জীবন সম্পর্কে আমার স্বচ্ছ ধারনা ছিল বলেই আশেপাশের সবার কাছ থেকে জেনে এসেছি , এ ধারনা কত অস্বচ্ছ ছিল তা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি নতুন শহরে এসে । সময়ের পরিক্রমায় এ শহরের অলিতে –গলিতে পরিভ্রমনে জেনেছি নিজের ক্ষুদ্রতার কথা , নিজের মেধার তুচ্ছতার কথা ।
ভাবলেই হাসি পায় একসময় নিজেকে রং-তুলির ঈশ্বর মনে করতাম , ছোট্ট শহরের গন্ডিতে
আমার প্রশংসা সাইক্লোনের ঘূর্ণি ছুটাতো , স্বপ্ন দেখতান পিকাসো , গিয়েত্তো , ভিঞ্চি , এঞ্জেলোর মাস্টার পিসের সাথে স্থান করে নিচ্ছে আমার কাজ । আলোর যুগের বাসিন্দা হয়ে দাম্ভিকতার দর্প চূর্ণ হবার নিমিত্তেই যেন আমার এখানে আসা । Académie des Beaux-Arts ঐতিহাসিক এক নাম যার যাত্রা শুরু হয়েছিল Cardinal Mazarin হাত ধরে, ফ্রান্সের সবচেয়ে ভালো-আকিয়েরা এখানের ডিপার্টমেন্টগুলোর শোভা বর্ধন করে । আবেদন করে কখনি ভাবিনি আমার স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে , আমাদের ডাকবক্সের এরিয়েন
যখন আমন্ত্রনপত্র হাতে দিয়েছিল , আবেগে জড়ীয়ে ধরে কেদে ফেলেছিলাম , বুড়ো এরিয়েন মনে হয়েছিল পৃথিবির সবচেয়ে আপন , বিকেলের মাঝে আমাদের
ছোট্ট গ্রামে চাউর হয়ে গেল বীওন বড় শিল্পী হতে যাচ্ছে , ন্যাড়া পাহাড়ের পাদদেশের গম্ভিরমুখো মিসেস গিভসন বিরক্তিকর বলিরেখা নিয়ে হাজির হয়েছ , সাথে ছিল তার বাগানের সেরা এক ঝুড়ি আপেল আর
এক বয়াম স্ট্রবেরির জেলি , অবাক হয়েছিল এই দুর্মুখ আমায় পছন্দ করে তা কখনি মনে হয় নি , এসেছিল পাশের বাড়ির যুবতী স্ত্রী রায়ান , অপূর্ব সৌন্দর্যের সাথে এনেছিলেন হাতে তৈরি রুটি , বর্ণে-গন্ধে
অতুলনীয় রায়ানের মতই অপূর্ব।
প্যারিসের মাটিতে নেমে মুগ্ধতা কাটতেই লেগে গেল তিন মাস , ততদিনে সকল দর্শনীয় স্থান আর ক্যাফেগুলতে ঢু মারা হয়ে গেছে । এক বিকেলের স্নিগ্ধতাকে বন্দি করতে ক্যানভাস আর ব্রাস নিয়ে হাজির
আইফেল টাওয়ারের তলায় । ধাতব কাঠামোর অবর্ণনীয় যান্ত্রিক দৈত্য সুলভ মুগ্ধতা , আমার ক্ষুদ্র ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলাই ছিল আকাঙ্খা । আপনার আকাঙ্ক্ষা সর্বদা বাস্তবে রুপ নেবে তা কিন্তু নয় বরঞ্চ শিল্পির খেয়ালিপনায় অধিকাংশ সময় চিন্তার বৃত্তে বন্দি থাকে । আমি একাগ্রতা নিয়ে এক কোনে বসে গেলাম আমাকে আঁকতেই হবে , কভু অদৃষ্টের লেখন সম্পর্কে আমার ন্যুনতম ধারনা
থাকলেও আমি প্যারিসের আশেপাশে আমার অবস্থান অনিশ্চিত করার সুনিশ্চিত প্রয়াস চালাতাম ।
কেবল পেন্সিলের স্ক্যাচে ধাতব কাঠামোর মুগ্ধতা নিয়ে দুটো আচড় দিয়েছি , আমার কর্ণ-কুহরে কোকিলের কন্ঠের শ্রুতিমধুরতা নিয়ে আঘাত করল বেহালার ঝঙ্কার , আমি বাধ্য হলাম শব্দের উৎসের খোজে তাকাতে , একটু সামনেই দেখতে পেলাম গ্রিক মিথের সুন্দরি শ্রেষ্ঠা আফ্রোদিতিকে , সুরের ঝঙ্কারের সাথে সাথে রুপের আগুনেও মজে গেলাম , ধাতব সৌন্দর্যের বদৌলে স্বর্গের কমনীয়তা ফুটে
উঠল আমার ক্যানভাসে ,লীটো আমার লীটো। কখন বেহালার সুর থেমে নিস্তব্দতার সৃষ্টি করেছে আমি টের পাই নি , যতক্ষন না স্বর্গের দেবি আমার কানের কাছে এস বলল আপনি তো অসাধারণ আকেন ।
কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে যখন আমার আফ্রোদিতিকে খুজতে যাব ,আবিষ্কার করলাম আমার পাশে , সেই অপরিচিত কণ্ঠস্বরের মালিক । লজ্জাবনত মুখে তার দিকে তাকাতেই অদ্ভুত সারল্যমাখা হাসি উপচে পড়ল তার চখে-মুখে , স্বর্গীয় সুধার নিরাবরণ বহিপ্রকাশ ।
