Click This Link
২৫শ দৃশ্য (রেল স্টেশন)
(রাত ন'টা। খোরশেদ একটা বেঞ্চে বসে আছে। তার হাতে মাঝারি আকারের লেদারের ব্যাগ । স্টেশনে লোকজন খুব একটা নেই। প্রায় সকল প্লাটফর্ম খালি। ময়লা জামা চৌদ্দ-পনের বছরের একটা ছেলে একটা বৃদ্ধ লোককে সাথে নিয়ে খোরশেদের দিকে এগিয়ে এল। ছেলেটার এক হাত কাটা।)
ছেলে : (অনুনয়ের স্বরে) স্যার, কিছু টেকা দেন স্যার।
খোরশেদ : কেন, টাকা দিয়ে কি করবি?
ছেলে : আমরা সারা দিন থাইকা ভুখা, একটা রুটি ছাড়া কিছুই খাই নাই। (বৃদ্ধকে দেখিয়ে) আমার বাবা বুড়া মানুষ, খিদার কষ্ট পাইতেছে। দুইদিন থাইকা জ্বর, ওষুধ নাই। দেন না স্যার।
খোরশেদ : কাজ টাজ করিস না কেন?
ছেলে : কাম? কাম আমার কে দিব? এক হাত দিয়া আমি কাম করব কিভাবে?
খোরশেদ : এক হাত দিয়ে কাজ করব কিভাবে মানে? পৃথিবীতে তোর মতো পঙ্গু লোক আর নেই? তারা কী সবাই ভিক্ষে করে? (পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে) যা পাঁচশ টাকার ভাংতি নিয়ে আয়, তুই বিশ টাকা পাবি।
ছেলে :

খোরশেদ : সামান্য পাঁচশ টাকার ভাংতি যোগাড় করে দিতে পারবি না, তাহলে পারবি কি? তোকে তো ভিক্ষে দেয়াটাও অন্যায় হবে। যা এখান থেকে।
(ছেলেটার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ছেলে এবং বৃদ্ধ দুজনেই পেছন ফিরে হাঁটতে লাগল। খোরশেদ অনেকক্ষণ বসে থেকে এক সময় বেঞ্চে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। লেদারের ব্যাগটা সে কোল বালিশের মত আঁকড়ে ধরে আছে।
২৬শ দৃশ্য (রেল স্টেশন)
(তিথি সন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ, হাতে মাঝারি আকারের লেদারের স্যুটকেস। বেঞ্চে খোরশেদকে শুয়ে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল।)
তিথি : খোরশেদ! এই খোরশেদ!
(খোরশেদ ধড়মড় করে উঠে বস। চোখ কচলে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তিথির দিকে তাকাল।)
খোরশেদ : তিথি তুমি!
তিথি : হ্যাঁ আমি। তোমার মেসে গিয়ে শুনলাম তুমি গ্রামে চলে যাচ্ছ, তাই তোমাকে খুঁজতে এখানে চলে এলাম।
খোরশেদ : (কঠিন স্বরে) তুমি এখানে কেন এসেছ? চলে যাও।
তিথি : চলে যাওয়ার জন্যতো আমি এখানে আসিনি- আমি তোমার সাথে যেতে এসেছি। (ব্যাগ দেখিয়ে) এই দেখ, জামা কাপড় সব নিয়ে এসেছি।
খোরশেদ : তুমি আমার সাথে কেন যাবে?
তিথি : কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি।
খোরশেদ : (টিটকিরির সুরে) এই সেদিন কপর্দকহীন বলে ভালবাসাকে লাথি মারলে, আর এখন এসে ভালবাসার দোহাই দিচ্ছ? তপনরা নিশ্চই বলেছে আমি এখন কয়েক লাখ টাকার মালিক, তাই না?
তিথি : (আহত স্বরে) খোরশেদ, আমি টাকার লোভে তোমার কাছে আসিনি। আমি মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে ছেড়ে চলে এসেছি শুধু তোমাকে ভালবাসি বলে; আর তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ?
খোরশেদ : (মাথা ঝুঁকিয়ে, দু’পাশে নেড়ে, লম্বা শ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত সুরে) আমি দুঃখিত তিথি, আমার মাথা ঠিক নেই।
তিথি : (খোরশেদের পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে) খোরশেদ কি হয়েছে তোমার? তুমি হঠাৎ এরকম বদলে গেলে কেন?
(খোরশেদ উঠে দাঁড়াল। অস্থিরভাবে কিছুক্ষণ পায়চারী করল, তারপর হঠাৎ ঘুরে তিথির দিকে তাকাল)
খোরশেদ : আমি কেন বদলে গেছি তুমি জান না?
