somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের জল-ময়ূরেরা

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।

বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সুলেমানের বুকটা কেঁপে ওঠে। কেমন নিষ্প্রাণ লাগছে বাড়িটা। অন্যদিন বাড়ির মানুষজনের সোরগোলের আওয়াজ রহমান চাচার বাড়ির সামনে থেকেই কানে আসে। শুধু যে সুলেমানের কানেই আসে তা নয়, সুলেমানদের বাড়ির ঝগড়া-ঝাঁটি ওদের মুসাপুর গ্রামের সবার কাছেই পরিচিত একটা দৃশ্য, চেনা আওয়াজে বেসুরো কলহ। ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের আলোতে বাড়ির বাইরের নারকেল গাছটা ফিন ফিন করে একটা শব্দ তুলে যাচ্ছে বলে রাতের নিস্তব্ধতাকে যেন বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। গা ছমেছমে নীরবতা কী একেই বলে না এটা সুলেমানের বেশি দুশ্চিন্তার ফল বুঝতে পারছে না। ওর খুশী হবারই কথা ছিলো আজ বাড়িতে ঝগড়া-ঝাঁটির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে না বলে কিন্তু পরিচিত দৃশ্যের অনুপস্থিতিই ওর বুকের কাঁপন বাড়িয়ে দিচ্ছে কোনো নতুন, আরো বাজে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে এই ভেবে। কাজ শেষে মালিকের গ্যারাজে অটোরিকশা জমা দেবার সময় বকুলতলা ঘুরে আসতে গিয়ে ওর বৌ চম্পার জন্য চুলের ব্যান্ড কিনে এনেছিলো। অনেকদিন ধরে চম্পা ওকে ছোট কাপড়ের কথা বলে ঘ্যানঘ্যান করলেও টাকা বাঁচাতে গিয়ে কিনি কিনি করেও কিনতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। কথা দিয়েছে আরেকটু টাকা জমাতে পারলেই সুরভী হলে সিনেমা দেখে ছোট, বড় সব কাপড়ই বৌ-কে কিনে দিবে। কিন্তু বাড়ির এমন থমথমে ভাব দেখে চম্পার জন্য কিনে আনা চুলের ব্যান্ডটা লুঙ্গির খুঁটে ভরে শার্ট দিয়ে লুঙ্গির উপরটা ঢেকে রাখে। পরিস্থিতি ভালো হলে না হয় তখন বৌ-কে উপহার দিয়ে খুশী করা যাবে ভাবে ও। সাথে সাথে তলপেটে প্রাকৃতিক কাজের চাপ অনুভব করে প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই।

টিউবওয়েলে চেপে চেপে পানি উঠিয়ে শব্দ করেই ও গড়গড়া করে, হাত মুখ ধোয়। ভাবে ওর বাড়ি ফেরার শব্দে চম্পা কিংবা ওর ছোট ভাই জাহাঙ্গীর নিদেনপক্ষে পারুলও দরজা খুলে দেখবে বাড়িতে কে ঢুকল। কিন্তু কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই অথচ যার যার ঘরে বাতি জ্বলছে ঠিকই। উপরওয়ালাই জানে আজকে কার কপালে শনির দশা আছে ভাবতে ভাবতে সুলেমান হাত মুখ ধোয়া শেষ করে। আজকে ওর মা সালেহা বেগমও কী ঘুমিয়ে গেলো? আর সবাই ঘুমিয়ে গেলেও ওর মা তো জেগে থাকে। রাতও বেশি হয়নি পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে একফাঁকে দেখে নেয় ও। মাত্র রাত সাড়ে দশটার মতো বাজে। অবশ্য ওর মায়ের কাছে রাত সাড়ে দশটা বা নিশুতি রাতের তেমন একটা পার্থক্য নেই। যেইই বাড়িতে ঢুকুক বা বের হোক কিংবা একটু শব্দ হলেই টনটনে আওয়াজে চেঁচাতে থাকবে --

কেডা যাইতাছে ? ঐ কেডা যায় !

