এমন একটি যায়গায় বসে আছি যেখানে হালকা করে ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একই সাথে একদিনের অপূর্ণ চাঁদের জোছনায় পা দুটাকে প্রশস্ত করে তার উপর লেপ্পুখানা নিয়ে মজায় আলতো করে কী বোর্ডের কী গুলোতে আঙ্গুলের ছাপ বসিয়ে যাচ্ছি। ডান পার্শে একজন মানুষ কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। বাঁ পার্শে হেলান দিয়ে দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক অনেক আগেই ঘুমে তলিয়ে গেছেন বোধহয়। ঠিক পছনেও দুজন বসে সস্তা কোনো ব্রান্ডের বিড়ি ফুঁকে শরীরের দুমড়ে কুঁকড়ে যাওয়া শীতলাগা হাঁড়গুলোর মজ্জায় উষ্ণতা ছড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরশুর ঝড়ের সাথে করেই শীত এসে জেঁকে তার নখড় ঢুকিয়ে দিয়েছে আমাদের মাংশের ভাঁজে ভাঁজে। লঞ্চের একদম উপরে উঁচু কিছু একটা থাকে। আমি নাম জানিনা। ওটাকে কেন্দ্র করেই এইসব। কেউ একজন আবার প্রচন্ড শব্দে হিন্দী বাংলা সেই গানগুলো বাঁজাচ্ছে যেগুলো তিরিশ টাকার বিনিময়ে কিংবা বিশটাকার বিনিময়ে পুরো মেমরীকার্ড ভর্তি করে পাওয়া যায় রাস্তার পাশের মোবাইলের দোকানগুলোতে।
এবারে আম্মু তার অব্যাবহৃত শাড়ী দিয়ে আমার জন্য কাঁথা বানিয়ে রেখেছেন। দেয়ার চেষ্টায় ত্রুটি করেননি। কিন্তু আমি আনিনি। লঞ্চে শীত পড়বে, নিয়ে যা। কে শোনে কার কথা? বলেছিলামঃ রোজা কেনো রাখতে হয়? গরীবের দুঃখ বোঝার জন্য। আর গায় শীত কেনো লাগাতে হয়? শীতার্তদের দুঃখ বোঝার জন্য। যেদেশে লক্ষ শীতার্ত মানুষ গরম কাপরের অভাবে কুঁকড়ে মরছে সেদেশে আমার ওঁম পোহানো কি সাজে? আম্মু মুখ ঝামটা মেরে অদ্ভুত ভঙ্গীতে ঠোট উলটে কপট রাগে বললেন আহারে আমার দরদী। কে শিখিয়েছে তোকে এসব? আব্বু। ব্যাস- কথা বন্ধ। ঐ চ্যপ্টার ওখানেই সমাপ্ত। কিন্তু তার ফলাফল বর্তমান- লঞ্চের ছাঁদে শীতের মধ্যে বসে বসে কাহিনি লিখছি। অবশ্য আফসোস ও লাগছেনা। ক্যামন যেনো মনে হচ্ছে আমিও ওদের একজন। উত্তর বঙ্গের কোনো এক কুঁড়েতে শীতের আক্রমণে পর্যদুস্ত দুঃখিনী কোনো মায়ের সাথে আমিও সমান ব্যথা ভোগ করছি। অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে শূন্যের কোঠায় এসে জমা হচ্ছে।
আমি এসব লিখে ব্লগে কিংবা বন্ধু মহলে ভাব বাড়াবো এমন উদ্দ্যেশ্যে না হলেও কিছুটা তাদের দূঃখ ভোগ করার আনন্দকে নিরানন্দ এই নগরের ক্লান্ত পাঠকদের সাথে শেয়ার করার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে রাজি নই।
কানায় কানায় পরিপূর্ণ এই জলতরীর ১ম,২য় ও ৩য় তলায় মানুষের নিঃশ্বাসে গরম হয়ে আছে। ওখানে কোনো যায়গা নেই। ফুপাতো বোনেরা কেবিন না পেয়ে ডেকে ঢালা বিছানায় চাঁদর বিছিয়ে যাচ্ছে। সাথে পুটলি পাটলা পুঁচকি পাঁচকা আরো ছ’সাতজন আত্মীয় (তাদের একটানা ভেঁপু বাঁজানো বাচ্চাগুলো) আর বৃদ্ধ শশুড় শাশুড়ী। দুটো বিছানায় সর্বসাকুল্যে ইলিশ ফাইল করে শুলেও দশজনের যায়গা হওয়ার কথা। মানুষ এগারো জন। ভাগ্নী পিচ্চিটার দুপুর থেকে কোনো কেয়ার নেই- দূরে দূরে থাকে- আম্মুকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে এটা কে? আরে চিনোনা? এটা তোমার মামা (হয়তো বিশ্বাস করেছে-কারন আপু তার মেয়ে আমি তিনজনই নাদুস নুদুস- একই