তিথি : (মাথা নেড়ে দুর্বল কণ্ঠে) না।
খোরশেদ : আমি জানি তুমি জান- কিছুটা হলেও জান। তার পরও বলছি শোন, আমি এমনি এমনি বদলে যাই নি; অভাব আমাকে বদলে দিয়েছে। বি.এ পাস করে ব্যবসা করতে শহরে এসেছিলাম, কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। দরিদ্র বাবার শেষ সম্বলটুকু খুঁইয়ে পথে নেমেছিলাম। ভাল একটা চাকরি পাওয়ার আশায় লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, কিন্তু পাইনি। অখ্যাত একটা মাসিক পত্রিকায় কাজ করেছি, নিয়মিত বেতন পাইনি। মেসে থেকেছি, ভাড়া দিতে পারিনি। ধার কর্জ করেছি- শোধ দিতে পারিনি। আমার ছাত্রীর মা আমাকে পাঁচশ টাকা ভিক্ষে দিয়ে অপমান করেছে- শুধু আমার অভাবের কারণে। যাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতাম তার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি শুধু দরিদ্র বলে। আমার মেস মেট আমার সাথে দুর্ব্যবহার করত শুধু আমার অভাবের কারণে। বশির মিয়া আমাকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দিয়েছে, বাকি শোধ করতে পারিনি বলে। এত কষ্ট আর অপমান আমি সহ্য করতে পারিনি তিথি, তাই আমাকে বদলে যেতে হয়েছে।
তিথি : এত টাকা তুমি কোথায় পেলে খোরশেদ?
খোরশেদ : সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করোনা তিথি, আমি বলতে পারবনা।
তিথি : (খোরশেদের হাতে হাত রেখে) খোরশেদ, সেদিন আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছিলাম, সে জন্য আমি অনুতপ্ত। তুমি যে মনে এত বড় আঘাত পাবে সেটা আমি বুঝতে পারিনি, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাকে ভালবাসি খোরশেদ, কিন্তু সেদিন সেটা বুঝতে পারিনি। তুমি আমাকে সাথে নেবে না? সুখে দুঃখে তোমার পাশে রাখবে না?
খোরশেদ : (তিথির পাশে বসে হাত চেপে ধরে আকুল কণ্ঠে) তুমি থাকবে আমার পাশে? থাকবে?
তিথি : হ্যাঁ খোরশেদ থাকব, সারা জীবন থাকব।
(হঠাৎ লম্বা ও বেঁটে উপস্থিত হল)
লম্বা : (খোরশেদেকে ইঙ্গিত করে বেঁটেকে) আরে ওস্তাদ, পার্কের সেই ভাইজান না?
বেঁটে : (খোরশেদের দিকে তাকিয়ে) তাইতো, সেই ভাইজানই দেখছি। (খোরশেদকে) ভাইজান ভাল আছেন?
খোরশেদ : (ভীত স্বরে) আ-আপনারা কারা?
বেঁটে : আরে ভাইজান, আমাদের চিনতে পারছেন না? এই সেদিন পার্কে দেখা হল; এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? আমরা কিন্তু আপনারে ঠিকই চিনেছি। স্যুট টাই পরে দেখছি বাবু সেজেছেন। (তিথিকে দেখিয়ে) এই ম্যাডাম কে? আপনার বউ?
খোরশেদ : (ভীত স্বরে) আপনারা কি চান?
বেঁটে : (কৃত্রিম হতাশার ভঙ্গিতে) দেখ দেখি কি সমস্যা! আপনি জানেন না আমরা কি চাই?
খোরশেদ : (ভীত স্বরে তোতলাতে তোতলাতে) আপনারা শক্ত সমর্থ মানুষ, কাজ করে খান না কেন?
বেঁটে : ওমা! এ শালা দেখি জ্ঞান দেয়। (ধমক) যা আছে তাড়াতাড়ি বাইর কর।
খোরশেদ : আ-আমার কাছে কোন টাকা নেই।
লম্বা : (পকেট থেকে চাকু বের করে) আমরা কিন্তু চেক করব। যদি পাই তাহলে সেদিনের মত চড় না, একেবারে ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেব। (বেঁটেকে) ওস্তাদ হাত লাগাব?