মায়ের কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না তার ঘরের মানুষজন কিংবা কেউই এবং মাঝেমাঝে সুলেমানও। বুড়া মাইনসের সব কথার উত্তর দেওনের দরকারডা কি ? হ্যাঁয় হারাদিনই চিল্লায়, বয়স হইছে গলার জোরডা এহনো আল্লাহ্‌য় নেয় নাই-- ওর বৌ চম্পা ও ঘরে ফিরলেই এসব নিয়ে গজগজ করে। ইদানীং মায়ের নামে বিচার নালিশটা বেশিই শুনতে হচ্ছে। সারাদিন কাজ কর্ম শেষে ঘরে ফিরে কারই ভালো লাগে এইসব শুনতে! ঘরে ফেরার পর শরীরটা আরাম চায় আর এটা কর্মজীবি মানুষ মাত্রই বোঝে। সুলেমানের গুছিয়ে এ কথাটা বলার ক্ষমতা থাকলে হয়তো চম্পাকে এটাই বলতো। প্যাসেঞ্জার নিয়ে ট্রিপ মারুক আর না মারুক মাঝে মাঝে কাজ না করে বসে থাকলেও শরীরে ক্লান্তি আসে। ঘরে ফিরে বৌয়ের আদর সোহাগ পেলে ক্লান্তিটা কেটে যায় কিন্তু ঘরে ফিরে বৌয়ের মান ভাঙাতে ভাঙাতে যদি চোখে ঘুম নেমে আসে তখন আর ধৈর্য থাকে না হাসি মুখে চম্পার সাথে ওর কথা বলতে।

সবসময় যে চম্পাই ওর মা সালেহা বেগমের নামে নালিশ করে তাও নয়। ওদের ঘরের পাশেই যে বারান্দাটা, সেখানেই বেড়ার চট দিয়ে জায়গাটা ঘের দিয়ে ওর মায়ের থাকার জায়গা করে দেয়া হয়েছে। এই তো কয়েকদিন আগে যেদিন চম্পার মনটা একটু ফুরফুরে দেখে সুলেমানের মনও উতলা হয়েছিলো সেদিন ওরা অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আগেই ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছিলো। তখনই ওর মায়ের চিৎকার শুরু হলো --

ঐ সুলেমান, বাত্তিডা আঙ্গাস না ক্যারে! ঐ সুলেমান! আন্ধারে আমার ডর করে। সুলেমান...সুলেমান... বলে নড়বড়ে জানালাটায় ধাক্কাতে থাকে, সুলেমান বলে ডাকতে ডাকতে ওর মা ক্লান্ত না হলেও চম্পার ধৈর্যের বাঁধ আর থাকে না। ধাক্কা মেরে সুলেমানকে সরিয়ে দেয় একপাশে । ওরও মায়ের উপর খুব রাগ হয়ে যায়। চম্পাকে কিছু বলতে না পেরে নিযেই মাকেই গলা উঁচিয়ে বলে --

হারাদিন পর কাম সাইরা আইয়া তোমাগো চিল্লানির জ্বালায় কি ঘুমাইতেও পারুম না ?

এরপর সালেহা বেগম কিছুক্ষণের জন্য চুপ করলেও পিনপিনে সুরে কাঁদেন। আমার আন্ধারে ডর করে। বাইরে কেমুন কব্বরের লাহান আন্ধার। আমারে তোগো ঘরে হুইতে দে। সুলেমান...

চাপা গলায় চম্পা বলতে থাকে, তোমার মার কি একটাই পোলা? জাহাঙ্গীর আর ওর বৌ-রে চোহে দেখে না? পাশ ফিরে শুতে শুতে সুলেমান ভাবে, ভাগ্যিস ওরা বাড়িতে নেই। থাকলে আজ খবর ছিলো।

কিন্তু আজ হলো টা কী! টিউবওয়েল চাপার শব্দ পেয়েও ওর মা এমন চুপচাপ যে! তার শরীর ভালো আছে তো! যাই মায়রে দেইখ্যা আসি এমন ভাবনাটা মনে এলেও নিজেকে সংযত করে। ভাবে মায়ের কাছে গিয়ে বসলেই বলবে -
পোলাও খাইয়াম। দৈ, মিষ্টি খাইয়াম।

