বাংলাদেশ ক্রিকেটে কোন পরাশক্তি নয় । কোনদিন ছিল না, আর এখন যে অবস্থা, এভাবেই চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে পরাশক্তি হতে পারার সম্ভাবনাও ক্ষীণ । আচ্ছা, "এভাবে চলতে থাকলে" - এই কথাটার ব্যাখ্যা নানান ভাবে দেওয়া যায় । আমি আমার মত করে দিচ্ছি ।
বিসিবি - বাংলাদেশ ক্রিকেট কাউন্সিল, বিশ্বের চতুর্থ ধনী একটি জাতীয় ক্রিকেট বোর্ড । চতুর্থ ধনী হলেও আদতে নখদর্পণহীন একটি প্রাণী হয়ে বিসিবি আছে সেই আদিকাল থেকেই । আমাদের দেশের ক্রিকেটে উন্নতি না হওয়া, ভালো ভালো ক্রিকেটার একেবারে রুট লেভেল থেকে গ্রুমিং করে নিয়ে না আসা, খেলোয়াড়ে খেলোয়াড়ে কিংবা খেলোয়াড় ও বোর্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যে গণ্ডগোল বাধিয়ে রাখা, ইত্যাদি নানামুখী কর্মকাণ্ড অবশ্য এই বিসিবি নিয়মিত দক্ষতার সাথেই করে থাকে । ক্রিকেটে ওভারঅল সাফল্য না আসলেও, এভাবেই বিসিবি আলোচনায় থাকতে পছন্দ করে। বিশেষ করে বিসিবি সভাপতি জনাব নাজমূল ইসলাম পাপন । ভদ্রলোক একাধারে ৩/৪টি পদে একেবারে উচ্চ আসনে বসে আছেন বিসিবি বাদেও নানা সেক্টরে (যেখানে ১টি উচ্চ পদ সামলাতেই মানুষ হিমসিম খেয়ে যায়) ।
এবার আসি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটে পঞ্চপান্ডব বলে খ্যাত ৫ জন সিনিয়র ক্রিকেটের মধ্যে খান বংশীয় ও প্রায় ১৭ বছর ধরে খ্যাতিনামাপ্রাপ্ত দেশীয় ওপেনার তথা তামিম ইকবাল খান এর বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত দলে চান্স না পাওয়া এবং পরবর্তীতে ভিডিও করে আত্ম সাফাই গাওয়া নিয়ে । অবশ্য এর সাথে গতকাল রাতে টি স্পোর্টস এ দেওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বর্তমান ক্যাপ্টেন ও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ইন্টার্ভিউ ভিডিও এর কথা না বললেই নয় ।
এখানে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর গতকাল তামিম আর সাকিব এর ভিডিওতে ক্লিয়ার হয়েছে । কিন্ত তবু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়, যা হয়তো সাংবাদিকদের মাথায় আসেনি, তাই সাকিব কিংবা তামিমকে এখনও করেনি, তাই ক্লিয়ার হয়নি কিংবা তারা নিজেরাও বিষয়গুলো ক্লিয়ার করেনি ।
প্রেক্ষাপট - ১ঃ মিডিয়ায় সাকিব কিংবা তামিম এই দুইজনের নামেই দুইটি মারাত্মক নিউজ এসেছে । সাকিবের নামে এসেছে এই যে সাকিব নাকি এই আপদকালীন সময়ে (মানে তামিম হঠাৎ অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর) অধিনায়কত্ব নেওয়ার সময় বোর্ডকে শর্ত দিয়েছে যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তাকে নিতে দিতে হবে কিংবা বোর্ডের হস্তক্ষেপ কম থাকবে । অথচ সাকিব এমন কোন শর্ত বোর্ডকে দেয়ইনি (চিন্তা করেন, কি ভয়ানক কথা এইটা । আর তামিমের নামে এসেছে, তামিম নাকি নিউজিল্যান্ড বাংলাদেশের চলমান ক্রিকেট সিরিজের মধ্যেই ৩য় ওয়ানডে ম্যাচ বিশ্রাম নিতে চায় এবং বোর্ডকে সাফ জানিয়ে দেয়, তার ফিজিকাল অবস্থা কিছুটা খারাপ, তার দেহে এখনও কিছুটা ব্যাথা আছে, তাই সে বিশ্বকাপে মাত্র ৫টি ম্যাচই খেলবে, এর বেশি একটা ম্যাচও খেলবে না । অথচ তামিম এটা বলেইনি (আবার ভাবেন কি ভয়ানক কথা) । এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে ঠিক বিশ্বকাপের আগে দলের মনোবল ভাংগার জন্য দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২জন খেলোয়াড়ের নামে এই যে দুইটি মারাত্মক মিথ্যা কথা, এইটা ছড়িয়েছে কে বা কারা? তাদের ধরতে এখনও বিসিবি বা খেলোয়াড় বা অন্য কোন পক্ষ থেকে এখনও কোন অবস্থান নেওয়া হচ্ছে না কেন?
