মাঝ রাত পার হয়েছে একটু আগে। একটু দূরে সিঙ্গাপুর বন্দর আর আর শহরের আলো গুলো দেখে সেটা বুঝার উপায় নেই। অসখ্য আলোয় আকাশের ধূসর মেঘ গুলো রহস্যময় হয়ে আছে। ঠিক রাতের আমেজটা যেন মনের মাঝে আসে না। আমার ডিউটি শুরু রাত ১২টায়। জাহাজে চাকরিতে রাত দিন টা ঠিক ক্যালেন্ডার আর ঘড়ির মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। তার পরও রাতে ইঞ্জিন রুম এ একা একা থাকতে থাকতে অসঙ্খ্য মেশিনের মাঝে, নিজেকেও মাঝে মাঝে লোহা লক্কর এর যন্ত্র বলে মনে হয়। তাই ডেক এ দাড়িয়ে খোলা সমুদ্রের মাঝে নিজেকে একটু অন্যভাবে দেখতে ভাল লাগে। কিছুক্ষনের জন্য যেন নিজেকে সবকিছু থেকে আলাদা করে অধরা এক জগতে খুজে পাই।
আজ মনটা একটু খারাপ। আমার জাহাজ এর আমি ছাড়া, একমাত্র বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন স্যার চলে গেছেন। পদের দিক দিয়ে অনেক উঁচুতে হলেও বাঙালি হিসেবে তিনি আমার পাশে আছেন, এটা ভাবতেই ভাললাগত। একটু হলেও মনের কথা বলতে পারতাম, আজ থেকে সেটাও হবে না। দুজনে বাংলাদেশের খেলা নেট এ লাইভ আপডেট দেখেছি বসে বসে, সম্মানের দুরত্ব বজায় রেখে সে কি আমাদের টেনশন বাংলাদেশ পাকিস্তান এশিয়া কাপ ফাইনাল ম্যাচ এর সময়। কত কথা। সব স্মৃতি যেন একসাথে ভীর করছে। তবে যাওয়ার আগে উনি আমাকে শ খানেক ই-বুক দিয়ে গেছেন। উনি জানতেন আমার বই পড়ার অভ্যাস এর কথা। বললেন এগুলো পড়তে থাক দেখ সময় কেটে যাবে। সেটা মনে হতেই ডেক থেকে ইঞ্জিন রুম এ আসলাম। মেশিনারিজ গুলো রুটিন চেক করে কম্পিউটার এর সামনে বসলাম।
হুমায়ুন আহমেদ আমার বরাবরই প্রিয় লেখক। প্রথমেই শুরু করলাম তার বই দিয়ে।
একটু একটু করে পড়ি। আগেও পড়েছি কিন্তু এ পড়ার ধরন টা আলাদা। আগে হয়ত অত মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারিনি। আর এখন পড়ছি সবটুকু আবেগ দিয়ে। একটা গল্প শুরু করি সেই সাথে নিজেও ঢুকে পরি সেই গল্পের মাঝে। একা একা আগে শুধু খারাপ লাগা ব্যাপার গুলোই ভাবতাম, বই পড়া শুরু থেকে ভাবনায় পরিবর্তন এল। যেখানে বই শেষ করে রাখি সেই যায়গা নিয়ে সারা দিন মনে মনে ভাবি। চরিত্র গুলো হয়ে নিজে নিজেই নিজের সাথে কথা বলি। খারাপ লাগা ব্যাপারটাই আর থাকে না আমার মাঝে। সেখানে খুজে পাই অন্য এক জগত। কোন কিছু নিয়ে চিন্তার, ভাললাগার ভালবাসার বা কোন ঘটনাকে অন্যভাবে দেখার সে অনুভূতি সত্যি লেখার বা মুখের ভাষায় প্রকাশ করার মত না। কখন কল্পনায় হুমায়ুন আহমেদ স্যার এর সাথে কথা বলি, কথা গুলো কিছুটা এ রকম,
“স্যার আপনার শেষ লেখা গুলোতে কেমন একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি”
“ পরিবর্তন ত আসবেই, তবে শেষ লেখা গুলো আসলেই অন্যরকম হচ্ছে সেটা আমিও বুঝতে পারছি”
“ পরিবর্তনে আমি কিছুর একটা আভাস পাচ্ছি স্যার যেটা আমি মনে প্রানে চাচ্ছি, না ঘটুক।”
“ কিসের আভাস পাচ্ছ?”
