১ম পর্বের ফিচার রচনার লিংকঃ ১ম পর্ব
গত বছরে একটি চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করে বাংলাদেশী ফুটবলপ্রেমীদের কাছে আলোচিত হয়েছিলেন, বাংলাদেশের কিংবদন্তীতূল্য ফুটবলার ও বর্তমান বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। তিনি বলেছিলেন "বার্সেলোনা থেকে মেসির চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যথার্থ"। এই বক্তব্য দিয়ে তিনি এই দেশে আর্জেন্টাইন সুপারস্টার লিওনেল মেসির এই দেশীয় ভক্তদের মনের আগুনে যেন একটু ঘি ঢেলে দিয়েছিলেন। যারা বাফুফে সভাপতি পরিচয় ছাড়া আর তার সম্পর্কে কিছুই জানেন না, তাদের জন্য -
কাজী সালাউদ্দিন কে অনেকে চিনেন বাংলাদেশ ফুটবল জাতীয় দলের কিংবদন্তী খেলোয়াড় হিসেবে কিন্তু অবাক করার মত বিষয় হচ্ছে তার স্পোর্টস ক্যারিয়ার শুরু হয় ক্রিকেট দিয়ে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আগে ৭০ এর প্রথম দিকে তিনি দুইবার বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে চান্সও পান। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালের শেষের দিকে শুরু হয় তার ফুটবল ক্যারিয়ার।
তৎকালীন সময় থেকে নব্বই এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশ ফুটবলে মোহামেডান - আবাহনীর মধ্যেকার দ্বৈরথ ছিল বর্তমান রিয়াল মাদ্রিদ - বার্সেলোনার মধ্যকার দ্বৈরথের মতই টানটান উত্তেজনাপূর্ন। তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় মোহামেডান দিয়ে। কিন্তু তার ফুটবল ক্যারিয়ারের সোনালী সময় কাটে আবাহনীতে। ৭২ থেকে ৮৪ (প্রায় ১৫ দীর্ঘ বছর) তিনি কাটান আবাহনীতে।
এই সময়ে তিনি জাতীয় ফুটবল দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন আর ৭৫ ও ৭৯ সালে তিনি জাতীয় দলের অধিনায়কও ছিলেন। তিনি কত বড় মাপের খেলোয়াড় ছিলেন তার অন্যতম প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি ৮৪ সালেই তার খেলোয়াড় জীবনের শেষ ম্যাচের আগের ম্যাচেও আবাহনীর জার্সিতে হ্যাট্রিক করেন।
৮৫ সাল থেকেই তিনি আবাহনীর কোচ হন এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেখানেও সফলতার মুখ দেখেন। সেই বছর আবাহনীই সব কয়টা কাপ জিতে নেয়।
কিন্তু মনে হয়, বাফুফের সভাপতি হওয়ার উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেই পথ ঠিকভাবে পাড়ি না দেওয়ার জন্য পদে পদে সমালোচনার শিকার হয়েছেন এই ফুটবলীয় কিংবদন্তি।
বাফুফে সভাপতি হিসেবে কাজী মো. সালাউদ্দিন দায়িত্ব নিয়েছেন ২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল। তিনি দায়িত্ব নেয়ার ১৯ দিন আগে ঘোষিত ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০। গত ১১ জুন ঘোষিত সর্বশেষ র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৭ নম্বরে (বর্তমানে এই র্যাংকিং ১৮৬ )। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে-এই চার মাস ১৯৭ নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। সর্বশেষ র্যাংকিংয়ের হিসেবে কাজী মো. সালাউদ্দিনের সভাপতিত্বের এই ১২ বছরে বাংলাদেশ পিছিয়েছে ৭ ধাপ। তবে তার ক্ষমতাকালীন সময়ে একেবারেই যে দেশের ফুটবল জগত কিছু হয়নি, তা নয়। তার ক্ষমতাকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি উল্লেখিত ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরছি -
১) সাউথ এশিয়ান বিচ গেমস ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন, সুপার মক কাপে অনূর্ধ্ব-১৪ দলের প্লেটপর্বে চ্যাম্পিয়ন, মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৪ দলের দুইবার এএফসি আঞ্চলিক পর্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া, জোকি কাপ ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া এবং অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল দলের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্ব বা বিশ্বকাপ অনূর্ধ্ব-১৭ এর বাছাই পর্বে খেলার সুযোগ পাওয়া-ইত্যাদি।
