ছেলেটি প্রায় প্রতিদিনই মাঠে আসে । সূর্যি মামা যখন প্রায় হেলে পড়বে বলে ইশারার অপেক্ষায় থাকে মানে বিকেল বেলায় ঠিক এই পার্কেই প্রতিদিন এই ছেলেকে দেখা যায় । ছেঁড়া একটি গ্যাঞ্জি আর ময়লা একটি হাফ জিনসের প্যান্ট পড়া অবস্থায় । ছেলেটার বয়স আন্দাজ করলে বার কিনবা তের হবে । স্পষ্টই বুঝা যায় ছেলেটির মধ্যে এক আশ্চর্য মায়া কাজ করে । সহসা এই মায়া যেন কাছে টানে । ছেলেটির চোখ সবসময় একদিকেই বদ্ধ থাকে । আর এই জিনিসটাই অস্বাভাবিক । এলাকার ছেলে-ছোকরারা এই পার্কের মাঠে এসে ফুটবল খেলে বিকেল বেলাতে । ছেলেটা সবসময় দাড়িয়ে দাড়িয়ে সেই ফুটবল খেলা দেখে । ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে খেলা দেখতে দেখতে ছেলেটার মুখ অবয়বে অনেকগুলা সূক্ষ্ম অনুভূতি ফুটে উঠেছে । এই কিছুক্ষণের খেলাতেও যেন প্রাণ ফিরিয়ে আনে ছেলেটা । কোন দল যখন গোল করে তখন আনন্দে লাফিয়ে উঠে সে । আবার কেউ গোল মিস করলে তার মুখে হতাশা আর আফসোস দুটোই দেখা যায় । আবার কেউ ফুটবলটিতে ভালো একটি শট দিলে তার মুখে চওড়া হাসি দেখা যায় । ছেলেটা যেন এলাকার এই সামান্য ফুটবল খেলার মাঝেই নিজস্ব ভুবন তৈরি করে ফেলেছে ।
রফিক সাহেব প্রতিদিন এই ছেলেটিকে খেয়াল করেন । প্রায় তিনমাস আগেই হঠাৎ করেই তার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে । আসলেই খুব কম বয়সেই এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি । কতই বা বয়স হবে তার । ৪২ কিংবা ৪৪, এর বেশি নয় । আসলে হয়তো রোগটি ধরাই পড়তো না । তিনি গিয়েছিলেন তার ডাক্তার বন্ধু সেলিম সাহেবের সাথে দেখা করতে সেলিম সাহেবের চেম্বারেই । সেইদিনই আবার সেলিম সাহেবের সাথে রফিক সাহেবের প্রায় দশ বছর দেখা । কারণ রফিক সাহেব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট করেই জার্মানী পাড়ি জমান । দেশ থেকে বাইরে যাওয়ার পর আর যোগাযোগ হয়নি দুই বন্ধুর মধ্যে । অবশ্য রফিক সাহেব তিন বছর পরেই দেশে ফিরে আসেন । দেশে আসার বছরেই চাকরী নেন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে । তার পরের বছরে বিয়ে করেন তার এক বন্ধুর ছোট বোন শিলাকে । তাদের ঘরে এখন এক সন্তানই । রাফসান । কিন্তু আফসোস, রাফসান ছোটবেলা থেকেই পঙ্গু । এখন রাফসানের বয়স দশ বছর । হুইল চেয়ার ছাড়া সে চলাচল করতে পারে না । এই কারণেই রফিক সাহেব সবসময় অত্যাধিক টেনশনে থাকেন । আর এই টেনশনের কারণেই বন্ধুর সাথে চেম্বারে দেখা করতে যান তিনি । সেদিনই সেলিম সাহেব কথায় কথায় তার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করেন । সেই পরীক্ষাতেই রফিক সাহেবের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে । তার পরদিন থেকেই সেলিম সাহেবের পরামর্শেই দৈনিক দুইবেলা করে এই পার্কেই হাঁটেন তিনি । সকালে এবং বিকেলে । এই পার্কটি তার বাসার পাশেই অবস্থিত । মাঝে মাঝেই রফিক সাহেব রাফসানকে নিয়ে আসেন হাঁটার সঙ্গী হিসেবে । রাফসান তো আর হাঁটতে পারেনা । রফিক সাহেব রাফসানের হুইল চেয়ার ঠেলেন আর রাফসানকে নিয়ে হাঁটতে থাকেন ।
