বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কোনটি? এই প্রশ্ন যে কাউকে করা হলে উত্তর একটাই আসবে ক্রিকেট। জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু কিংবা হকি, ফুটবল ইত্যাদির নাম কারও মুখ থেকেই বের হবে না। আর সেটা হবেই বা না কেন!! ক্রিকেট দিয়ে বাংলাদেশ যে বিশ্বের দরবারে নিজেদের পরিচিত করতে পেরেছে, সেরকম আর কোন খেলা দিয়েই পারেনি। কিন্তু এই দেশে কিন্তু ফুটবলের ক্রেজ একেবারে কম না। এর প্রমাণ উঠতি বয়স থেকে শুরু করে মধ্যবয়সীদের বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে ক্লাব ফুটবলের প্রতি উন্মাদনা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই হালের ফুটবল ফ্যানরা নিজ দেশের ফুটবল সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন প্রায় শ্যূন্যের কোটায়।
এই জন্য কয়েকটি পর্ব আকারে বাংলাদেশীয় ফুটবল সম্পর্কে জানার ও জানানোর চেষ্টা করবো। ১ম পর্বে হাইলাইট করা হয়েছে ইংলিশ কোচ জেমি ডে বাংলাদেশের কোচ হওয়ার পর বিদেশি বংশদ্ভূত বাংলাদেশী ফুটবল খেলোয়াড়দের এই দেশের ফুটবল নিয়ে আগ্রহ এবং এমনকি তাদের কারো কারো এই দেশে খেলার আগ্রহ নিয়ে। তাহলে শুরু থেকেই শুরু করা যাক।
১৯৭২ সালে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। দুই বছর পর ১৯৭৪ সালে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) সদস্য হয় বাংলাদেশ এবং ফিফার সদস্য পদ পায় আরো দুই বছর পর ১৯৭৬ সালে। ১৯৯৭ সালে আঞ্চলিক সংস্থা সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (সাফ) গঠিত হওয়ার শুরু থেকেই বাংলাদেশ সদস্য। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ র্যাংকিং ছিল ১১০, যেটি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। প্রায় দুই যুগ অর্থাৎ ২৪ বছরে সর্বনিন্ম র্যাংকিং ছিল ১৯৭ (২০১৮ সালে)। বর্তমানে এটি ১৮৬ (সম্প্রতি মুজিববর্ষ ফিফা ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল টুর্নামেন্টে নেপালকে ৩ ম্যাচের সিরিজে ২ - ১ ম্যাচে হারিয়ে বাংলাদেশের র্যাংকিং ১৮৭ থেকে এক ধাপ উন্নীত হয়ে ১৮৬ হয়)। অর্থাৎ দেশের ফুটবলের অবস্থা যে কেউই র্যাংকিং দিয়েই অনুমান করে নিতে পারে।
দেশের ফুটবলের শুরু থেকেই কাজী সালাউদ্দিন, বাদল রায়, আলফাজ, এমিলি, মামুনুল ইত্যাদি ফুটবল তারকা দ্বারা দেশীয় ফুটবল সম্বৃদ্ধই ছিল কিন্তু ২০১৮ সালে ইংলিশ কোচ জেমি ডে কোচ হয়ে আসার পর দেশের ফুটবলে অন্যরকম একটা উন্নতির হাওয়া আসতে শুরু করে।
জেমি ডে খোঁজ নিতে শুরু করে বিদেশী বিশেষ করে ইউরোপে থাকা বাংলাদেশী বংশদ্ভূত কোন ফুটবলারকে যদি দেশে ফিরিয়ে আনা যায়। তার ডাকে প্রথম সাড়া দেয় ডেনমার্কে থাকা বাংলাদেশী বংশদ্ভূত জামাল ভূঁইয়া। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক।
জামাল ভূঁইয়া - জামাল ভূঁইয়া বাংলাদেশে আসার আগে ডেনমার্কের প্রথম সারির ক্লাবদল Brøndby IF এর খেলোয়াড় ছিলেন, মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি ডেনমার্কের বিখ্যাত ক্লাব F.C. Copenhagen (FCK) এর বিপক্ষে গোল করে সবাইকে অবাক করে দেন । মাতৃভূমির প্রতি টান অনুভব করে তিনি ২০১৩ সালে বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশের হয়ে তার অভিষেক ঘটে ৩১ই আগস্ট, ২০১৩ সালে নেপালের বিপক্ষে । বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল এর অধিনায়ক ।
তারেক রায়হান কাজী - জামাল ভূঁইয়ার পর ২য় প্রবাসী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় দলে নাম লেখান এই খেলোয়াড়। ফিনল্যান্ডের লীগে খেলা এই ফুটবলার বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় দলে একজন পরীক্ষিত ডিফেন্ডার।
তারা দুইজন ছাড়াও বেশ কয়েকজনের সাথে জেমি ডে ম্যানেজমেন্টের নিবিড় যোগাযোগ চলছে। এরা হচ্ছে -
ফরিদ আলী - পোল্যান্ড প্রবাসী ফরিদ আলী। বর্তমানে ফরিদ খেলছেন পোল্যাল্ডের সেকেন্ড ডিভিশনে। ক্লাব জিকেএস জাস্টরজেবির হয়ে খেলছেন তিনি। এর আগে ২০১৫ সালে ইউক্রেন প্রিমিয়ার লিগে মেটালার্ফ জাপোরিজিয়া ক্লাবের হয়ে অভিষেক হয় ফরিদের। ২০১৬ সালে পোল্যান্ডের ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন। তিন বছর ধরে এখানেই খেলছেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে
ইতোমধ্যে ইউক্রেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফরিদ আলীর দিকেই নজর জেমির। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের এই লড়াইয়ে তাকে দলের সঙ্গে সামিল করতে উঠে পড়ে লেগেছেন কোচ।
জিদান মিয়া - যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের স্পোর্টিং ইউনাইটেড সকার ক্লাবের হয়ে দুর্দান্ত খেলছেন জিদান মিয়া। জামাল ভূঁইয়ার উত্তরসূরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে তারও।
হামজা চৌধুরী - লম্বা ঝাকড়া চুলের ইপিএলের দল লেইচেস্টার সিটির মিডফিল্ডার হামজা চৌধুরী বাংলাদেশী ফুটবল ফ্যানদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
ইংল্যান্ড প্রবাসী এই ফুটবলারের অদূর ভবিষ্যতে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পাবার সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও তিনি বাংলাদেশের হয়েও খেলার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
রিদওয়ান হান্নান - অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ক্যানবেরা একাডেমির হয়ে খেলছেন ২০ বয়সী তরুণ ডিফেন্ডার রিদওয়ান হান্নান। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার এএফসি ক্লাবের হয়ে খেলছেন তিনি। অসাধারণ ক্ষিপ্রতা, ট্যাকলিং এবং মাঠের চতুর্দিকে পাস দিতে পারার সক্ষমতার কারণে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় ক্রেইগ ফোস্টার তার বিষয়ে বলেছিলেন, ‘তার গতি, টেকনিক্যাল এবিলিটি আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা যেকোনো দলের জন্য সহায়ক হবে।’
সামিত বোস - কানাডিয়ান প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ২১ বছরের এই ফুটবলার এখন মেজর সকার লীগ তথা এমএলএসে খেলা প্রথম বাংলাদেশি। মেজর লিগের কানাডিয়ান ক্লাব মন্ট্রিয়াল ইম্প্যাক্টের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। এর আগে খেলে এসেছেন কানাডার বিভিন্ন স্তরের ফুটবল।
রিসায়াত ইসলাম খাতন - ২০১৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ডাকে সাড়া দিয়ে অনুশীলন করেছিলেন তিনি। ইনজুরি ছিটকে দিয়েছিল লাল-সবুজ বাহিনী থেকে। এরপর ২০১৫ সালে এসে ফের জাতীয় দলে অনুপ্রবেশ। সেবার দেশের জার্সি গায়ে চাপিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু অভিষেক হয়নি তার। কি এক অদৃশ্য কারণে বাংলাদেশের ফুটবলে ‘নির্বাসিত’ ফুটবলার তিনি। সেই ফুটবলারটি রিয়াসাত ইসলাম খাতন। এখন ইউরোপের এক শীর্ষ পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করে জ্যামাইকান শীর্ষ লিগে নাম লিখিয়েছেন।
বর্তমানে জেমি ডে এর রাডারে এই প্রবাসী ফুটবলাররাই আছেন। অনেকেই মনে করেন, এইসব প্রবাসী ফুটবলারদের দেশের বাইরে থেকে না নিয়ে এসে তৃণমূল পর্যায় থেকে আমাদের দেশীয় উঠতি ফুটবলারদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষণ করলেও তো আমাদের দেশীয় ফুটবলের উন্নতি হয় । এই ধারণা মোটেও অমূলক নয় কিন্তু পরীক্ষিত প্রবাসী ফুটবলারদের নিয়ে এসে বর্তমানে সংকটে থাকা দেশীয় ফুটবলের হাল যদি একটু উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তাতে ক্ষতি নেই । তাছাড়া তৃণমূল পর্যায় থেকে খাঁটি সোনা বেছে আনার মত জুহুরিদের অভাব নেই যদিও কিন্তু ফেডারেশনের আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতা এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নয় ।
এর আগে বেশ কয়েকজন আফ্রিকান ফুটবলার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে জাতীয় দলে খেলার ইচ্ছা পোষণ করেছেন কিন্তু অনেকেই মনে করেন এতে দেশীয় ফুটবল সংস্কৃতি নষ্ট হতে পারে। বাবা কিংবা মায়ের বদৌলতে এ দেশের প্রতি টান থাকা ঐসব প্রবাসী ফুটবলাররা নাকি শুধুমাত্র টাকা ও স্ট্যাটাসের লোভে খেলে যাওয়া আফ্রিকান ফুটবলাররা - কারা বাংলাদেশের জন্য কতটুকু কার্যকর হবে এখন সেটাই ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
তথ্যসূত্রঃ সারাবাংলা ডট কম ও ফেসবুক
[বাংলাদেশী ফুটবল নিয়ে জানতে পরবর্তী ফিচার পর্বে চোখ রাখুন)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:২৪