প্রেক্ষাপট - ২ঃ অনেকেই বলছে তামিম যেহেতু ফিজিকালি নিজেকে অতটা ফিট মনে করছে না কিংবা যেহেতু সে ভাবছে তার দীর্ঘ বিশ্রাম দরকার, তাই সে হঠাৎ করে এই বছরের শুরুর দিকে ক্যাপ্টেনসি ছেড়ে দেয় । একেবারে হুট করেই । অনেক তামিমভক্ত কিংবা সাধারন জনগনের মতে সেটা সম্পূর্ণ দলের ভালোর জন্যই । আবার গতকাল রাতে প্রকাশিত ভিডিওতে সাকিব বললো তামিম সেই ২০২১ থেকেই ক্যাপ্টেনসি আজ ছাড়ি কিংবা কাল ছাড়ি করছে । এমনকি দলের একজন ক্রিকেটার (যে কিনা সিনিয়র নয়), সে নাকি এও বলেছে, ভাই ক্যাপ্টেনসি ছাড়লে আগেই ছেড়ে দেন, যাতে নতুন কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে সময় পায় । তাহলে আমার প্রশ্ন, এক্ষেত্রে তামিম দলের চিন্তা করলে তো ২০২১, এমনকি ২০২২ এও ক্যাপ্টেনসি ছেড়ে দিতে পারতো । এই ২০২৩ সালে এসে যখন দলের দুইটি বড় টুর্নামেন্ট খেলতে হবে (এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপ), তখন দলের ক্যাপ্টেনসি ছেড়ে দিয়ে দলকে অগোছালো বানিয়ে দিলো কেন? আবার হঠাৎ অভিমানে অবসরেই বা গেলো কেন ? জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে খান সাহেব এত কথায় কথায় অভিমান করেন কেন? তিনি তো আর এলাকার/পাড়ার ক্রিকেট খেলছেন না, জাতীয় পর্যায়ে খেলছেন, এটা তার মনে রাখা দরকার । জানি না, এই কথাগুলোর উত্তর খান সাহেব হয়তো দ্বিতীয় পর্যায়ে আত্ম সাফাই দিয়ে ভিডিও করে জানাবেন (মনে হচ্ছে কোন ইন্টারেস্টিং ওয়েব সিরিজ উপভোগ করছি আমরা) ।
প্রেক্ষাপট - ৩ঃ তামিম তার ভিডিওতে বলেছে, ফিজিও এর রিপোর্টে বলা আছে, সে যদি বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ড বাংলাদেশের চলমান ক্রিকেট সিরিজের ৩য় ওয়ানডে ম্যাচসহ টানা ১৪/১৫ দিন বিশ্রাম নেয়, তাহলে বিশ্বকাপের সে ফিট হয়েই বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচ খেলতে পারবে (শরীরে টুকটাক ব্যাথা থাকলেও) । তাই তামিম এই বিষয়টাই সবাইকে (বোর্ড কর্মকর্তা ও নির্বাচকদেরকে) জানিয়েছে । সে ৫টি ম্যাচ বা বেছে বেছে খেলার কথা বলেইনি । আবার সাকিব টি স্পোর্টস এর ভিডিওতে বলেছে সে নাকি শুনেছে যে তামিম বেছে বেছে খেলবে । আচ্ছা এবার আমার প্রশ্ন, তামিম যেটা বলেইনি, সাকিব ঠিক সে কথাটিই শুনলো কি করে? আর এই কথাটা সাকিব জানলো কি করে? কোন বোর্ড কর্মকর্তা তাকে জানিয়েছে নাকি কোন সাংবাদিক ? আদতে এই দুইয়ের মাঝে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার ইচ্ছাটা কার বেশি ? এটাও জাতির কাছে খোলাসা হওয়া দরকার ।
প্রেক্ষাপট - ৪ঃ তামিমকে বিশ্বকাপে সুযোগ দিলে কখনও কখনও তাকে ওপেনিং ছেড়ে মিডল অর্ডারে খেলতে হতে পারে, বোর্ড কর্মকর্তাদের একজন তামিম ইকবালকে এই প্রস্তাব দিলে, প্রচণ্ড আত্মসম্মানে ভুগা খান সাহেব মনে করলেন যখন ১৭ বছর তিনি ওপেনিং ছাড়া অন্য পজিশনে খেলেননি, তাই এই কথাটা আদতে তাকে অপমান করতে বলা হয়েছে । ফলাফল তাকে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ দেওয়া হয়নি, বরং সে