আপনারা যারা আজকে ব্লগে লগইন করে বা না করে, অ্যাকাউন্ট খুলে বা না খুলে, বিনে পয়সায় আমার পোস্টটি পড়েছেন, আপনাদের ধারণাও নাই আপনারা কত ভাগ্যবান। বাংলাভাষায় ব্লগিংয়ের কথা বলতে গেলে যে নামটি সবার আগে আসে, ব্লগিংয়ের একমাত্র ভূমিপুত্র, সেটি এই শর্মা। ডাইরি লেখার অভ্যাস আমার নেই। তবে আমার বিভিন্ন শাগ্রেদরা তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে আমার ব্লগিং জীবনের কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। এর কিছু অংশতো স্কুলে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার মত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়। এর কিছু আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
বাংলা ভাষায় ব্লগিং এর শুরুটা আজ থেকে প্রায় দেড় দুই যুগ আগে, যখন আমি ধোলাইখালের টং ঘর ডট ব্লগস্পট ডট ওআরজি ডট বিডি ডট কম ডট নেট নামের ব্লগে ব্লগিং শুরু করি। ব্লগিঙের শুরুতে আমার নিক ছিল আইনস্টাইনের বাপ। পরবর্তীতে সেই সময়ের মডারেটর কৌশল সেন এর অনুরোধে মিশেল ফুকোর বাপ , অ্যাডাম স্মিথের বাপ, নোয়া হারারির বাপ, ডারউইনের বাপ, শেক্সপিয়ারের বাপ, এইসব নিকেও লেখা শুরু করি ।
করোনা আসার আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার রাস্তায় যে রকম ট্রাফিক জ্যাম হতো। ঐ সমস্ত দিনে আমি ব্লগে পোষ্ট দেওয়ার পর ইন্টারনেটের জগতে ও নাকি সেই রকমের জ্যাম লেগে যেত। হাজার হাজার লাইক, লক্ষ লক্ষ কমেন্টস, কোটি কোটি ভিউ আসতে থাকতো। সব কমেন্টের জবাব দিয়ে আমি কুলিয়ে উঠতে পারতাম না, কিছু অ্যাসিস্ট্যান্ট রেখেছিলাম। মারিনুল খান, হাতুড়ি কাস্তে দত্ত, আরজে ডিজে, সুপার গ্লু এরকম কয়েকজনের নাম মনে পড়ছে।
আমার পোস্টের কমেন্টের জবাব দিতে যেয়ে ঐ সব অ্যাসিস্ট্যান্টের কত কিবোর্ড-মাউস নষ্ট হয়েছে তার হিসেব রাখিনি। শুনেছি দু-একটা ভাঙারির দোকান নাকি আমার পোস্টের উপরেই ব্যবসা করতো।
কখনো সখনো ভালোবেসে কারো পোস্টে যেয়ে 'ইডিয়ট' বলে কমেন্ট করলে সেই সৌভাগ্যবান ব্লগারের উত্তেজনায় ঘুম হতো না, কমেন্টগুলো বাঁধিয়ে রেখে দিত, সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতো। তো আমিই ছিলাম সেই ধোলাইখালের টং ঘর ডট ব্লগস্পট ডট ওআরজি ডট বিডি ডট কম ডট নেট ব্লগের মধ্যমণি। অবশ্য মধ্য মনি বলাটা ভুল হবে, এর মানে তো আরো মণি ছিল। আসলে আর কোন মনি ছিল না। সেই হিসেবে আমাকে ঐ ব্লগের মক্ষীরানী বলতে পারেন।
আমার লেখা ফিনান্সিয়ল এনালাইসিস একবার নিউইয়র্ক টাইমসে হুবহু কপি করে ঝেড়ে দিয়েছিল। আমি তীব্র প্রতিবাদ করার পর অবশ্য আমাকে ওখান থেকে রয়ালটি দিয়েছিল। এরপর থেকে ব্লগে আমার সব লেখায় সংযোজন করে দিতাম: সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত, অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ নিষেধ।