“ আমি বলতে পারব না স্যার, অনেক ক্ষেত্রেই এমন টা সত্যি হয়েছে, সেটা কাকতালিয় বলেই আমি বিশ্বাস করি”
“ তোমার বিশ্বাস এ কিছু যায় আসবে না, প্রকৃতি মাঝে মাঝে কাউকে কিছু বুঝিয়ে দেয়”
“ স্যার এটা আপনি বিশ্বাস করেন?”
“ আমি বিশ্বাস অবিশ্বাস করার কেউ না।”
“ হিমু যা বলে সেটা সত্যি হয়ে যায়, কিন্তু সেটাও ত যথেষ্ট যুক্তি বিশ্লেষন করে, আমার ব্যাপারটা ত এমনই এসেছে মনের মাঝে।”
“ মানুষ তার পারিপার্শিক থেকে যুক্তি বিশ্লেষন শেখে, কেউ কেউ সেটা অবচেতনে করে ফেলে, সেটা কে অনেকেই অন্যরকম পাওয়ার বলে চালিয়ে দেয়, অনেকে সেটা বিশ্বাস করতে চায় না”।
“স্যার আমার সত্যিই ভয় করছে”
হেসে বলেন স্যার, “ ভয় পাওয়া টা ভালবাসার একটা অংশ”
“ হয়তবা, স্যার আপনি কিছু বুঝতে পারছেন?”
“ আমি সব সময়ই নিজেকে বুঝতে চেষ্টা করেছি, এটাও আমার অজানা নয়, ভয়ের কিছু নেই, কোন ঘটনাতেই অবাক বা বিস্মিত না হয়াটা ভাল”
“ সেটা আমি মনে প্রানে মেনে আসার চেষ্টা করি স্যার”
এ রকম আরো অনেক কথা বলি। একবার রাগ করেছিলাম, বলেছিলাম “স্যার আপনি আমার একটা ঈদ মাটি করে দিয়েছেন”
স্যার বলল “কিভাবে?”
“তখন আমি ছোট ঈদ মানেই আপনার নাটক, সিনেমা আর সেটা দেখা ঈদ এর আনন্দের অবশ্য একটা অনুষঙ্গ ছিল, আপনার লাল পিরান দেখে সেই ঈদে আমি আর ঠিক থাকতে পারি নি। প্রথমে লেপের মাঝে মুখ লুকিয়ে কেদেছি, পরে লুকিয়ে লুকিয়ে কেদেছি”।
স্যার বললেন “আমিও”।
আমার এবার অবাক হবার পালা, “ আপনিও?”
“ হ্যা, আমি যদি মানুষ এর মনের কথটা না বুঝতে পারি সেটা লিখতে পারি না, সেখানে কান্না আসলে কাদি, সত্যিকার এর কান্না”।
“ এ এক অন্যরকম ব্যাপার স্যার, তাই না?”
“ কি অন্য ব্যাপার দেখলে?”
“ এই দেখুন আমরা এই জিনিসটা দেখে কষ্টে কাদছি, আদতে এ এক ভাললাগা অন্যরকম এক মনের সন্তুষ্টি”
“ ব্যাপারটা এ রকম ও হতে পারে আবার হতে পারে আমরা মানুষ তাই আমাদের অনুভুতির প্রকাশ গুলো আমাদের মত”।
এমন অনেক কথা তার সাথে আমার প্রতিদিন হয়। কখন শান্ত সাগরে হিমু হয়ে যাই। কল্পনায় হলুদ পাঞ্জাবি পরে হাটা হাটি করি। সাগরের জোস্না দেখি। সে সৌন্দর্যের কথা আমি জানিনা কোন ভাষায় প্রকাশ করা যায় কি না। এর জন্য কোন ভাষাকেই আমার যথেষ্ট মনে হয় না। ফেনিল সাগরে চার দিক এক মায়াময় আলোয় ঢেকে থাকে। জাহাজ এর ইঞ্জিন এর শব্দকে ছাপিয়ে ঢেউ এর শব্দের সাথে সে এক অন্যরকম ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি করে। নাবিক হিমু তখন হুমায়ুন আহমেদ এর সাথে কিছুটা তর্ক শুরু করে। বলে,
“ আপনি শুধু জঙ্গলেই জোস্নার সৌন্দর্যের কথা ফলাও করে বললেন, সাগরের এ সৌন্দর্য কি আপনি দেখেন নি?”
স্যার হেসে বলে “ দেখেছি”
“তাহলে আমাকে শুধু জঙ্গলে কেন পাঠালেন জোস্না দেখতে?”
স্যার একটু রহস্য করে বলে “ সাগর জঙ্গল এর মাঝে এক যায়গায় কিন্তু মিল আছে”।
হিমু বলে, “ যে মিলই থাকুক, আমাকে সাগরে না পাঠানোর কারন কি?”
স্যার উত্তর দেন, “কে বলল পাঠাই নি?”
“আমি বলছি”।
স্যার হেসে বলেন “ হিমু, তুমি ত সমুদ্রের জোস্নার নিচে থেকেই কথা বলছ”।
“ তা বললেও আপনার হাত ধরে আসলে ত অন্য কিছু সৃষ্টির স্বাধ পাওয়া যেত”।
স্যার বলেন “আমি ত কিছু সৃষ্টি করি না সৃষ্টির বর্ননা দেই মাত্র, তুমি যা দেখছ সেটাই ত হিমু দেখে, আর আমার কলম সেটাই লেখে”।
“ স্যার আমি হিমুর ভাব ধরেছি, কিন্তু সেই হিমু কি আমি হতে পারব, না তার সাথে আমার কোন তুলনা চলে?”
“ আমি তোমাদের মাঝ থেকেই হিমু কে নিয়েছি, তোমাদের সব সত্ত্বার একক সে, তুমিও তার বাহিরে নও”।
স্যার এর এক কথায় আমি যেন আলাদা এক অনুভূতি পাই। নিজেকে হারিয়ে অন্য এক আমি হয়ে উঠি। আর স্যার চশমার ফাকে চোখ রেখে আমার দিকে মুচকি হাসেন। তিনি ডেকে বলেন “তোমার ঐ গানটা মনে আছে?”
“ কোন গানটা স্যার”
“ উকিল মুন্সির, পুবালি বাতাসে, বাদাম তুইলা চেয়ে থাকি, আমার নি কেউ আসে............”
“ মনে আছে স্যার, এ গান কি ভোলা যায়?”
“ সে টা মনে কর ভাল লাগবে”
আসলেই মাটির পৃথিবী থেকে অনেক দূরে জোস্না ভরা রাতে জাহাজ এর ডেক এ দাঁড়িয়ে মনে মনে গানটা মনের মাঝে বাজাই। আপন জনের অপেক্ষায় সত্যি এক অদ্ভুত ভালোলাগা মনে দোলা দিয়ে যায়। অপেক্ষা কষ্টের হলেও আসলে জীবনে কষ্ট ব্যাপার গুলো গোলমেলে। এই অপেক্ষাতেই যেন বুঝতে পারি আপনজনের মায়া। কাছে থেকে কি বুঝতাম এত গভীর ভাবে?
