরতের পক্ষে কিভাবে কঠিন হতে পারে ? তাঁর পক্ষে এ বিষয়টি কঠিন হওয়ার ধারণা করা কি অন্ধত্বের উপর অন্ধত্ব নয় ?
তদুপরি বনি আদমের মধ্য থেকে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রাসূল, যারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ, সর্বসম্মতভাবে আল্লাহ তা‘আলার হাজারও নিশ্চিত প্রতিশ্র“তি ও অঙ্গীকারের ভিত্তিতে চিরন্তন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আখিরাতে স্থায়ী হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে ঘোষনা করেছেন এবং তাদের অসংখ্য মুজিজার (অলৌকিক ঘটনার) মাধ্যমে এর সত্যতা প্রমাণ করেছেন এবং তাঁর অসংখ্য নেককার প্রিয় বান্দারা (ওলীগণ) তাদের কাশফ ও উপলদ্ধির মাধ্যমে একই সত্যের বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
সুতরাং এই হাকিকত মধ্যাহ্নের সূর্যের ন্যায় অত্যন্ত স্পষ্ট। যে ব্যক্তি এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে সে অবশ্যই প্রকৃত জ্ঞান-বুদ্ধি থেকে দূরে রয়েছে। কারণ, কোন জ্ঞান-বিজ্ঞান অথবা পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে সেই বিজ্ঞান বা পেশার সাথে জড়িত একজন বা দু’জন বিশেষজ্ঞের মতামত সেই বিষয়ে অনভিজ্ঞ হাজারও বিরোধীতাকারীর মতামত ও চিন্তাকে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করে। হতে পারে, তারা (শেষোক্ত ব্যক্তির) অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ও পারদর্শী। কোন বিষয়ে সত্যতা প্রমাণকারী দু’জনের ইতিবাচক সাক্ষ্য সে বিষয়ের অস্বীকারকারী হাজার ব্যক্তির উপর প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য। যেমনটি সন্দেহের দিনে (يوم الشك) রমজানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে ঘটে থাকে অথবা এর উদাহরণ হল, কারো পক্ষ থেকে পৃথিবীতে দুধের পাত্র সদৃশ নারিকেল বাগানের অস্তিত্বের দাবী করা। কারণ এই দাবীর পক্ষে অবস্থানকারী কেবল এটির দিকে ইশারা করার মাধ্যমে বা একটি নারিকেল দেখানোর মাধ্যমে বা এর স্থানের বর্ণনা দেয়ার মাধ্যমে বিষয়টি জয় করে ফেলে।
আর যে অস্বীকারকারী এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে, সে সারা পৃথিবী অনুসন্ধান করা ও ঘুরে বেড়ানো এবং সকল স্থানে তার দাবীর বাস্তবতার বিষয়ে তদন্ত না করা পর্যন্ত তার দাবী প্রমাণ করতে সক্ষম হবে না।
ঠিক তেমনিভাবে, যে ব্যক্তি জান্নাত, সৌভাগ্যের আবাস ও স্থায়ীত্বের বিষয়ে সংবাদ দেয় সে বিষয়টি কাশফ-এর মাধ্যমে কেবল জান্নাতের কোন একটি চিহ্ন বা আলামত বা ছায়া প্রকাশ করার মাধ্যমে একে প্রমাণ করে এবং জয়ী হয়ে যায় অথচ যে তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে সে শত চেষ্টা করেও তার অস্বীকারের পক্ষে কোন প্রমাণ পাবে না, যদিনা সে নিজে সকল সৃষ্টিজগত ও সকল কাল- অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতকে দেখতে পারে এবং অন্যদেরকেও তা দেখাতে পারে এবং এর অনস্তিত্বের বিষয়টি প্রমাণ ও প্রকাশ করতে পারে!!
এই হেকমতের কারণেই মুহাক্কিক আলিমগণ একটি মূলনীতির বিষয়ে একমত হয়েছেন। সেটি হল ঃ যে অস্বীকার সুনির্দিষ্ট নয় এবং যার স্থানও নির্ধারিত নয়, যদি স্বতঃসিদ্ধভাবেই বিষয়টি অসম্ভব না হয় তাহলে সেই অস্বীকারের বিষয়টি প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
যেমন, সারা সৃষ্টি জগতের মধ্যে বি¯তৃত ঈমানী হাকিকতের বিষয়টি অস্বীকার করা ”
সুতরাং এই অকাট্য হাকিকতের ভিত্তিতে এই ধরনের ঈমানী বিষয়সমূহের বিষয়ে কোন সত্যবাদী সংবাদদাতার সামনে হাজারও দার্শনিক ও বিরোধীতাকারীর অস্বীকৃতি কোন বিন্দুমাত্র সন্দেহ বা সংশয় সৃষ্টি করতে সক্ষম নয় .. কিছু সংখ্যক বস্তুবাদী দার্শনিকের কেবল অস্বীকৃতির কারণে ঈমানের স্তম্ভসমূহের বিষয়ে কোন ধরনের সন্দেহে পতিত হওয়া কতইনা বোকামীর বিষয়, যে দার্শনিকদের বিবেক-বুদ্ধি তাদের চোখে নেমে এসেছে তাই তারা বস্তু ছাড়া কিছুই দেখতে পায়না বরং তাদের অন্তরগুলো মরে গিয়েছে; ফলে তারা অন্তরের বিষয়গুলো অনুভব করতে পারে না। অথচ এই রুকনসমূহের উপর একলক্ষ বিশ হাজার বিশেষজ্ঞ প্রমাণকারী- সত্যবাদী নবী-রাসূলগণ একমত হয়েছেন এবং এ বিষয়ে আরও একমত হয়েছেন (যুগে যুগে গত হওয়া) অসংখ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রমাণকারী, যারা হাকীকতের অনুসারী ওলী-আওলিয়া ও অনুসন্ধানী পন্ডিত (আলিম)। তদুপরি আমরা দিবালোকের ন্যায় স্থায়ীভাবে আমাদের নিজেদের মধ্যে এবং আমাদের চারপাশে নিজের চোখে সর্বব্যাপী রহমত (দয়া) ও হেকমত (প্রজ্ঞা) এবং অবিরত ছড়িয়ে থাকা সুরক্ষা লক্ষ্য করি।
এমনিভাবে আমরা লক্ষ্য করি, বিশাল বিশাল ঐশী/রবুবী নিদর্শন ও প্রকাশ, বিচক্ষনতাপূর্ণ ন্যায়ের আলো এবং প্রতাপশালী ও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা; বরং আমরা দেখতে পাই তাঁর ‘হেকমত’ একটি গাছকে তার ফুল ও ফলের সমপরিমাণ অসংখ্য হেকমত দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। এবং আমরা দেখতে পাই তাঁর ‘রহমত’ প্রতিটি মানুষের উপর তার অনুভূতি, মানসিক শক্তি ও প্রতিটি উপাদানের সমপরিমাণ ইহসান ও অনুগ্রহ দান করে এবং আমরা দেখতে পাই প্রতাপময় ‘ন্যায়বিচার’ এর শাস্তির কষাঘাতে নূহ, হুদ ও সালিহ (আ.)-এর জাতি এবং আদ, ছামুদ ও ফেরআউনের জাতির মত বহু পাপাচারী স¤প্রদায়কে ধ্বংস করে এবং এই ‘ন্যায় বিচার’ আবার ক্ষুদ্র ও দুর্বল সৃষ্টিসমূহের অধিকার সংরক্ষণ করে। সুতরাং এই নিুোক্ত আয়াত বিস্ময়কর সংক্ষিপ্তভাবে এই রবুবিয়াতের প্রতাপ ও নিরঙ্কুশ মহিমার বর্ণনা দেয় ঃ
“এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, তাঁরই আদেশে আকাশ ও পৃথিবী স্থিতিশীল থাকে; অতঃপর আল্লাহ যখন তোমাদেরকে মাটি থেকে উঠাবার জন্য একবার আহ্বান করবেন তখন সাথে সাথে তোমরা উঠে আসবে। (৩০-সূরা রূমঃ ২৫)
যখন এটি স্পষ্ট হল যে, আকাশসমূহ ও পৃথিবী দু’টি সেনানিবাসে মোতায়েনকৃত ও কুচকাওয়াজরত সৈন্যবাহিনীর মত ইলাহী নির্দেশ অনুসরণ করে থাকে। সৈনিকেরা যেমনভাবে তাদের কমান্ডারের নির্দেশে এবং বাঁশি দেয়ার সাথে সাথে তাদের অবস্থান গ্রহণের জন্য তাদের অস্ত্র-শস্ত্র গ্রহণের জন্য দ্রুতবেগে ছুটে চলে তেমনিভাবে আকাশসমূহ ও পৃথিবী দু’টি সেনানিবাসের মত। যখন ইসরাফিল (আ.) ঘুমন্ত মৃতদেরকে শিঙ্গার ফুঁ দ্বারা ডাক দিবেন তখনই তারা শরীরের পোষাক পরিধান করে দ্রুতবেগে কবর থেকে বের হবে। বরং আমরা এই মহত্ব ও আনুগত্য প্রতিটি বসন্তেই দেখতে পাই, যখন পৃথিবীর সেনানিবাসে যে সৈন্যবাহিনী রয়েছে তাদেরকে সমবেত করা হয় এবং বজ্রের ফেরেশতার বাঁশির ফুঁ দ্বারা পুনর্জীবিত করা হয়.. সূতরাং পুর্বোক্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায় যে, অবশ্যই ঐ রহমত, হেকমত, তত্ত্বাবধান, ন্যায়বিচার ও চিরন্তন সম্রাজ্য শীঘ্রই অন্য জগতে এদের চুড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবে অর্থাৎ এগুলো অবশ্যম্ভাবীভাবে হাশরকে দাবী করে। যেমনটি ‘দশম বাণী’তে প্রমাণ করা হয়েছে। সুতরাং আখিরাত আসার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই; বরং আখিরাত না আসাটাই অসম্ভব; হাজার বার অসম্ভব। যেহেতু এর অস্তিত্বহীনতার অর্থ দাঁড়ায়: সবচেয়ে সুন্দর ‘রহমত’-এর কদাকার ‘নিষ্ঠুরতা’য় রূপান্তরিত হওয়া এবং এর অর্থ দাঁড়ায়: পরিপূর্ণ ‘হেকমত’-এর অসম্পূর্ণ অর্থহীনতা ও চূড়ান্ত অপচয়ে পরিবর্তিত হওয়া এবং যেহেতু এর অর্থ হল: নিবিড় ‘তত্বাবধান’-এর Ñ যা কিনা অনিন্দ্য সুন্দর ও মহত্ব Ñ চূড়ান্ত মন্দ ও তিক্ততাপূর্ণ ‘অবমাননা’য় রূপান্তরিত হওয়া এবং যেহেতু এর অর্থ হল: চূড়ান্ত ইনাসাফ ও ন্যায়পূর্ণ ‘আদালত’-এর মারাত্মক ‘নিষ্ঠুরতা’য় পরিবর্তিত করা। এভাবে এগুলোর সাথে এরূপ আরও যোগ করে নিন। কারণ, আখিরাত না আসার মানে হল, প্রতাপশালী চিরন্তন সম্রাজ্যের মর্যাদার পতন এবং এর মহত্ব ও শক্তি ধ্বংস হয়ে যাওয়া এবং এর অর্থ হল: ‘রবুবিয়াত’-এর পূর্ণতার উপর অক্ষমতা ও অসম্পূর্ণতার অপবাদ আরোপ করা... আর এ সবই মিথ্যা ও অসম্ভব, কোন মানুষের বিবেক-বুদ্ধিই তা কবুল করে না। এটি অগ্রহণযোগ্য ও অসম্ভব; কেননা প্রত্যেক অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ জানে যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সর্বোত্তম গঠনে তৈরি করেছেন, তাকে সুন্দরভাবে প্রতিপালন করেছেন এবং তাকে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন, ‘আক্বল’ (বিবেক-বুদ্ধি) ও ‘ক্বালব’ দ্বারা সজ্জিত করেছেন, যার মাধ্যমে সে স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রত্যাশী হয় এবং তা তাকে এর দিকে চালিত করে। এবং যখন সম্মানিত মানুষের গন্তব্যস্থল চিরন্তন অনস্তিত্বের দিকে গিয়ে শেষ হয় বলে মনে করা হয় তখন সে (এই ধারণার মধ্যে) জুলুম ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা অনুভব করতে পারে। এবং সে পুনরুত্থানের অস্তিত্ব না থাকার ধারণার মধ্যে প্রজ্ঞাহীনতার মাত্রাও বুঝতে পারে, যে ধারণা হাজারো কল্যাণ ও উপকারী সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও স্বভাবগত শক্তিকে অপ্রয়োজনীয় ও মূল্যহীন করে দেয়!
অথচ আল্লাহ তা‘আলা কেবল তার মস্তিস্কের মধ্যেই শত শত হেকমত ও উপকারীতা প্রদান করেছেন... তেমনিভাবে সে (এই ধারণার মধ্যে) প্রকাশ্য অক্ষমতা ও পূর্ণ অজ্ঞতার মাত্রা বুঝতে পারে, যা এই মহান সম্রাজ্যের মহত্ব ও পূর্ণ সার্বভৌমত্বের বিপরীত, যার মানে হল হাজার হাজার প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্র“তি পূরণ না করা! এসব থেকে আল্লাহ অনেক ঊর্র্ধ্বে। এর উপর ‘ইনায়াত’ (নিবিড় তত্বাবধান) ও ‘আদালত’ কে কিয়াস কর (তুলনা কর)।
এভাবে আল্লাহ তা‘আলা আসমাউল হুসানার অন্তর্ভুক্ত নাম ‘আর-রাহমান’, ‘আল-হাকীম’, ‘আল-আদল’, ‘আল-ক্বারীম’ ও ‘আল হাকিম’ আখিরাত সম্পর্কে আমাদের প্রশ্নের বিষয়ে উল্লিখিত হাকিকত সম্পর্কে জবাব দিচ্ছে এবং তিনি সন্দেহাতীতভাবে আমাদের জন্য এগুলো প্রমাণ করছেন বরং সূর্যের স্পষ্টতা ও ঔজ্জ্বল্যের ন্যায় এগুলোকে সুস্পষ্ট করছেন।
এরপর আমরা দেখতে পাই স্পষ্ট ও সমন্বিত দারুন এক ‘সংরক্ষণব্যবস্থা’ প্রতিটি জীব ও প্রতিটি ঘটনার উপর প্রভাব বিস্তার করে আছে, যা এগুলোর অসংখ্য ছবি-প্রতিচ্ছবিকে সংরক্ষণ করে, এদের স্বভাবগত কাকর্মকাণ্ডকে রেকর্ড করে, এরা এদের অবস্থার ভাষায় আসমাউল হুসনার প্রতি যেসব তাসবীহ পেশ করে তা লিপিবদ্ধ করে রাখে... এগুলোকে লিপিব্ধ করে ক্ষুদ্রাকার ফলকসমূহে, এগুলোর ছোট ছোট বীজ ও দানার মধ্যে, এগুলোর সংরক্ষণ শক্তির মধ্যে Ñ এগুলো লাওহে মাহফুজের ছোট ছোট নমুনা Ñ বিশেষ করে, মানুষের স্মরণশক্তির মধ্যে, যেটি তার মস্তিস্কে স্থাপিত ক্ষুদ্রাকার বিশাল লাইব্রেরী Ñ এবং সকল বস্তুগত ও অবস্তুগত দর্পন ও প্রতিবিম্বের মধ্যে।
যখনই বসন্তকালের আগমন ঘটে Ñ যা কিনা ইলাহী কুদরতের ‘বাস্তব ফুল’ Ñ তখনই সেই ‘সংরক্ষনব্যবস্থা’ আমাদের জন্য সেই অশরীরী/ বিমূর্ত লিখাসমূহকে স্পষ্ট ও বাস্তবরূপপে প্রকাশ করে। এবং ঐ ‘বিশাল ফুল’ হাশরের হাকিকতকে প্রদর্শন করে এবং কোটি কোটি উদাহরণ ও দলীল-প্রমাণের ভাষায় এগুলোকে ঘোষণা করে। যা এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
‘‘যখন পাতাসমূহ ছড়িয়ে দেয়া হবে” (সূরা আত্তাকভীরঃ ১০)
এবং তা (অর্থাৎ ‘সংরক্ষনব্যবস্থা’) আমাদেরকে দৃঢ়তার সাথে নিশ্চিত করে যে, দুনিয়ার তাবৎ বস্তু, বিশেষ করে জীবন্ত বস্তু, বিলীন, নিশ্চিহ্ণ ও নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, বিশেষ করে মানুষ; বরং তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে উন্নতির মাধ্যমে অমরত্বকে জয় করার জন্য, তাদের নফ্স-এর পরিশুদ্ধির মাধ্যমে স্থায়ী জীবনের জগতে প্রবেশ করার জন্য এবং স্বভাবগত প্রস্তুতির মাধ্যমে চিরন্তন দায়িত্ব-কর্তব্যের দিকে প্রবেশ করার জন্য, যা স্থায়ীজগতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
হ্যা, যখনই বসন্তের হাশরের আগমন ঘটে তখনই প্রতিটি গাছ, প্রতিটি শিকড় ও শরতের কিয়ামতে মরে যাওয়া অসংখ্য গাছ-পালার প্রতিটি দানা ও বীজ এদের বিশেষ ভাষায় এই আয়াত পাঠ করেঃ
‘‘যখন পাতাসমূহ ছড়িয়ে দেয়া হবে” (সূরা আত্তাকভীরঃ ১০)
