মোবাইল ভাইব্রেশন করতে করতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে তার পরও কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে চোখ সড়ছেনা। সাড়াদিন কি যে এতো পড়ে। রুমমেট মাঝে মাঝে পেছনে এসে বসে দেখার চেষ্টা করে। সবাই পিসি নিয়ে কত রঙ বেরঙ্গের জিনিশ দেখে। আর এই আঁতেল সারাটাক্ষন কঠিন কঠিন কি সব হাবিজাবি পড়ে। ওর কি মাজা ব্যথা হয়না? আজিব। নাজিব বলে কিরে... তোর ফোন বাঁজছে। কোনো খবর আছে? এতোক্ষনে সমুদ্রের খেয়াল হয় যে আসলেই ফোন এসেছে।
মেঘের অস্থির কন্ঠ। কি? তোমার আসতে কতক্ষন লাগবে? আমি রোদে এতোক্ষন দাড়িয়ে থাকতে পারবোনা।
ওকে বস আমি আর দশ মিনিটের মধ্যে আসছি। টাকা লুকানোর যায়গা থেকে একশত টাকার দুটি নোট বের করে চামরা ঊঠে যাওয়া বিবর্ণ ওয়ালেটে শুইয়ে দেয় সমূদ্র। বেড়িয়ে আসে সূর্যের রাগ মাথায় করে।
ভিখারী তার হাতেরশষ্টিকটাকে সম্বল করে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে চলছে রাস্তার পুকুরগুলোর পানি জমে থাকা প্রান্তর ছাড়িয়ে। ভোরে কিছুটা বৃষ্টি হওয়ায় এখনো পানি জমে আছে। পিচের রাস্তার পাতলা আবরনের নিচেই লাল ইটের আস্তর খসে খসে গলে যাচ্ছে সময়ের মতো। সামনে থেকে গাড়িটা আসছিলো। কিন্তু অন্ধ বেচারা তা টেড় পাচ্ছিলোনা। দ্রুত গতির গাড়িটি সামনে এসেই গতি কিছুটা কমিয়ে দেয়। ছানি পড়া চোখে দেখা যাচ্ছেনা সাদা এলিয়েন। দরদ মাখা একটি হাত ধিরে তাকে তুলে রাস্তার পাশে নিয়ে যায়।
পেটুক রেষ্টুরেন্টে অনেক ভীর। আভিজাত এই সব খাবারের আড্ডায় মাঝে মাঝেই আসা হয়। মেঘ আবার ফোন দেয়। মেয়েটা এতো অস্থির কেনো? সমূদ্র বলে আমার সাথে একজন মেহমান আছে। আমাদের সাথে লাঞ্চ করবে। মেঘ তার মেঘ গুড়গুড়ে কন্ঠে নীল আকাশের আহবান জানিয়ে দেয়। আব্দুল হাকিম অনেক লজ্জা পাচ্ছিলো। এ তাকে কোথায় নিয়ে আসা হলো? জুতো খুলে প্রবেশ করে পায় ঠান্ডা টাইলসের চোয়া পেয়ে কিছুটা নংকায় পড়ে গেলো। এমন রেষ্টুরেন্টে এর আগে জীবনেও আসা হয়েছে কিনা তার আমার জানা নেই। তবে সমূদ্র বেশ আদর করেই তাকে কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে হাত ধরে প্রবেশ করছিলো। খাবার টেবিলে মৌ মৌ ঘ্রাণ ছুটতে থাকা প্লেট সামনে নিয়ে বসে থাকা অগনিত চোখ অবাক হয়ে দেখছে। অবর্ণনীয় অবাক হচ্ছে এমন রাস্তার একজন মানুষকে নিয়ে আসা তরুনটির দিকে তাকিয়ে। জিন্স আর কালো গেঞ্জি পড়া পিঠে ব্যাগ ঝুলানো, চুলে হালকা জেল দেয়া সেই সাথে ষ্টাইলিশড দাড়ি-- একে ব্যাক্সট্রিটের গান গাইতে গাইতে মেয়েদের সৌন্দর্য্য বর্ননাকারী তরুনদের মধ্যমণি হিসেবেই হয়তো বেশী মানাতো। সবার খাওয়া মনে হয় বন্ধ হয়েগিয়েচছে মুহুর্তের জন্য। রেষ্টুরেন্টের লোকগুলো কি ভাবছে তার তোয়াক্কা না করে - এটা কোনো ব্যাপারইনা এমন একটা ভাব নিয়ে এক কোনায় বসে থাকা মেঘের অবাক চক্ষুর নিকটবর্তি হচ্ছে সমূদ্র। মেঘের চোখে সামান্য অশ্রুর আভাস-- খুশিতে মনে হয় চাঁদটাকে জড়িয়ে চুমু খাবে।