মায়ের যে কী হইছে কে জানে। খালি খাই খাই করে। এদিকে ভাতের পয়সা জুটাইতে শইল্যের রক্ত পানি অইয়া যায় আর আরেকজন আইছে পোলাও, দৈ খাইবো। মুন্সী বাড়ির মেজবানিতে গিয়ে সেই কবে পোলাও, মাংস খেয়ে এসেছিলো এখনো সেটা মনে করেই বসে আছেন সালেহা বেগম আর ঘুরে ফিরে সুলেমানকে দেখলেই খাওয়ার বায়না ধরেন। নিষেধ করার পরেও গুটিগুটি পায়ে হেঁটে মুন্সী বাড়িতে ওর মা গিয়েছিলো। থালা চেটে পুটে খেয়ে মুন্সী চাচার বৌয়ের কাছ থেকে চেয়ে একটা বাটিতে করে একটু খাবারও এনেছিলো। খাওন নিবেন কি দিয়া চাচী এটা জিজ্ঞেস করতেই ওর মা আঁচলের তলা থেকে টিনের ছোট বাটিটা বের করে দিয়েছিলো হাসি হাসি মুখে। ওর মায়ের শরীরে হাঁটাচলার জোরটা আগের মতো থাকলে ঠিকই এর ওর বাড়ি খুঁজে খাবার দাবার চেয়ে খেতো ভাবে সুলেমান। ভালো হইছে এহন হাঁটতে গেলে দম ফুরাইয়া যায় বুড়ির। মাইনসের কাছে আর ছোড তো অইতে অয় না!

ছোট ছোট শব্দে সতর্কাতার সাথে সুলেমান দরজায় আঙুলের টোকা দেয়। চম্পা দুয়ারডা খোলো। চম্পা দরজা খোলে ঠিকই কিন্তু পায়ে ধুপধাপ আওয়াজ তুলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘরের বাতিটা জ্বালালে না জানি আবার কোন মুখ ঝামটা শুনতে হয়। এদিকে খিদেয় পেটে গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। সুলেমান ভেবে পায় না কী করবে! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যখন ভাবে একরাত না খেয়ে শুয়ে পড়লে খুব একটা সমস্যা হবে না, বিছানার দিকে হাতড়ে হাতড়ে যখন আসবে ভাবে তখনই চম্পা জোরালো গলায় বলে ওঠে -

প্যাঁচার লাহান আন্ধারেও দেখতারো নি? বাত্তিডা আঙ্গাইয়া ভাত গিল্যা লও

২।

অনেকক্ষণ ধরেই পারুল চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। চুল আঁচড়াতে এতো সময় লাগছে কেন জাহাঙ্গীর ভেবে পায় না। পারুলের সময় নিয়ে চুল আঁচড়াবার দুটো কারণ থাকে বরাবর দেখে এসেছে, যখন ওর কোনো আবদার থাকে তখন চুল আঁচড়ানোটা হয় একটা বাহানা আর দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে জাহাঙ্গীরের মা'কে নিয়ে কোনো অভিযোগ বা ঝগড়ার আভাস দিতে পারুল চিরুনি নিয়ে বসে। আজকে কোনটা হয়েছে কে জানে। ওদের আড়াই বছর বয়সী ছেলেটা বিছানার মাঝামাঝি শুয়ে ঘুমিয়ে আছে হাত পা ছড়িয়ে। জাহাঙ্গীরেরও কেমন ঘুম পাচ্ছে। এর মাঝে কয়েকবার হাই তুলে পারুলকে বুঝিয়েছেও। কিন্তু পারুল নির্বিকার। এরকম অবস্থায় পারুলের সাথে ওর কথা বলতেও ভয় লাগে। শ্বশুর বাড়ি একটা অবস্থাসম্পন্ন হলে যা হয় আর কি। বিয়ের সময় বেশ ভালোই টাকা দিয়েছিলো পারুলের বাবার বাড়ি থেকে। সে টাকায় ঘরের ভিটেও পাকা করেছে, টুকটাক শৌখিন জিনিস ছাড়াও মুদি দোকান দেয়ার টাকাও টেনেটুনে হয়ে গেছে। আল্লাহর রহমতে দোকান থেকে ভালোই আয় হয় আর সে সবই যে পারুলের বাবা-ভাইয়ের অবদান সময়ে সময়ে পারুল সেটা মনে করিয়ে দিতে ভোলে না। তাই সে বৌ-কে যে ভয় না করে, সমীহ না করে উপায় নেই জাহাঙ্গীর সেটা ভালোই বোঝে।

রাইত হইছে, ঘুমাইবা না ? জাহাঙ্গীর বিছানায় পা মেলে শোবার ভঙ্গী করে শরীরের আড়মোড়া ভাঙার চেষ্টা করলেও ওর মনের আড়ষ্ঠ ভাবটা রয়েই যায়।