আমার লেখা পলিটিকাল এনালাইসিস রোনাল্ড রিগ্যান থেকে শুরু করে বারাক ওবামা- সবার ক্যাবিনেট মিটিঙে আলোচনা করা হতো, এবং সেই হিসেবে মিলিটারি প্ল্যানিং করা হতো। 'হাইকু কবিতা এবং নন্দনতত্ত্ব' বিষয়ক আমার একটি লেখা জাপানের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় বলে শুনেছি। ব্লগিং জীবনে সহস্রাধিক সনেট লিখেছি। আমার লেখা কিছু সনেট একাধিক দেশের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বেউলফে চর্যাপদের প্রভাব বিষয়ক আমার একটি গবেষনার সামারি ব্লগে পোস্ট করেছিলাম। ঐ লেখায় মুগ্ধ হয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান বিভাগে আমার নামে একটি চেয়ার খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নিতুন কুন্ডু মারা যাওয়ার পর ওনার ছেলেমেয়েরা ভালো মানের চেয়ার ডিজাইন করে না বলে আমি না করে দিয়েছি।
বাতাবি লেবু চাষ বিষয়ক আমার খোলাচিঠি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় বলে শুনেছি। বাংলাদেশ টেলিভিশনও নাকি এর উপরে একটি ডকুমেন্টারি করেছে। কোরান-হাদিসের বিষয়ে আমি যে অগ্নিবর্ষি ব্যাখ্যা দিতাম তাতে আল আঝার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের মাথা চুলকে চুলকে টাক পড়ে গেছে বলে শোনা যায়।
বিশ্বসাহিত্যের লুকানো মুক্তা নামের একটি সিরিজ লিখতাম। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের লাইব্রেরিতে ঐ লিস্ট অনুসারে নাকি বই কেনা হতো। নিউমার্কেট আর বাংলাবাজারের বড় বড় আমদানিকারকেরা আমার ঐ সিরিজের ফলোয়ার ছিলেন। পোস্ট দেখে সেই হিসেবে বই আমদানি করতেন।
অহংকার ভালো জিনিস না। ডোনালট্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি অনেকগুলো ডিগ্রী নিয়েছি; কিন্তু এগুলো নিয়ে কখনো বড়াই করি নি। শুধু আপনাদেরকে জানাতে চাচ্ছিলাম , আপনারা কোন লেভেলের লোকের সাথে ব্লগিং করছেন না এটা মনে রাখবেন। আমার বংশমর্যাদার লোকের সাথে দেখা করতে অনেক রথি-মহারথি জুতোর শুকতলা খইয়ে ফেলেছেন, এটা স্মরণে রাখলে ভালো হয়।
যাহোক জেনারেল জীবনের কথা বলতে চাচ্ছিলাম। ঐ ব্লগের ঐ সময়ের মডারেটর কৌশিক সেন আমার বড় ভক্ত ছিলেন। আমার বিভিন্ন নিক উনিই খুলে দিয়েছিলেন। কোন নিক থেকে কোন পোস্ট হবে এটাও উনি ঠিক করতেন, এসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম না।
দিন সমান যায় না। কিছু ইডিয়েট, বর্তমান জেনারেশনের প্রশ্ন ফাঁস ছেলেপুলে, যারা ব্লগিংয়ের বও জানেনা, এরা ব্লগে এসে বিতং শুরু করলে কৌশিক সেন ক্ষোভে ব্লগ ছেড়ে চলে যান। পরবর্তীতে অজানা ভালোবাসা নামের এক অর্বাচীন ছেলে ধোলাইখালের টং ঘর ডট ব্লগস্পট ডট ওআরজি ডট বিডি ডট কম ডট নেট ব্লগের দায়িত্ব নেয় । কার কান কথায় কি হলো বুঝে ওঠার আগেই দেখি একদিন এই ডোডো মডারেটর অন্যের পোস্টে আমার কমেন্ট করার সুযোগ রহিত করে দিলো।