কিসিমের) দূরত্ত্ব কমাতে গ্রামীন ফোনেও (মোবাইল সেঁধে) কাজ হয়নি। কিন্তু ল্যাপ্পুর চেহারা দেখার পরই আমার সাথে ভাব জমাতে চেষ্টা। আবদার গান শুনাতে হবে- পল্লী গীতি, দেশাত্মবোধকে কাজ হচ্ছেনা- আমি নাকি গজল গাইছি- গান কোথায়? নিরুপায় হয়ে আপুকে জিজ্ঞেস করলাম ওর গানের সংজ্ঞা কি? আপু বললেন আমি তুমি তুমি আমি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার ইচ্ছে হলো। লজ্জা আমার অনেকদিন আগেই হাড়িয়ে গেছে। এখন আর লজ্জা পাইনা- কেবল লজ্জা পাওয়ার ভান করি। শুনালাম “ভালো বাসবো বাসবোরে” ও দেখি চরম খুশী। এতক্ষনে মনের মতো একটা গান পেলো।
ওকে ঘুমুতে বলে উঠে নিচতলার কার্ণিশে এসে বসলাম। যায়গাটি লঞ্চের পেছনে হওয়ায় ইঞ্জিনের শব্দে কানে বড় সাইজের দুটি তালা লেগে গেলো। লাগুক। চাবিগুলোকে পকেটে রেখে চুপচাপ নদীতে চাঁদের রূপের খেলা দেখে যাচ্ছিলাম। এখনো একদিন বাঁকী। তাও সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ছে। কি অদ্ভুত। আমার আগেও আমার বহু অতীতের পূর্বপুরুষের দৃষ্টির ছাঁপ আছে চাঁদের বুকে। তাকালেই যেনো আমি সেসব দেখতে পাই। হয়তো আমার মতোই কিংবা এর চেয়ে গভীর কোনো দৃষ্টিতে তারা তাঁকিয়ে ছিলো। নির্বাক ভাবে খুঁজে চাচ্ছিলাম তাদের। শেঁকড় খোঁজার একটা অব্যাক্ত উন্মাদনা মানুষের বুকের ভেতর সর্বদাই অস্থির ভাবে জলপ্রপাতের ন্যায় আলোড়ণ সৃষ্টি করে যায়। সেখানে রংধনূ ওড়ে। রঙের আবহে কখনো অস্পষ্ট কখনো ঝাপসার চেয়ে অস্পষ্ট মত দৃশ্যমান হয়। আমার মতো চন্দ্ররোগে আক্রান্ত মানুষগুলো বড় অস্থির হয়ে উঠে এই সময়গুলোতে। রোগটা ক্রমেই বাড়তে থাকে। আর তা যদি হয় বহতা নদীর টলমল বুকে তাহলে তো আর ধরে রাখা যায় না। দিলাম ঝাপ!!! কে? কে বাঁধা দিলো? ধুর। ডান পাশের মাথায় হলুদের মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা নীল রঙ করা মাফলার বাঁধা আর কালো গেঞ্জির উপর দিয়ে কমলা কালারের শার্টের কলার বেড় হয়ে থাকা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়ির লোকটা সুখটান দিয়ে ভুস করে সবটা ধোঁয়া বাতাসে ছুড়ে মারলো। বাতাস আমার সামনে দিয়েই যাচ্ছিলো বলে কিছুটা বিষ আমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে লঞ্চের পেছনে পালিয়ে গেলো।
জনাব, যদি এপাশটায় সরে এসে কাজটা সারতেন তাহলে কি খুব একটা কষ্ট হবে? ঠিক এভাবেই বলেছিলাম। মনে আছে। কারন একটু আগেই বলেছিতো। লোকটা জনাব সম্বোধনে একটা ধাক্কা খেলো- বললো জি জি... কোনু সমস্যা নাই। তার পাশের জনের হাতেও সেই মৃত্য সনদ জ্বালানো ছিলো। দেখিয়ে দেয়া বাঁ পাশটাতে এসে লুঙ্গী পড়া দু ভদ্রলোকই হাটু ভাঙ্গা “দ” এর মতো করে বসে আরামসে জ্বালিয়ে যাচ্ছিলেন বিবর্ণ ফুসফুস। মাথা ঘুড়িয়ে নদীর সৌন্দর্যটাকে আবার চক্ষুর ফ্রেমে বন্দী করার প্রত্যয়ে তাকালাম। ভুস। কিরে ভাই? কত্থেকে? ঠিক আগের যায়গায় আরেকজন এসে। ক’জনকে আর কষ্ট দেয়া যায়? তাই এবার নিজেই কষ্টকরে সরে আসলাম।