নিজের নাম উইথড্রো করেছে । এখানে দলের প্রয়োজনে মানুষকে ছাড় দিতে হয়, নিজের জন্য খেলা উচিত না, ইত্যাদি কথাগুলো সাকিব গতকাল প্রকাশিত ভিডিওতে বলেছে । আচ্ছা তাহলে আমার প্রশ্ন, খান সাহেব ক্যাপ্টেন থাকাকালীন, সৌম্য সরকারওকে ওপেনিং থেকে ৭ এ খেলিয়েছেন (কেন? কারণ তার ফর্ম নেই), সাকিবকে ৩ থেকে ৪ বা ৫ এ খেলিয়েছেন, মুশকিল কে ৪ থেকে ৫ বা ৬ এ খেলিয়েছেন, আফিফ, মিরাজ ইত্যাদি আরও কতজনকে তাদের পছন্দনীয় পজিশন থেকে নামিয়ে উঠিয়ে পরীক্ষা করেছেন, তখন তিনি ঠিক আছেন, আর কেউ যদি তাকে নামিয়ে উঠিয়ে পরীক্ষা করেন, তাহলে সেটা মস্ত ভুল । আসলে তিনি প্রচন্ড ইগোস্টিক পারসন । দলের প্রয়োজনে এরকম পজিশন চেঞ্জ করলে কেউ কখনও আপত্তি না করলেই খান সাহেবকে নিজের কম্ফোর্ট জোন ছাড়তে বললে তার প্রবল আপত্তি । অথচ আফগানিস্তানের বিপক্ষেই কেবল তাকে একটু নিচে নেমে খেলতে বলা হয়েছিল । যেহেতু আফগানিস্তানের ওপেনিং বোলিং পার্টনারশিপ ফারুকি ও মুজিবের বলে খান সাহেব বরাবরই উদার হয়ে উইকেট বিলিয়ে আসেন । এখানেও তার ভালোটাই চাওয়া হয়েছিল ওভারঅল দলের জন্য, তিনি সেটা মানবেন না কেন?
প্রেক্ষাপট - ৫ঃ খান সাহেব অভিমান করে বিশ্বকাপ দল থেকে নিজে সরে গেলেন, ভালো কথা । খান সাহেবের আপন বড় ভাই নাফিস ইকবালের দলের ম্যানেজার পদ থেকে সরে যাওয়ার বিজ্ঞানটা বুঝলাম না । এখানে কি তিনি ভাইয়ের জন্যই কেবল দলে ছিলেন? নাকি দেশের জন্য? দেশের জাতীয় দলের জন্য? পরিবারপ্রীতি তথা স্বজনপ্রীতি তথা নেপোটিজম ব্যাপারটা বরাবরই ভয়ানক । এটা থেকে যতটা দূড়ে থাকা যায়, সেটাই ভালো । আবার নির্বাচক প্যানেল থেকে নাকি সরে গেছেন আরেক খান পরিবারের সাবেক খেলোয়াড় আকরাম খান । কারণ নাকি সেই একই (এটা আমার শোনা কথা, শিউর বলতে পারছি না) । এই যে স্বজনপ্রীতির একটি চক্র গড়ে উঠেছিল, এটা থেকে সরে আসা বাংলাদেশ জাতীয় দলের জন্য মঙ্গল নয় কি?
ইত্যাদি আরও আরও প্রেক্ষাপট । আমি লিখতে থাকলে, ঠিক এরকম সাইজের আরও কয়েকটি লেখা তৈরি করা সম্ভব । কিন্তু এই প্রশ্নগুলো যেহেতু তৈরি হয়েছেই, এটা শুধু আমার মনের প্রশ্ন নয়, এটা অমুক ভক্ত তমুক ভক্তকূল ব্যতীত নিরপেক্ষ আপামর জনতার মনের প্রশ্ন ।
তাই শুরুতে যেই কথা বলে শুরু করেছিলাম, সেটা আবারও বলি । বিসিবি লংকায় আগুন দিয়ে এখন মজা নিচ্ছে । চাইলে তারাই সব দফারফা করে সবকিছু শান্ত করে দিতে পারতো কিন্তু না, সব শান্ত হয়ে গেলে তো তাদেরই সমস্যা । যে দল তারা বিশ্বকাপে কোনরকমে পাঠাতে পেরেছে, এদের তো কোনকিছু অর্জন করার কথা নয়, তাই এরকম টুকটাক বিষয় নিয়েই আলোচনায় থাকার মোক্ষম সুযোগটা হারাতে চায় না বিসিবি ।
যত যাই হোক, নিজের দেশ, বাংলাদেশের এই দলের বিশ্বকাপ সফরের জন্য রইলো অনেক অনেক শুভকামনা । দল জিতুক কিংবা হারুক, দলের সাথেই থাকবো । যারা এখন দলে আছে, তাদের উপরই ভরসা এখন সবটা । এই বিশ্বকাপে আমাদের বড় কোন সাফল্য আসবে, এই কামনা করেই শেষ করছি......
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:৪৪