যাগো যাগো ঘুমান দরকার হেরা ঘুমাইলেই চলবো। নিজের বাইত্যে থাইক্যাই যুদি হুনন লাগে বাড়ির থন বিদায় অইয়া যাইতে হইব গা, তাইলে ঘুমাইয়া কাম কি! পারুল জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। অন্য সময় হলে জাহাঙ্গীর পারুলকে টেনে এনে কাছে বসাতো। আজকে ওর সাহস হয় না। পারুলের মতো মুখরা নারী এমন অভিমানের সুরে কথা বলছে ব্যাপারটা ঠিক হজম হয় না ওর। তার উপর পারুলকে কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার হুমকি দিয়েছে এটা বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার নয়। কৌতূহল বা দুশ্চিন্তা যাই হোক না কেন জাহাঙ্গীর শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে।

কি হইছে না কইলে বুঝুম কেমনে? জ্যোতিষী হইলে না হয় কথা আছিলো। জাহাঙ্গীর পরিস্থিতিকে একটু হালকা করার চেষ্টা করলেও আজকে পারুল কেমন যেন নির্বিকার হয়ে রয়।
তোমার মায়রে জিগাও গা। পারুলের হাতে পানির গ্লাসটা ধরাই থাকে, পানি ওকে মুখে নিতে দেখা যায় না। যা করণের আজকাই আমারে জানাইবা নাইলে কাইল থিকা আমারে আর আমার পোলারে কাউরেই ঘুম ভাঙনের পর দেখবা না। যেহান থিকা আইছিলাম অইহানেই যামু গা। আজকা তোমার পোলায় ঘরের পিঁড়ায় বইয়া মুড়ি আর কলা খাইতাছিল, তোমার মায় আইয়া ইমনের হাতে কামুড় মাইরা কলা লইয়া গেছে। এটুকু বলে পারুল তার স্বরূপে ফিরে আসতে থাকে। ওর ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলার ধরণ দেখেই বোঝে জাহাঙ্গীর।

হের পর?

হের পর আবার কী, ইমনে মাডির চাক্কা লইয়া তোমার মার শইল্যে মারছে। তোমার মায় কি কম নি, হাপুর পাইরা আইয়া আইয়া ইমনরে ধাক্কা দিয়া হালায় দিছে। আমিও কি ছাইড়া দিমুনি তোমার মায়রে?

তুমি কিয়ার ছো ?

আমিও তোমার মায়রে ধাক্কা দিছি।

জাহাঙ্গীর পরের কথা গুলো শোনার অপেক্ষায় থাকে কিন্তু পারুল আর বলে না তার জা চম্পা আর সে মিলে তার শাশুড়িকে টেনে হিঁচড়ে উঠোনের একেবারে বাইরে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসে বস্তায় ভরে , বাইরের বাঁশের চাটাইয়ের দরজাটা নড়বড়ে হলেও সেখানে তারা দরজাটা বাঁশের খুঁটির সাথে গুনা আটকে রাখতে ভোলে না। বুড়ির গায়ে মাংস না থাকলে কী হবে, গায়ে জোর কম না। বস্তায় ঢোকাতে কম কষ্ট হয়েছে ওদের! বস্তার মুখটা শক্ত করে বাঁধলেও বস্তায় একটা ছোট ফুটো করে দিয়েছিলো। সবচেয়ে ভালো হতো বুড়ির বস্তায় কতগুলো ইট ভরে নদীতে ডুবিয়ে দিলে। জায়ের বুদ্ধিতে তার মুখে কাপড় গুঁজে দিলেও সময়মত ইট খুঁজে পায়নি। এশার আযানের পর পর পথঘাট নীরব হলে নদীর সামনের জংলা ঘেঁষে তারা তড়িঘড়ি করে বস্তায় শাশুড়িকে ফেলে চলে এসেছিলো।

জাহাঙ্গীরের বুকটা কেঁপে উঠলেও পারুলকে জিজ্ঞেস করার সাহস পায় না তার মা ব্যথা পেয়েছিলো কিনা। বরং একটা দীর্ঘশ্বাস প্রলম্বিত হতে হতে সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় মিশিয়ে যায়। ব্যথা পাইলে পাউক গা, এই কথা জিগাইয়া আবার বৌয়ের ঝাড়ি খামুনি এতো রাইতে? পারুলের মেজাজ তো ভালোই থাহে না। এহন ওর লগে লগে কথা কইলে দেহা যাইবো দুই মাসেও ওর লগে ভাব ভালোবাসা করন যাইবো না। এমুন আগুন লইয়া দিনের পর পর এক বিছনায় থাইক্যা রাইত পার করা অনেক কষ্টের। সকালে উঠলে শইল্যে জায়গায় জায়গায় ব্যথায় টনটনাইয়া উডে।