বেঁটে : লাগা।
(লম্বা বাম হাতে চাকু ধরে ডান হাতে খোরশেদের ব্যাগে ঝাপটা মারল। খোরশেদ ব্যাগ ধরে রাখার দুর্বল চেষ্টা করে ছেড়ে দিল। তিথি খোরশেদের শরীর ঘেঁষে ভয়ে কাঁপতে থাকে। লম্বা ব্যাগটা বেঁটের হাতে দেয়। বেঁটে ব্যাগ খোলে।)
বেঁটে : বাহ! ব্যাগে দেখছি অনেক টাকা। এই শালা আজকেও মিথ্যে কথা বলেছে। পকেট চেক কর।
(লম্বা খোরশেদকে কলার ধরে দাঁড় করাল। পকেট থেকে আরো বেশ কিছু টাকা বের করে বেঁটের হাতে দিল।)
বেঁটে : পকেটেও দেখছি অনেক টাকা। এই শালা দেখা যাচ্ছে এক নম্বরের মিথ্যুক। এই ম্যাডামের কাছে যা যা আছে নিয়ে নে, তারপর দেখছি এই শালাকে।
(লম্বা তিথির গলা থেকে একটানে চেন ছিড়ে ফেলল, কোলের উপর ভ্যানিটি ব্যাগটা নিতে যাবে তখন বেঁটে কয়েকজন পুলিশকে তাদের দিকে ছুটে আসতে দেখল।)
বেঁটে : (উত্তেজিত কণ্ঠে) গুড্ডু! পুলিশ! পালা।
(বেঁটে দৌঁড়াতে লাগল। লম্বা একটানে তিথির ব্যাগটা নিয়ে বেঁটের পেছন পেছন ছুটতে লাগল। পুলিশ বাঁশি বাজিয়ে তাদেরকে ধাওয়া করছে, বাঁশির শব্দ শুনাচ্ছে ট্রেনের হর্ণের মত।)
২৭শ দৃশ্য (রেল স্টেশন)
(খোরশেদ ধড়মড় করে উঠে বসল। একটা ট্রেন হর্ণ বাজিয়ে ধীরে ধীরে প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াচ্ছে। খোরশেদ তার ব্যাগ চেপে ধরে রেখেছে। সে মাথা ঘুরিয়ে আকুল হয়ে চার পাশে কিছু খুঁজে বেড়াল। বুঝা যাবে এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল। এক সময় সে স্থির হয়ে বসল, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকাল। ট্রেন থেকে যাত্রীরা নামছে। সামান্য দূরে ভিক্ষুক ছেলেটা তার বাবাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খোরশেদ ছেলেটাকে ডাকল।)
খোরশেদ : এই ছেলে! এই! (ছেলেটি এগিয়ে এসে খোরশেদের সামনে দাঁড়াল) টাকা পয়সা কিছু পেলি? (ছেলেটি একটা ছেঁড়া দু টাকার নোট দেখায়) টাকা কী জিনিস বলতো?
ছেলে : কী আবার, কাগজ।
খোরশেদ : সেটাতো জানি, আমি জানতে চাচ্ছি টাকা কী কাজে লাগে?
ছেলে : (অসহিষ্ণু কণ্ঠে) টেকা সব কাজে লাগে, টেকায় সব পাওয়া যায়।
খোরশেদ : কয়েকদিন আগে তোর মতো আমিও ভাবতাম, টাকা দিয়ে সব কিছু পাওয়া যায়। এখন আমি বুঝতে পারছি আসলে আমার ধারনা ভুল। টাকা দিয়ে আর যা-ই পাওয়া যাক, সুন্দর একটা মন পাওয়া যায়না। (আড়মোড়া ভেঙ্গে) আচ্ছা ঠিক আছে, যা, তুই তোর কাজে যা।
ছেলেটি পিছন ফিরে হাঁটতে লাগল। খোরশেদ আবার তাকে ডাকল)
খোরশেদ : এই ছেলে! এই! (ছেলেটি খোরশেদের সামনে এসে দাঁড়াল) নাম কি তোর?
ছেলে : (কঠিন স্বরে) নাম দিয়া কি করবেন?
খোরশেদ : এমনিই জানতে চাচ্ছি।
ছেলে : (নির্লিপ্ত স্বরে) খোরশেদ আলম।
খোরশেদ : খোরশেদ! একটু হাসতো।
ছেলে : (ঝাঁঝালো স্বরে) হাসি দিয়া কি করবেন? দাঁত দেখবেন? দাঁতে কত ময়লা আছে দেখবেন? বেরাশ করে দেবেন?
(খোরশেদ ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে ছেলেটার হাতে দিল। ছেলেটা দ্বিধান্বিতভাবে টাকা হাতে নিল। খোরশেদ প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের দিকে হাঁটতে লাগল। ছেলেটা টাকা হাতে অবাক বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল।)
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ২:২৩