আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী কারণে আমাকে হাসপাতাল যেতে হয়েছিলো কিন্তু আমাকে হাসপাতাল যেতে হয়েছিলো শুধু এটুকু বুঝতে পেরেই আমার ভেতরটা বরফ শীতল হয়ে গিয়েছিলো। কী রকম ধরণের ভয় এটা আমার পক্ষে লিখে বোঝানো সম্ভব না, দুই একটা উদাহরণ দেই। আমি একমাত্র আমার বাবাকে ছাড়া আর কোনো মৃত মানুষ ছুঁয়ে দেখিনি। বাবাকে শেষবারের মতো যখন কাফনে মুড়িয়ে খাটিয়ায় শোয়ানো হয়েছিলো, দেখেছিলাম তার শরীরে কর্পূর ছড়িয়ে আছে। কৃষ্ণ বর্ণের মানুষটার চেহারা সাদা সাদা হয়ে ছিল জায়গায় জায়গায় কর্পূর ছিটিয়ে থাকার কারণে। আমি ঘোলা চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, মাথার দিকে কাফনের মোড়ানো মুখটা খুলে বাবার গালে আমার দু'হাত ছুঁইয়ে রেখেছিলাম আর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। শরীরটা তখন ঠাণ্ডার জমানো একটা ভাব নিয়ে শীতল নিথর হয়ে পড়েছিলো! আমি আজ হাসপাতালে গিয়ে প্রথমে ঐ ধরণের একটা কাঁপুনি অনুভব করি। শীতল, নিথর ধরণের অনুভবের কাঁপুনি।
এরপর আমার চোখে ভেসে ওঠে পত্রিকায় দেখা এক মৃত নারীর অল্প হা করা মুখের ছবি। হাঁটু মুড়ে মেয়েটাকে শুয়ে রাখা হয়েছিলো কিন্তু ঘাড়টা কাত করে ঘোরানো থাকায় হঠাৎ দেখলে মনে হবে কেউ বুঝি ফট্ শব্দ করে ঘাড় মটকে দিয়ে গেছে। মেয়েটার ঠোঁটের কোণ বেয়ে রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা শুকিয়ে চিবুকের কাছটায় এসে কালচে হয়ে গেছে। মৃত্যুর দুইদিন পর উদ্ধার হওয়া লাশটির এমন একটা ছবিই পত্রিকায় দেখেছিলাম। হাসপাতালে গিয়ে এরপরে নীল বা কালচে হয়ে যাওয়া মৃতদেহের ঐ মেয়েটির মুখ মনে পড়াতে আমার মাঝে ভয়ের চোরা একটা আতংক কাজ করছিলো।
একটা পর্যায়ে মনে হলো এটা কি আদৌ হাসপাতাল? একতলা বিল্ডিং এর পুরোটা ফ্লোর ঘুরে ঘুরে দেখে আমার মনে হলো এটা কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টার যেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় রোগীদের। একটা ঘরের সামনে গিয়ে কীসের এক আতংক যেন আমার পা জোড়াকে প্রাণপণে থামাতে চাইছিল জানি না! হঠাৎ ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে একটা লোহার গেট খুলে একটা বিবর্ণ দেখতে অসুস্থ একজন অল্পবয়সী নারী তার পেট ধরে বের হয়ে আসতে আসতে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। বললো -
" ঐ রুমে ঢুকতে হলে ইউরিন ক্লিয়ার করে ঢুকতে হবে। অনেক কষ্ট..." আঙুল তুলে নারীটা আমাকে দেখালো। সে এতোটাই অসুস্থ তার যে নিঃশ্বাস নিতে, একেকটা শব্দ উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছিলো আমি বুঝতে পারছিলাম। নারীটা যখন আঙুল তুলে একটা দরজার দিকে আমাকে ইঙ্গিত দিচ্ছিলো দেখলাম তার হাতটা কেমন ক্ষতবিক্ষত আর একটা ক্যানোলা লাগানো। সে চলে যেতে যেতে দেয়াল ধরে কিছুক্ষণ হাঁপায়, বলে -
" তুমিও আসছো ?" বলে হাসির ভঙ্গী করে। দেখে আমার মাঝে কেমন একটা অশরীরী অনুভবের ঢেউ খেলা করে।
এরপর কী করে যে আমি সেই নারীটার দেখানো ঐ রুমটায় চলে আসলাম জানি না। হাল্কা আকাশি নীল এপ্রোন পরা অল্পবয়সী নার্স আমাকে বললো -