অহন কও তোমার মায়রে এই বাইত্যে রাখবা না অন্য কোনো হানে দিয়া আইবা? হারাডা দিন ইমন্যাইর খাওনের দিহে নজর দেয়। এই লাইগ্যাই পোলাডার কয়দিন পরপর পেটে বেদনা অয়। দিন ভইরা খালি খাই খাই করবো আর হাগবো মুতবো! গন্ধে বাইত্যে টিহন যায় না।

মা'কে নিয়ে যে কি করবে জাহাঙ্গীর ভেবে পায় না। বড় ভাইজানের সাথেও দুই একবার কথা বলার চেষ্টা করেছিলো সে। কিন্তু বসে বসে দুই ভাই কূল কিনারা না পেয়ে কোনো সমাধানেও পৌঁছাতে পারেনি। তাদের দুজনেরই মনে মনে কাজ করে মা তো কদিন পর মরেই যাবে কিন্তু নিজ নিজ বৌয়ের সাথে অশান্তি করে সারাজীবন কাটানো টা বোকামি ছাড়া কিছুই না। মাঝে মাঝে তাদের এটাও মনে হয়েছে চিকিৎসার নাম করে শহরের কোনো সরকারী হাসপাতালে কিংবা দূরগামী কোনো ট্রেনে মা’কে উঠিয়ে দিয়ে তারা লুকিয়ে চলে আসবে কিংবা অচেনা কোনো হাটে গিয়ে তারা সটকে পড়বে কিন্তু কেউই কারো কাছে মনের কথা বলে উঠতে পারেনি। রোজ রাতে বাড়ি ফিরে শাশুড়ি বৌয়ের এসব ঝগড়া, নালিশ শুনতে কারই বা ভালো লাগে। তাই জাহাঙ্গীরও এ ঘটনার পরবর্তী অধ্যায় শুনতে আর আগ্রহ দেখায় না। আইচ্ছা দেহি কি করন যায় বলে জাহাঙ্গীর পাশ কাটাতে চাইলে পারুল ঝনঝন করে বেজে ওঠে।
তোমার আর কিছু করন লাগতো না। কাইলই আমি যামু গা আমার পোলা লইয়া। তুমি তোমার মায়রে লইয়া থাহো।
এ কথা শুনে জাহাঙ্গীর কি আর বিছানায় বসে থাকতে পারে! বৌয়ের কাছে গিয়ে মান ভাঙিয়ে, প্রতিজ্ঞা করে তবেই রাত্রির মধুময় সমাপ্তির দিকে এগোয়।

৩।

সালেহা বেগমের ভেতরটা বড্ড হাঁসফাঁস লাগে। নিঃশ্বাস কেমন আটকে আটকে আসতে চাইছে। আল্লাহর এতো বড় দুনিয়াতে সালেহা বেগমের মতো ছোটখাট মানুষের জন্য আলো-হাওয়ার কি এতোই অভাব পড়ে গেলো - এটা ভেবে তার একটা অভিযোগ ভেতরে ভেতরে ঘনীভূত হয়ে উঠতে চায়। হঠাৎ করে কী যেন একটা ওলটপালট হয়ে গেলো তার জীবনে আর সেটা বুঝে ওঠার আগেই কেমন এক আলোবাতাসহীন বস্তায় নিজেকে বন্দী অবস্থায় আবিষ্কার করে সে। কিছু সময়ের জন্য মনে হয় সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলো। নিজের বোধ ফিরে এলে অন্ধকারের পাশাপাশি হাত-পা বাঁধা অবস্থার কারণে গায়ে কেমন কুটকুট করে চুলকোনিও টের পেতে থাকে। অন্ধকারকে সালেহা বেগমের এমনিতেও ভীষণ ভয়। সে কিছুক্ষণ পরিস্থিতির সাথে ধাতস্থ হবার চেষ্টা করে নিজেকে শান্ত করতে চায়। কিন্তু ডুকরে ডুকরে তার ভেতরটা মনে হয় কেঁদে উঠছে, শরীরের কাঁপুনির সাথে সাথে শীতল এক অনুভূতিও কাজ করতে থাকে তার কুঁচকে যাওয়া চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে। চোখ খোলার পর নিজেকে ধাতস্থ করতে করতে একটানা কেমন কল্‌কল্‌ একটা শব্দ কানের কাছে বেজেই যাচ্ছিলো টের পেয়েছিলো। থেমে থেমে শব্দটা হচ্ছে। বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো , ঢেউয়ের মাটিতে বাড়ি খেয়ে খেয়ে ফেরার শব্দের মতো অনেকটা!