মোবাইল বেচারা মারাই গেলো শেষ পর্যন্ত। শেষের কয়েকদিন থেকে আজ দুপুর পর্জন্ত তাকে স্যালাইন লাগিয়েই রাখতে হচ্ছিলো। নতুন একটা ব্যটারী কিনতে হবে। এখন হাতে টাকা নাই। ঢাকা গেলে টাকা পাওয়া যাবে। তখন কিনবো বলে তাকে পুনরায় লাইফ সাপোর্ট দেয়ার চিন্তা আপাতত মাথাটাকে একটা ঝাকি দিয়ে ঝেরে ফেললাম। কেননা চোখ কেবলি ছাদে বসানো লাইটগুলোর পাশে লাগানো সকেট ঘুঁজতে যাচ্ছিলো। এখন লাইফ সাপোর্ট দেয়া মানে কি? ওটায় স্যলাইন লাগিয়ে এই গাঁদাগাঁদি করা ভিরে দাঁড়িয়ে থাকা—আর পেছনে আরো কজন হাসি হাসি মুখে তেলতেলে একটা ভাব নিয়ে বলবে ভাই আপনারটা শেষ হলে আমরটা একটু দিয়েন। সে তো জানেনা আমারটার পেট যে কোনো দিনই ভরবেনা। তাই মনে মনে গজ গজ করে গুষ্টি উদ্ধারের চেষ্টা করবে। পারবেনা জানি। কারন অত ফেমাস কোনো বংশ কিংবা গুষ্টিতে জন্মাইনি। তাই সে আমার বাবা কিংবা মা পর্জন্ত গিয়েই খালাস। যদি নিজস্ব কোনো গবেষনা সে চালায়ও তাও খারাপ কি? একদিন তার ঠিকানায় গিয়ে লিখে নিয়ে আসবো। কারন আমি নিজেও দাদা আর নানার ওপারে কাউকে চিনিনা।
চায়ের দোকানে ভির লেগে আছে। সবাই চুমুক দিয়ে বিস্বাদ এই উত্তপ্ত পানিয় পান করে যাচ্ছে। লঞ্চ ভর্তি টিউবলাইটের আলোয়, তারপরও সিঁড়িতে উঠার সময় হাতের ডানপাশে যে হাবিজাবির দোকানটা আছে ওখানে ষাট পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে। বাতির নিচটা বেশ গরম। আর ডানপশে যে বাদামওয়ালা মোটা লোকটা আসন করে বসে আছে সে ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে খরিদ্দারের অপেক্ষায়।
ছাঁদ থেকে নেমে এখন সেই সিঁড়িটায় বসে আছি। ঠান্ডায় জমে গিয়েছি। আর পারিনি ব্যাথিতদের ব্যথা সহ্য করতে। পালিয়ে এসেছি। এখানে বসে নানান রঙের মানুষদের ঘুমন্ত শরীর দেখছি। আর চেষ্টা ভাবনার ক্লান্তিকর পথ বেয়ে বহুদুর হেটে যাওয়ার প্রচেষ্টারত মস্তিস্কের উন্মুখ নিউরনগুলোকে ঘুম পাড়ানীর গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর। কিন্তু বসে বসে কি ঘুমানো সম্ভব? মনে হয়না। ঘুমন্ত মায়েরা তাদের শিশুগুলোকে অজান্তেই আগলে রেখেছে। কি অবাক মায়া। যদি হাত ছুটে যায় কিংবা যেতো তাহলে হয়তো বিপদ জড়িয়ে নিতো আপন করে। অজানা আশংকায় সন্তানকে বুকের কোমল উষ্ণতায় চেঁপে রাখা মায়েদের দেখে আম্মুর কথা আবার মনে পড়ে গেলো। আমি ঢাকায় আসতে চাইলেই মনে হয় যেনো আম্মুর কলজেকে কেউ খামচে ধরেছে। মনে হয় যেনো তার শিরা উপশিরা নিয়ে কেউ টানা হেঁচরা করছে। যেনো তার পরান তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কেনো?? কেনো এমন হয়? কি অবাক মায়া তাদের হৃদয়ের গহীনে স্রষ্টা স্বযতনে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। আম্মু বলছিলেন- তোরা যে নাটক গানে মায়ের কথা বলিস সেই মা’ইতো আমি। আমাকে ইমোশোনালি ব্লাক মেইলিং চলছে, আমি টের পাই। কিন্তু সেই মায়া মমতার বিশাল পাহাড়ও আমাকে মায়ের কাছে রাখতে পারলোনা। আমরা সন্তানরা কত নিষ্ঠুর তাই না? তাদেরকে ছেড়ে কতদুরের এই শহরে একলা পড়ে থাকি—কিংবা বৌ সন্তান আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যাস্ত জীবনে নিজেদের জড়িয়ে রাখি। আর তারা?? নিজেদের জীবনটাকে উৎসর্গ করেও সেই গ্রামের মাটির টানে পড়ে থাকে একলা। কজনই খোঁজ নেই?? আমাদের মা মনিটা কেমন আছে?? গ্রামের ঐ ছোট্ট ঘরে?? নেই না। দিনে দিনে আমরাও যন্ত্রের মত যান্ত্রিক হইয়ে যাচ্ছি। যেনো তেল খাওয়া এক একটা ট্রাক।
রাত ২টা।
ফ্লটিলা লঞ্চে বসে...