এবং এই আয়াতের মর্মার্থসমূহের মধ্য থেকে একটি মর্মার্থের ব্যখ্যা পেশ করে। আর তা গাছের প্রতিটি অংশ পূর্ববর্তী বছর যে স্বভাবগত দায়িত্ব পালন করেছে তার অনুরূপ দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে। এবং একই সময়ে ব্যপক পরিসরে এই সংরক্ষনব্যবস্থার মহত্ব প্রকাশ করে যা এই আয়াতের মাধ্যমে বুঝা যায়ঃ
‘‘তিনিই প্রথম ও তিনিই শেষ এবং তিনিই প্রকাশ্য ও তিনিই অপ্রকাশ্য” (সূরা আল-হাদীদঃ ৩)
এবং এই আয়াত আমাদেরকে প্রতিটি বস্তুর মধ্যে চারটি স্পষ্ট হাকিককতের বিষয়ে নির্দেশ করে এবং বসন্তের আগমনের অত্যাবশ্যকীয়তা ও এর সহজতার মতই হাশরের অত্যাবশ্যকীয়তার বিষয়ে দৃঢ় প্রমান প্রতিষ্ঠিত করে।
হ্যা, এই চারটি আসমাউল হুসনার আলো ও এদের স্পষ্ট প্রকাশ ক্ষুদ্রতম বস্তু থেকে বৃহত্তর বস্তু পর্যন্ত প্রতিটি বস্তুর মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে.. এই বিষয়টি একটি উদাহরনের মাধ্যমে স্পষ্ট করা যেতে পারে:
আল্লাহর নাম ‘আল-আওয়াল’কে প্রকাশ করার মাধ্যমে একটি বীজ Ñ যা গাছের মূল -‘সংরক্ষণব্যবস্থা’র মহত্ব প্রকাশ করে। আর তা একারনে যে, এই বীজের মধ্যে গাছের অত্যন্ত সুক্ষ পরিকল্পনা রয়েছে এবং এর মধ্যে গাছের সৃষ্টি ও এর বেড়ে উঠার চমৎকার নিয়ম-কানুন অঙ্কিত রয়েছে রয়েছে, যা পূর্ণাঙ্গ ও নিভূল। এবং এর মধ্যে গাছের গঠনের সকল শর্তাবলী বিদ্যমান রয়েছে যদিও দেখতে এটি একটি ছোট কৌটা।
তেমনি গাছের ‘ফল’ আল্লাহর নাম ‘আল-আখির’কে প্রকাশ করার মাধ্যমে ‘সংরক্ষণব্যবস্থা’র সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করে। কারণ, এই ফলের মধ্যে এই গাছের সকল স্বভাবগত অতীত কর্মকাণ্ডের সূচী (রহফবী) এবং এর দ্বিতীয় জীবনের নিয়ম-কানুন অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। যদিও এটি ক্ষুদ্র একটি কৌটা।
আর বাস্তব গাছের প্রকাশ্যরূপ ‘নিরঙ্কুশ সংরক্ষনব্যবস্থা’র মধ্যে থেকে কুদরতের মহত্ব, হেকমতের পূর্ণতা ও রহমতের সৌন্দর্য প্রকাশ করে। এবং আল্লাহর নাম ‘আয্ যাহির’কে প্রকাশ করার মাধ্যমে এগুলোকে মানুষের চোখের সামনে দৃশ্যবস্তুরূপে প্রকাশ করে। আর তা এর চমৎকার বৈচিত্যময় নকশাখচিত মনোমোগ্ধকর গাউন ও অলংকারময় সুদর্শন রূপের মাধ্যমে, এটি যেন ডাগর নয়না হুরের সত্তর রঙের রঙ্গীন পোশাক।
আর এই গাছের আভ্যন্তরীন যন্ত্রপাতিগুলো যেন দর্পনের মত যা আল্লাহর নাম ‘আল-বাতিন’কে প্রতিফলিত করছে। এগুলো সূর্যের স্পষ্টতার মত স্রষ্টার কুদরত ও ন্যায়ের পূর্ণতা এবং তাঁর রহমত ও হেকমতের সৌন্দর্য প্রমাণ করছে। এটি একটি বিস্ময়কর শৃঙ্খলাপূর্ণ কারখানা; বরং বিশাল এক ক্যমিক্যাল পরীক্ষাগার; বরং খাদ্য-পানীয় ও জীবিকার গুদাম যা এমনকি একটি ডাল, একটি ফল বা একটি পাতাকেও প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয় সরবরাহ না করে ছাড়ে না।
যেমনভাবে প্রতিটি বীজ ও ফল এবং গাছের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য রূপ ‘আল-আওয়ালু’, ‘আল-আখিরু’, ‘আয্-যাহিরু’ ও ‘আল-বাতিনু’ এই চারটি আসমাউল হুসানার মহিমা প্রকাশ করছে, তেমনিভাবে এই ভূ-গোলকও এগুলোর মহিমা প্রকাশ করছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, সম্মান ও মর্যাদাবান ‘আল-হাফিজ’ (মহাসংরক্ষক) কেবল তাঁর নিরঙ্কুশ কুদরত, আদালত, হেকমত ও রহমত দ্বারা কর্ম সম্পাদন করেন। কারণ, এই ভু-গোলক বাৎসরিক কাল পরিবর্তনের দিক থেকে একটি গাছের মত। সূতরাং সকল বীজ ও দানা, যেগুলো আল্লাহর নাম ‘আল-আওয়াল’কে প্রকাশ করার মাধ্যমে শরৎকালে ‘সংরক্ষনব্যবস্থা’র নিকট আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে, তা অসংখ্য ডাল-পালা পল্লবিত করে, এগুলোকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয় এবং অসংখ্য মনোরম ফুল ও উত্তম ফল-ফলাদি মঞ্জরিত করে। এভাবে পৃথিবীকে পোশাকে সজ্জিত করে ও মনোরম বসন্তের আগমন ঘটে ... এটি এ কারনে যে, প্রতিটি বীজ বা দানার মধ্যে বহু ক্ষুদ্রাকার খাতা রয়েছে যেগুলোতে ঐশী আদেশ-নিষেধ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা রয়েছে যেগুলোতে সংশ্লিষ্ট গাছটি গত বছর কি কি কর্মকাণ্ড সম্পাদন করেছে তা লিখা রয়েছে; বরং এই এই বীজ ও দানাসমূহ পৃথিবীর মহান বৃক্ষের সংযোজনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুকে ধারণ করে।
আর পৃথিবীর বাৎসরিক গাছের শেষ হল, গাছটি গত শরৎকালে যেসব কর্মসমূহ সম্পাদন করেছে তা এবং যেসকল স্বভাবগত তাসবীহ ও যিকির সে আসমাউল হুসনার প্রতি পেশ করেছে তা, এবং আগামী বসন্তকালের হাশরে যে কাজ-কর্মের পাতাসমূহ প্রসার ঘটানো সম্ভব তার সবকিছু একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র কৌটার মধ্যে রাখে এবং সৃষ্টিজগতের শ্রবনশক্তিতে ও দৃষ্টিশক্তিতে অসংখ্য ভাষার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার নাম ‘আল-আখির’ আবৃত্তি করতে করতে এই সবকিছু মহা মর্যাদাবান ‘আল-হাফিজ’ (মহাসংরক্ষক)-এর হেকমতের হাতে হস্তান্তর করে।
আর এই গাছের বাহ্যিক রূপ হল, এই বৈচিত্র্যময় ও বিভিন্নধর্মী মৌলিক ফুলসমূহ, যা তিনলক্ষ ধরনের হাশরের (পুনর্জীবনের) উদাহরণ ও নমুনা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে। এগুলো হল, অসীম করুণাময় পরম দয়ালু মহা সম্মানিত রিজিকদাতার খাবারের টেবিল। এগুলো হল সকল জীবের জন্য উন্মুক্ত মেহমানদারী। সুতরাং এই গাছের বহিরাংশে যা রয়েছে সবই এর ফল, ফুল ও খাবারের ভাষায় আল্লাহ তা‘আলার নাম ‘আয যাহির’-কে স্মরণ করে ও পাঠ করে এবং দ্বিবালোকের ন্যায় নিুোক্ত আয়াতের হাকিকত প্রকাশ করেঃ
‘‘যখন সহীফাসমূহ (লিখিত পাতসমূহ) প্রকাশিত হবে।” (৮১- সূরা আত্তাকভীরঃ ১০)
এই মহান গাছের ভেতরের রূপ হল, এটি একটি ওয়ার্কশপ ও কারখানা, যা অসংখ্য সুশৃঙ্খল মেশিন ও সুসমন্বিত কারখানা পরিচালনা করার মাধ্যমে এক দিরহাম উপাদান থেকে টনে টনে খাবার প্রস্তুত করে এবং তা ক্ষুধার্তদের নিকট পৌঁছে দেয়। এটি এতটাই নিপুনভাবে কাজ সম্পাদন করে যে, এর মধ্যে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রাখে না।
অতঃপর পৃথিবীর ভেতরের অংশ আল্লাহ তা‘আলার নাম ‘আল-বাতিন’ কে স্মরণ করে বরং হাজারও ধরন ও পদ্ধতিতে তা প্রমাণ করে ও এর ঘোষণা দেয়, যেমনভাবে কিছু সংখ্যক ফেরেশতা এর ঘোষণা দেয়, যারা লক্ষ লক্ষ জিহ্বার মাধ্যমে তাঁর তাসবীহ পাঠ করে।
যেমনভাবে বাৎসরিক জীবনের দিক থেকে এই পৃথিবী একটি গাছের মত এবং তা (পৃথিবী) এই চারটি আসমাউল হুসনার মধ্যে যে ‘সংরক্ষণব্যবস্থা’ রয়েছে তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে এবং একে হাশরের (পুনর্জীবনের) দরজার চাবি বানিয়েছে। এমনিভাবে এটি যুগ ও কালের জীবনের দিক থেকে অত্যন্ত সমন্বিত একটি গাছের মত যা তার ফলসমূহ যুগে যুগে, কালে কালে আখিরাতের বাজারের দিকে পাঠাচ্ছে।
এভাবে পুরো পৃথিবীটাই এই চারটি নামের প্রকাশের জন্য একটি বিশাল আয়নায় পরিণত হয় এবং আখিরাতের দিকে একটি প্রশস্ত পথ উন্মুক্ত করে যা অনুধাবন করতে আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও আমাদের ভাষা অক্ষম ও অনুপযোগী। এ কারণে নিুোক্ত কথা বলেই ক্ষান্ত হব; কলেবর বৃদ্ধি করব না ঃ
একটি ঘড়ির মধ্যে বিদ্যমান যে কাঁটাসমূহ সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন গণনা করে, সেগুলো পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ। একটি অন্যটিকে প্রমাণ করে ও স্মরণ করিয়ে দেয়। সুতরাং যে ব্যক্তি সেকেন্ডের কাঁটার দিকে লক্ষ্য করবে সে অন্য কাটাগুলোর চলাচলকে স্বীকার করতে বাধ্য হবে। এরূপই এই পৃথিবী আসমান ও যমীনের স্রষ্টার একটি বৃহৎ ঘড়ির মত। যেখানে দিনসমূহ পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ যেগুলো এই বৃহৎ ঘড়ির সেকেন্ডসমূহ গণনা করছে, বছরসমূহ পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ যেগুলো এর মিনিটসমূহ গণনা করছে এবং যুগসমূহ পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ যেগুলো এর ঘন্টাসমূহ প্রকাশ করছে এবং কালসমূহও পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ যেগুলো এর দিনসমূহ পরিচয় করিয়ে দেয়। এগুলো পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এদের প্রতিটি অন্যটিকে নির্দেশ করে ও প্রমাণ করে এবং এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমরা দেখি, পৃথিবী আমাদেরকে অসংখ্য চিহ্ন ও আলামতের সংবাদ দিচ্ছে যে, দুনিয়ার নশ্বর ও অন্ধকারময় শীতকালের পর একটি স্থায়ী বসন্তকাল ও চিরন্তন সকাল আসছে ..।
পৃথিবী আমাদেরকে এমন নিশ্চয়তার সাথে এর সংবাদ দিচ্ছে যেমনি রাতের পর দিন আসাটা অবশ্যম্ভাবী এবং শীতের পর বসন্তের আগমন অনিবার্য। এবং এই হাকিকত প্রকাশের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নাম ‘‘আল-হাফিজু’’ ও চারটি আসমাউল হুসনা ‘আল-আউয়ালু’, ‘আল-আখিরু’, ‘আয-যাহিরু’, ও ‘আল-বাতিনু’ আমাদের হাশর সংক্রান্ত আমাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে।
আমরা আমাদের নিজের চোখে দেখতে পাচিছ এবং আমাদের বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে বুঝতে পারছি যে,
মানুষ হল জগতবৃক্ষের চূড়ান্ত ফল এবং এর মধ্যে জগতবৃক্ষের সকল গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য একত্রিত করা হয়েছে ...
সে হল মুহাম্মদী হাকিকতের দিক থেকে জগতবৃক্ষের প্রকৃত বীজ।
সে হল জগতের কুরআনের সর্ববৃহৎ জাগতিক নিদর্শন.. বরং এই জাগতিক কুরআনের ইসমে আযম যেমন ‘আয়াতুল কুরসী’-এর সুস্পষ্ট প্রকাশ বহনকারী নিদর্শন ..
সে হল জগত প্রাসাদের সবচেয়ে সম্মানিত মেহমান ..
সে হল এই জগত প্রাসাদে অবস্থানকারীদের মধ্যে ক্ষমতা চর্চা করার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত সবচেয়ে তৎপর কর্মকর্তা।
সে হল পৃথিবী নামক কৃষিক্ষেত্রে চাষাবাদের জন্য আদিষ্ট ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সৃষ্টি এবং এর উৎপাদন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক, যেহেতু তাকে শতশত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও হাজারও যোগ্যতার দ্বারা প্রস্তুত করা হয়েছে..
সে হল পৃথিবীর খলিফা, পৃথিবী রাজ্যের অনুসন্ধানকারী ও গবেষক, যে চিরস্থায়ী ও চিরন্তন সুলতানের পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং তারই তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত কর্মী ..
সে হল পৃথিবীর ছোট বড় সব ধরনের কাজ-কর্মের জন্য রেজিস্ট্রিকৃত পৃথিবীর সকল বিষয়াদিতে ক্ষমতা চর্চাকারী সৃষ্টি ..
সে হল ব্যাপক ও সমন্বিত ইবাদতের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্ণ বান্দা..
সে হল সেই সর্ববৃহৎ আমানতের বহনকারী যা বহন করতে আসমান, যমীন ও পর্বতমালা সবাই অস্বীকার করেছিল, অতঃপর তার সামনে দু’টি পথ খোলা রইলঃ একটি হল দুর্ভাগাদের পথ আর অন্যটি হল সৌভাগ্যবানদের পথ ..
সে হল এমন সৃষ্টি যে আয়নার মত আসমাউল হুসনার সকল প্রকাশকে প্রতিফলিত করছে এবং যার মধ্যে ‘ইসমে আযম’ স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়ে উঠে..
সে হল সুব্হানী সম্বোধনের কাক্সিক্ষত শ্রোতা এবং রাব্বানী কালামের অধিক বুঝ সম্পন্ন সৃষ্টি ..
আবার সেই হল জগতের সৃষ্টিজীবের মধ্যে সবচেয়ে অভাবী ও অক্ষম ..
সে হল সীমাহীন অক্ষম ও অভাবী জীবিত সৃষ্টি, যদিও তার রয়েছে অসংখ্য শত্র“ এবং কষ্টদায়ক বস্তু ও প্রাণী; অথচ তার রয়েছে সীমাহীন উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও আশা-আকাক্সক্ষা .. সে হল জীবত প্রাণীদের মধ্যে প্রস্তুতির দিক থেকে সবচেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ..
সে জীবনের স্বাদ-আস্বাদ উপভোগ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী ব্যথা অনুভবকারী ও ভোগান্তির সম্মুখীন হয়, যার আনন্দ উপভোগ ব্যথা-বেদনার যারা বাধাগ্রস্ত হয় ..
সে অমরত্ম লাভের জন্য সবচেয়ে বেশি আগ্রহী এবং তার স্থায়িত্ব লাভের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী, বরং সে এর জন্য সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত।
সে-ই অমরত্ম ও স্থায়ীত্ব লাভের জন্য অসংখ্য দু‘আর মাধ্যমে উপায় তালাশ করে। যদি তাকে দুনিয়ার সকল ভোগ-বিলাসের সামগ্রীও দান করা হয় তবুও তার স্থায়ীত্ব ও অমরত্ম লাভের আকাক্সক্ষা মিটবে না ..
সে-ই ইবাদতের মাধ্যমে তাঁকে ভালবাসে যিনি তার উপর অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছেন এবং সে তাঁকে অন্যদের নিকট প্রিয় করে তোলে এবং সে তাঁর প্রিয় বান্দাও বটে..