এরপর বিষণ্ণ এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে কিছু সময়ের জন্য। সে কান পেতে থাকে মাঠ ভেঙে, জমির আল ভেঙে কেউ এই নিস্তব্ধতাকে উড়িয়ে দিতে কেউ আসে কিনা। নাহ্‌ কেউ আসে না। সালেহা বেগম ভাঙা ভাঙা গলায় কেঁদে ওঠে - 'আমার ডর করে...এএএএ...' তার গলার আওয়াজ তার কানেই কেমন গমগমে লাগে। শব্দহীন সময়ের কাছে হাঁটু গেড়ে সে প্রার্থনা করে। তার প্রার্থনার উষ্ণতায় রাতের গভীরতা বাড়তে বাড়তে পৃথিবীতে নেমে আসে। বস্তাটাকে এক সময় তার বন্ধ ঘরের মতো মনে হয়। ঘরের কোথাও যদি একটুও ফাঁকফোকর থাকতো, নিশ্চিত সালেহা বেগম সে ফাঁক গলে বের হয়ে যেতো। সে তার হাত পা নাড়তে চেষ্টা করে। চেষ্টা করতেই থাকে। এ যেন এক অনন্তহীন চেষ্টা করে যাওয়া, রাত ভোর হবার অপেক্ষা। একটা সময় সে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করে ঘরের দুয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে খুব ক্ষীণভাবে একটা জলজ বাতাস যেন বয়ে যাচ্ছে। বাতাসের আর্দ্রতায় শক্ত হয়ে হাতে-পায়ে চেপে থাকা রশির বাঁধনগুলো নরম হয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়। তার মনে হতে থাকে আরেকটু চেষ্টা করলেই আটকে থাকা ঘরের দেয়াল ফুঁড়ে সে বেরও হতে পারবে। সাঁতার কাটার মতো করে সে তার শরীরটা নাড়াতে চেষ্টা করলেই দেখে ধীরে ধীরে সে তাও পারছে। আহ্‌ এ যেন মুক্তির দ্বারগোঁড়ায় চলে আসা। নাক মুখ দিয়ে অবিরত জলের ধারা ঢুকলেও তার শ্বাস নিতে একদমই কষ্ট হচ্ছে না। নিজেকে জলে বাস করা অন্য অধিবাসীদের মতই লাগতে থাকে তার। যে শরীরটা কিছুক্ষণ আগেও প্রকাণ্ড ভারবাহী কিছু মনে হচ্ছিলো ঠিকমতো নিঃশ্বাস না নিতে পারার কারণে, সে শরীরটাই এখন কেমন তুলোর মতো হালকা লাগতে থাকে। নিজেকে চঞ্চল প্রজাপতি মনে হয় প্রতি মুহূর্তে আবার কখনোবা পাখির মতো। হঠাৎ করেই একটা নতুন পৃথিবী তার সামনে ঝলমল করে ওঠে আতরের সুঘ্রাণে। ধীরে ধীরে সামনে জমে থাকা জঞ্জাল দু'হাতে সরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে সুমধুর কোনো শব্দে একটু থমকে দাঁড়ায়। মনে হয় পৃথিবী থেকে ভেসে আসা ভোরের কোনো প্রার্থনাসঙ্গীত! মাথাটা একটু উঁচিয়ে ধরতেই দেখে দীর্ঘ সময় ধরে চরাচরে জমে থাকা অন্ধকার যেন ফিকে হতে শুরু করবে এখনই।
তার ভেতরের সত্তাটির নতুন রূপান্তর যখন সে টের পায়, দেখে এক জল-ময়ূর ভেজা মাটির গা মাড়িয়ে দিগন্তে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৩০
৩৪টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×