১।
বাইরে তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস! এটাকেই শৈত্যপ্রবাহ বলে নাকি! তাপমাত্রা মাইনাসের ঘরে এখন। কাচের জানালার বাইরে থোকা থোকা বরফ জমে দেয়ালের শুভ্রতাকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের এমাথা ওমাথা হাঁটতে হাঁটতে শফিকের ভেতরে এসব দৃশ্যের সৌন্দর্য অবশ্য বাড়তি কোনো জায়গা করতে পারে না। বরং তীব্র রাগের একটা ঝলক ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘোরাফেরা করছে। উড স্ট্রীটের লেনে ঢুকতে না ঢুকতে বিষ্ণুদা গাড়িটা থামিয়ে বললো - কি ভাই দাওয়াত পানি দিবেন না ? শুনলাম আপনার এক্স ওয়াইফ বিয়া করতাছে ? রাইতে আপনার বাসায় আসতাছি, কথা আছে - বলেই চোখ টিপে।
হারামির বাচ্চাটা দেখা হলেই শফিকের পুরনো ক্ষতে খোঁচাখুঁচি করে। বাংলাদেশ ছেড়ে নিউইয়র্কে এসেও শফিক তার অতীতকে পিছু ছাড়াতে পারেনি। এখানে এসে ঝাঁকে ঝাঁকে বাঙালি দেখলে মনে হয় শালারা এক একটা শকুনের দল, যেখানেই যায় সেখানেই মনে হয় হাগে। নিউইয়র্কে আসার পরপর এই বিষ্ণুদাই শফিক কে তার বাসায় থাকতে দিয়েছিলো, একটা কাজও জুটিয়ে দিয়েছিলো। তাই মুখের উপর তাকে কিছু বলতেও পারে না। একটু আগেই বিষ্ণুদা শফিকের রুম থেকে বের হয়েছে। জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও শফিক জানতে চেয়েছে -
আপনে কই থিক্যা জানলেন বুবুনের মায় বিয়া করতাছে?
আরে মিয়া আমার ছোট শালী তো পান্না ভাবীর এলাকাতেই থাকে। অইখান থেইকাই শুনছে মনে হয়।
হারামজাদী মাগীর সাহস কত্তো বিয়া করতাছে!
হ, আর কতো দিন, এমন জুয়ান বয়সে কি একলা থাকন যায়! তাও তো আপনেগো ডিভোর্সের ছয় বছর পর হেয় বিয়া করতাছে আর আপনে মিয়া পাঁচ দিনের মাথায় বিয়া কইরা ফালাইলেন! বলে বিষ্ণুদা হাসতে থাকেন।
ঐ মাগীর তেজ বেশি। সততা, মূল্যবোধ বালছাল লইয়া বেশি হিসাব করে। ক্যান রে ভাই একলগে থাকতে গেলে জামাই বৌয়ের কি ঝগড়াঝাঁটি ভুল বুঝাবুঝি হয় না? এক্কেবারে মুখ দিয়া যেইডা বাইর করবো হেইডাই ওর করন লাগবো। ভালো হইছে ওরে ডিভোর্স দিয়া। বলতে বলতে শফিক মাথার পেছনে দুই হাত দিয়ে হেলান দিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে।
মিয়া বেশি প্যাকপ্যাক কইরেন না। আপনেগো তো আর ঝগড়াঝাঁটির কারণে ছাড়াছাড়ি হয় নাই। আপনের মিয়া খাউজ বেশি। ঘরে এমন টসটসা বৌ থুইয়া আপনে রাস্তাঘাটের মাইয়াগো যাইয়া পোন্দাইবেন আর আপনেরে পান্না ভাবী কি সেলাম করবোনি ? আর ডিভোর্স তো হেয় আপনেরে দিছে। হালা আপনে বেডা জাতির কলংক। বেডি হইয়া হেয় আপনেরে গোয়া মাইরা গেলো গা।
বিষ্ণুদা ভুল কিছু বলেনি কিন্তু এই সত্যগুলো শফিকের গায়ে কম জ্বালাও ধরাচ্ছে না। পান্না আবার বিয়ে করবে শোনার পর থেকে অসহ্য এক বুনো রাগে হাসফাঁস লাগছে শফিকের ভেতরটায়। তাই বিষ্ণুদাকে বলে ওঠে –
ধুর মিয়া আজাইরা কথা না কইয়া কামের কথা কন। বিয়াতে ক্যামনে প্যাঁচ লাগানি যায়। বিয়াডা বন্ধ করা দরকার।
এহ আপনে যহন বিয়া করছেন হেইডায় সমস্যা হয় নাই, এহন ভাবী বিয়া করলে আপনের এতো জ্বলে ক্যান। নাকি ভাবীরে এহনও নিজের বৌ ভাবতে ভালো লাগে? গা জ্বালানো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বিষ্ণু তাকিয়ে থাকে শফিকের দিকে। আপনে সত্যিই বুদ্ধি চান ?