সে হল ইলাহী কুদরতের সর্ববৃহৎ মু’জিজা; বরং সে হল সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে বিস্মরয়কর সৃষ্টি যার মধ্যে পুরো বিশ্বজগত লুক্কায়িত রয়েছে এবং তার সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সে এমন একটি সৃষ্টি, যাকে স্থায়িত্ব ও অমরত্বের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
এই মানুষ উপরিউক্ত বিশটি হাকিকতের মাধ্যমে আল্লাহর নাম ‘আল হাক্ব’ এর সাথে সংশ্লিষ্ট এবং সে আল্লাহর নাম ‘আল-হাফিজ’ এর সাথে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত, যার নিকট আসমান ও যমীনের কোন কিছুই গোপন নয়, যিনি ক্ষুদ্রতম প্রাণীর ছোট-খাট প্রয়োজনের প্রতিও লক্ষ্য রাখেন, তার প্রয়োজনের ডাকে সাড়া দেন এবং তাকে সাহায্য করেন। তাঁর সম্মানিত লেখকেরা এই মানুষের সকল কর্মকান্ড এবং সৃষ্টিকুলের সাথে সম্পর্কিত তার কাজ-কর্ম লিপিবদ্ধ করে.. এই বিশটি হাকিকতের অধিকারী হওয়ার কারণে এই মানুষের হাশর (আখিরাতে একত্রিত হওয়া) ও পুনর্জীবন অনিবার্য। সন্দেহ নেই যে, সে যেসব সেবা ও ভালকাজ সম্পাদন করেছে তার কারণে শীঘ্রই সে আল্লাহর নাম ‘আল হাক্ব’ এর মাধ্যমে পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে এবং এর মধ্যে যে অবহেলা করেছে তার প্রতিফলও পাবে। সন্দেহ নেই, সে ছোট-বড় যেসব কাজ করেছে তার জন্য শীঘ্রই তাকে ‘আল-হাফিজ’ নামের মাধ্যমে হিসাব নিকাশ ও জবাবদিহিতার জন্য প্রেরণ করা হবে। এবং এতেও সন্দেহ নেই যে, শীঘ্রই তার সামনে খুলে দেয়া হবে স্থায়ী সৌভাগ্য ও চিরন্তন মেহমানদারীর দরজা অথবা ভয়ঙ্কর জেলখানা ও স্থায়ী দুর্ভাগ্যের দরজা এবং এটি সম্ভব নয় যে, এমন একজন অফিসারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখী করা হবে না এবং সে কবরে প্রবেশ করবে না, যে অফিসার এই পৃথিবীর সকল সৃষ্টিজীবের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের বিষয়-আশয়ে হস্তক্ষেপ করেছে এবং এটিও সম্ভব নয় যে, তাকে পুনরুত্থিত করা হবে না।
কেননা, এটি কখনো বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন হতে পারে না যে, মাছির ভনভনের চেয়ে নিচু আওয়াজের আহ্বান শ্রবণ করা যায় এবং একে জীবনের অধিকার প্রদান করাসহ এর ডাকে সাড়া দেয়া যায় অথচ এমন শক্তিশালী আহ্বানসমূহ শ্রবণ করা হয় না যার ফলে আরশ কেঁপে উঠে, যেগুলো পূর্বোক্ত অসংখ্য মানবাধিকার সম্বলিত বিশটি হাকিকতের ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে, যা অমরত্ব ও স্থায়ীত্ব প্রার্থনা করে। এবং এটিও একেবারে বোধগম্য নয়; বরং তা সম্ভবের বাইরে যে, এই এত বেশী অধিকার পুরোপুরি ক্ষুন্ন করা হবে; নষ্ট করা হবে। বরং কোন তামাশামুক্ত হেকমতের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয় Ñ এমনকি মাছির ডানা পরিমাণও Ñ ঐসব অধিকার সম্বলিত মানুষের যোগ্যতাকে ও স্থায়িত্বলাভ করা পর্যন্ত বি¯তৃত তার সকল আশা-আকাঙ্খাকে ব্যর্থ করতে পারে এবং এই যোগসূত্রসমূহ (روابط) ও জগতসমূহের বিভিন্ন হাকিকতসমূহকে ব্যর্থ করতে পারে যা মানুষের এই যোগ্যতা ও আকাঙ্খাসমূহকে বৃদ্ধিসাধন করে। কারণ, এই অযৌক্তিক সম্ভাবনা একটি ভয়ঙ্কর জুলুম ও লজ্জাজনক অনিষ্ট যাকে সকল সৃষ্টিও প্রত্যাখ্যান করে এই বলে যে, ‘এটি একেবারেই অসম্ভব, একশত দিক থেকে অসম্ভব, হাজার দিক থেকে অসম্ভব’। উপরন্তু,আসমাউল হুসনা ‘আল-হ্ক্কা’ (সত্য), ‘আল হাফিজ’ (সংরক্ষণ), ‘আল হাকিম’ (মহা প্রজ্ঞাময়), ‘আল জামিল, (সুন্দর) ও ‘পরম দয়ালু’-এর সাক্ষ্য বহনকারী সকল সৃষ্টিই একে প্রত্যাখ্যান করে।
এবং এভাবে এসব আসমাউল হুসনা আমাদেরকে আখিরাত সম্পর্কে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। এই আসমাউল হুসনা আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছে ঃ ‘নিশ্চয় হাশর সত্য, যাতে কোন সন্দেহ নেই, এটি দৃঢ় সত্য যাতে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই, যেমনভাবে আমরা সত্য এবং যেমনভাবে সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের হাকিকত আমাদরেকে সাক্ষ্য দিচ্ছে।
যদি বিষয়টি সূর্যের চেয়েও বেশী সুস্পষ্ট না হত তাহলে এ বিষয়ে আমি আরও বর্ণনা করতাম কিন্তু উল্লিখিত দৃষ্টান্তসমূহকে যথেষ্ট মনে করে এবং পূর্বোক্ত অনুচ্ছেদসমূহের উপর কিয়াস করে সংক্ষিপ্ত করলাম। কেননা, শত আসমাউল হুসনার বরং হাজারও আসমাউল হুসনার প্রতিটি Ñ যা সৃষ্টি জগতের দিকে অভিমুখী Ñ এর নামকরণের গুরুত্বকে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যেভাবে তা হাশর ও আখিরাতকে প্রকাশ করে এবং একে অকাট্য ও দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে।
যেভাবে আমাদের প্রভু সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সকল কিতাবসমূহে উল্লিখিত নির্দেশাবলীর মাধ্যমে ও তাঁর নিজেকে সে সকল নামে নামকরণ করেছেন সেগুলোর মাধ্যমে আখিরাত সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞাসার দৃঢ় জবাব প্রদান করেছেন এমনিভাবে তিনি তাঁর ফেরেশতাকুলের ভাষায় অন্যভাবে আমাদেরকে জবাব দিচ্ছেন এবং আমাদেরকে আখিরাতের পরিচয় প্রদান করছেন। ফেরেশতারা বলছেঃ
‘‘আমাদের অস্তিত্ব ও রূহানী জগতের অস্তিত্বের বিষয়ে অসংখ্য চিহ্ন ও প্রমাণাদি রয়েছে। আদম (আ.) এর সময় থেকে আমাদের মাঝে, তোমাদের মাঝে ও রূহানী ব্যক্তিদের মাঝে অসংখ্যবার সাক্ষাৎ ঘটেছে এবং কথোপকথন ও পরিচয় ঘটেছে। এগুলো বহু সূত্রে বর্ণিত নিশ্চিত ঘটনা, যাতে সন্দেহ নেই। আমরা আখিরাতের মনযিলসমূহে এবং এর আঙ্গিনাসমূহে ঘোরাফেরা করার সময় যা প্রত্যক্ষ করি তা ইতোমধ্যেই তোমাদের নবীদের সাথে সাক্ষাতের সময় তাদের নিকট উল্লেখ করেছি এবং সর্বদা উল্লেখ করব ঃ ‘আমরা তোমাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছি, যাতে কোন সন্দেহ নেই যে, এসব স্থায়ী কক্ষ এবং এসব স্থায়ী প্রাসাদসমূহ ও সুসজ্জিত আবাসসমূহ কেবল সম্মানিত মেহমানদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য এবং তাদের বসবাসের জন্য তৈরি করা হয়েছে।’
এর মাধ্যমে সম্মানিত ফেরেশতাকুল আমাদেরকে আখিরাত সম্পর্কে আমাদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করছে।
তদুপরি আমাদের মহা সম্মানিত সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য নিয়োগ করেছেন একদল মহান ও পরিপূর্র্ণ শিক্ষক, সবচেয়ে উপযোগী আদর্শ ও সবচেয়ে সরল-সঠিক পথ নির্দেশক .. আর তিনি হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি তাকে সর্বশেষ রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন। সুতরাং আমাদের উচিত আখিরাত সম্পর্কে আমরা আমাদের স্রষ্টার নিকট থেকে যা জানতে চাই সে সম্পর্কে সব কিছুর পূর্বে আমাদের শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করা। হতে পারে, এর মাধ্যমে আমরা জ্ঞানের দিক থেকে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারব এবং ইলমুল ইয়াকিন (নিশ্চিতের জ্ঞান)-এর পর্যায় থেকে আইনুল ইয়াকিন (নিশ্চিতের প্রত্যক্ষ করা)-এর পর্যায় এবং তা থেকে হাক্কুল ইয়াকিন (নিশ্চিত সত্য) এর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারব। কেননা, এই প্রিয় সত্যবাদী নবী, যিনি হাজারও মুজিজা দ্বারা মহান স্রষ্টা ও সর্বজ্ঞানীর পক্ষ থেকে সত্যায়নকৃত, যেমনভাবে তিনি কুরআনুল কারীমের মু’জিজা তেমনি তিনি সমগ্র পৃথিবীর নিকট প্রমাণ করেছেন যে, এই কিতাব (কুরআন) জগতসমূহের প্রতিপালকের কিতাব। ‘বাতিল’ যার সামনের দিক থেকে আসতে পারে না, এর পেছনের দিক থেকেও না। তেমনি কুরআনুল কারীমও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অন্যতম মু’জিজা এবং তার সপক্ষে দলীল যে, তিনি সত্যবাদী ও সত্যায়নকৃত এবং তিনি জগতসমূহের প্রতিপালকের রাসূল।
সুতরাং এই দু’টি মুজিজা Ñ একটি হল দৃশ্য জগতের ভাষা, যার সাথে রয়েছে সকল নবী আলাইহিমুস সালাম ও ওলীগণের সত্যায়ন আর অন্যটি হল অদৃশ্য জগতের ভাষা যা সকল আসমানী কিতাব ও পুরো জগতের হাকিকত দ্বারা সত্যায়নকৃত Ñ হাশর ও নশরের সত্যতার বিষয়ে সূর্য ও দিনের স্পষ্টতার মত অত্যন্ত দৃঢ় ও দলীল প্রমাণ পেশ করেছে। প্রথম মুজিজার পুরো জীবনের মাধ্যমে এবং দ্বিতীয় মুজিজার হাজারও আয়াতের মাধ্যমে।
এটি সত্য যে, হাশর ও আখিরাতের বিষয় অনুধাবন করা মানুষের বিবেক-বুদ্ধির সর্বোচ্চ সক্ষমতা ও সীমার বাইরে। কুরআনুল কারীম ও প্রিয় রাসূল (সা.)- এই দুই উস্তাদের শিক্ষন ও দিকনির্দেশনা ছাড়া তা বুঝা সম্ভব নয়।
আর পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ তাদের উম্মতদেরকে কেন হাশরের বিষয়টি স্পষ্ট করেননি? যেমনটি কুরআনুল কারীমের বর্ণনা থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়? এর কারণ হল, তাদের যুগসমূহ হল মানবজাতির শৈশবকাল ও শুরুর দিক। আর এটা সবারই জানা যে, প্রাথমিক পাঠসমূহে ব্যাখ্যা প্রকাশ করা হয় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে।
মূল বক্তব্য ঃ
যেহেতু অধিকাংশ আসমাউল হুসনা আখিরাতকে দাবী করে এবং একে নির্দেশ করে সুতরাং আবশ্যকীয়ভাবে এই আসমাউল হুসনার নির্দেশক দলীল-প্রমাণই আখিরাতের অস্তিত্বের পক্ষে দলীল প্রমাণ.. যেহেতু ফেরেশতারা আমাদেরকে সংবাদ দেয় যে, তারা আখিরাত ও স্থায়ী জগতের বিভিন্ন মনযিল প্রত্যক্ষ করেছে সুতরাং আবশ্যকীয়ভাবে ফেরেশতা ও রূহানী জগতের অস্তিত্বের সাক্ষ্যদানকারী দলীল-প্রমাণ এবং তাদের ইবাদতই স্বয়ং আখিরাতের জগতের পক্ষের দলীল প্রমাণ।
এবং যেহেতু মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর পবিত্র ও বরকতময় জীবন জুড়ে যে সব বাণী ঘোষণা করে গেছেন তার মধ্যে তাওহীদের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং যেদিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন তার মূল ভিত্তি হল ‘আখিরাত’। সুতরাং তাঁর নবুয়ত ও সত্যতার নির্দেশক সকল মুজিজা ও দলীল-প্রমাণ আবশ্যকীয়ভাবে আখিরাতের পক্ষে সাক্ষ্যদানকারী দলীল-প্রমাণ।
এবং যেহেতু কুরআনুল কারীমের এক চতুর্থাংশই হাশর ও আখিরাত সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করছে এবং হাজারও আয়াতের মাধ্যমে একে প্রমাণ করছে ও এর বিষয়ে সংবাদ দিচ্ছে সুতরাং কুরআনুল কারীমের সত্যতার পক্ষের সকল সাক্ষ্য ও অসংখ্য অকাট্য দলীল-প্রমাণ নিজেই আখিরাতের সত্যতার পক্ষের দলীল-প্রমাণ ও এর নির্দেশক।
অষ্টম মাসআলার সার সংক্ষেপ
সপ্তম মাসআলায় আমরা হাশর এর বিষয়টি বহু প্রসঙ্গ অবতারণার মাধ্যমে স্পষ্ট করেতে চেয়েছি। যদিও তাঁর আসমাউল হুসনার মাধ্যমে আমাদের স্রষ্টার জবাবই যথেষ্ট ও সুস্পষ্ট ছিল যা আমাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস ও পূর্ণ তুষ্টির জন্ম দিয়েছে এবং আমাদেরকে অন্য কোন ধরনের ব্যাখ্যা থেকে অমুখাপেক্ষী করেছে। তাই সেখানে এই বর্ণনা পেশ করেই ক্ষান্ত হয়েছি।
আর এই মাসআলাতে আমরা ‘আখিরাতের প্রতি ঈমান’ এর শত শত ফলাফল, উপকারিতা ও সুবিধাকে সংক্ষেপিত করব। এর মধ্যে কিছু সুবিধা আখিরাতে মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সম্পর্কিত এবং কিছু সুবিধা তার দুনিয়ায় সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সম্পর্কিত।
যে সুবিধাগুলো আখিরাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সম্পর্কিত সে বিষয়ে কুরআনুল কারীমের সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত বর্ণনার পর আর কোন বর্ণনা নেই। এই বিষয়ে জানার জন্য সেদিকে মনোনিবেশ করা যেতে পারে। আর যে সুবিধাগুলো দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সম্পর্কিত এ বিষয়ে রাসাঈলে নুরে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। মানুষকে ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক জীবনে সুখী করার জন্য আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস মানুষকে যে শত শত সুবিধা প্রদান করে তার মধ্য থেকে আমরা এখানে মাত্র কয়েকটি সুবিধা সংক্ষেপে বর্ণনা করব।
প্রথম ফল / সুবিধা ঃ
যেমনভাবে মানুষ পশু থেকে ব্যতিক্রমধর্মীভাবে তার ঘরের সাথে সম্পর্কযুক্ত তেমনিভাবে সে পৃথিবীর সবকিছুর সাথেও দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এমনিভাবে সে তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে বিভিন্ন বন্ধন ও সম্পর্কের জালে আবদ্ধ। সে মানবজাতির সাথে স্বভাবগত সম্পর্কের অধিকারী। এবং যেমনভাবে সে নশ্বর দুনিয়ায় অমর থাকতে পছন্দ করে তেমনি সে স্থায়ী আবাসেও অমর হতে আকাঙ্খা পোষণ করে। এবং যেভাবে সে তার পাকস্থলীর চাহিদা পূরণের জন্য সর্বদা খাবার সংগ্রহের জন্য সচেষ্ট থাকে তেমনি সে স্বভাবগতভাবে তার বিবেক-বুদ্ধি, অন্তর, আত্মা (রূহ), মানবিকতার জন্য খাবার সংগ্রহে বাধ্য; বরং সে এর জন্য সদা সচেষ্ট থাকে। কারণ তার এমন আশা-আকাঙ্খা ও উদ্দেশ্য-লক্ষ্য রয়েছে যা স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া পরিতৃপ্ত হতে পারে না।
আমার শৈশবে আমি আমার কল্পনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ঃ তুমি এই দু’টি জিনিসের কোনটিকে পছন্দ কর, পৃথিবীতে হাজার হাজার ব্যাপী স্থায়ী সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপন করা, পৃথিবীর শাসনব্যবস্থায় আসীন থাকা এবং পরে অস্তিত্বহীন ও বিলীন হয়ে যাওয়া নাকি কষ্টকর স্বাভাবিক জীবন যাপন করে স্থায়ীভাবে অস্তিত্বশীল থাকা? আমি দেখেছি, আমার কল্পনা দ্বিতীয়টিতে আগ্রহী হয়েছে এবং প্রথমটিকে বেদনাদায়ক মনে করেছে এবং বলেছে ঃ “আমি অস্তিত্বহীন হতে চাই না বরং স্থায়ী থাকতে চাই, যদিও তা জাহান্নামেও হয়”।
যেহেতু পৃথিবীর তাবৎ স্বাদ-আস্বাদ মানুষের কল্পনা ও অভিলাসকে পূরণ করতে পারে না, যা কিনা মানুষের স্বভাব প্রকৃতির একটি সেবক, সুতরাং মানুষের ব্যাপকভিত্তিক স্বভাব-প্রকৃতির বাস্তবতা প্রকৃতিগতভাবেই স্থায়িত্ব ও চিরন্তনতার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
সুতরাং ‘আখিরাতের প্রতি ঈমান’ এই মানুষের জন্য কেমন বিশাল যথেষ্ট ও অফুরন্ত ভাণ্ডার (ঞৎবধংঁৎু) হতে পারে যে অশেষ আগ্রহ ও আশা-আকাঙ্খার সাথে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত অথচ সে আংশিক ইচ্ছাশক্তির অংশ বিশেষ ছাড়া অন্য কিছুর মালিক নয় এবং সে অসীম দারিদ্রের মধ্যে বিচরণ করে ! এই বিশ্বাস কাক্সিক্ষত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ইস্পিত স্বাদ-আস্বাদের জন্য কেমন কেন্দ্রস্থল হতে পারে! এবং দুনিয়ার অসংখ্য দুঃখ ও দুশ্চিন্তার বিপরীতে কেমন আশ্রয়স্থল, সাহায্যের উৎস ও সান্তনার উপায় হতে পারে ? এই ফল ও উপকার লাভ করার জন্য যদি এই মানুষ তার দুনিয়ার জীবন পুরোটাই উৎসর্গ করে দেয় তাহলেও তা অনেক সস্তা হবে।
দ্বিতীয় ফল / সুবিধা ঃ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সম্পর্কিত
মানুষকে সর্বদা যে বিষয়টি ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখে এবং তার জীবনকে তিক্ত করে তুলে তা হলো তার শেষ পরিণতি এবং কবরে প্রবেশ করার বিষয়ে তার সার্বক্ষণিক চিন্তা-ভাবনা, যেমনভাবে তার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন একই পরিণতির শিকার হয়েছে। তাই এই অসহায় মানুষ Ñ যে তার একজন মাত্র প্রিয় বন্ধুর স্বার্থে তার জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে Ñ এই ভুলধারণা ও কল্পনার মধ্যে অবস্থান করে যে, তার হাজার হাজার মানুষ-ভাই বরং লক্ষ লক্ষ মানুষ-ভাই মৃত্যুর মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সে মনে করে এটি হল চিরস্থায়ী বিচ্ছেদ যার পর তাদের সাথে আর কখনো সাক্ষাৎ হবে না। মানুষের এই কল্পনা তাকে এমনভাবে যন্ত্রণাকাতর করে যা জাহান্নামের যন্ত্রণার চেয়েও গুরুতর। এই মানুষটি যখন এই ধরনের কল্পনাপ্রসূত বেদনাদায়ক শাস্তির যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে তখন ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ তার দৃষ্টি শক্তিকে খুলে দেয়, তার চোখের পর্দা সরিয়ে দেয় এবং বলে ঃ ‘লক্ষ্য কর ... ’ অতঃপর সে ঈমানের আলো দ্বারা লক্ষ্য করে। তখনই সে গভীর আত্মিক স্বাদ লাভ করে যা তাকে জান্নাতের স্বাদের কথা জানিয়ে দেয়; কেননা সে তখন তার বন্ধুদের চূড়ান্ত মৃত্যু ও নিঃশেষ হয়ে যাওয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করে এবং চিরস্থায়ী আলোর জগতে তাদের স্থায়ীভাবে বেঁচে থাকার বিষয়টি অনুধাবন করে যেখানে তারা তার জন্য অপেক্ষমান রয়েছে। এই প্রসঙ্গে এই আলোচনাই যথেষ্ট মনে করছি। কারণ ‘রাসাঈলে নূর’ (অন্য অংশে) এই ফলটি দলীল-প্রমাণসহ স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছে।
তৃতীয় ফল/ সুবিধা ঃ মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পর্কিত
সকল জীবের উপর মানুষের সর্বোচ্চ অবস্থান ও সমুন্নত মর্যাদা হল তার সর্বোচ্চ গুণ-বৈশিষ্ট্য, স্বভাবগত ব্যাপক যোগ্যতা, চিরন্তন দাসত্ব ও তার অস্তিত্ত্বের ব্যাপক ব্যপ্তির কারণে। এ কারণে অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন ও ভবিষ্যতের সাথে সম্পর্কহীন ও কেবল বর্তমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ মানুষ ব্যক্তিত্ব, ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার গুণাবলী অর্জন করে তার সংকীর্ণ বর্তমানের ভিত্তিতে এবং এগুলো তার মধ্যে সীমিত থাকে তার সীমাবদ্ধ মানদন্ড অনুসারে। তাইতো সে সেই সংকীর্ণ মানদন্ড অনুসারেই তার বাবা, ভাই, স্ত্রী বা দাসীর প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করে এবং তাদের সেবায় নিয়োজিত হয়। মনে হয় যেন সে অতীতে কোন দিন তাদেরকে দেখেনি এবং ভবিষ্যতেও কখনো দেখবে না। সে কখনোই কর্মসম্পাদনে যথার্থতার পর্যায়ে এবং বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে একনিষ্টতার অবস্থানে এবং ভালবাসার ক্ষেত্রে সন্দেহ-সংশয়মুক্ত খাঁটি মমত্বের পর্যায়ে এবং সেবার ক্ষেত্রে নিঃস্বার্থ সম্মানের পর্যায়ে আরোহন করতে পারে না। কেননা এসব গুণাবলী ও পূর্ণাঙ্গতার ব্যপ্তি তার ক্ষেত্রে (তার বিশ্বাসের সংকীর্ণতার কারণে) সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। আর তখনই মানুষ বিবেক-বুদ্ধির দিক থেকে নিকৃষ্ট প্রাণীর পর্যায়ে নেমে যায়।