ব্যাটা, তুমি চলো ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। তো অন্যের পোস্টে আমার কমেন্ট ব্যান হবার পর সে সময়ে আমি দিনের শেষে একটা করে পোষ্ট দিতাম। পোস্টের নাম ' আজকের ব্লগ এনালাইসিস' । আমার ঐ পোস্টে বিগত ২৪ ঘন্টায় ব্লগে যত পোস্ট এসেছে তার চুলচেরা এনালাইসিস থাকতো, কোন ব্লগার কতটা অশিক্ষিত, কার পিছনের দিকের চামড়া মোটা করে আসা, কার জ্ঞান আমার কমোডের ফ্যানার চেয়ে কম এসব বিশ্লেষন থাকতো।
দেখা গেল ঐ অর্বাচিন মডারেটরের সিদ্ধান্ত ব্যাকফায়ার করেছে। আমার ওই ২৪ ঘন্টার ব্লগ অ্যানালাইসিস সিরিজটা আমার মূল লেখার চেয়ে অনেক বেশি হিট হয়ে গেলো। লোকজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে থাকত কখন আমি এই পোষ্ট দেই তা পড়ার জন্য। আমার পোস্টে কাকে ইডিয়ট বলবো আর কাকে বেকুব বলবো এটা নিয়ে স্পট বেটিংও হতে লাগলো। অবস্থা বেগতিক দেখে ওই মডারেটর আমার কমেন্ট ব্যান তুলে নেন; কিন্তু জন দাবির মুখে আমি আমার ঐ সিরিজ অব্যাহত রাখি।
অবক্ষয় সমাজের সব ধাপেই প্রকট। কিছু নবযুগের ছেলেপুলে, ফেসবুক থেকে এসেছে এরা, উল্টাপাল্টা না জেনে আমার সঙ্গে তর্কে জড়াতে থাকে। নোয়া হারারির বই থেকে কোট করে আমার ভুল ধরার চেষ্টা করে। জানেনা আমি হারারির বাপ। সিন্ডিকেট ব্লগিং শুরু করে। এদের কেউ কেউ আমাকে এমনকি ব্লক পর্যন্ত করে দেয়। আরে গর্দভ, আমি যে তোদের পোস্টে যেতাম, এ তো তোদের সৌভাগ্য। পরে আমি নিজে থেকেই অবশ্য কয়েকজনের পোস্টে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। দেখা গেল আমি ঐসব পোস্টে পদধূলি দেওয়া বা কমেন্ট করা বন্ধ করার পর ঐ সমস্ত পোষ্টের মাছিও ভিড়তো না।
যেই সমাজে গুণের কদর নাই সেই সমাজে গুণী জন্ম নেয় না। অবশেষে বিভিন্ন প্রতিকূলতা বিরুদ্ধে লড়াই করা সমীচীন না মনে করে আমি ওই ব্লগ একসময় ছেড়ে দেই। আমি ব্লগ ছাড়ার পর প্রকৃত ব্লগাররা অনেকেই সেই শোকে ধোলাইখালের টং ঘর ডট ব্লগস্পট ডট ওআরজি ডট বিডি ডট কম ডট নেট ব্লগ ছেড়ে দেন, এবং এক মাসের মধ্যে মানসম্মত লেখা এবং ক্রিটিকের অভাবে ব্লগটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এখনো আপনারা ওই ব্লগে ঢুকতে গেলে 'নো অ্যাক্সেস' নোটিশ পাবেন।
আমার বন্ধু সেফু ঐ সময় আমাকে একদিন বলেছিলো- দোস্ত কানাডা চলে আসো। দুজন মিলে মদ খাবো, বেকুবদের ট্রস ট্রস করে বেত মারবো আর অসহায় মহিলাদের সাহা্য্য করবো। আমি জবাব দিয়েছিলাম- দোস্ত- চিনের চেয়ারম্যান আমার চেয়ারম্যান। পুজীবাদে লাথি মারি। থার্ড ক্লাস সিটিজেন হবার জন্য বাইরে যাবো না। কচুরলতি দিয়ে গরুর মগজ খেতে আমার ভালো লাগে। তুমিও এদেশে চলে আসো।
যাহোক যা বলতে চাচ্ছিলাম, আপনারা কখনো অহংকার করবেন না। আমার মতো সাদাসিদা জীবন যাপন করবেন। চোখে যত ব্যাথা থাকনা কেনো, প্রতিদিন দশটা ব্লগ পড়বেন, দশটা পোস্ট দেবেন এবং কম করে দশটা কমেন্ট করবেন। অন্যের পোস্টে কমেন্ট করতে না পারেন নিজের পোস্টেই কমেন্ট করবেন। জীবন মধুর মনে হবে।
সবাইকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:৪৭