আপনের লগে মিয়া মশকরা করি নি ?
মিয়া আপনে আবার আমার বুদ্ধির লইগা বইয়া থাকোনের মানুষ ! আমারেও কইলেন আর আমিও বিশ্বাস করলাম? আপনের প্রাক্তন শাশুড়ির লগে কাইন্দা কাইট্যা মিডা সুরে কথা কন দেখবেন পান্না ভাবীর বিয়া বন্ধ। এর আগেও তো যা যা চিপা দেওনের আপনের শাশুড়িরে ফুসলাইয়া ফুসলাইয়া করাইছেন। শাশুড়িরে কয়ডা টেকা পয়সা পাডান দেখবেন সব সমস্যার সমাধান।
বিষ্ণুদার প্রস্তাবটা মন্দ লাগে না শফিকের। শফিকের প্রতি তার প্রাক্তন শাশুড়ির দুর্বলতাকে প্রতি মুহূর্তেই শফিক জিইয়ে রেখেছে এই বলে - " আমার মা বেঁচে নেই। আপনাকেই মা বলে জানি"। এই লাইগ্যাই তো কই ওইদিন আমার শাশুড়ি কেন বুবুনরে আমেরিকায় আমার কাছে পাডাইতে চায়!
আপনে কি কইলেন?
কি আবার কমু ! কইছি বুবুনরে আমার কাছে আনলে ওরে দেখাশুনা করনের লাইগা তো তাইলে আমার তানিয়ারের আনন লাগবো। এহন বুঝলাম বুবুনরে ক্যান আমার কাছে পাডাইতে চায়। মাগী আরেকটা হাঙ্গা করবো!
তানিয়া জানি কে ? আপনের নতুন বৌ নাকি? যাই হোক ভাই এইবার উডি। নাইলে আপনের শায়লা ম্যাডাম রাগ করবো।
শায়লা আর তুহিন ভাইয়ের ফ্ল্যাটে শফিক একটা রুম নিয়ে সাবলেটে থাকে এখানে। বাসায় গেস্ট আসা আবার পছন্দ না শায়লা ভাবীর। শায়লা ভাবীর নাম শুনেই তার স্লিম ফিগার আর শাইনি রিবন্ডিং চুলের ছবিটা শফিকের মনে ভেসে ওঠে চকিতে।
২।
শাহানাজ বেগমের ক'দিন ধরেই মনমেজাজ ভালো যাচ্ছে না। ছোট থাকতে সন্তানেরা তাকে তেমন কষ্টই দেয়নি। কি সুন্দর হেসেখেলে ওদের বড় করেছেন কিন্তু একেক জনের বয়স বাড়ার সাথে সাথে মনে হয় পিঠে চারটা করে পাখা গজিয়েছে। না তার বড় ছেলে তার কথা শোনে না তার ছোট মেয়ে তার কথা মানে। সেদিনও তাদের কাজের মহিলা হনুফা বলছিলো -
খালাম্মা, বুবুনের বাপের মনে অয় পান্না আফার লাইগা এহনও ভিত্রে ভিত্রে টান আছে। দেখলেন না ফোন কইরা ক্যামনে কানলো আর কইলো আম্মা, পান্না কি আর বিয়া শাদী করবো না, কয়দিন আর পাগলামি করবো! দুলাভাই যে ক্যান খারাপ খারাপ কাজ করলো আফার মতো বৌ থাকতে কে জানে। শয়তানে ধরছিলো নি? ডাই করে রাখা ময়লা থালাবাসন পরিষ্কার করতে করতে হনুফা গজগজ করে কথা বলতে থাকে।
হ, তোর মতো মূর্খ বেডি এইডা বুঝলেও তোর পান্না আফাই বুঝব না। বেশি শিক্ষিত বানাইয়া বিপদে পড়ছি। মাইয়া মানুষ হইয়া জন্মাইসস, কই নত হইয়া চলবি, জিদ মাডি কইরালাবি তা না বেশি তেজ দেহায়। বেডা মাইনসে দুই চারটা বিয়া করলে যেমন দোষের কিছু নাই, লগে তিন চাইরটা মাগী লইয়া শুইয়া থাকলেও দোষের কিছু নাই। অমন একটু আধটু হইতেই পারে। এমন ভালো পোলা দেইখা বিয়া দিছিলাম কে কইব পান্নারে এমন আকামডা করতে। আমাগো বংশে পান্নাই প্রথম জামাইরে ডিভোর্স দিলো। অর কপালে বহুত দুঃখ আছে আমি কইয়া রাখলাম, তুই দেহিস হনুফা
যা অওনের অইছে। আফায় যে হের কোন বন্ধুরে বলে বিয়া করতে শেষতক রাজী অইছে একদিন দিয়া ভালাই। মাইয়া মাইনসের জামাই ছাড়া থাকন ঠিক না। চাইরপাশে বহুত খাচ্চর বেডারা ঘুরঘুর করে একলা থাকলে।
হ তোর আফায় চাইলো আর অরে আমি হাঙ্গা করনের পারমিশন দিলাম। তুই ভাবলি ক্যামনে? দরকার পড়লে অরে আমি শফিকের লগে আবার বিয়া দিমু। আর মাইয়া মাইনসের জীবনে বিয়া কয়ডা অয় রে?