কিন্তু যখনই এই মানুষের নিকট ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ আসে তাকে উদ্ধার করার জন্য ও সাহায্য করার জন্য, তখন এই বিশ্বাস এই কবর সদৃশ সংকীর্ণ সময়কালকে অত্যন্ত প্রশস্ত সময়কালে রূপান্তরিত করে; ফলে সে বর্তমানের সাথে অতীত ও ভবিষ্যতকেও একই সাথে গণ্য করে এবং তা তাকে সারা দুনিয়ার প্রশস্ততার সমান প্রশস্ত অস্তিত্ব হিসেবে দেখায় বরং অনাদি থেকে অনন্ত পর্যন্ত প্রলম্বিত ও প্রশস্ত অস্তিত্ব হিসেবে দেখায়। তখন এই মানুষ তার পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আবাস ও রূহের জগত পর্যন্ত বি¯তৃত পিতৃত্বের চাহিদা অনুযায়ী এবং এই চিন্তাধারার কারণে সে তার ভাইকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করে অনন্তকাল পর্যন্ত স্থায়ী ভ্রাতৃত্বের চাহিদা অনুযায়ী। এবং সে তার স্ত্রীকে ভালবাসে এবং তার সাথে সদাচরণ করে এ কারণে যে, সে তার জীবনে সবচেয়ে উত্তম সাথী, কেবল দুনিয়াতে নয়; আখিরাতেও। সে জীবনের এই প্রশস্ত ব্যপ্তিকে Ñ যার মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও কর্মকান্ড রয়েছে Ñ দুনিয়াবী তুচ্ছ স্বার্থ সিদ্ধি করার ও নগণ্য উপকার লাভের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে না। একারণে সে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ও কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে পূর্ণ মমত্ব, আন্তরিকতা ও পূর্ণাঙ্গ একনিষ্টতার মাধ্যমে সফলতা লাভ করে। তখন তার স্বভাব-চরিত্র ও গুণাবলী উন্নত হতে শুরু করে এবং তার মনুষ্যত্ব উন্নত হয়।
এই মানুষ, যে জীবনে স্বাদ-আস্বাদ উপভোগের ক্ষেত্রে একটি চড়–ই পাখির পর্যায়েও পৌঁছতে পারত না, সে এখন আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসের বদৌলতে পৃথিবীতে অত্যন্ত সম্মানিত অতিথি, একটি সৌভাগ্যবান ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে যে সকল জীবের উপর মর্যাদাবান। বরং সে জগতের প্রতিপালক ও মালিকের নিকট সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি ও সবচেয়ে সম্মানিত বান্দায় পরিণত হয়।
এই ফল এর বর্ণনার ক্ষেত্রে আমরা উপরোক্ত বর্ণনাকে যথেষ্ট মনে করছি কেননা রাসাঈলে নূর তা বিস্তারিত দলীল-প্রমাণসহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে।
চতুর্থ ফল ঃ মানুষের সামাজিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত
এ বিষয়ে ‘নবম রশ্মি ’এর মধ্যে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। এর সারসংক্ষেপ হল ঃ শিশুরা, যারা মানব জাতির এক চতুর্থাংশের প্রতিনিধিত্ব করে, ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ ছাড়া তাদের পক্ষে মানবকি বৈশিষ্ট্য সম্বলিত সুস্থ মানুষ হিসেবে জীবন-যাপন করা সম্ভব নয়।
যদি মানুষের মধ্যে ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ না থাকত তাহলে তারা এমন এক ধরনের জীবন যাপনে বাধ্য হত যা নির্লজ্জতা, অস্থিরতা ও বেদনাময় দুশ্চিন্তায় পরিপূর্ণ। সুতরাং তাদেরকে তাদের খেলাÑধুলায় স্বাগত জানানো হত না এবং খেলনা দ্বারা সান্তনা প্রদান করা হত না। কেননা তাদের চারপাশে যেসব শিশু মৃত্যুর শিকার হয় তা প্রতিটি শিশুর মনে তার সংবেদনশীল কোমল অনুভুতিতে চরম প্রভাব ফেলে এবং প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে তার অন্তরে যা ভবিষ্যতে অনেক আশা-আকাঙ্খাকে ধারন করবে, আরো প্রভাব ফেলে তার রূহের মধ্যে, যা স্থির হতে পারে না তাই অস্থিরতা ও হতাশায় পতিত হয়। এভাবে তার জীবন ও আক্বল (বিবেক-বুদ্ধি) তার জন্য শাস্তির উৎসে পরিণত হয়। তার জিজ্ঞাসা ও হতাশার জবাব পাওয়ার পূর্র্ব পর্যন্ত সে যে খেলা-ধুলার মাধ্যমে এসব মৃত্যুর বেদনাকে গোপন করে তা তার কোন কাজেই আসে না। তবে ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’-এর নির্দেশনা তাকে নিজের সাথে কথোপকথনে বাধ্য করে যা নিুরূপ ঃ
“আমার যে বন্ধু বা ভাই মৃত্যুবরণ করেছে, সে এখন জান্নাতের একটি পাখি হয়ে গিয়েছে। সে আমাদের চেয়ে বেশী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে আছে ও এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমার ‘মা’, যদিও তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, তবুও তিনি ঐশী প্রশান্তি ও রহমতের দিকে চলে গিয়েছেন এবং শীঘ্রই তিনি জান্নাতে তাঁর মমতাময়ী বুকে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন এবং আমার সেই মমতাময়ী মাকে আমি আবার দেখতে পাব।” এই আত্ম কথোপকথনের মাধ্যমে সে প্রশান্তিময় জীবনযাপনে সক্ষম যেমন জীবনযাপন মানুষের জন্য মানানসই।
এমনিভাবে ‘বৃদ্ধরা’, যারা মানবজাতির এক চতুর্থাংশের প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের জীবনের আসন্ন সমাপ্তি ও মাটির নীচে প্রবেশের মোকাবেলায় তারা কোন স্বস্তি খুঁজে পায় না। তাদের সুন্দর ও সুমিষ্ট পৃথিবী তার চোখের সামনে এর দরজাসমূহ বন্ধ করে দিচ্ছে। ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ ছাড়া তাদের জন্য আর কোন আশার আলো অবশিষ্ট নেই। এই ঈমান যদি অবশিষ্ট না থাকত তাহলে এই দয়াশীল সম্মানিত বাবাগণ এবং এই মমতাময়ী উৎসর্গপ্রাণ মায়েরা দুঃখের পর দুঃখ গলঃধরণ করতেন এবং অত্যন্ত নাজুক ও নির্দয় মানসিক অস্থিরতায় দিনাতিপাত করতেন। পৃথিবী তাদের জন্য কারাগারের ন্যায় সংকীর্ণ হয়ে যেত এবং জীবনটা তাদের জন্য অসহনীয় স্থায়ী শাস্তিতে পরিণত হত।
কিন্তু ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ তাদেরকে ফিসফিসিয়ে এই কথা বলে ঃ “হে বৃদ্ধরা! তোমরা চিন্তা করো না। তোমাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী যৌবন। এটি তোমাদের সামনে রয়েছে এবং অবশ্যই তা স্থায়ীভাবে আসবে। একটি উজ্জ্বল ও আনন্দময় জীবন, একটি চিরস্থায়ী দীর্ঘ জীবন তোমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। তোমরা তোমাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে শীঘ্রই মিলিত হবে। তোমাদের সকল নেককাজ সংরক্ষিত আছে এবং শীঘ্রই তোমরা এর পুরস্কার পাবে ... ” এভাবে ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ তাদেরকে সান্তনা ও প্রশস্তি দান করে। ফলে তাদের কেউ যদি একশ বৃদ্ধাবস্থার ভার বহন করতে দেয়া হয় তাহলেও সে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ আখিরাতের জীবনের অপেক্ষায় থেকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে তা বহন করবে।
এমনিভাবে যুবকরা, যারা মানবজাতির এক তৃতীয়াংশের প্রতিনিধিত্ব করে, প্রায়শঃই তাদের দুঃসাহসী বিবেক-বুদ্ধির কারণে কোন কিছু পরোয়া করে না। তাদের ইচ্ছা-অভিলাস ও প্রবৃত্তি থাকে উত্তেজনাপূর্ণ ও অদম্য। তারা তাদের অনুভূতি ও ঝোক প্রবণতার কাছে পরাজিত হয়ে যায়। সুতরাং যখনই এসব যুবকরা ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ হারিয়ে ফেলে এবং জাহান্নামের শাস্তিকে স্মরণ না করে তখনই মানুষের ধন-সম্পদ, মান-সম্মান, দুর্বলের শান্তি ও বৃদ্ধদের মান-মর্যাদা হুমকির মুখে পড়ে। যেমন তাদের কেউ অত্যন্ত স্বল্প সময়ের স্বাদ আস্বাদনের জন্য একটি শান্তিময় ও সুখময় ঘরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে ধ্বংস করে দিতে পারে এবং তার এহেন কর্মের শাস্তি হিসেবে কয়েক বছর কারাগারে দণ্ড ভোগ করে অতঃপর এক বণ্য পশুতে পরিণত হয়।
কিন্তু ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ যদি তাকে সাহায্য করে তাহলে শীঘ্রই তার সঠিক অনুভূতি ফিরে আসে এবং সে নিজেকে এই বলে সম্বোধন করে ঃ
“যদিও সরকারের পুলিশ ও তাদের দৃষ্টি আমাকে দেখতে সক্ষম নয়; কারণ আমি তাদের থেকে পালিয়ে আছি, কিন্তু চিরস্থায়ী ও বৃহত্তম কারাগার জাহান্নামের মালিক মহান সুলতানের ফেরেশতারা আমার মন্দকর্মসমূহের রেকর্ড সংরক্ষণ করছেন.. সুতরাং আমি লাগামহীন, মুক্ত ও স্বাধীন নই; বরং আমি একজন মুসাফির যার অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে .. অবশ্যম্ভাবীভাবে একদিন তাদের মত আমিও দুর্বল ও বৃদ্ধ হয়ে যাব” অতঃপর তৎক্ষণাত তার হৃদয়ের গভীরে দয়া, মমতা ও সৌহার্দ্যরে ধারা প্রবাহিত হতে থাকে এবং জুলুম করে যাদের অধিকারের উপর সে সীমালঙ্ঘন করতে চাইত তাদের প্রতি সম্মানবোধ অনুভব করে। যেহেতু ‘রাসাঈলে নুর’ এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছে তাই এই আলোচনা করেই এখানে ক্ষান্ত হলাম।
এমনিভাবে ‘রোগাক্রান্ত, নির্যাতিত, আমাদের মত বিপদগ্রস্ত এবং ফকীর ও অভাবগ্রস্তরা’ যারা বিভিন্ন ধরনের কঠিন শাস্তির দণ্ডে দণ্ডিত। তারা সবাই মিলে মানবজাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ যদি তাদেরকে সাহায্য না করে এবং এর দ্বারা যদি তারা স্বস্তি না পায় তাহলে রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণে তাদের সামনে তারা যে মৃত্যুকে তারা সদা দেখতে পায় এবং জালিমদের পক্ষ থেকে তারা যে অবহেলা ও অমর্যাদার শিকার হয় Ñ তাদের থেকে তারা প্রতিশোধ নিতে পারে না এবং তাদের থাবা থেকে তাদের মান-সম্মান উদ্ধার করতে পারে না Ñ এবং দুর্যোগের ফলে তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের মধ্যে যে বেদনাদায়ক হতাশা সৃষ্টি হয় এবং কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘন্টার স্বাদ আস্বাদনের ফলে কয়েক বছরের কারাগারের বেদনা ও শাস্তি থেকে যে প্রচণ্ড সংকীর্ণতা উদ্ভূত হয়... সন্দেহাতীতভাব এই সবকিছুই পৃথিবীটাকে এই বিপদগ্রস্তদের একটি বড় কারাগারে পরিণত করে এবং খোদ জীবনটাকে বেদনাদায়ক শাস্তিতে পরিণত করে!
কিন্তু যখনই ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ তাদেরকে সমবেদনা ও সান্তনার মাধ্যমে সাহায্য করে তখনই তারা আনন্দিত হয় এবং প্রত্যেকের ঈমানের মাত্রা অনুযায়ী তাদের নিকট থেকে সংকট হতাশা, আতঙ্ক, অস্থিরতা, প্রতিশোধ স্পৃহা দূর হওয়ার কারণে Ñ পুরোপুরি দূর হোক বা আংশিক দূর হোক Ñ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
এমনকি আমি একথা বলতে পারি ঃ যদি ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ না থাকত, যা আমাকে এবং আমার ভাইদেরকে ভয়ঙ্কর বিপদের সময় এবং বিনা দোষে এই কারাগারে অবস্থানকালে সাহায্য করেছে, তাহলে শাস্তির দিনগুলোর একটি দিনের তিক্ততা সহ্য করা খোদ মৃত্যুর মত হত এবং এই মুসিবত আমাদেরকে আমাদের স্বীয় জীবন পরিত্যাগ করার দিকে নিয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার অসংখ্য শুকরিয়া যে তিনি আমাকে আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় ভাইয়ের অনেক বেদনা সহ্য করার এবং আমার চোখের চেয়ে প্রিয় হাজার হাজার রাসাঈলে নূর নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং আমার অতি মূল্যবান খণ্ডসমূহ (প্রস্তকসমূহ) হারিয়ে যাওয়ার বেদনা সহ্য করার শক্তি দিয়েছেন...
অতঃপর এসকল দুঃখ ও বেদনা সহ্য করি আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসের কারণে, যদিও আমি কারো পক্ষ থেকে কোন ধরনের অবমাননাই সহ্য করতে পারতাম না। আমি আপনাদের নিকট কসম করছি Ñ যাতে আপনারা বিশ্বাস করেন Ñ নিশ্চয় আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসের আলো ও শক্তি আমাকে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সান্তনা ও দৃঢ়তা দিয়েছে এবং এই পরীক্ষায় বড় জিহাদের পুরস্কার লাভের মাধ্যমে সফলতা অর্জনের আগ্রহ দিয়েছে এই পর্যন্ত যে আমি একটি কল্যানময় ও সুন্দর শিক্ষালয়ে শিক্ষা প্রচারের প্রচেষ্টার অগ্নিপরীক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করেছি। এটিকে ‘মাদরাসা ইউসুফিয়া’ বলা যেতে পারে যা আমি এই আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। আমার যদি এমন ধরনের রোগ-ব্যধি না থাকত, যার দ্বারা আমি প্রায়ই আক্রান্ত হই এবং বৃদ্ধাবস্থার কারণে উদ্ভূত বিরক্তি না থাকত তাহলে এই শিক্ষালয়ে আমার দারুসসমূহ নিয়ে আরো ভালভাবে এবং মানসিক নির্ভরতা ও প্রশান্তির সাথে কাজ করতে পারতাম। যা হোক আমরা বিষয় থেকে দূরে সরে গিয়েছি। আমি আশা করি এই অপ্রাসঙ্গিকতা ক্ষমা করে দেয়া হবে।
এমনিভাবে ‘প্রতিটি মানুষের গৃহ’ তার জন্য ছোট একটি পৃথিবী; বরং তার ছোট জান্নাত। সুতরাং যদি আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এই গৃহের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপর শাসক ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হত, তাহলে এই পরিবারের প্রতিটি সদস্য পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার প্রতি তাদের হৃদ্যতা ও ভালবাসার মাত্রা অনুযায়ী বেদনাদায়ক অস্থিরতা অনুভব করত ও কঠিন শাস্তি ভোগ করত। ফলে এই জান্নাত অসহনীয় জাহান্নামে পরিণত হত। কখনো বা তাদের বিবেক-বুদ্ধিকে সাময়িক খেল-তামাশা ও আমোদ-প্রমোদে মত্ত করে রাখত। তখন এক্ষেত্রে তার দৃষ্টান্ত হত উট পাখির উপমার মত, যখন সে শিকারীকে দেখে তখন সে বালির স্তুপের মধ্যে তার মাথাকে লুকিয়ে রাখে যাতে শিকারী তাকে দেখতে না পারে। কারণ সে পালিয়ে যেতে বা উড়ে যেতে অপারগ। তেমনভাবে তারাও নির্বুদ্ধিতাবশতঃ সাময়িকভাবে তাদের অনুভূতিকে অকার্যকর করে দিয়ে অবহেলা ও অমনযোগিতার মধ্যে তাদের মাথাকে ডুবিয়ে রাখে যাতে মৃত্যু, ধ্বংস ও বিচ্ছেদ তাকে দেখতে না পারে। এভাবে তারা উম্মাদের মত সাময়িক সমাধান খুঁজে বেড়ায়।
উদাহরণস্বরূপ জন্মদাত্রী মা Ñ যে তার সন্তানের স্বার্থে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে Ñ যখনই তার সন্তানকে বিপদাপন্ন হতে দেখে তখনই সে ভয়ে কম্পমান হয়।
এমনিভাবে সন্তানেরাও যখন অবিরত বিপদ-মুসিবত দেখে তাদের পিতা-মাতাকে অথবা ভাইদেরকে উদ্ধার করতে পারে না তখনই তারা সার্বক্ষণিক মানসিক অস্থিরতা ও ভয়ের মধ্যে থাকে। এমনিভাবে এই পার্থিব জীবন যাপন Ñ যাকে ধারনা করা হয় যে, এটি একটি সুখময় জীবন Ñ এই বিশঙ্খল ও ধ্বংসশীল পৃথিবীতে বিভিন্নভাবে কাক্সিক্ষত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। সুতরাং অতিসংক্ষিপ্ত এই জীবনে পারস্পরিক সম্পর্ক ও আত্মীয়তার সম্পর্কের মধ্যে প্রকৃত হৃদ্যতা, সত্যিকারের আনুগত্য, পূর্ণ আন্তরিকতা, নির্ভেজাল সেবা ও ভালবাসা পাওয়া যায় না; বরং চারিত্রিক গুণাবলী জীবনের সংক্ষিপ্ততার অনুপাত অনুসারে হ্রাস পায়, এমনকি, হতে পারে, তা পুরোপুরি পতিত হয় এবং নিঃশেষ হয়ে যায়।
কিন্তু যখনই এই গৃহে ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ এর আগমন ঘটে তখনই তা একে পুরোপুরি আলোকিত করে। কেননা, তখন যে আত্মীয়তার সম্পর্ক, হৃদ্যতা ও ভালবাসা তাদের পরস্পরকে জড়িয়ে রাখে তখন তা সংক্ষিপ্ত সময়ের হিসাবে বিবেচনা করা হয় না বরং তা এমন সম্পর্ক অনুসারে বিবেচনা করা হয় যা আখিরাতের আবাসে ও স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের চিরস্থায়ী হওয়া পর্যন্ত প্রলম্বিত। তখন প্রত্যেক ব্যক্তি ছোট-খাট ভুল ত্র“টি উপেক্ষা করে অন্যের দিকে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করে, তাদের প্রতি নির্ভেজাল ভালবাসা পোষণ করে এবং সত্যিকারের হৃদ্যতা প্রদর্শন করে। সুতরাং তাদের চরিত্র উন্নত হয় এবং এই ঘরের মধ্যে প্রকৃত মানবতার সুখ অবারিত হতে থাকে।
এই বিষয়টি রাসাঈলে নূর-এ বর্ণিত হয়েছে। এখানে এতটুকু আলোচনা করেই ক্ষান্ত হলাম।
এভাবে প্রতিটি ‘শহর’ এর অধিবাসীদের জন্য একটি প্রশস্ত ‘ঘর’। যদি ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ এই বিরাট পরিবারের সদস্যদের উপর প্রভাবশালী না থাকত তাহলে আন্তরিকতা, ব্যক্তিত্ব, সদগুণ, ভালবাসা, ত্যাগ, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের পুরস্কারের আশা ইত্যাদি প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলীর পরিবর্তে তাদের উপর ঘৃণা, ব্যক্তিস্বার্থ, প্রতারণা, স্বার্থপরতা, কৃত্রিমতা, প্রদর্শনেচ্ছা, ঘুষ ও ধোকাবাজি প্রভাব বিস্তার করত। এবং শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও মানবতার ছদ্ধাবরণে সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা, হিংস্রতা শাসক ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হত। তখন এই শহরের জীবন বিষাক্ত হয়ে উঠত, শিশুরা নির্লজ্জতা ও অবহেলার পাত্র হত, যুবকেরা নেশা ও আমোদ-প্রমোদে মত্ত থাকত, শক্তিশালী লোকেরা জুলুম ও সীমালঙ্ঘন করত এবং বৃদ্ধরা ক্রন্দনরত থাকত।
উপরোক্ত বর্ণনার উপর কিয়াস করে বলা যায় ঃ একটি ‘দেশ’ পুরোটাই একটি প্রশস্ত ঘর ছাড়া কিছুই নয়। এবং জন্মভূমি হল উম্মাহর পরিবারের ঘর। যখনই ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ এই ঘরসমূহকে শাসন করে ও এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন সেখানে সদগুণাবলী প্রকাশিত ও বি¯তৃত হয় এবং স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় এবং পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন, আন্তরিক অনুগ্রহ, অকৃত্রিম নিঃস্বার্থ ভালবাসা, ছল-চাতুরীমুক্ত পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, প্রদর্শনেচ্ছামুক্ত আচার-আচরণ, অহংকারমুক্ত সদগুণ এবং অন্য সবধরনের সদগুণাবলীর প্রসার ও প্রকাশ ঘটে। তখন আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এসব শিশুদেরকে কানে কানে বলে : ‘‘তোমাদের প্রতিএই ধৃষ্টতা ও অবহেলাকে তোমরা পরোয়া করো না, তোমাদের সামনে রয়েছে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত, তোমরা এটি ছেড়ে দিয়ে খেলা-তামাশায় মত্ত থেকো না” এভাবে তা তাদেরকে কুরআনুল কারীমের দিক নির্দেশনার মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সচ্চরিত্র শিক্ষা দেয়।
‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ যুবকদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তোমাদের সামনে রয়েছে জাহান্নামের আগুন, সুতরাং তোমরা নেশা ও আমোদ-প্রমোদ থেকে বিরত থাক’ এভাবে তা তাদেরকে সঠিক অনুভূতির দিকে নিয়ে আসে ..