২) মেসিসহ আর্জেন্টিনা দলকে ঢাকায় এনে নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলিয়ে চমক দেখিয়েছিল কাজী সালাউদ্দিন এবং তার কমিটি। এটা অবশ্যই সাংগঠনিক দক্ষতা।
৩) ঘরোয়া লীগ যেটা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ বলে পরিচিত সেটা গত ১২ বছরে অন্যান্য যে কোন সময় থেকে নিয়মিত।মাঠে ১২ মাসই খেলা ছিল লীগ বা অন্যান্য টুর্নামেন্ট এর মাধ্যমে। ফেডারেশন কাপ, স্বাধীনতা কাপের বাইরে ঘরোয়া ফুটবলে চমক জাগানো কোটি টাকার সুপার কাপও তিনবার আয়োজন হয়েছে কাজী সালাউদ্দিনের সময়ে। ১৬ বছর বন্ধ থাকা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ ২০১৫ সাল থেকে আবার নিয়মিতই হচ্ছে। সর্বশেষ ৬ বছরে জাতির পিতার নামে ৪টি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হয়েছে। প্রথমবারের মতো হয়েছে বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক ফুটবল ফুটবল টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশ যৌথ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লাওসের সঙ্গে।
৪) অনূর্ধ্ব-১৬ মেয়েরা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশকে রুখে দিয়েছে। প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-২৩ পুরুষ ফুটবল দল এশিয়ান গেমসের দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছিল। সেটা আবার কাতারের মতো দেশকে হারিয়ে। অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবল দল স্বর্ণ জিতেছে ২০১০ সালে ঢাকা এসএ গেমসে। ছেলেদের অনূর্ধ্ব-১৬ দল কাতারের মাটিতে কাতারকে হারিয়েছে ইত্যাদি।
৫) জাতীয় দলের উন্নয়নের স্বার্থে তিনিই প্রথম জাতীয় দলের জন্য বিদেশি কোচ নিয়োগ দেন। (বর্তমান জাতীয় দলের কোচ ইংলিশ জেমি ডে)। সালাউদ্দিন সাহেবই প্রথম দেশের বাইরে টুর্নামেন্ট এর সময় ছাড়াই থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর ইত্যাদি জায়গাতে জাতীয় দলের ক্যাম্প করান।
৬) ৪র্থ টার্মে জয়লাভ করেই নভেম্বরের ১৮ তারিখে বাফুফে সভাপতি হিসেবে নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের মুজিববর্ষ ফিফা ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল সিরিজ ২০২০ জয়ের সাক্ষী হন (২ ম্যাচের সিরিজে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ২ - ০ গোলে জয়লাভ করে, দ্বিতীয় ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হলে বাংলাদেশ সিরিজটি জিতে নেয়)। এই জয়ের ফলে বাংলাদেশের ফিফা র্যাংকিং ১৮৭ থেকে ১৮৬ হয় ।
এবার আসি, কাজী সালাউদ্দিনের বাফুফে সভাপতি হিসেবে সমালোচিত হওয়ার পিছনের কারণগুলো -
১) সালাউদ্দিন সাহেবের ক্ষমতাকালীন সময়ে ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ পিছিয়েছে ৭ ধাপ এবং এই ১২ বছরে ৬টি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ একবার শুধু সেমিফাইনাল খেলেছে। বাকি ৫ বার বিদায় নিয়েছে গ্রুপপর্ব থেকে। এ সময়ে ৪টি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট হলেও বাংলাদেশ মাত্র একবার ফাইনাল খেলেছে।
২) সালাউদ্দিন সাহেবের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা চোখে পড়ে পুরুষ জাতীয় ফুটবল দলের পারফরম্যান্সে। যেই ভূটানের আগে যেখানে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ২০০৮ সালে ড্র করে, সেই ভূটানই তার ক্ষমতাকালীন সময়ে ২০১৬ সালে এশিয়া কাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশকে ৩-১ গোলে হারায়। বাংলাদেশ আর ভূটানের মধ্যকার বাকী সবকয়টি ম্যাচের ফলাফলে বাংলাদেশই জয়ী।