আফার বয়স তো বেশি না। সংসারে জামাই বৌয়ের মইদ্যে সুখ না থাকলে ঘর করন অনেক জ্বালা গো খালাম্মা। আমি এক জানোয়ারের লগে থাইক্যা বুঝতাছি। কপাল ভালা বিদেশে যে দেওরডা থাকে,হেয় টেকা পয়সা দিয়া মাঝে মাঝে সাহায্য করে দেইখা মাইয়া গুলিরে লইয়া আর বাসাবাড়ির কাম কইরা থাকতে পারতাছি। মাঝে মাঝে মন চায় লাত্থি মাইরা এই সংসার থুইয়া যাই গা।
এতো দেওর দেওর করিস না। সংসার থুইয়া যাইবি গা, তোর জামাইর লগে সম্পর্ক না থাকলে তোর দেওর তরে খাওন পিন্দন দিবো না হেয় তোরে বিয়া করবো? এতো চইদ্দ হাঙ্গা বইলে আর বেহেশতে যাওন লাগতো না।
শাহানাজ বেগমের মুখ ঝামটা খেয়ে হনুফার বলতে ইচ্ছা করে তার দেওর তাকে বলেছে প্রয়োজনে দেশে এসে তাকে বিয়েও করবে কিন্তু শর্ত একটাই সেই বিয়ের খবর গোপন রাখতে হবে এবং তার প্রথম বৌ যাতে জানতে না পারে। কিন্তু বিয়ে করে তখন দেওরকে ভাগাভাগি করার যন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে দেওরের সাথে রঙ্গ তামাশা করে যদি সংসার খরচটা চলে যায় তাহলে বিয়ে করার ঝামেলায় কে যেতে চায়। গতবার এতো এতো চকলেট, শ্যাম্পু, সাবান দিতে এসে রাতের বেলায় তো থেকেই গেলো হনুফার ঘরে। তার মাতাল স্বামীর তো সে খবরও ছিলো না। কিন্তু শাহানাজ বেগমকে সে কথা জানাবার জো নেই বরং দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাড়িপাতিল ঘসতে ঘসতে বলে - হ আমাগো গরীবের সুখ আর দুখ! আমাগো ভাতকাপড়ডাই আসল হেইডা যেমনেই আহুক। ভাব,বালোবাসা তো আপনেগোর লাইগা।
এতো প্যাঁচাল পারিস না মাতারি। কোন আক্কেলে তুই আবার পান্নার বিয়া লইয়া বয়সের কতা কস। তোর খালু যহন মরলো আমার বয়স কতো আছিলো? পাঁচচল্লিশ ছেচল্লিশ এমুন। আমি কি তহন বেশি বুড়ি হইয়া গেছিলাম নি? আমরা শইল্যে কি জ্বালা আছিলো না? তাই বইল্যা কি আমি আবার হাঙ্গা করছি?
আপনের আর পান্না আফার বিষয়ডা এক না খালাম্মা। হনুফা আরো কিছু কথা বলার জন্য মুখ খুলতে উদ্যত হলেও শাহানাজ বেগমের ঝাড়ি খেয়ে কাজে হাত লাগায়।
শাহানাজ বেগমের ভেতরটা অক্ষম এক ক্রোধে ফুঁসতে থাকে। অতীতের কোনো ধূসর স্মৃতি যেন পেখম মেলতে থাকে তার ভেতর। পান্নার বাবা মারা যাবার কয়েকবছর পর যখন সেই সাদাকালো অতীত রঙের ছোঁয়া নিয়ে সামনে দাঁড়ালো তখনো চাইলে শাহানাজ বেগম পারতো দেলোয়ার সাহেবকে নিয়ে ভাবতে। ততদিনে দেলোয়ার সাহেবও তার স্ত্রীকে হারিয়ে একাকীত্বের যন্ত্রণায় কাতর। উফফ্ কাদের জন্য নিজের জীবনের সুখ আনন্দ মাটি দিয়েছেন ভাবতেই শাহানাজ বেগমের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যেতে চায়। পান্নার কতো বড় সাহস সে আবার বিয়ে করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়। যেভাবেই হোক এ বিয়ে বন্ধ করতে হবে। পান্নার কাছে নিজের নারীত্ব, নিজের পরাজয় আজকে তার কাছে বেশ বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। শাহানাজ বেগমের চোখের ধিকিধিকি জ্বলে ওঠা দেখলে মনে হয় পান্না যেন তারই আরেক প্রতিপক্ষ!
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪০