আজ আবার বাড়ী গেলাম। সারাদিন থাকার নিয়তে। দ্বিতীয় বারের মতো। গ্রামের আত্মীয়-স্বজনরা ভাবলেন, দুপুরের খাওয়ার জন্য না ডাকলে বুঝি তাদের ডিসক্রেডিট হবে। দায়িত্বের খাতিরে তারা দুপুরের খাওয়ার জন্য টানাটানি করলেন। অনেকে। কিন্তু আমি অনড়। বাসা থেকে হট বক্সে করে নেয়া খাবারেই খেলাম। পয়ঁত্রিশ বছর ধরে পরিত্যক্ত ঘরে প্রায় সারাদিন কাটালাম।
এক দাদী। বয়স শতোর্ধ। বাবার ডাক নাম বলাতে চিনতে পারলেন। আম্মার বিয়ের কাহিনী শোনালেন। বললেন, কেন জানি গত রাতে আমার আম্মার কথা উনার মনে পড়েছে খুব। আজ আমাকে দেখে খুব, খুউব খুশী হলেন। খাঁটী চট্ট্গ্রামের ভাষায় কতো কথা যে বললেন! আমার মরহুম চাচার একটা ছবি আনিয়ে আমাকে দেখালাম।
বড় চাচা। আমার মরহুম পিতার অন্ততঃ এক যুগ কনিষ্ঠ। বললেন, তোর বাবার এতো বছরের ছোট হয়েও এখনো আমি বেচে আছি। অথচ বদ্দা মারা গেছে আজ ২০ বছর। বাবা-মায়ের সুনাম এনজয় করা যে কতো বিরাট একটা ব্যাপার এটি আমরা গ্রামে গেলে টের পাই। খুব কম লোকেরাই আমাদের চিনে। অধিকাংশ লোকদের আমরা আইডেন্টিফাই করতে পারিনা। মুরুব্বীরা বিশেষ করে আমার চেহারা দেখে প্রায়শঃই বলে উঠে, ‘এটা মহব্বতের ছেলে নাকি?’। বোধকরি বাবার চেহারার সাথে আমার মিল বেশী।
দাদারা আট ভাইয়ের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে আমার বাবা সবার বড়। যতটুকু দেখেছি, শুনেছি - উনি সব দিক থেকেই বড় ছিলেন। আম্মাও ছিলেন তেমন-ই। আমার দাদীকে আব্বা দেখেননি। ছোট বেলা হতে যাকে দাদী হিসাবে জানতাম তিনি যে আমাদের আপন দাদী নন -এটি আমরা জেনেছি অনেক বড় হয়ে। আব্বা যতদিন বেচে ছিলেন, আমাদের শহরতলীর বাসাটিতে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আম্মও এটি মেইনটেইন করে গেছেন।
আজ তাঁরা নাই। ঢাকা-চট্টগ্রামে এলিট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ভাই-বোনরা কেউ গ্রাম-মুখী কখনো হবেনা - এটি স্থির নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারার পর দীর্ঘ ৩৫ বছর পর; বেড়াতে নয়, একবেলা ঘুরে আসার জন্য নয়, শুধু জেয়ারতের জন্য নয়; নাড়ীর টানে, প্রাণের আবেগে শেকড়ের সন্ধানে একজন অধিবাসী হিসাবে আমার গ্রামে যাত্রা। পরবর্তী প্রজন্মকে চাই, মৃত্তিকা-সংলগ্ন থাকুক তারা। যেন ভুলে না যায় তাদের ঐতিহ্য, চেতনা আর মাটিকে। যে মাটিতে মিশে আছে তাদের পূর্ব-প্রজন্ম। তাঁদের সমস্ত স্বত্তা নিয়ে।
ঐতিহ্যহীন্ বৈভব - অর্থহীন। ঐতিহ্য হলো অমলিন প্রেরণা।
১. ১৭ ই আগস্ট, ২০১০ দুপুর ১:৪১ ০