এই বিশ্বাস জালিমকে উদ্দেশ্য করে বলে ঃ “সতর্ক হও, তোমাদের উপর প্রচণ্ড শাস্তি আপতিত হবে” এভাবে তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখে এবং তাকে ন্যায় বিচারের প্রতি অনুগত বানায় .. এবং এটি বৃদ্ধদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে ঃ ‘‘তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। কারণ, তোমাদের সামনে রয়েছে ঔজ্জ্বল্যপূর্ণ চিরস্থায়ী যৌবন এবং তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আখিরাতের স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। এসব তোমরা পৃৃথিবীতে যে বিভিন্ন ধরনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়েছ তা থেকে উন্নত। সুতরাং এই সফলতা অর্জনের জন্য তোমরা দৌড়ে আস।” এভাবে তাদের কান্না আনন্দ-উৎফুল্লে পরিণত হয়।
এর উপর কিয়াস করে বলা যায় ঃ ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ প্রতিটি দল ও গ্র“পের উপর ভাল প্রভাব বিস্তার করে এবং এর আলোর স্ফুরণ ঘটায়, তা আংশিকভাবে হোক বা পূর্ণভাবে হোক, সাধারণভাবে হোক বা বিশেষভাবে হোক, কম হোক বা বেশী হোক। সুতরাং মানুষের বিষয়-আশয় নিয়ে যারা কাজ করে সেসব সমাজবাদী ও নৈতিকতাসম্পন্নদের এ বিষয়ে আরও বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা উচিত।
যদি ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’ এর অন্যান্য হাজারও সুবিধাসমূহকে উপরিউক্ত পাঁচ-ছয়টি সুবিধার সাথে কিয়াস করা হয় তাহলে অত্যন্ত স্পষ্ট ও অকাট্যভাবে অনুধাবন করা যাবে যে, দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের জীবনে ঈমানই হল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের একমাত্র উপায়।
‘২৮তম কালিমা’-এর মধ্যে এবং রাসাঈলে নূরের অন্যান্য অংশে ‘শারিরিক হাশর’ বা শারিরিক পুনরুত্থানের বিষয়ে ঠুনকো সন্দেহ-সংশয়ের জবাবস্বরূপ অত্যন্ত শক্তিশালী বর্ণনা পেশ করা হয়েছে। আমরা ঐ আলোচনাকে যথেষ্ট মনে করি। তবুও আমরা এখানে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও ছোট পরিসরে এর দিকে ইশারা দিব। তাই আমরা বলছি ঃ
অধিকাংশ আসমাউল হুসনা-ই শারিরিকতা বা শারিরিক গঠনের মধ্যে প্রকাশিত হয়, এটিই এই আসমাউল হুসনার সবচেয়ে ব্যাপক আয়না ... সৃষ্টিজগতের সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্রষ্টার সর্বোচ্চ উদ্দেশ্যাবলী শারিরিকতার মধ্যে প্রকাশিত হয়। এই শারিরিকতাই হল, এই উদ্দেশ্যাবলীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সবচেয়ে কার্যকরী কেন্দ্র ... এবং বিভিন্ন রাব্বানী অনুগ্রহ ও অঢেল নেয়ামতের অধিকাংশ প্রকারই শারিরিকতার মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় .. এবং মানুষ তার প্রয়োজনের ভাষায় আল্লাহ তা‘আলার নিকট যেসব দু’আ পেশ করে তার অধিকাংশ বীজ এবং পরম দয়ালু স্রষ্টার নৈকট্যের দিকে অগ্রসরকারী কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপনের অধিকাংশ ভিত্তি শারিরকতা থেকে উদ্ভূত .. এবং জগতের অশরীরি ও রূহানী জগতের বীজসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বৈচিত্র্য শারিরিকতার মধ্যে লুক্বায়িত।
উপরিউক্ত আলোচনার উপর কিয়াস করে বলা যায়ঃ শারিরিকতা বা শারিরিক অস্তিত্বের মধ্যে শত শত মৌলিক হাকিকত কেন্দ্রীভূত রয়েছে। এ কারণে মহা সম্মানিত স্রষ্টা ভূপৃষ্ঠের উপর শারিরিকতাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেন যাতে এর মধ্যে উল্লিখিত হাকিকতসমূহ স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। এবং তিনি অসম্ভব দ্রুততা ও হতভম্বকারী কার্যক্রমের মাধ্যমে সৃষ্টিসমূহকে কে অস্তিত্ব দান করেন। একটি কাফেলার পর আরেকটি কাফেলা আসে এবং এগুলোকে এই জগতের মেলায় প্রেরণ করেন, অতঃপর এগুলির দায়িত্ব-কর্তব্যের পরিসমাপ্তি ঘটান এবং এগুলির পেছনে অনবরত অন্যান্য সৃষ্টিসমূহকে প্রেরণ করেন। এভাবে পৃথিবীর বুকে শারিরিক পণ্য উৎপাদন করার মাধ্যমে এবং পৃথিবীকে আখিরাতের শস্যক্ষত্র ও জান্নাতের বীজক্ষেত্র বানানোর মাধ্যমে সৃষ্টি জগতের মেশিনকে সদা সচল রাখেন। এমনকি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মানুষের পাকস্থলীকে (শারিরিকতাকে) প্রশান্ত ও সন্তুষ্ট করার জন্য মানুষের স্থায়ীভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে বর্তমানের ভাষায় তাঁর নিকট যেসব দু‘আ উপস্থাপন করা হয় তাও তিনি শ্রবণ করেন। এবং সত্যিই তিনি সুনিপুনভাবে তৈরীকৃত অসংখ্য সুস্বাদু খাবার ও শত শত, হাজার হাজার ধরনের প্রাণী সৃষ্টি করার মাধ্যমে তাঁর ডাকে সাড়া দেন। যার ফলে সন্দেহতাতীতভাবে ও স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, জান্নাতের মধ্যে অধিকাংশ ধরণের বস্তুগত ও অনুভূতিশীল স্বাদ-আস্বাদ প্রকৃতপক্ষে শারিরিক। আর (আখিরাতে) স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নেয়ামতসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামতসমূহও, যা সবাই তালাশ করে ও পছন্দ করে, শারিরিক হবে।
ওহ! এটি কি সম্ভব এবং এটি কি যুক্তিসঙ্গত এবং এর মধ্যে কি কোন সন্দেহ রয়েছে যে, সর্বশক্তিমান, পরমদয়ালু সর্বজ্ঞানী প্রতিপালক সর্বদা সামান্য পাকস্থলীর স্বভাবের ভাষায় যে, প্রার্থনা করা হয় তা কবুল করেন এবং স্বেচ্ছায় ও কার্যকরভাবে এর ডাকে সাড়া দান করেন। এবং একারণে তিনি বিস্ময়কর সুনিপুনতার সাথে এর জন্য বস্তুগত খাবার সৃষ্টি করেন এবং এর দ্বারা ঐ পাকস্থলীকে সন্তুষ্ট করেন। অথচ সেই স্রষ্টা সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা অসংখ্য ও সাধারণ প্রার্থনায় সাড়া দিবেন, যা কামনা করে বৃহত্তর মানবীয় পাকস্থলী এবং এর মৌলিক স্বভাব, এবং তিনি আখিরাতে এর জন্য শারিরিক স্বাদ-আস্বাদের ব্যবস্থা করবেন না। সে তো তা-ই স্বভাবগতভাবে পছন্দ করে ও আশা করে এবং তা-ই সে স্থায়ীজগতে কামনা করে? সুতরাং এটি কি সম্ভব যে তিনি এই আহ্বানসমূহে সাড়া দিবেন না এবং শারিরিক হাশর সৃষ্টি ফলিত করবেন না এবং এই মানুষকে তিনি স্থায়ী সন্তুষ্টির দ্বারা সন্তুষ্ট করবেন না, যে মানুষ হল সৃষ্টিজগতের ফল, পৃথিবীর খলিফা ও সম্মানিত মর্যাদাবান বান্দা? কক্ষনো না .. কক্ষনো না ..! এটি অসম্ভব, শতভাগ অসম্ভব বরং পুরোপুরি বাতিল। এটি কিভাবে সম্ভব যে, তিনি মাছির ভনভন শব্দ শুনতে পান অথচ আকাশের গর্জন শুনতে পান না। এবং কিভাবে তিনি এক তুচ্ছ সৈনিককে পরোয়া করেন অথচ বিরাট সৈন্যবাহিনীকে গণ্য করেন না। আল্লাহ তা‘আলা তা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। হ্যাঁ, কুরআনুল কারীমের এই আয়াতের অকাট্য সুস্পষ্ট বক্তব্য ঃ
وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ
অর্থঃ “সেখানে রয়েছে সবকিছু, যা মন চায় এবং যাতে নয়ন তৃপ্ত হয়” (৪৩-সূরা আয্ যুখরুফঃ ৭১)
সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে যে, মানুষ যেসব অনুভবযোগ্য বস্তুগত স্বাদ-আস্বাদকে পছন্দ করে, যার নমুনা সে পৃথিবীতে আস্বাদন করে, শীঘ্রই সে জান্নাতের মধ্যে এগুলোকে আরো উপযুক্ত আকারে দেখতে পাবে এবং এগুলোর স্বাদ গ্রহণ করবে। এবং মানুষের জিহ্বা, চোখ, কান ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং ইবাদত বন্দেগী করে, শীঘ্রই তাকে এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট শারিরিক স্বাদ-আস্বাদ প্রদান করার মাধ্যমে এর পুরস্কার দেয়া হবে। সুতরাং শারিরিক স্বাদ-আস্বাদের বিষয়ে কুরআনুল কারীমের বর্ণনা অত্যন্ত সুস্পষ্ট; এই বিষয়ে কোন ধরনের ভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুযোগ নেই।
এভাবে আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসের ফলসমূহ প্রকাশ করে যে, যেভাবে মানুষের পাকস্থলীর হাকিকত ও এর প্রয়োজনীয়তা অকাট্যভাবে খাবারে অস্তিত্বের বিষয়টি নির্দেশ করে তেমনিভাবে মানুষের হাকিকত, তার পরিপূর্ণতা, তার স্বভাবগত প্রয়োজন, অমরত্বের আকাক্সক্ষা, তার যোগ্যতা ও সম্ভাবনাসমূহ ‘আাখরাতের প্রতি বিশ্বাস’ এর উল্লিখিত ফলাফল ও সুবিধাবলী দাবী করে এবং নিশ্চিতভাবে আখিরাত, জান্নাত ও স্থায়ী অনুভবযোগ্য বস্তুগত স্বাদ-আস্বাদকে প্রমাণ করে এবং এগুলোর নিশ্চিত অস্তিত্বের বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়। এই বিশ্বজগতের পরিপূর্ণতার হাকিকত, এর বিজ্ঞানময় সৃষ্টিগত নিদর্শণাবলী ও মানবীয় হাকিকতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল হাকিকতও অকাট্যভাবে আখিরাতের অস্তিত্বের বিষয়টি নির্দেশ করে এবং হাশরের আগমন ও জান্নাত-জাহান্নামের দরজাসমূহ খুলে যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত সাক্ষ্য প্রদান করে। যেহেতু রাসাঈলে নূর অত্যন্ত চমৎকার ভঙ্গীতে ও অত্যন্ত শক্তিশালী দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে এই বিষয়টি প্রমাণ করেছে, বিশেষ করে ‘দশম বাণী’, ‘২৮তম বাণী’, ‘২৯তম বাণী, ‘নবম রশ্মি’ ও ‘রিসালাতুল মুনাজাত’-এর মধ্যে। আমরা এগুলোকেই যথেষ্ট মনে করছি।
জাহান্নামের বিষয়ে কুরআনুল কারীমের বর্ণনা এতটাই স্পষ্ট ও পরিস্কার যে, এই বিষয়ে অন্য কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। তবে আমরা দু’টি পয়েন্টে কিছু আলোচনা করব যা ছোট-খাট কয়েকটি সন্দেহ-সংশয় দূর করবে। এই বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে রাসাঈলে নূর-এর মধ্যে ঃ
প্রথম পয়েন্ট ঃ
জাহান্নামের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ও জাহান্নামের ভয় উল্লিখিত ঈমানের ফলাফলে স্বাদ-আস্বাদকে দূর করে দেয় না। কেননা, অপরিসীম ঐশী রহমত ঐ ভয়কারী বান্দাকে কানে কানে বলে ঃ ‘আস, তোমার জন্য তওবার দরজা খোলা রয়েছে, এই দরজায় প্রবেশ কর’। কারণ, জাহান্নামের অস্তিত্ব ভয় প্রদর্শনের জন্য নয়; বরং জান্নাতের স্বাদ-আস্বাদের সাথে পুরোপুরিভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য, তোমাকে এর পরিপূর্ণ স্বাদ পাইয়ে দেয়ার জন্য, তোমার পক্ষে ও অসংখ্য সৃষ্টির পক্ষে প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য, যাদের অধিকার হরণ করা হয়েছিল এবং যাদের উপর সীমালঙ্ঘন করা হয়েছিল, এবং এর মাধ্যমে তাদের সবাইকে আনন্দিত ও সন্তুষ্ট করার জন্য।
সুতরাং ওহে পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ব্যক্তি Ñ যে পথভ্রষ্টতা থেকে বের হতে সক্ষম নয় Ñ নিশ্চয় চিরস্থায়ীভাবে অস্তিত্বহীন হওয়ার চেয়ে জাহান্নামের অস্তিত্বই তোমার জন্য উত্তম। কারণ, জাহান্নামের অস্তিত্বের মধ্যে, এমনকি কাফিরদের জন্যও, এক ধরনের রহমত রয়েছে। কেননা মানুষ ও সন্তান জন্মদানকারী প্রাণীসমূহ তাদের আত্মীয়-স্বজন, সন্তান-সন্ততি ও বন্ধু-বান্ধবের আনন্দ-সুখে আনন্দিত হয় এবং তাদের সুখে এক ধরনের সুখ পায়। সুতরাং হে নাস্তিক! তোমার পথভ্রষ্টতার কারণে তুমি হয়ত অস্তিত্বহীনতার অতল গহবরে পতিত হবে অথবা জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে। আর অস্তিত্বহীনতা যেহেতু কেবলই অনিষ্টতা সুতরাং তোমার বন্ধুদের এবং যে আত্মীয়-স্বজন, বাবা-মা ও বংশধরের সুখে তুমি সুখ পাও তাদের সকলের চূড়ান্ত অস্তিত্বহীনতা তোমার আত্মাকে জ্বালিয়ে দিবে, তোমার হৃদয়কে শাস্তি দিবে এবং তোমার মানবীয় প্রকৃতিকে জাহান্নামের শাস্তির চেয়েও হাজার গুণ বেশী যন্ত্রণা দিবে। কেননা, জাহান্নাম যদি না থাকত তাহলে জান্নাতও থাকত না। তোমার কুফরীর কারণে সবকিছুই অস্তিত্বহীনতায় পতিত হত। কিন্তু যখন তুমি জাহান্নামে প্রবেশ করলে এবং অস্তিত্বশীলতার আওতার মধ্যে রয়ে গেলে তখন তোমার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন হয় জান্নাতে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে, না হয় তারা আল্লাহ তা‘আলার রহমতের মধ্যে অস্তিত্বহীনতার আওতার মধ্যে থাকবে। সুতরাং জাহান্নামের অস্তিত্ব মেনে নেয়া ছাড়া তোমার কোন উপায় নেই; কারণ, এর অস্তিত্বের বিষয়ে বিরোধিতা করা অথবা তা প্রত্যাখ্যান করার মানে হল অস্তিত্বহীনতাকে সমর্থন করা, যার মানে হল সকল প্রিয়জন ও বন্ধু-বান্ধবের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে নির্মুল ও নিঃশেষ করে দেয়া!
হ্যাঁ, নিশ্চয় জাহান্নাম অস্তিত্বের আবাস যা মহাপ্রজ্ঞাবান ও মহামহিমান্বিত স্বত্তার হেকমত ও ন্যায়-নীতি অনুসারে কারাগারের দায়িত্ব পালন করে। এটি অস্তিত্বশীলতার আওতার মধ্যে ভয়ঙ্কর ও সাংঘাতিক স্থান যা প্রকৃতই ‘কল্যাণ’। এর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ও বিভিন্ন হেকমত রয়েছে যা স্থায়ীজগতের সাথে সম্পর্কিত। এটি অনেক জীবন্ত প্রাণীর জন্য সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আবাসস্থল, যেমন ফেরেশতাদের জন্য।
দ্বিতীয় পয়েন্ট ঃ
জাহান্নামের অস্তিত্ব এবং এর প্রচণ্ড শাস্তি নিশ্চিতভাবে আল্লাহ তা‘আলার অসীম রহমত, প্রকৃত ন্যায়বিচার ও সীমালঙ্ঘনমুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ হেকমতের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বরং আল্লাহ তা’আলার রহমত, ন্যায়বিচার ও হেকমত জাহান্নামের অস্তিত্ব দাবী করে। কেননা, যে হিংস্রজন্তু একশ জীব-জন্তু শিকার করেছে সেটিকে হত্যা করা অথবা যে জালিম হাজারও নিরপরাধ মানুষের সম্মান হরণ করেছে, তার উপর শাস্তি আরোপ করা ন্যায়বিচারের দিক থেকে অত্যাচারিতদের জন্য হাজারগুণ ‘রহমত’। আর এই জালিমকে ক্ষমা করে দেয়া বা তার অপরাধকে উপেক্ষা করা এবং ঐ হিংস্রজন্তুকে মুক্ত অবস্থায় ছেড়ে দেয়া একটি ঘৃণ্য জুলুম এবং শত শত অসহায়ের জন্য শত শতগুণ নির্দয়তা।
অনুরূপ চূড়ান্ত কাফিরও জাহান্নামের কারাগারে প্রবেশ করবে। কারণ, সে তার কুফরীর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার আসমাউল হুসনার অধিকারসমূহকে অস্বীকার করে অর্থাৎ ঐ অধিকারসমূহের উপর সীমালঙ্ঘন করে .. এবং যেসব সৃষ্টি এই নামসমূহের সাক্ষ্য প্রদান করে তাদের সাক্ষ্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার মাধ্যমে সে এদের অধিকারের উপরও সীমালঙ্ঘন করে .. এবং সৃষ্টিসমূহের মহান দায়িত্ব-কর্তব্যকে Ñ অর্থাৎ এই নামসমূহের প্রতি তাসবীহ পাঠ করাকে Ñ অস্বীকার করার মাধ্যমে এদের অধিকারের উপর সীমালঙ্ঘন করে ..এবং সকল সৃষ্টি রবুবিয়াত ও উলুহিয়্যাত-এর প্রকাশের প্রতি যে বিভিন্ন ধরনের ইবাদত বন্দেগী করে থাকে তা অস্বীকার করার মাধ্যমে Ñ এই ইবাদত-বন্দেগীই এদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং এদের অস্তিত্বশীল থাকার অন্যতম কারণ Ñ সে সকল সৃষ্টিজীবের অধিকারের উপর চরম সীমালঙ্ঘন করে। এ কারণে কুফরী একটি বড় অপরাধ ও ঘৃণ্য জুলুম যার কদর্যতা ক্ষমার সকল সীমা অতিক্রম করে। তাই তার উপর কুরআনুল কারীমের এই আয়াতের হুমকি প্রযোজ্য হয় ঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا
অর্থঃ ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না, এটি ছাড়া অন্যান্য অপরাধ তিনি যার জন্য ইচ্ছা করেন ক্ষমা করেন এবং যে আল্লাহর সাথে শরীক করল সে এক মহাপাপ উদ্ভাবন করল’’ (সূরা নিসা ঃ ৪৮)
বরং এই ধরনের ব্যক্তির প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ না করাটা এ বিশাল সংখ্যক সৃষ্টিজীব ও সৃষ্টবস্তুর Ñ যাদের অধিকার নষ্ট করা হয়েছে Ñ সাথে সংশ্লিষ্ট আল্লাহ তা’আলার ‘রহমত’-এর সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
এমনিভাবে এই দাবীকারীরা যেভাবে জাহান্নামের অস্তিত্বকে দাবী করে তেমনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সম্মান, ক্ষমতা ও বিশালতা ও তাঁর পূর্ণতা নিশ্চিতভাবে দাবী করে।
হ্যাঁ, কোন নির্বোধ বা পাপাচারী-দুর্ভাগা যদি দেশের প্রতাপশালী শাসকের প্রতি সীমালঙ্ঘন করে ও তাঁর মর্যাদা ও মহত্বকে অবজ্ঞা করে বলে ঃ “তুমি আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে পারবে না এবং কখনোই তুমি এতে সক্ষম হবে না।”
তবে এই দেশে কোন কারাগার না থাকলেও এই শাসক এই সীমালঙ্ঘনকারী নির্বোধের জন্য শীঘ্রই একটি কারাগার তৈরী করবে। চূড়ান্ত কাফিরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি এমনই। কেননা, তার কুফরীর মাধ্যমে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার মর্যাদার উপর চরম সীমালঙ্ঘন করে এবং তাঁকে অস্বীকার করার মাধ্যমে তাঁর কুদরতের মহত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এবং তাকে অতিক্রম করার মাধ্যমে তাঁর প্রভূত্বের পূর্ণতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সুতরাং যদি জাহান্নামের অস্তিত্বের জন্য এসব কারণ, অসংখ্য যুক্তি ও হেকমত নাও থাকত, তবুও এ ধরনের কাফিরদের জন্য জাহান্নাম সৃষ্টি করা এবং এদেরকে এতে নিক্ষেপ করাই এই মর্যাদা ও মহত্বের জন্য মানানসই ।
তদুপরি কুফরীর প্রকৃতি নিজেই জাহান্নামের সংবাদ দেয়। যেভাবে ঈমানের প্রকৃতি যখন বাস্তব রূপ লাভ করে তখন এর স্বাদ ও সৌন্দর্যের নেয়ামতসমূহের মাধ্যমে মানুষের অনুভূতিতে ও তার অন্তরে একটি বিশেষ জান্নাত তৈরী করা সম্ভব। এটি একটি ক্ষুদ্র জান্নাত, যা আখিরাতের স্থায়ী জান্নাতের সংবাদ দেয় ও এর দিকে ইঙ্গিত করে। তেমনি কুফরী Ñ বিশেষ করে চূড়ান্ত কুফরী Ñ নিফাক (কপটতা) ও ধর্মদ্রোহীতার মধ্যে অনেক যন্ত্রণা, শাস্তি ও ভয়ঙ্কর অন্ধকার রয়েছে, যদি এগুলো কারো মাঝে মূর্ত হয়ে উঠে ও শিকড় গেড়ে বসে তাহলে এগুলি তার জন্য বিশেষ একটি জাহান্নাম তৈরি করে যা তাকে সেই জাহান্নামের দিকে ইঙ্গিত করে যার মধ্যে সে আখিরাতের দিনে প্রবেশ করবে, যা ভয়াবহতা ও শাস্তির দিক থেকে অধিক কঠিন ও ভয়ঙ্কর।
এই বিষয়টি আমরা অকাট্য দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে রাসাঈলে নূর-এ প্রমাণ করেছি। এবং এই মাসআলার শুরুতেও এই দিকে ইশারা করা হয়েছে।
আর এই দুনিয়া যেহেতু আখিরাতের শস্যক্ষেত্র তাই এই পৃথিবীর বীজতলার ছোট ছোট হাকিকতসমূহ আখিরাতে অঙ্কুরিত হয়। সূতরাং এই বিষাক্ত বীজ (কুফরী) এই দৃষ্টিকোন থেকে যাক্কুম বৃক্ষের দিকে ইশারা করে এবং বলে ঃ ‘আমি ঐ গাছটির মূল ও এর নির্যাস। যে দুর্ভাগা তার মনে আমাকে লালন করবে তার জন্য শীঘ্রই আমি তার জন্য ঐ অভিশপ্ত গাছের একটি বিশেষ নমুনা উৎপন্ন করব’।
আর ‘কুফরী’ যেহেতু অসংখ্য অধিকারের উপর সীমালঙ্ঘন ও নির্লজ্জ বাড়াবাড়ি সেহেতু এটি একটি সীমাহীন অপরাধ। তাই ‘কুফরী’ কাফির ব্যক্তিকে সীমাহীন শাস্তির হকদার বানিয়ে দেয়। যে হত্যাকাণ্ড এক মিনিটে সংঘটিত হয় তা যদি হত্যাকারীকে ১৫ বছরের শাস্তি ভোগ করাতে পারে (যা প্রায় ৮০ মিলিয়ন মিনিটের সমান) এবং একে মানবীয় ন্যায়বিচারের সাথে সংগতিপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং একে জনস্বার্থ ও জনঅধিকারের সাথে সংগতিপূর্ণ গণ্য করা হয় তাহলে চূড়ান্ত কুফরীর এক মিনিট সময়কে Ñ কুফরীকে এক হাজার হত্যা হিসেবে গণ্য করে Ñ ৮ বিলিয়ন মিনিট সময় শাস্তির সমান গণ্য করা দোষনীয় কিছু নয়। এই মানবীয় ন্যায়বিচার অনুসারে যে ব্যক্তি তার পুরো জীবন কুফরীতে কাটায় সে দুই ট্রিলিয়ন ৮৮০ বিলিয়ন মিনিট শাস্তি পাওনা হয়। অর্থাৎ সে কুরআনুল কারীমের এই সতর্কবাণীর হকদার হয়ঃ “সেখানে তারা চিরকাল থাকবে” (সূরা নিসা ঃ ১৬৯)
জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনার ক্ষেত্রে কুরআনুল কারীমের বিস্ময়কর বর্ণনাপদ্ধতি এবং ‘রাসাঈলে নূর’ Ñ যা কুরআনুল কারীম থেকে প্লাবিত ও কুরআনের তাফসীর Ñ এর মধ্যে জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্বের বিষয়ে যেসব দলীল-প্রমাণ রয়েছে তা অন্য কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জায়গা রাখেনি। অনেক আয়াতে এ বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে ঃ
وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
অর্থ ঃ এবং তারা আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে ও বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এটি অনর্থক সৃষ্টি করেন নি। পবিত্র আপনি! আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। (সূরা আলে ইমরান ঃ ১৯১)
وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا(৬৫)إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا
অর্থ ঃ এবং তারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত করুন, নিশ্চয় এর শাস্তি সর্বনাশা। নিশ্চয় বিশ্রামস্থল ও বাসস্থান হিসেবে তা খুবই নিকৃষ্ট। ( সূরা আল ফুরকান ঃ ৬৫-৬৬)
রাসূলুল্লাহ (সা.), নবী-রাসূলগণ ও হাকিকতের অনুসারীরা তাদের নিয়মিত দু‘আর মধ্যে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যা বারবার বলতেন তাহলো ঃ “আমাদেরকে আগুন থেকে রক্ষা করুন ...’ ‘আমাদেরকে আগুন থেকে উদ্ধার করুন’.. ‘আমাদেরকে আগুন থেকে মুক্তি দিন’ .. যা ওহী ও কাশফ-এর ভিত্তিতে তাদের হৃদয়ে (জাহান্নামের অস্তিত্বের বিষয়ে) নিশ্চিত বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। এই সবকিছু আমাদের নিকট বর্ণনা করছে যে, পৃথিবীতে মানবতার সবচেয়ে বড় প্রসঙ্গ হল, জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া এবং সৃষ্টিকুলের হাকিকতসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে হতভম্বকারী হাকিকত; বরং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাকিকত হল ‘জাহান্নাম’ যা ঐ মুহাক্কিক ব্যক্তিবর্গ এবং সাক্ষ্য ও কাশফ-এর অধিকারীদের একাংশ প্রত্যক্ষ করে এবং অন্যরা এর ভয়াবহতার জিহ্বা ও এর নিকষ-কালো অন্ধকার দেখতে পায় এবং তাদের কেউ কেউ এর অগ্নিশিখার ও টগবগ করার গুঞ্জন শুনতে পায় এবং এর ভয়াবহতা দেখে চিৎকার করে বলে উঠেঃ
أجرنا من النار
অর্থাৎ ‘আমাদেরকে আগুন থেকে বাঁচান’।
হ্যাঁ, এই জগতে ভাল-মন্দ, স্বাদ-বিস্বাদ, আলো-অন্ধকার, উষ্ণতা-শীতলতা, সৌন্দর্য-কদর্য ও হেদায়াত-পথভ্রষ্টতার সম্মিলন ও একটির সাথে অন্যটির আন্তঃপ্রবেশ কেবল মহান হেকমতের কারণে; কেননা ‘মন্দ’ না থাকলে ‘ভাল’ অনুধাবন করা যেতনা। এবং ‘বেদনা’ না থাকলে ‘স্বাদ’ বুঝা যেত না। আলোর পরে অন্ধকার না আসলে আলোর সৌন্দর্য স্পষ্ট হয়ে উঠে না। শীতলতার অস্তিত্ব না থাকলে তাপের মাত্রা বুঝা যাবে না। এভাবে সৌন্দর্যের একটি হাকিকত কদর্যের অস্তিত্বের কারণে হাজার হাকিকতে পরিণত হয়; বরং হাজার ধরনের সৌন্দর্য উৎপন্ন করে। জাহান্নামের অস্তিত্ব না থাকলে জান্নাতের অনেক স্বাদ-আস্বাদ অনুধাবন করা যাবে না। উপরিউক্ত বর্ণনার উপর তুলনা করে প্রতিটি বস্তুকে এর বিপরীত বস্তুর দ্বারা অনুধাবন করা সম্ভব এবং বিপরীত বস্তুর অস্তিত্বের দ্বারা একটি হাকিকত অনেক হাকিকতের জন্ম দিতে পারে।
যেহেতু এই পরস্পর মিশ্রিত সৃষ্টিসমূহ নশ্বর আবাস থেকে স্থায়ী আবাসের দিকে প্রবাহমান সুতরাং ভাল, স্বাদ, আলো, সৌন্দর্য, ঈমান ইত্যাদি অবশ্যম্ভাবীভাবে জান্নাতের দিকে প্রবাহমান। এবং মন্দ, বেদনা, অন্ধকার, কদর্যতা, কুফরী ইত্যাদি অনিষ্টকর বিষয়াবলী জাহান্নামের দিকে পতনোন্মুখ। সুতরাং এই পারস্পরিক সংঘাতপূর্ণ জগতের প্রবল প্রবাহ সর্বদা ঐ দু’টি হাউজের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে এবং আবর্তনের শেষ লগ্নে এ দুটির নিকটই গিয়ে স্থির হবে।
এই আলোচনা আমরা এখানেই শেষ করছি এবং “২৯তম কালিমা’-এর শেষাংশে যে চমৎকার কিছু পয়েন্ট আলোচিত হয়েছে সেদিকে নির্দেশ করছি।
ওহে মাদ্রাসা ইউসুফিয়ার সহপাঠীবৃন্দ!
ভয়ঙ্কর স্থায়ী কারাগার জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ পথ হল পার্থিব কারাগারে আমাদের বেঁচে থাকার সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। এটিই অনেক পাপ থেকে আমাদের হস্তসমূহকে গুটিয়ে রেখেছে এবং এগুলো থেকে আমাদেরকে মুক্ত রেখেছে। সূতরাং এখন আমাদের দায়িত্ব হল আমাদের অতীতে সংঘটিত পাপরাশি থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তাওবা করা।
ফরজ কাজ ও ইবাদতসমূহ সম্পাদন করা যাতে এই কারাগারের প্রতিটি ঘন্টাকে একদিনের ইবাদতের সমান ইবাদতে পরিণত করতে পারি। স্থায়ী কারাগার থেকে মুক্ত পাওয়ার ও আলোকিত জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য এটি আমাদের মোক্ষম সুযোগ। এই সুযোগ যদি আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে আমরা আমাদের আখিরাতকে চোখের পানিতে ডুবিয়ে দিব, যেমনভাবে আমরা আমাদের দুনিয়াকে ডুবিয়ে দিয়েছি। এবং আমাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’আলার এই বাণী প্রযোজ্য হবেঃ
‘‘সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে” (২২- সূরা আল-হাজ্জঃ ১১)
এই লিখাটি যখন লিখা হচ্ছিল তখন বরকতময় ঈদুল আযহার তাকবীর ধ্বনি উচ্চ কণ্ঠে উচ্চারিত হিেচ্ছল। তখন আমর মনে হল, পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারণ করছে। ত্রিশ মিলিয়নের বেশী মুসলিম একসাথে এই ঘোষণা দিচ্ছে। ভু-গোলকের প্রাকাণ্ডতা ও এর প্রশস্ততার আকার অনুসারে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে এবং পৃথিবী আকাশের দিক-বিদিকে তার সাথী-সহযোগী গ্রহ-নক্ষত্রকে এই পবিত্র কালিমাটি জানিয়ে দিচ্ছে। রাসূলে আকরাম (সা.) তেরশ বছর পূর্বে তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাথীদেরকে যা বলেছিলেন ও যা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই মোতাবেক বিশ হাজারেরও বেশী হাজী আরাফার ময়দানে ও (কুরবানীর) ঈদ উপলক্ষ্যে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারণ করছে। আমি পুরোপুরি অনুভব করলাম বরং পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম যে, এই উচ্চারণ, এই ঘোষণা হল, ‘পৃথিবীর প্রতিপালক’ ও ‘জগতসমূহের প্রতিপালক’-এই মহান দুই অভিধার মাধ্যমে ইলাহী রবুবিয়াতের নিরঙ্কুশ ও স্পষ্ট প্রাকাশের প্রতি সর্বোত ও সার্বিক আনুগত্যের প্রকাশ।
এরপর আমি আমার নিজকে প্রশ্ন করলাম ঃ
আখিরাত ও এই পবিত্র কালিমা ‘আল্লাহু আকবার’-এর মধ্যে কি সম্পর্ক থাকতে পারে? অতঃপর তৎক্ষণাত আমার মনে হল, এই কালিমাটি এবং ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘ওয়ালহামদু লিল্লাহ’, ‘ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সহ এধরনের পবিত্র ও ইসলামের নিদর্শনবহনকারী কালিমাসমূহ Ñ যেগুলো স্থায়ী সৎকাজ হিসেবে গণ্য Ñ সন্দেহতাতীতভাবে আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়, আংশিকভাবে হোক আর পুরোপুরি হোক, এবং এগুলির যথার্থতার দিকে ইঙ্গিত দেয়।
‘আল্লাহু আকবার’ এর অর্থের একটি দিক হলঃ আল্লাহ তা‘আলার কুদরত ও জ্ঞান সবকিছুর ঊর্ধ্বে এবং সবকিছু থেকে বড় ও মহান। কোন কিছু কোনভাবেই তাঁর জ্ঞানের আওতা থেকে বের হয়ে যেতে পারে না, তাঁর নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা থেকে পালিয়ে যেতে বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে না। তিনি সকল বড় থেকে বড় যেগুলোকে আমরা ভয় পাই ও বড় মনে করি। অর্থাৎ তিনি হাশর সৃষ্টি করা থেকে বড়, আমাদেরকে অস্তিত্বহীনতা থেকে উদ্ধার করা থেকে বড়, আমাদেরকে অস্তিত্বহীনতা থেকে উদ্ধার করা থেকে বড় এবং আমাদেরকে চিরস্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দান করা থেকে বড়। তিনি প্রত্যেক এমন কিছু থেকে বড় যা দেখে আমরা বিস্মিত হই এবং যা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধির আওতার বাইরে। যেমন, আল্লাহ সুব্হানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ
‘‘তোমাদের (সকলের) সৃষ্টি ও পুনরুত্থান একটি আত্মার সৃষ্টি ও পুনরুত্থানেরই অনুরূপ” (৩১-সূরা লুকমানঃ ২৮)
এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, মানবতাকে একত্রিত করা এবং তাদের সবাইকে পুনজীর্বিত করা কুদরতে ইলাহীর জন্য একটি মাত্র নাফস বা আত্মা সৃষ্টি করার মতই অত্যন্ত সহজ কাজ। এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, মানুষ যখন বিরাট কিছু দেখে অথবা বড় ধরনের বিপদ-আপদ বা মহান উদ্দেশ্য-লক্ষ্যের মুখোমুখি হয় তখনই প্রবাদ-প্রবচনের মত উচ্চারণ করেঃ ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’! এই মহান কালিমাকে তারা তাদের সান্তনা, শক্তি ও নির্ভরতার উৎস বানিয়ে নেয়। হ্যাঁ, এই কালিমাটি এবং এর সাথী দু’টি কালিমাঃ ‘সুবহানাল্লাহ’ ও ‘ওয়াল হামদুলিল্লাহ’ হল সকল ইবাদতের সূচীপত্র, নামাজের বীজ ও সারসংক্ষেপ (যেমনটি নবম কালিমাতে আলোচিত হয়েছে) সুতরাং এই কালিমাসমূহ বারবার উচ্চারণ করা হয় Ñ এগুলি নামাযে ও নামাযপরবর্তী যিকিরে তিনটি বড় বড় হাকিকত Ñ কেবল নামাযের অর্থ শক্তিশালীকরণ, একে বিশ্বাসের গভীরে স্থাপন করা এবং একে মন-মস্তিস্কে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করার জন্য। এগুলো ঐসকল প্রশ্নাবলীর অকাট্য জবাব যা বিস্ময়, আনন্দ ও আতঙ্ক থেকে মানুষের মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়, যখন সে এই জগতকে প্রত্যক্ষ করে এবং এমন কিছু দেখে যা তাকে উত্তেজিত করে এবং হতাশাগ্রস্ত করে এবং যা তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিকে চালিত করে/ তাড়িত করে।
হ্যাঁ, ঈদ উৎসবের সময় একজন ফিল্ডমার্শালের মত একজন সৈনিকও সুলতানের দরবারে প্রবেশ করতে পারে অথচ অন্যসব দিন এই সৈনিকটি তার কমান্ডিং অফিসারের মাধ্যমে কেবল ফিল্ড মার্শালের সাথেই যোগাযোগ করতে পারে। সে সুলতানকে চিনে কেবল তার স্বীয় পদ-পদবী ও অবস্থান থেকে যেমনটি ২৬তম কালিমার শেষাংশে আলোচনা করা হয়েছে। এমনিভাবে হজ্জের মধ্যে প্রতিটি ব্যক্তি তার সত্য প্রভূকে চিনতে শুরু করে ‘পৃথিবীর প্রতিপালক’ ও ‘বিশ্বজগতের প্রতিপালক’ নামে। সে আল্লাহ তা‘আলাকে তাঁর সৎকর্মশীল বন্ধুদের চেনার মতই চিনতে শুরু করে। যখনই তার মনের কোণে মহত্ব ও ইলাহী মহত্বের স্তরসমূহ উন্মুক্ত হয় তখনই সে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে এর জবাব দেয়। যখন ক্লান্তিকর প্রশ্নাবলী তার রূহের মধ্যে বারংবার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে তখন ‘আল্লাহু আকবার’ই হল শয়তানের মারাত্মক ষড়যন্ত্রসমূহের মূল কেটে দেয়ার জন্য উপযুক্ত জবাব।
যেমনটি ত্রয়োদশ ঝলকে বর্ণনা করা হয়েছে।
হ্যাঁ, যেমনভাবে এই ‘আল্লাহু আকবার’ কালিমা আখিরাত সম্পর্কে আমাদের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত ও শক্তিশালী জবাব দেয় তেমনি ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বাক্যটি আরেকটি বাক্য যা হাশরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং হাশরের অস্তিত্বকে দাবী করে। এটি আমাদেরকে বলেঃ ‘‘আখিরাত না থাকলে আমার কোন অর্থ হত না’’। কারণ আমার অর্থ হল ঃ “অনাদিকাল থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত সকল প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা Ñ তা যে প্রশংসাকারীর নিকট থেকে বের হোক এবং যে প্রশংসার অধিকারীর উপরই পতিত হোক, তা সবই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্য বিশেষিত। কারণ, স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ সকল নেয়ামতের মূল ও চূড়া । এটিই নেয়ামতসমূহকে প্রকৃত নেয়ামতে পরিণত করে যা অফুরন্ত ও অনিঃশেষ। এটিই সকল অনুভূতিশীল সৃষ্টিকে অস্তিত্বহীনতার মুসিবত থেকে উদ্ধার করে ও মুক্তি দেয়। ত্ইা কেবল স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই আমার পুরোপুরি অর্থের সমান হতে পারে।’’
হ্যাঁ, প্রতিটি মু’মিন শরীয়তের নির্দেশ অনুসারে প্রতিদিন নামাযের পর কমপক্ষে একশত পঞ্চাশ বার ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ পাঠ করে যা অনাদি থেকে অন্তকাল পর্যন্ত প্রলম্বিত প্রশংসা, স্তুতি ও অত্যন্ত ব্যাপক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এগুলি মূলতঃ জান্নাতে স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করার জন্য অগ্রিম পরিশোধকৃত মূল্য। কারণ ‘আল-হামদু লিল্লাহ’র অর্থ কষ্ট-বেদনাপূর্ণ ধ্বংসশীল ক্ষণকালীন দুনিয়ার নেয়ামতসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা সম্ভব নয়; বরং এমনকি যদি আপনি এই নেয়ামতসমূহ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে, এগুলো চিরস্থায়ী নেয়ামতের উপায় ছাড়া আর কিছুই নয় যার জন্য শুকরিয়া আদায় করা প্রয়োজন।
আর ‘সুবহানাল্লাহ’ বাক্যটির অর্থ হল ঃ আল্লাহ তা‘আলা সকল অংশীদার, ত্র“টি-বিচ্যুতি, জুলুম-অত্যাচার, অক্ষমতা, কঠোরতা, অভাব-অভিযোগ ও প্রতারণা থেকে মুক্ত এবং প্রত্যেক এমন কিছু থেকে মুক্ত যা তাঁর পূর্ণতা, সৌন্দর্য ও মহত্বের বিপরীত। এই অর্থটি স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আখিরাতের দিকে নির্দেশ করে, যা তাঁর বড়ত্ব, মহত্ব ও পূর্ণতার অক্ষ/কেন্দ্রবিন্দু। এই অর্থটি এই আখিরাতের আবাসে যে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত রয়েছে তার দিকে ইশারা করে এবং তার প্রতি নির্দেশ করে। নতুবা, যদি সেখানে স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা না থাকত তাহলে আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব, পূর্ণতা, মহত্ব, সৌন্দর্য ও রহমতের দিকে অভিযোগের আঙুল উচানো হত এবং এগুলোকে ত্র“টিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণতার কলঙ্কে কলঙ্কিত করা হত। অথচ আল্লাহ তা‘আলার এসব অসম্পূর্ণতা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ আখিরাত সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই, কারণ এটি হল আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, পূর্ণতা, মহত্ব, সৌন্দর্য ও রহমতের দাবী।
এমনিভাবে ‘বিসমিল্লাহ’, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’সহ এই তিনটি পবিত্র কালিমা এবং সকল বরকতপূর্ণ কালিমার প্রতিটিই ঈমানের রূকনসমূহের এক একটি বীজ। এগুলির প্রত্যেকটিই ঈমানের রূকনসমূহ ও হাকিকতসমূহের সারসংক্ষেপ।
যেমনভাবে এই তিনটি কালিমা নামাজের বীজ তেমনি এগুলো কুরআনুল কারীমেরও বীজ। কিছু সংখ্যক ঝলঝলায়মান সূরার শুরুতে এগুলোকে প্রত্যক্ষ করা যায়। এগুলো এ সূরাসমূহের শুরুতে চকচকে অলঙ্কারের মত শোভা পাচ্ছে। এগুলো রাসাঈলে নূর-এর বেশ কয়েকটি খন্ডের প্রকৃত ভাণ্ডার ও শক্তিশালী ভিত্তি । এই চিন্তাধারার অনেক কিছুই আমার মনে উদয় হয়েছে যখন আমি নামাজ পরবর্তী তাসবীহসমূহ আবৃত করতাম। এগুলিই হল রাসাঈলে নুরের হাকিকতসমূহের বীজ। আবার এগুলো মুহাম্মদী পথ-পদ্ধতির জপ/অভিমন্ত্রন যা মুহাম্মদী ইবাদতের অংশ হিসেবে অত্যন্ত প্রশস্ত পরিসরে প্রত্যেক নামাজের পর আবৃত করা হয়। এই বিরাট জিকিরের সমাবেশে দশ লক্ষেরও বেশী ঈমানদার প্রত্যেক নামাজের পর তেত্রিশবার ‘সুবহানাল্লাহ’, তেত্রিশবার ‘আলহামদু লিল্লাহ’ ও তেত্রিশবার ‘আল্লাহু আকবার’ একসাথে আবৃত্তি করে। সুতরাং তুমি অবশ্যই জানতে পেরেছ, এই তিনটি বরকতময় কালিমা আবৃত্তি করার যে কি গুরুত্ব রয়েছে, যেগুলো কুরআন, ঈমান ও নামাজের বীজ এবং এগুলোর সাংসংক্ষেপ। এবং আরও জানতে পারবে, এই বিরাট সমাবেশের মধ্যে নামাজের শেষে এই কালিমাসমূহ তেত্রিশবার করে পড়ার কি গুরুত্ব রয়েছে।
এভাবে এই রিসালার মধ্যে প্রথম মাসআলাটি ছিল নামাজের বিষয়ে একটি মূল্যবান আলোচনা। আর এই শেষ রিসালাটিও Ñ আমার ইচ্ছা ব্যতিরেকেই Ñ নামাজের যিকির সংক্রান্ত বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় পরিণত হল। সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য, কারণ তিনি আমাদেরকে তাঁর নেয়ামতের অধিকারী করেছেন ।
‘‘পূত:পবিত্র আপনার স্বত্তা! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আামাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী ও মহাপ্রজ্ঞাবান।’’ (২-সূরা বাক্বারাঃ ৩২)
নবম মাসআলা
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি অসীম করুনাময় ও পরম দয়ালু।
“রাসূল তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে এবং মুমিনরাও। প্রত্যেকেই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে। (তাদের বক্তব্য হচ্ছে) আমরা তাঁর রাসূলদের কারো মধ্যে কোন পার্থক্য করি না” (২- সূরা বাক্বারা ঃ ২৮৫)
যে কারণে এই ব্যাপক অর্থবোধক ও মহান আয়াতটির স্পষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও বর্ণনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তা হল, একটি বিশেষ ও নির্দিষ্ট অবস্থা যা একটি ভীষন ও উত্তেজনাকর প্রশ্ন থেকে এবং একটি মহান ইলাহী নেয়ামত প্রকাশিত হওয়া থেকে উদ্ভূত, যা নিুরূপ ঃ
আমার রূহে এই প্রশ্নটি জেগেছে ঃ যে ব্যক্তি ঈমানী হাকিকতের মাত্র কিছু অংশকে অস্বীকার করে তাকে কেন কাফির বলে গণ্য করা হয় এবং তাকে মুসলিম বলে গণ্য করা হয় না ? যদিও আল্লাহ ও আখিরাতের দিনের প্রতি বিশ্বাসের আলো সূর্যের মত দীপ্তিমান যা সকল অন্ধকারকে বিদূরিত করে?
আবার, যে ব্যক্তি ঈমানের কোন একটি হাকিকত বা রূকন অস্বীকার করে সে কেন মুরতাদ (ধর্মদ্রোহী) হয়ে যায় এবং কুফরীতে পতিত হয়? এবং যে তা স্বীকার করে না সে ইসলামের চৌহদ্দি থেকে বের হয়ে যায়। অথচ উচিত ছিল, সে যদি ঈমানের অন্যান্য রূকনের উপর ঈমান আনে তাহলে তা তাকে এই চূড়ান্ত কুফরী থেকে মুক্ত করবে ?
উত্তর ঃ ঈমান হল একটি হাকিকত যা একতাবদ্ধ ও একীভূত ছয়টি রূকন এর সমন্বয়ে গঠিত যা বিভক্ত করা যায় না। এটি অখন্ড যা বিভাজন করা যায় না এবং যার রূকনসমূহ বিভাজনকে গ্রহণ করে না। কেননা, এই ঈমানী রূকনের প্রতিটি অন্যসব রূকনকে প্রতিষ্ঠিত করে Ñ ফলে প্রতিটি রূকন অন্য রূকনসমূহের প্রতিটির জন্য অকাট্য ও বড় প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। তাই যে ব্যক্তি তাদের সকল যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা ঈমানের সকল রূকনকে নড়বড়ে করতে সক্ষম হয় না, সে তার দু’চোখকে বন্ধ করে রাখা বা অস্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যানের মানসিকতার উপর অটল থাকা ছাড়া প্রকৃতপক্ষে এদের একটি রূকনকেও বা একটি হাকিকতকেও বাতিল প্রমাণ করতে সক্ষম নয়। তখন সে একগুঁয়ে কুফরীতে প্রবেশ করে এবং কালের প্রবাহে তা তাকে চূড়ান্ত কুফরীর দিকে নিয়ে যায়। অতঃপর তার মানবিকতা হারিয়ে যায় এবং সে বস্তুগত ও মানসিক জাহান্নামে প্রবেশ করে।
যেমনভাবে ঈমানের ‘ফলাফল’-এর মাসাঈলে আমরা সংক্ষিপ্তভাবে হাশরের বিষয়ে ঈমানী রূকনসমূহের দলীল-প্রমাণ বর্ণনা করেছি, তেমনিভাবে এখানে আল্লাহ সুব্হানাহু ওয়া তা‘আলার সাহায্যের উপর ভরসা করে আমরা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কয়েকটি ইশারায় বক্ষমান বিষয়টি ছয়টি পয়েন্টে বর্ণনা করব ঃ
প্রথম পয়েন্ট ঃ
নিশ্চয় ‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস’ স্বীয় অকাট্য যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে অন্যান্য সকল ঈমানী রূকনসমূহকে প্রমাণ করার সাথে সাথে ‘আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস’কেও প্রমাণ করে। যেমনটি সপ্তম মাস্আলাতে স্পষ্ট করা হয়েছে।
হ্যাঁ, যে ঐশী সার্বভৌমত্ব, অনন্ত কুদরত, স্থায়ী শক্তি, চিরন্তন স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও চিরস্থায়ী প্রভূত্বের ক্ষমতা এই অসীম জগতকে একটি মাত্র প্রাসাদ বা একটি শহরকে পরিচালনা করার মত পরিচালনা করে ... এবং যা নিপূন শৃঙ্খলা ও ভারসাম্যের মধ্যে এর সকল বিষয়াবলী নিয়ন্ত্রণ করে এবং অসংখ্য হিকমত অনুসারে এর মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করে ... এবং যা অনু-পরমাণু ও তারকারাজিকে পরিচালনা করে এবং মাছি থেকে তারকা পর্যন্ত সবকিছুকে অনুগত সৈনিক ও চৌকষ সেনাবাহিনীর মত সজ্জিত করে এবং যা তাদেরকে সার্বক্ষণিক কর্মতৎপরতায় নিয়োজিত করা ও অনবরত ঘুরাফেরা ও ভ্রমণ করানোর মাধ্যমে কেবল তাঁরই দাসত্বের জন্য বিরাট ও ব্যাপক কুচকাওয়াজের দিকে পরিচালিত করে, এটি টি সম্ভব বা এটি কি যুক্তিসঙ্গত অথবা এই বিষয়ে কি কোন সন্দেহ আছে যে, এই ধরনের চিরস্থায়ী সার্বভৌমত্বের ও এই ধরনের চিরস্থায়ী ক্ষমতার কোন স্থায়ী ক্যাম্পাস, স্থায়ী রাজ্য ও চিরস্থায়ী প্রকাশ থাকবে না ?
আল্লাহ না করুন! কখনো না .. হাজার বার না।
সুতরাং মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহর রবুবিয়াতের সার্বভৌমত্ব ও মহত্ব এবং অধিকাংশ আসমাউল হুসনা Ñ যেমনটি সপ্তম মাসআলাতে বর্ণিত হয়েছে Ñ এবং তাঁর অস্তিত্বের অনিবার্যতার পক্ষের সকল দলীল-প্রমাণ আখিরাতের সাক্ষ্য দেয় এবং আখিরাতের অস্তিত্বকে দাবী করে।
সুতরাং দেখ, এই মহান ঈমানী রূকনের কত শক্তিশালী প্রমাণাদি রয়েছে! তোমরা তা অনুধাবন কর এবং এতে এমনভাবে বিশ্বাস কর যেন তুমি তা দেখছ!
তদুপরি ‘আল্লাহর উপর বিশ্বাস’ যেমনি ‘আখিরাতের উপর বিশ্বাস’ ব্যতিরেকে হওয়া সম্ভব নয় তেমনি ‘আল্লাহর উপর বিশ্বাস’ ‘রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস’ ব্যতিরেকে সম্ভব নয় এবং তা যুক্তিসঙ্গতও নয়, যেমনটি ‘হাশর’ বিষয়ক রিসালার মধ্যে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এটি এজন্য যে, আল্লাহ তা’আলা এই জগতকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রভুত্ব ও ইবাদতের হকদার হওয়ার বিষয়টি একটি বাস্তব কিতাবের আকারে প্রকাশ ঘটানোর জন্য, যার প্রতিটি পাতা একটি কিতাবের অর্থ প্রকাশ করে এবং এর প্রতিটি লাইন একটি পাতার অর্থ প্রকাশ করে.. এবং তিনি এটিকে সৃষ্টি করেছেন একটি বাস্তব কুরআনের আকারে যেখানে প্রতিটি সৃষ্টিগত নিদর্শন এবং প্রতিটি কালিমা বরং এমনকি এর প্রতিটি অক্ষর ও প্রতিটি পয়েন্ট পূত:পবিত্র মুজিজার শামিল। এবং তিনি এটিকে সৃষ্টি করেছেন একটি চমৎকার রাহমানী মসজিদের আকারে যা অসংখ্য খোদাইকরা নকশা ও সাজ-সজ্জা দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত। এর প্রতিটি কোনে রয়েছে একটি প্রজাতি/দল যারা তাদের পরম দয়ালু স্রষ্টার প্রতি কোন এক ধরণের স্বভাবগত ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন রয়েছে।
সূতরাং এটি কি সম্ভব যে, এই সত্যিকারের ইবাদতের হকদার সত্য স্রষ্টা এই মহান কিতাবের অর্থ ও মর্ম শিক্ষাদানের জন্য কিছু সংখ্যক শিক্ষক প্রেরণ করবেন না?.. অথবা এটি কি সম্ভব যে, এই বাস্তব ও চিরন্তন কুআনের আয়াতসমূহ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার জন্য কিছুসংখ্যক মুফাস্সির পাঠাবেন না? .. অথবা এটি কি সম্ভব যে এই বিশাল মসজিদে যারা বিভিন্ন ধরণ ও পদ্ধতিতে ইবাদত-বন্দেগী করছে তাদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য কিছু সংখ্যক ঈমাম নিয়োগ করবেন না?.. অথবা এটি কি সম্ভব যে, এসব শিক্ষক, মুফাস্সির ও ঈমামকে সুলতানী নির্দেশাবলী দ্বারা প্রস্তুত করা হবে না? .. কক্ষনো নয়.. হাজার বার বলছি, কক্ষনো নয়!
তদুপরি এই পরমদয়ালু ও মহাসম্মানিত স্রষ্টা, যিনি এই জগতকে সৃষ্টি করেছেন অনুভূতিশীল সৃষ্টিসমূহের মধ্যে তাঁর সৌন্দর্য, রহমতের প্রকাশ ঘটানোর জন্য এবং তাদের প্রতি তাঁর মমতা, তাদের জন্য তাঁর রবুবিয়াতের পূর্ণতা প্রকাশের জন্য এবং তাদের কর্তৃক তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপনের জন্য। তিনি এই জগতকে সৃষ্টি করেছেন একটি গর্বোন্নত অতিথিশালা, একটি চমৎকার প্রদর্শনী ও একটি মনোরম ও সৃষ্টিশীল ভ্রমন-বিনোদনের স্থান হিসেবে এবং এর মধ্যে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় ও বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু নেয়ামত তৈরী করেছেন এবং সেখানে অসংখ্য বিস্ময়কর ও মনোমুগ্ধকর শিল্পকলার ব্যবস্থা করেছেন..
সূতরাং এটি কি সম্ভব যে, এই পরম দয়ালূ ও মহাসম্মানিত স্রষ্টা এই গর্বোন্নত/মর্যাদাবান অতিথিশালায় তাঁর অনুভূতিশীল সৃষ্টিকুলের সাথে তাঁর রাসুলদের মাধ্যমে কথা বলবেন না.. অথবা এটি কি যুক্তিসঙ্গত যে, এই অফুরন্ত নেয়ামতরাজির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তিনি তাদেরকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিবেন না এবং তাঁর অবারিত রহমত ও স্পষ্ট ভালবাসার প্রতি তাদের দাসত্ব প্রকাশের জন্য তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য শিক্ষা দিবেন না? কক্ষনো না.. হাজার হাজার বার না..