তিনি এই ছেলেটিকে খেয়াল করছেন আজ প্রায় পনেরদিন হল । রোজ ভাবেন ছেলেকে ডেকে কথা বলবেন কিন্তু এরপরেই আবার ভুলে যান । তাছাড়া ছেলেটিও বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলেই গায়েব হয়ে যায় । তখন তাকে আর এই পার্কে পাওয়া যায়না । ছেলেটা কে, কোথা থেকে আসে প্রতিদিন বিস্তারিত শুনা দরকার ভাবলেন রফিক সাহেব । কিন্তু আবার ভাবলেন ছেলেটি সম্পর্কে এত জানতে আগ্রহী কেন তিনি । তাই আজও কথা না বলে তিনি রাফসানকে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন । যথারীতি প্রায় সন্ধ্যার দিকে ঐ জায়গাটিতে এসে তিনি আর ঐ ছেলেটিকে খুজে পেলেন না । রাতে তিনি ছেলেটির কথা বললেন শিলা আর রাফসানকে । তিনি জানালেন ছেলেটার প্রতি কেন জানি তার অনেক অনেক মায়া কাজ করে । তিনি ছেলেটির জন্য কিছু করতে চান । শিলা জানে তার স্বামী আর রাফসান জানে তার বাবা অনেক অনেক ভালো মানুষ । এই দুনিয়াতে এমন ভালো মানুষ খুজতে গেলে খুব কমই পাওয়া যাবে । তাই তারাও রফিক সাহেবের কথায় তাকে সমর্থন দিল । রাফসান এতদিন জানতো না তার বাবা পার্কে এমন একটি ছেলেকে রোজ খেয়াল করেন । এখন সে যখন ছেলেটি সম্পর্কে জানতে পারল তখন সে ছেলেটিকে দেখার ইচ্ছাপোষণ করলো । তাই রাফসানকে নিয়েই পরেরদিন রফিক সাহেব পার্কে হাঁটতে গেলেন । তিনি পার্কে গিয়েই প্রথম রাফসানকে নিয়ে ঐ জায়গাটিতে গেলেন যেখানে ছেলেটি রোজ দাড়িয়ে ফুটবলখেলা দেখে । আজ ছেলেটি সেখানে নেই । মাঠেও ফুটবল খেলা হচ্ছে না । রফিক সাহেব বুঝলেন না কেন আজ খেলা হচ্ছে না, আবার কেনইবা ছেলেটি আজ নেই । এই ষোল দিনের মধ্যে আজ প্রথম তিনি বিকেল বেলাতে ছেলেটিকে পার্কে দেখতে পেলেন না । রফিক সাহেব চিন্তা করতে করতে হাঁটতে লাগলেন । রাফসান রফিক সাহেবকে খেয়াল করল এবং ব্যাপারটা বুঝতে পারল । তাই সে রফিক সাহেবকে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না । আবার পরেরদিন রফিক সাহেব ছেলেটিকে পের্কে দেখতে পেলেন । আজও তিনি রাফসানকে নিয়ে পার্কে হাঁটতে এসেছেন । রফিক সাহেব ছেলেটিকে শেষ পর্যন্ত ডাকলেন । ছেলেটি রফিক সাহেবকে খেয়াল করলো এবং তার ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এল ।
- নাম কি তোমার ?
- জী, ছামছু ।
- কি করো ?
- জী, পাশেই একটি খাওয়ার হোটেলে কাজ করি ।
- বাড়িতে কেউ নেই ?
- বাপ-মা মইরা গেছে । বড় ভাইটা না বইলা বাড়ি থেকে ভাগছে আর বড় আপা এক মাস্তানের লগে পলাইছে । কেউই আর ফিরে আসেনি ।
- থাকো কোথায় ?
- হোটেলেই ঘুমাই ।
- এইখানে কি করো প্রতিদিন ?
- ফুটবল খেলা দেখি ।
- কেন ?
- এই ফুটবল খেলা আমার খুব ভাল্লাগে । আমার বড় ভাই আমারে শিখাইছিল । আমি খুব ভালো খেলতে পারি । গোল দিতে পারি । আমার খেলা দেইখা আমাগো এলাকার বারেক ভাই আমারে তার খেলার স্কুলে ডাকছিল । কিন্তু আমি যাওয়ার পর আমারে তাড়ায়ে দিছে ।
- কেন ?
- বারেক ভাই আমারে জুতা কিন্না আনতে কইছিল । আমার তো টাকা নাই । তাই আমি কিনতে পারি নাই । এর লাইজ্ঞা আমারে তাড়ায়ে দিছে ।
- তুমি কি এক জোড়া জুতা পেলে আবার ফুটবল খেলা শুরু করতে চাও ?
- আমাগো হোটেলের মালিক খুব ভালা লোক । সে আমারে কইছে আমি খেলতে চাইলে সে আমারে মানা করবো না । কিন্তু আমি জুতা পামু কই । তাই আমি ভাবছি আমি কোনদিন আর ফুটবল খেলুম না । তয় দেখুম । দেখতে তো আর কিছু কিনা লাগবো না আর টাকাও খরচ হইবো না ।
- যদি আমি তোমারে কিনে দেই, তোমার চলবে ?
- আপনে কেন কিন্না দিবেন ? আমি আপনের কি হই ?
- দেবো । আমি তোমাকে জুতা কিনে দেব । তুমি সেই জুতা পড়ে ফুটবল খেলবে । অনেক সুন্দর খেলবে । আমি তো কোনদিন আমার ছেলের জন্য জুতা কিনতে পারিনি । কিন্তু আজ আমি তোমাকে জুতা কিনে দেব ।
রফিক সাহেবের চোখে পানি । রফিক সাহেব খেয়াল করলেন হুইল চেয়ারে বসে রাফসানও কাঁদছে । ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে । ছামছু বুঝতে পারেনা এত বড় ভালো মানুষটা কেন কাঁদছে । আর হুইল চেয়ারে বসা তার বয়সী ছেলেটাই বা কেন কাঁদছে । তার কাছে এসব আশ্চর্যই ঠেকে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৪