" তোমার এই টেস্ট করা জরুরী। ইউরিন ক্লিয়ার করে আসছ? টেস্ট করতে গেলে ইউরিন দিয়ে কাপড় নষ্ট করবে না তো ? "
বলে সেই নার্সটি একটি ইনজেকশন হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কোমরের কোথায় যেন পুশ করে দেয়। আমার মাঝে গভীর একটা দুঃখ এসে ভর করে। নার্সটিকে আমার একমাত্র পরমজন বলে মনে হয়। ওকে জড়িয়ে ধরে আমি কাঁদতে থাকি। কেমন যেন একবার মনে হয় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি আবার মাঝ সমুদ্র থেকে মাথা ভাসিয়ে বেঁচে থাকতে চাইছি, ফুসফুস ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাচ্ছি। আমি কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো গলায় ওকে বলি -
কেন আমাকে এভাবে ইনজেকশন দিয়ে আমার সবুজ চারাটি নষ্ট করে দিচ্ছো। আমাকে যেতে দাও। আমি আমার স্বামীকে একটা ফোন করবো। আমার ব্যাগটা এনে দাও, মোবাইলটা ওখানে রাখা। নার্সটি খুব আদুরে গলায় আমাকে বলতে থাকে -
"এই টেস্ট না করালে তোমার শরীরের অসুখ শেষ হবে না, হরমোনের ব্যালেন্স আসবে না। তোমার সুন্দর বাবুটার মুখ দেখবে না। ইনজেকশন দিয়েছি যাতে ব্যথা না পাও, মেয়ে ঘুমিয়ে পড় তুমি! "
আমার খুব আতংকিত লাগতে থাকে। অচেতন হতে হতে আমি জেগে উঠি আবার তীব্র ব্যথায়। আমাদের তো সন্তান আছে। তবে কেন নার্সটি বাচ্চার কথা বলছে! কোন বাচ্চার কথা বলছে! আমার ভেতর কি আরো কেউ ঘুমিয়ে আছে! আমি কিছুই ভাবতে পারছি না, সব বিচ্ছিন্ন লাগতে থাকে। মনে হচ্ছে ধারালো চাকু দিয়ে আমাকে চিরে ফেলা হচ্ছে। চাকুর ফলা আমার মাংসের ভাঁজে ভাঁজে গেঁথে যেতে থাকে। আমি নার্সটিকে জড়ানো গলায় বলি -
অনেক ব্যথা... আমাকে ব্যথা দিও না। আমি ওকে একটা ফোন করবো। ও আমাদের বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনতে গেছে... আমার গলা শুকিয়ে আসে এটুকু কথা বলতে গিয়েই। আমার মোবাইলটা এনে দাও। নার্সটি আমার হাতে মোবাইল দিয়ে বলে -
নাও ফোন করো কিন্তু এখন সব শেষ! লাভ নেই আর।
নার্সটির প্রেতের মতো হিহিহি হাসির আওয়াজ ছাপিয়ে শুনতে পাই ওদিকে ফোনের অপরপ্রান্তে ফাইয়াজ আকুল হয়ে বলছে -
আমি আসছি...ভয় পেও না । তুমি জ্ঞান হারিও না। আর একটু সময়ের জন্য জেগে থাকো। আরিয়ান,রাবি আর রাইয়ানকে স্কুল থেকে নিচ্ছি। আর একটু সময় জেগে থাকো অর্পা!
আমি যে রুমটায় আছি বুঝতে পারি না সেখানে সময়টা দিন না রাত। আমার কাছে থমকে থাকা মুহূর্ত যা অন্তহীনভাবে একই রকম আছে, থেকে থেকেই মনে হচ্ছে রাতের লুকোচুরির মাঝে অপারেশন থিয়েটার টেবিলের আলো যা ঘোলাটে হলুদের মতো দেখাচ্ছে আরেকবার মনে হতে থাকে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের আলোর মতো। কান্নার জলে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখে দেখি নার্স মেয়েটির শরীর শিশিরবিন্দুর মতোই অদৃশ্য হয়ে কোথাও যেন মিশে গেলো দরজার ওপাশে। চোখের উপর অপারেশন থিয়েটারের আলোকে এবার মনে হয় পূর্ণ চাঁদের মতো। আমার সাথে সাথে চাঁদও যেন কাঁদছে অসময়ের সঙ্গী হয়ে। নিরাকার, শব্দহীন কান্নার মতো কিছু একটা নিজের ভেতরে আটকে আমি জেগে থাকার চেষ্টায় রত থাকি। যতক্ষণ জ্ঞান থাকে আমাকে জেগে থাকতে হবে...
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:১১