এরপর যেই স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টি ও শিল্পকে ভালবাসেন এবং তাঁর সৃষ্টি ও শিল্পের দিকে অন্যদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আকর্ষন করতে চান, বরং তিনি মুখের মধ্যে হাজারও ধরনের স্বাদের অনুভূতি প্রদানের মাধ্যমে এও চান যে, অন্যরা এদেরকে সাদরে গ্রহণ করুক এবং বড় মনে করুক। এবং এভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতিটি সৃষ্টির মাধ্যমে নিজের পরিচয় পেশ করেন এবং এর দ্বারা এক ধরণের আত্মিক সৌন্দর্য প্রকাশ করেন এবং একে তাঁর সৃষ্টিকুলের ভালবাসার পাত্রে পরিণত করেণ। এবং এভাবে তিনি এই জগতকে তাঁর সৃষ্টিশীলতা, শিল্প ও সৃষ্টিসমূহের দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন। সূতরাং এটি কি যুক্তিসঙ্গত যে, এই সৃষ্টিনৈপূণ্যের অধিকারী মহান স্রষ্টা এমন সম্মাণিত মানুষের সাথে কথা বলবেন না, যারা সকল সৃষ্টির নেতৃত্বের আসনে আসীন... এবং এটিও কি সম্ভব যে, এই সম্মানিতদের থেকে রাসূল হিসেবে কাউকে পাঠাবেন না, ফলে এই চমৎকার সৃষ্টিগুলো সম্মান ও মর্যাদাবিহীন অবস্থায় রয়ে যাবে এবং এসব বিস্ময়কর আসমাউল হুসনার সৌন্দর্য মূল্যায়ন ও শ্রদ্ধাবোধ ব্যতীত থাকবে এবং তাঁর পরিচয় ও প্রশংসাজ্ঞাপন বিনিময় ব্যতীত থেকে যাবে?! কক্ষনো না, হাজার বার না!
তদুপরি যেই সর্বজ্ঞানী বক্তা যথাসময়ে সকল জীবের প্রকৃতিগত প্রয়োজন পূরণ করা এবং অবস্থার ভাষায় তাঁর দিকে উত্থাপিত তাদের কাকুতি-মিনতি ও আকাক্সক্ষা পূরনে এগিয়ে আসার মাধ্যমে তাদের আহবানে সাড়া দেন, এবং তাদের জন্য স্পষ্টভাবে তৎক্ষণাত অনিঃশেষ অনুগ্রহের ও তাদের উপর সীমাহীন নেয়ামতের বিষয়ে কথা বলেন, যা তাঁর ইচ্ছা, এখতিয়ার ও উদ্দেশ্য প্রকাশ করে । সূতরাং এটি কি সম্ভব এবং এটি কি যুক্তিসঙ্গত যে, এই সর্বজ্ঞানী বক্তা ক্ষুদ্রতম জীবন্ত সৃষ্টির সাথে তৎক্ষণাত কথা বলেন, তার অসুস্থতায় দ্রুত এগিয়ে আসেন এবং তাঁর অনুগ্রহ দ্বারা তাকে সাহায্য করেন এবং তার অভাব-অভিযোগ পূরণ করেন, অথচ তিনি মানুষের আধ্যত্মিক নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন না, যে (মানুষ) পৃথিবীর সকল সৃষ্টির নেতা, যে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি এবং যে সৃষ্টিকুলের বাছাইকৃত ফল... অথবা এটি কি যুক্তিসঙ্গত যে, তাদের সাথে তিনি কথা-বার্তা বলবেন না যেভাবে তিনি সকল জীবের সাথে তৎক্ষণাত কথা বলেন...? অথবা এটি কি সম্ভব যে, তিনি তাদের মাধ্যমে তাঁর আদেশ-নিষেধ, তাঁর পবিত্র বানী ও কিতাবসমূহ প্রেরণ করবেন না? কক্ষনো না, হাজার বার না!
এভাবে ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান’ অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে তাঁর পবিত্র কিতাবসমূহের উপর ঈমান ও তাঁর সম্মানিত রাসূলদের (আ.) উপর ঈমানকে প্রমাণ করে।
তদুপরি যে মহান ব্যক্তি কুরআনের হাকিকত দ্বারা এই জগতকে প্রতিধ্বনিময় ও সুরময় করেছে, এই বিস্ময়কর স্রষ্টাকে পূর্ণভাবে চিনেছে ও অন্যদের নিকট তাঁকে পরিচয় করে দিয়েছে, তাঁকে ভাল বেসেছ ও অন্যদের নিকট তাঁকে প্রিয় করে তুলেছে এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে ও অন্যদেরকে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পথ দেখিয়ে দিয়েছে; বরং এই পৃথিবীকে বার বার ‘সুবহানাল্লাহ’ ও ‘আলহামদু লিল্লাহ’ আবৃত্তি করিয়েছে, যা সুউচ্চ আকাশমণ্ডলী থেকেও শ্রবন করা সম্ভব... এবং যে ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার প্রভাবশালী প্রভূত্বের বিপরীতে ব্যপক ও সার্বিক দাসত্বের নজীর স্থাপন করেছে এবং এক হাজার তিনশত বছর ধরে সংখ্যার দিক থেকে এক পঞ্চমাংশ মানবতাকে এবং প্রকারগত/বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে অর্ধেক মানবতাকে নেতৃত্ব দিয়েছে, যে নেতৃত্ব পৃথিবীর জলভাগ ও স্থলভাগ উভয়কে নাড়া দিয়েছে এবং এ দু’টিকে আবেগ ও উত্তেজনায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছে.. এবং যে ব্যক্তি ইলাহী উদ্দেশ্যাবলীর বিপরীতে মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং তাঁর মর্যাদা ও অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে জগতের কানে কানে ও সকল যুগের নিকট কুরআনুল কারীমের মাধ্যমে চিৎকার করে ঘোষণা করেছে, গুরুত্বপূর্ণ পাঠ পেশ করেছে ও সনির্বন্ধ আহবান জানিয়েছে.. তিনি হলেন বিশ্বস্ত, সত্যবাদী মুহাম্মাদ (সা.) যিনি হাজারও মু’জিজা দ্বারা সত্য বলে প্রমাণিত।
সূতরাং এটি কি সম্ভব যে, এই বাছাইকৃত ও পছন্দনীয় প্রিয় বান্দাটি এই ‘সত্য মা’বুদ’-এর সবচেয়ে সম্মানিত রাসূল হবে না?... এবং এটিও কি সম্ভব যে, সে তাঁর মহান নবী হবে না? না, কক্ষনো না, হাজার বার না!
সূতরাং ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ্ নেই’’ এই কালিমার হাকিকত ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল’’ এই কালিমার হাকিকতকে প্রমাণ করে।
তদুপরি এটি কি সম্ভব যে, যে স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকুলকে শত শত ও হাজার হাজার ভাষায় ও প্রকাশভঙ্গীতে নিজেদের মধ্যে কথা-বার্তা আদান-প্রদান করার শক্তি দিয়েছেন এবং যিনি সকলের কথা-বার্তা শ্রবন করেন ও জানেন, তিনি নিজে কথা বলেন না? ... কক্ষনো না, কক্ষনো না! এরপর এটি কি যুক্তিসঙ্গত যে, তিনি কুরআনে কারীমের মত মহান কিতাবের দ্বারা তাঁর ইলাহী উদ্দেশ্যাবলীকে শিক্ষাদান করবেন না, যা এমন তিনটি প্রশ্নের জবাব দান করে যার সামনে বিবেক-বুদ্ধি হয়রান হয়ে যায়ঃ ‘‘এই সৃষ্টিকুল কোথা থেকে আসে?’’, ‘‘তাদের শেষ পরিণতি কোন দিকে?’’ এবং ‘‘কেন তারা দলে দলে একের পর এক আসে, খানিকের জন্য থমকে দাঁড়ায়, অতঃপর মৃত্যুমুখে পতিত হয়?’’... কক্ষনো না।
আর যে কুরআনে কারীম তেরটি শতাব্দীকে উজ্জ্বল ও আলোকিত করেছে.. যাকে একশ মিলিয়ন জবান পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদার সাথে প্রতি মূহুর্তে উচ্চারণ করছে.. যাকে মিলিয়ন মিলিয়ন হাফেজের বক্ষে পূর্ণ সম্মান ও পবিত্রতার সাথে খোদাই করা হয়েছে.. এবং যা তার আইনের দ্বারা মানবতার বিশাল একটি অংশকে পরিচালনা করেছে, তাদের নফসসমূহকে প্রশিক্ষন দিয়েছে, তাদের রূহসমূহকে পরিশুদ্ধ করেছে এবং তাদের অন্তরসমূহকে পরিচ্ছন্ন করেছে ও তাদের বিবেক-বুদ্ধিকে সঠিকপথ দেখিয়েছে.. এবং যেটি একটি স্থায়ী মু’জিজা, যেমনভাবে আমরা রাসাঈলে নূরের মধ্যে কুরআনে কারীমের বিস্ময়কর হওয়ার বিষয়টি চল্লিশটি দৃষ্টিকোন থেকে প্রমাণ করেছি এবং স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এর মধ্যে মানুষের চল্লিশটি শ্রেণীর প্রতিটি শ্রেণীর জন্য অলৌকিকত্ব রয়েছে (যেমনটি বিস্ময়কর কারামতপূর্ণ ১৯তম মাকতুবে বর্ণনা করা হয়েছে).. এই মহান কুরআনকে প্রকৃত অর্থেই ‘‘আল্লাহর কালাম’’ নামে অভিহিত করা যথাযথ। এভাবে তা মুহাম্মাদ সা. এর হাজারও মু’জিজার মধ্যে একটি উজ্জ্বল মু’জিজায় পরিণত হল।
সূতরাং এটি কি সম্ভব যে, এই কুরআনে কারীম এই চিরন্তন বক্তা সুব্হানাহু ওয়া তা’আলার বাণী হবে না? এবং এটিও কি সম্ভব যে, তা এই মহিমান্বিত চিরস্থায়ী স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ হবে না? আল্লাহ মাফ করুন! কক্ষনো না, হাজার হাজার বার না!
সূতরাং ‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস’ সকল দলীল-প্রমাণ দ্বারা এটি প্রমাণ করে যে, কুরআনে কারীম মহা সম্মানিত আল্লাহ তা’আলার বাণী।
আবার, যে মহিমান্বিত সুলতান তাঁর পরিচয় প্রকাশ করার জন্য, তাঁর ইবাদতের জন্য এবং তাঁর তাস্বীহ পাঠের জন্য এই পৃথিবী-পৃষ্ঠকে অনবরত জীবনধারণকারীদেরকে দিয়ে পূরণ করছেন আবার একে খালি করছেন এবং আমাদের দুনিয়াকে অনুভূতিসম্পন্নদেরকে দিয়ে আবাদ করছেন, তাঁর পক্ষে কি এটি সম্ভব যে, তিনি আকাশমণ্ডলী ও তারকারাজিকে খালি ও ফাঁকা অবস্থায় রেখে দিবেন এবং এই আসমানী অট্টালিকাসমূহকে এদের সাথে মানানসই বসবাসকারী দ্বারা আবাদ করা হবে না?...
এবং এটিও কি সম্ভব যে, এই মহান সুলতান তাঁর প্রশস্ততম রাজ্যসমূহে তাঁর রবুবিয়াতের সালতানাতকে মর্যাদা ও মহত্ব ব্যতিরেকে ছেড়ে দিবেন, যেখানে থাকবে না কোন নির্দেশপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কোন প্রেরিত দূত, কোন তত্বাবধানকারী দায়িত্বশীল, কোন আগ্রহী দর্শক, কোন সম্মানিত বান্দা ও কোন আনুগত্যকারী প্রজা সাধারণ? কক্ষনো না... ফেরেশতাদের সংখ্যা পরিমাণ কক্ষনো না..
এরপর, যে মহা প্রজ্ঞাবান বিচারক ও পরম দয়ালু সর্বজ্ঞানী এই জগতকে একটি কিতাবের আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন, এমনকি প্রতিটি বীজের মধ্যে প্রতিটি গাছের জীবনের তারিখ লিপিবদ্ধ করেছেন এবং সকল বীজের মধ্যে প্রতিটি ঘাস ও লতার জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য ও প্রতিটি ফুলের দায়িত্ব-কর্তব্যকে লিপিবদ্ধ করেছেন। এবং প্রত্যেক অনুভুতিসম্পন্নের জীবনের সকল ঘটনাপ্রবাহকে তার সরিষার দানার মত ক্ষুদ্র মুখস্থশক্তির মধ্যে লিখিয়েছেন এবং তাঁর পুরো রাজত্বের প্রতিটি কাজকে ও তাঁর সালতানাতের আওতার মধ্যে সংঘটিত সকল ঘটনাকে এগুলোর বিভিন্ন ছবি-প্রতিচ্ছবি কুড়ানোর মাধ্যমে সংরক্ষন করেছেন এবং যিনি জান্নাত, জাহান্নাম, সিরাত ও মিযান সৃষ্টি করেছেন ন্যায়বিচার, হিকমত ও রহমতের প্রকাশ ঘটানোর জন্য, যা রবুবিয়াতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি...
সূতরাং এই মহাপ্রজ্ঞাবান বিচারক ও এই পরম দয়ালূ সর্বজ্ঞানীর পক্ষে এটি কি সম্ভব যে, তিনি সৃষ্টিকুলের সাথে সম্পর্কিত মানুষের কর্মকাণ্ডকে রেকর্ডভূক্ত করবেন না?..
এবং এটি কি সম্ভব যে, মানুষের কর্মসমূহ পুরস্কার প্রদানের জন্য বা শাস্তিদানের জন্য লিপিবদ্ধ করা হবে না এবং তার মন্দকর্মসমূহ ও ভালকাজসমূহ ‘ভাগ্য ফলকে’ লিপিবদ্ধ করা হবে না?! কক্ষনো না .. লৌহে মাহফুজে ভাগ্যলিপির জন্য যা লিখা হয়েছে তার অসংখ্য অক্ষরের সংখ্যা পরিমাণ না!
অর্থাৎ ‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস’ স্বীয় দলীল-প্রমাণ দ্বারা ‘ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস’-এর হাকিকতকে প্রমাণ করে, তেমনিভাবে তা ‘ক্বাদর’-এর প্রতি বিশ্বাসের হাকিকতকেও দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে, এটি যেন সূর্যের মত যা দিনকে প্রকাশিত করে এবং দিনের মত যা সূর্যকে দেখিয়ে দেয়।
এভাবে ঈমানের রূকনসমূহ একটি অন্যটিকে প্রমাণ করে।
দ্বিতীয় পয়েন্টঃ
আসমানী কিতাব ও সহীফাসমূহ যেসব বিষয়ের দিকে আহ্বান করেছে, বিশেষ করে কুরআনে কারীম, এবং আম্বিয়া (আ.) যেসব দাওয়াত নিয়ে এসেছেন, বিশেষ করে মুহাম্মদ (সা.), তা সবই দৃঢ় ভিত্তি ও সুনির্দিষ্ট রূকনসমূহকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে।
তাদের সবাই এই ভিত্তিসমূহকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং এগুলো অন্যদেরকে শিখিয়ে দেয়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তাই যেসব যুক্তি ও দলীল-প্রমাণ তাদের নবুয়্যত ও তাদের সত্যতার বিষয়ে স্বাক্ষ্য দেয় সেগুলো একসাথে ঐসব ভিত্তি ও রূকসসূহের দিকে অভিমূখী হয় এবং এগুলোর দৃঢ়তা ও সত্যতাকে প্রমাণ করে। এই ভিত্তিসমূহ হল, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের দিনের প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস ও ‘কাদর’ এর প্রতি বিশ্বাস- যে, এর ভাল ও মন্দ উভয়টিই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে।
সূতরাং ঈমানের ছয়টি রূকনের মধ্যে পার্থক্য করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ, প্রতিটি রূকনই সাধারণভাবে সকল রূকনকে প্রমাণ করে; বরং এদেরকে প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য মনে করে। এ কারণে এই ছয়টি রূকন কোনভাবেই বিভাজনকে গ্রহণ করে না এবং এদেরকে কখনো বিভাজিত করা সম্ভব নয়। যেমনভাবে রবকতময় বৃক্ষের (তুবা বৃক্ষের) প্রতিটি ডাল Ñ যার শিকড় আকাশ পর্যন্ত বি¯তৃত Ñ এবং এর প্রতিটি ফল ও প্রতিটি পাতা এই বৃক্ষের স্থায়ী জীবনের উপর নির্ভর করে। সূতরাং কারো পক্ষে এই বৃক্ষের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি পাতার জীবনকে অস্বীকার করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না তার পক্ষে এই সূর্যের ন্যয় দীপ্তমান প্রকাশ্য বৃক্ষের জীবনকে অস্বীকার করা সম্ভব হয়। আর যদি সে তা অস্বীকার করে তবে এই বৃক্ষটি তাকে এর ডাল, ফল ও পাতার সমান সংখ্যক বার মিথ্যাবাদী বলবে এবং চুপ করিয়ে দিবে, তেমনই ছয়টি রূকন সমেত ঈমানও একই ধরণের।
এই আলোচনার প্রথমে আমি ঈমানের ছয়টি রূকন ছয়টি পয়েন্টে ব্যখ্যা করতে চেয়েছিলাম যেখানে প্রতিটি পয়েন্টে পাঁচটি করে উপ-পয়েন্ট থাকবে। শুরুতে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর আমি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে সবিস্তারে বর্ণনা করতে আগ্রহী ছিলাম, তবে কিছু প্রতিবন্ধকতা ও পরিস্থিতি এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। তবে আমি মনে করি প্রথম পয়েন্টটি জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারীদের জন্য আরও বেশী ব্যখ্যার পথ রাখেনি, কারণ এটিই বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ।
এভাবে পুরোপুরি স্পষ্ট হল যে, যখনই কোন মুসলিম কোন একটি ঈমানী হাকিকত অস্বীকার করে তখনই সে চুড়ান্ত কুফরীতে পতিত হয়। কারণ, ঈমানী রূকনসমূহ একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এবং ইসলাম অন্যান্য ধর্মসমূহে যা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ছিল তা স্পষ্টভাবে ব্যখ্যা করেছে। সূতরাং যে মুসলিম মুহাম্মদ (সা.) কে চিনে না, তাঁকে সত্য বলে স্বীকার করে না, সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকেও (তাঁর গুণাবলী সহকারে) চিনে না এবং আখিরাতকেও চিনে না.. সূতরাং মুসলিমের ঈমান এমনই শক্তিশালী ও সুদৃঢ় যে তা কখনো প্রকম্পিত হবে না এবং অনেক বেশী দলীল-প্রমাণের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে তা অস্বীকারের কোন অবকাশ রাখে না; এমনকি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এই ঈমানকে গ্রহণ করার জন্য আত্মসমর্পন করে।
তৃতীয় পয়েন্টঃ
একদা আমি ‘‘আলহামদু লিল্লাহ’’ বলেছিলাম। এরপর এমন একটি মহান নেয়ামত খোঁজ করেছি যা এর অতি ব্যপকার্থের সমান বলে গণ্য হতে পারে। অতঃপর আমার মনে নিুোক্ত বাক্যটি আসল ঃ
الحمد لله على الإيمان بالله، وعلى وحدانيته، ,وعلى وجوب وجوده وعلى صفاته، وأسمائه، حمدا بعدد تجليات أسمائه من الأزل إلى الأبد.
অর্থঃ সকল প্রশংসা আল্লাহর প্রতি, আল্লাহর উপর ঈমানের কারণে, তাঁর একত্বের কারণে, তাঁর অস্তিত্বের অনিবার্যতার কারণে এবং তাঁর গুণাবলী ও নামসমূহের কারণে; অনাদি থেকে অনন্ত পর্যন্ত তাঁর নামসমূহ প্রতীয়মান হওয়ার (সধহরভবংঃধঃরড়হং) সংখ্যা পরিমাণ (প্রশংসা)।
অতঃপর এটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলাম এবং এটিকে (ঐ কালিমাটির) অর্থের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ পেলাম.. যা নিুরূপ:
অনুবাদঃ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:৫৪