এভাবেই দিন কেটে যায় রাত কেটে যায়। কখন মিসির আলী হয়ে জাহাজ এর নানা সমস্যা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করি। কখন নতুন কোন দেশে হিমু হয়ে রাস্তায় হাটাহাটি করি। মানুষ দেখি, ভাষা বুঝি না কিন্তু তাদের হাসি কান্না বা মুখের অবয়বে অনেক ভাষা পড়ার চেষ্টা করি। কখন রূপা কে কল্পনা করি। ভাবি রূপার সাথে বসে জোস্না দেখব জাহাজে। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন।
রূপার কথায় ভাবছি বলে আমা একটু লজ্জা হয়, অনুযোগের সুরে বলি “ স্যার আমি কিন্তু রূপাকে চাই”
স্যার বলেন “তাত চাইবেই”।
“মহা মানব তৈরির স্কুলের ছাত্র হিসেবে ত সেটা আপনি বন্ধ করে রেখেছেন”
“ খোলা রাখলে ত এত করে চাইতে না হিমু”
হিমু ডাকে আমি ফিরে তাকাই, তার মুখে রহস্যের হাসি। আমি বলি “স্যার আপনি কিন্তু এ বিভ্রান্ত হাসি দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছেন”
স্যার বলেন “ হিমু, রুপাকে তুমি কল্পনা করছ, কল্পনা টা সত্যিই হয়ে গেলে কতটা ভাললাগবে সেটা তুমি কল্পনাতেও আনতে পারবে না, রুপাকে খোজ অন্তরের চোখে”।
আমি যেন কিছু একটা বুঝতে পারি তার কথায়। মাথা নারি শুধু, স্যার হাসেন।
আমি বলি “ স্যার জানেন, কত দিন গরম ভাতের সাথে বেগুন ভাজা আর তার উপরে ঘি ঢেলে খাই না?”
স্যার আমার দিকে ভ্রু কুচকে বলেন “ তুমি ত দেখছি আমার ক্ষুধা বাড়িয়ে দিলে”
আমি বলি “আপনিও ত সবখানে এ খাবার এর কথা বলে আমাকে পাগল করে রেখেছেন”।
স্যার বলেন “ ঠিক আছে আমি বলে আসি আজ যেন বেগুন ভাজা করে, আর স্টকে ঘি আছে একটা ভোজ হয়ে যাবে দুপুরে”।
আমি বলি “আমি করব?”
স্যার উত্তর দিতে দিতে উঠে পরেন বলেন “ তোমার মা তোমার জন্য বেগুন ভাজা করবে চিন্তা কর না”।
স্যার উঠে গেলে মা কে ফোন দেই। বলি দেশে আসলে আমাকে বেগুন ভাজা আর ঘি দিয়ে ভাত খাওয়াবে। মা হাসেন বলেন খাওয়াব বাবা চিন্তা কর না। আমি সান্তনা পাই।
আর কদিন পর দেশে যাব। স্যার নেই। মনে মনে ভাবি না আমি বেগুন ভাজা আর ঘি দিয়ে ভাত খাব না। স্যার আমাকে ধমক দিয়ে বলেন “আমি নেই কে বলল?” আমি অশ্রু ভেজা চোখে স্যার এর দিকে চেয়ে থাকি। তিনি আমার কাছ থেকে কথা নেন আমি যেন অবশ্যই মা র হাতে র বেগুন ভাজা আর গরম ভাতে ঘি ছড়িয়ে খাই। আমি শুধু মাথা নাড়ি।
সত্যি তিনি আছেন। তাকে অনুভব করি ঠিক আগের মত। কথা বলি তর্ক করি। আমার নিঃসঙ্গ সময় গুলো তিনি সাজিয়ে দিয়েছেন। এ অনুভূতি কতটা প্রবল তা আমি বুঝাতে পারব না। তার সাথে জোস্না দেখার সময় গুন গুন করে গাই
“ ও কারিগর
দয়ার সাগর, ও গো দয়াময়
চান্নি পসর রাইতে যেন
আমার মরন হয়”।