ক্যানভাসটি মুড়িয়ে তার হাতে দিতেই , এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে উঠল । আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে গেল ক্যাফে ডি ভেলে তে , তার স্পর্শে আন্দোলিত হল আমার সমগ্র দেহ , প্রচন্ড ভাল-লাগার আবেশে নির্বাক হয়ে তার যাত্রার সঙ্গী হলাম । কফির সাথে আলোচনার ঝড় উঠল।
Conservatoire national supérieur de musique et de danse de Paris (CNSMDP) শিক্ষনবিশ ভবিষ্যৎ মোজার্ট ।
মোজার্টের সিম্পফনি , ভলতেয়ারের দর্শন , কিংবা এঞ্জেলোর স্কাল্পচার সবকিছুতেই দুজনের সমান আগ্রহ বিদ্যমান , সপ্তাহান্ত গুল কেটে যাচ্ছিল বসন্তের সবুজের ন্যায়। দুমাসেই বুঝে গিয়েছিলাম আমার জীবনে লীটোর অবস্থান দেবী সম , অদ্ভুত অস্থিরতায় একগুচ্ছ ক্রিসামথিমাম
নিয়ে হাজির হলাম লীটোর ডারমাটরিতে , হৃদয়ের সব ব্যাথা উজার করে দিয়ে জানিয়ে দিলাম
তার অবস্থান ।
আমি তীব্র প্রতীক্ষার অপেক্ষায় চোখ বন্ধ করে ছিলাম , হঠাত করে কারো নিশ্বাস আমায় স্পর্শ করল , সাটিনের ছোয়া পেলাম রুক্ষ গালে , চোখ খুলতেই মৃদু ভৎসনা “এত দেরি হল” । চিতার ক্ষিপ্রতায় কাছে টেনে নিলাম , কোবরার হিংস্রতায় তার শিল্পিত ঠোটে ছোবল বসালাম। অনাসাধিত সুধা আহারনে তীব্রতা দেখে লীটো শুধু হেসে ছিল , একটুও বাধা দেয় নি ।একে-অপরকে উজার করে ভালবেসে ছিলাম । মরুর বুকে বৃষ্টির ছোঁয়া যেমন তৃপ্ততার উদ্রেককারী , আমার একাকীত্বে লীটো ছিল তদ্রূপ। একসাথে ছবি আকা , পছন্দ গুলো একে অপরের সাথে বিনিময়ে আমরা হয়ে উঠেছিলাম রাজযোটক । ছয়টি মাস কেটেছে নিরঝঞ্চাট ।
ঝামেলার শুরু ফ্রেব্রুয়ারির সেই পাঁচ তারিখ , এক পথের কোনে পাইনের ঝাড়ের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলছিলাম ক্যানভাসে , এক নচ্ছার মাতাল গাড়ী নিয়ে সোজা তুলে দিল আমার ক্যানভাসে , ক্যানভাসকে বাচাতে গিয়ে মাথা ঠুকে গেল পিচের রাস্তায় । জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম সফেদ বিছানায় , পাশে আমার লাস্যময়ী লিটো , কান্নাসিক্ত চোখে ।
ডান হাত ঊঠাতে গিয়ে ব্যাথ্য জ্ঞান হারালাম, আবার জ্ঞান ফিরতেই লিটোর সাথে ডাক্তার কে দেখতে পেলাম সফেদ আপ্রোনে মৃত্যদূত, হেসে হেসে বলছে এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন
শুধু হাতের উপর দিয়ে গেল আপানার , মোটর সাপ্লাই ডিস্ট্রাক্টেড , কোন সূক্ষ্ম কাজ আপনি করতে পারবেন না । এ ডাক্তার নিজেও হয়ত বুঝতে পারেনি হাসতে হাসতে আমার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করল , একজন শিল্পীর জীবনে আরেকটি ছবি আকা হবেনা , এই ভাবনার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয় , কম বেদনাদায়ক । বুঝতে পারবেই বা কিভাবে এদের কাছে ব্যাথা মানেইতো মরফিন পুশ মনের ব্যাথের ওষুধ এরা কি জানবে ।
জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে , লীটো ছায়া হয়ে ছিল আমার পাশে , আমি অভিনয় করে গেছি হতাশা কাটাবার প্রতিনিয়ত , পারিনি , ধীরে অবক্ষয় হয়েছে চেতনার ।
লীটো একদিন হঠাত আমায় আবিষ্কার করল প্রফেসর মিস হেসবারগের বাসায় , দুজনে মদে চ্যুর হয়ে উদ্দাম আদিম খেলা রত অবস্থায় । ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নীল লীটো , আমার লীটো ।
আমি তার কাছে অনুনয় করিনি , যাবার বেলায় তার ছলছল চোখে তাকিয়ে সান্ত্বনা দেই না , জানতাম দুটো কথায় গলে যাবে সব অবিশ্বাসের বরফ , তবু কিছু বলতে পারিনি
, আমার মুক্তি বড় প্রয়োজন , তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন লীটোর মুক্তি আমার কাছ থেকে ।এই হতদ্যোম বীওনের কাছে থাকলে লীটো ও হয়ে ঊঠবে আমার মতই প্যারানয়েড।
নিজের ভালবাসাকে তিলে তিলে এভাবে ক্ষয়ে যাওয়ার দর্শক হবার মানসিক শক্তি আমার ছিল না ।ভাল থেক তুমি লীটো , আমি আজীবন তোমার।