মেঘ তার মহা দরদী কন্ঠে লোকটাকে সালাম দেয়। লোকটা অদ্ভুত এক সমিকরনে এসে ভাবতে থাকে জীবনটা আসলে কি? তার এই দূঃখ ভরা মরূ জীবনে এই সাময়ীক মরূদ্যানের সাক্ষাতে সে অনেকটা বাক হারা। মেঘের নানান প্রশ্নে সমুদ্র ও অবাক হয়ে তাকায়। এযেন সত্যি তার মেঘ। এমন মেঘের জন্যই প্রার্থনা ছিলো প্রভূর কাছে।
মেঘের যেসব প্রশ্ন ছিলো-
পৃথিবীতে আপনি কোনো কিছুই দেখতে পাননা। এতে আপনার ক্যামন লাগে? মেঘ মনে হলো প্রশ্ন করছে আর ভেতরে ভেতরে কাঁদছে। কারন নেকাবের আড়ালে ছলছল দুটি চোখ ছাড়া আর কিছুই দৃশ্যমান নয়।
আব্দুল হাকিম ভাবলেশহিন কন্ঠে জবাব দেন-- আল্লাহ যা কিছু করেন ভালোর জন্যই করেন। আমার কোনো আফসোস নাই।
মেঘ সমূদ্রকে বলে দেখছো? আমরা সব কিছু পেয়েও কত অসুখি আর উনার সবচেয়ে মূল্যবান একটি অঙ্গ নেই তার পরও তার কোনো ক্ষোভ নেই স্রষ্টার প্রতি। আর আমরা দিনে রাতে কতো অভিযোগ করি। আরো নানান প্রশ্নে মুখরিত করে তুলছিলো রেষ্টুরেন্টের পরিবেশ। ওয়েটার'রা সব কাজ ফেলে তাকিয়ে তাকিয়ে ভিন্ন জগতের এই তিনজন মানুষকে দেখছে। আর খাবার খেতে থাকা মানুষগুলো যেনো মকখের কচছে লোকমা তুলে স্থবির হয়ে থমকে গেছেন কোনো অদৃশ্য রিমোটের পজ ক্লিকে।
সমুদ্র বলে কি খাবেন বলেন-
আব্দুল হাকিম বড় লজ্জা পায়। নিজেকে দামী চেয়ারটাতে আরো সংকুচিত করে নেয়। বলে আপনারা যা খাওয়ান তাই খাবো।
এই ঘন দুপুরের অভুক্ত একজন মেহমানকে মেঘ তার নরম ভায়োলিনের বিমুগ্ধ সুরে বলে- আপনি যা খেতে ইচ্ছে করেন তাই খাওয়াবো। আজকে আমাদের খাবার আপনার সম্মানে। আমরা সৌভাগ্যবান আপনার মত মেহমান পেয়ে। আমরা অবশ্য ভাত খাবো বলে এসেছি।
সমূদ্র মেঘের দিকে অপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। বিদেশী ভাষায় বলে হি ডন্ট নো দা নেম অফ দিস রিচ ফুডস। মেঘ বলে ওকে- দেন ফ্রাইড রাইস উইথ চিকেন রোজালা? প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকায় সমুদ্রের চোখে।
এক টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে তিনজন ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। একজন কালো মতো আফ্রিকান দেখতে লোকটা নিজের খাবার না খেয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে অবাক করা এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সমুদ্র মেঘকে বলে আমরা সংসার জীবনে যদি এভাবে প্রতিদিন একজন মেহমান নিয়ে খাবার খাই তুমি কি রাগ করবে? মেঘ ভাবে আবার বুঝি আগমন হচ্ছে খলিফা মামুনের!! কপট রাগের চোখ রাঙ্গানি দিয়ে বলে--- তুমি কি আমাকে তাই মনে করো? আমিই বরং মাত্র ভাবছিলাম এমনটা যদি সাড়া জীবন হতো--- অপার্থিব কিছু সুখ ছুয়ে যেতো। পৃথিবীটা হতো আরো একটু সুন্দর। ছানি পড়া দৃষ্টিহীন চোখে নোনা অশ্রুর আনাগোনা। ভাবছে কেবলি আব্দুল হাকিম। এরা কি মানুষ? নাকি অন্য কিছু? ইচ্ছে করলেই দশ টাকা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বিদেয় করে দিতে পারতো। কিন্তু এভাবে নিজেদের জীবনটা রাস্তার একজন অচেনা দরীদ্রের সাথে যারা পরম আদর আর যত্নে শেয়ার যারা করেছে তারা কি? (যদি অন্যরা মানুষ হয়)
এভাবেই হয়তো মেঘ সমুদ্রে আবার আবাদ হবে উর্বর এই শশ্যক্ষেত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১০ ভোর ৫:৫২