ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সংসারে মা আর এক স্কুল পড়–য়া ছোট বোন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সেনারা তার স্কুল মাস্টার বাবাকে ধরে নিয়ে যায় একদিন। দুই দিন পর বাবার লাশ পাওয়া যায়, গ্রামের পাশে এক ধান ক্ষেতের মধ্যে। হাত পা বাঁধা অবস্থায়। তার বাবার অপরাধ ছিল তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে আশ্রয়, প্রশ্রয় আর সহযোগিতা করেছেন। সেই ছেলেটির তখন ৬/৭ বছর বয়স। সেই থেকে রাজাকার আর পাকিস্তানীদের প্রতি ছেলেটির তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা। কী বা করতে পারে অতটুকুন ছেলেটি !
সেই ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালায়। প্রতিমাসে মা’কে গ্রামে সামান্য কিছু টাকাও পাঠায়। তার পাঠানো টাকা আর মায়ের সেলাই থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে মা আর বোনের ছোট সংসারটা ভালোই কেটে যায়। ছেলেটির রুমমেট এক বিদেশি ছাত্র। খুব অল্প দিনে দুজনের মধ্যে দারুন বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। এভাবে প্রায় দু’বছর কেটে যায়।
অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় একদিন রাতে ছেলেটির গায়ে সামান্য চুলকানী শুরু হয়। তেমন পাত্তা দেয় না সে। পরদিন যথারীতি ক্লাসে যায়। দু’তিনটে ক্লাসের পর আর সহ্য করতে না পেরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসে। সাথে বন্ধুটিও। ক্যাম্পাসে মেডিকেল সেন্টারে ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার বলেন, এলার্জি। সামান্য ওষুধ দেন। বলেন, দু’এক দিনের মধ্যেই সেরে যাবে। রুমে ফিরে আসে তারা। রাত থেকে তার অবস্থা খুব খারাপের দিকে যেতে থাকে। সারা শরীরে গোটা গোটা হয়ে যায়। সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা ! রাতেই ছেলেটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেশের সেরা এলার্জি বিশেষজ্ঞরা তাকে দেখে যান। কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। রক্তের বিভিন্ন টেস্ট করা হলো। সে সব রিপোর্ট নিয়ে মেডিকেল বোর্ড বসলো। তারাও মুখ কালো করে বেরিয়ে এলেন, বোর্ড থেকে। ৪/৫ দিনের মধ্যেই ছেলেটির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। ওকে এখন আর চেনাই যায় না। শরীরে প্রতিটি স্থানে গোটা গোটা হয়ে সারা শরীর ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।
ওর ক্লাসের বন্ধুরা আসে। ওকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়। ওর বিদেশি বন্ধুটি সারাক্ষণই ওর সাথে থাকে। প্রিয় বন্ধুর অবস্থাটা কোনো ভাবেই সে মেনে নিতে পারছে না। ডাক্তারদের অনুরোধ করেছে- বন্ধুকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। বিদেশে চিকিৎসার সকল টাকা সে দেবে। ডাক্তাররা রাজিও হয়েছিলো। অথচ বাধ সাধে ছেলেটি। সে বিদেশ যাবেনা। যে দেশের মুক্তিযুদ্ধে তার বাবা মারা গেছেন, যেখানে তার মা আর একমাত্র বোনটি আছে- সে দেশ ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। তার জন্য সবার উদ্বেগ আর ভালোবাসা দেখে ছেলেটি হাসে। পৃথিবীতে সে আর বেশিদিন নেই, এটাও সে নিশ্চিত হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ছেলেটি বুঝে গেছে- তার অসুখটা কী ?
তার অসুখটার নাম এলার্জি। তার বিদেশি বন্ধু। যার বাড়ি পাকিস্তান...
ফুটনোট : এ রকোম একটি গল্প অনেকদিন আগে কোথাও পড়েছিলাম। আজ আর তা মনে নেই। গত ১১ অক্টোবর, শনিবার শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে কোনো এক ব্লগার আমার সাথে হাত মেলানোর পর থেকে আমার ডান হাতে এলার্জি মনে হচ্ছে...উপরের গল্পটি আবার মনে পড়লো...।