৩) তার অন্যতম আরেকটি ব্যর্থতার চিত্র ফুটে ওঠে বাজেট বরাদ্দ হওয়ার পর খরচের হিসাব ঠিকমত না দেওয়ার জন্যও। ফুটবলের উন্নয়নের জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকা বিশেষভাবে বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু বাফুফে কেবল ১০ কোটি টাকা পেয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তির ১০ কোটি টাকা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) দেয়নি বাফুফেকে। কারণ, দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণকারী সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানকে প্রথম কিস্তির অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত পর্যাপ্ত কাগজপত্র দেখাতে পারেনি সংস্থাটি। এর জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে বাফুফের জন্য কোন টাকাই আর দেওয়া হয়নি ইত্যাদি।
বাংলাদেশী উঠতি বয়সী ফুটবলপ্রেমীরা ইউরোপ নির্ভর ফুটবল খেলা রাত জেগে দেখে তাদের আবেগের একটি বড় অংশ বানিয়ে ফেলেছে এই ফুটবল খেলাটিকে । বিশ্বকাপ, ইউরোকাপ, এশিয়ান কাপ, কনফেডারেশন কাপ ইত্যাদি বড় বড় আন্তর্জাতিক ফিফা ফুটবল টুর্নামেন্টগুলোতে ভিনদেশের জন্য চিল্লায়ে এরা হয়তো গলা ফাটায় ঠিকই কিন্তু এরা নিজ দেশের ফুটবল থেকেই ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে । এই বড় অংশের উঠতিবয়সী ফুটবলপ্রেমীদের নিজ দেশের ফুটবলে আগ্রহ বাড়িয়ে ফুটবলের টানে দেশীয় ফুটবল খেলা দেখতে টেনে আনাটাই দায়িত্ব কিন্তু অনেকাংশেই এই কাজি সালাউদ্দিন সাহেবের উপরই। তাই তো অসংখ্য সমালোচনার পরও ৪র্থ টার্মে তাকে জিতিয়ে ক্ষমতায় আনলেন বাংলাদেশী ফুটবল নিয়ে কাজ করা দায়িত্বশীল ১৩৯ জন ভোটার ।
২০২০ সালের ৩ই অক্টোবর প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৩৯ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দিতে আসে ১৩৫ জন । সেখানে আগের ৩ বারের চেয়েও প্রতিপক্ষ চেয়ে সর্বাধিক (৯৪ ভোট) পেয়ে নির্বাচিত হন কাজী সালাউদ্দিন সাহেব। তার প্রতিপক্ষ বাদল রায় পান ৩০ ভোট এওং শফিকুল ইসলাম মানিক পান ১ ভোট । যদিও পরাজিত প্রার্থীরা নির্বাচনে কারচুপি এবং ভোটারদের আগে থেকে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ তুললেও, প্রমাণের অভাবে সেই অভিযোগ ধোপে টিকেনি । নির্বাচন নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত বললেঃ নির্বাচনে ২১ পদের বিপরীতে মোট ৪৭ জন প্রার্থী লড়াই করেছেন; ভোটার ছিলেন মোট ১৩৯ জন। দুটো প্যানেল প্রকাশ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিল। একটি কাজী সালাউদ্দিন-মুর্শেদী সম্মিলিত ফুটবল পরিষদ, অন্যটি শেখ আসলাম-মহি সমন্বিত প্যানেল পরিষদ। নির্বাচনের ২১টি পদের মধ্যে সালাউদ্দিনের সম্মিলিত পরিষদ থেকে সবমিলিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ১৪ জন (সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, তিন জন সহ-সভাপতি ও নয় জন সদস্য)। অর্থাৎ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে তারা। অন্যদিকে, সমন্বয় পরিষদ থেকে ছয় জন সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছেন।
এই হচ্ছে সবমিলিয়ে কাজী সালাউদ্দিনের দেশীয় ফুটবলে অবদানের আদ্যোপান্ত । সফল কি অসফল, সেটা বড় প্রশ্ন নয়, বড় প্রশ্ন দেশীয় ফুটবল তার সময়ে কতটুকু পেয়েছে । তার সময়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে বেশকিছু উঠতি খেলোয়াড় উঠে এসেছে, বিদেশী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফুটবলাররা এ দেশীয় ফুটবলে আগ্রহ দেখিয়েছে, বিদেশী কোচ নিয়োগ হয়েছে । তবে তৃণমূল থেকে খেলোয়াড় উঠিয়ে আনতে তার ফেডারেশনের আগ্রহ ও দায়িত্ব পর্যাপ্ত নয় । তবে দেশীয় ফুটবল সমর্থকগোষ্ঠীরা যে এই কিংবদন্তীতুল্য ফুটবলারের সময়েই দেশীয় ফুটবলের অভাবনীয় সাফল্য দেখবেন বলে ২০০৮ সাল থেকে আশা করে আছেন, তা ২০২১ সালে এসেও সে হারে পূরণ হয়নি । এখন সামনের দিনগুলোতে তিনি তার বর্তমান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে দেশীয় ফুটবলকে কতদূর নিয়ে যান, সেটাই এখন দেখার বিষয়..
তথ্যসূত্
১) জাগোনিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কম
২) সময়নিউজ ডট কম
৩) ডেইলি স্টার
৪) বাংলাদেশ জার্নাল
৫) উইকিপিডিয়া
৬) ফেসবুক
(বাংলাদেশী ফুটবল নিয়ে পরবর্তী ফিচার পর্বে চোখ রাখুন)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:৪১