আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিতে হাসি ও কান্নার মেলবন্ধন গড়ে উঠেছিলো পালকিকে ঘিরে– এতোটা গভীর করে ভাবনার বয়স সে সময় নাহিয়ানের হয় নি। অথচ আজ যে বিমানের পাখায় ভর করে সুদূর রোম থেকে বাঙ্গাল মুলুকের দূরত্বটুকু পারি দিয়েছে সে, তার নাম ‘পালকি’। বিমান থেকে নেমে কাস্টম-কারবারের ঝক্কিঝামেলা পার হয়ে যখন বাইরের আকাশে চোখ মেলে দিলো নাহিয়ান, তখন বহুবছর পরে আবার দেখলো সেই আবেগজড়ানো দৃশ্য– উপরে কান্না, নীচে হাসি। বিমানবন্দরের এটাই চিরচেনা রূপ। যেনো অবিকল পালকি যাত্রার প্রতিচ্ছবি। এ বাড়িতে কন্যা বিদায়ের বিরহবিধুর সঙ্গীত। ও বাড়িতে বধূবরণের হিল্লোল জাগানো উৎসব। প্রচণ্ড রকমের অনুভূতিশীল না হলে দুই যাত্রার এই অভূতপূর্ব মিলন কাউকে ভাবাবে বলেও মনে হয় না। নাহিয়ান ভেবেছে, কারণ, তাদের বাড়ির অলিন্দে কিংবা কখনো সখনো দলিজার কোল ঘেঁষে অনাদরে পড়ে থাকতে দেখছে সে সিন্দুকের মতো একটা বড়সড় কাঠের বাক্স– পালকি। তখন একটু ছোট ছিলো। সে পালকি-ঘরের আড়ালে বউ-পুতুল খেলাও হয়েছে অনেকবার। এখন একটু বড়। আজো কি বাড়ির আঙিনায় সেই পালকিটাকে পড়ে থাকতে দেখবে সে? থাকলে খুবই ভালো হয়। হয়তো এটাকেই মেরামত করে বিয়ের আয়োজনে সবাইকে চমকে দেয়া যাবে। একটা লাল টাট্টু ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে পারবে তার বন্ধুরা? একটু খোঁজখবর নিলে বোধ হয় তা-ও মিলে যাবে। তারপর... তুমি যাচ্ছো পালকিতে গো চড়ে, আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে। টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে...
ইতিহাসের পথ ধরে
পালকিটা কে বানিয়েছিলো– এ রকম একটা কথা এ সময়ে তার মনে হলো কেনো, নাহিয়ান নিজেও জানে না। অথচ এখন এই বিলাসবহুল গাড়িতে গা এলিয়ে বাড়ির পথে যেতে যেতে তার এ কথাটাই বারবার মনে হচ্ছে। পালকিটা প্রথমে বানিয়েছিলো কে? শুনেছে, বাবা তার ছেলেবেলা থেকেই ওটা দেখে এসেছেন, পুরোনো, জীর্ণশীর্ণ। কেউ ঠিক করে জানে না সেটা কত পুরোনো, তবে বাবা মনে করেন, হয়তো তাঁর দাদা, কিংবা দাদার বাবা ফরমাশ দিয়ে বানিয়েছিলেন।
ইতিহাসের দুয়ারে ধর্ণা দিলে কি জানা যাবে? যেতে পারে। তবে সেটা এ রকম– স্লেজচালিত গাড়ির ধারণা থেকে পালকি পরিবহনটির ব্যুৎপত্তি ঘটেছে। প্রাচীন মিশরীয় চিত্রকর্মে এমনই একটা ছবির সন্ধান পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় পালকি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ পালঙ্ক থেকে; যার অর্থ বিছানা বা খাট। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী পালকি অর্থ– মানুষটানা এক প্রকার ‘বিলাসবহুল’ যান, শিবিকা। যে যানে চড়ে ধনিকগোষ্ঠী কিংবা সম্ভ্রান্তবংশীয় ব্যক্তিগণ ভ্রমণ করে থাকেন। চাকাবিহীন যানবাহন হওয়ায় কয়েকজন ব্যক্তি ঘাড়ে বহন করে একে ঝুলন্ত অবস্থায় একস্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। একই সঙ্গে উল্লেখ আছে– পালকি শব্দটির উৎস ফারসি। যেমন পা শব্দটিও এসেছে ফারসি থেকে। ফারসি অভিধানেও শব্দটির উপস্থিতি প্রমাণ করে পারস্য রাজ্যেও যানটির ব্যবহার ছিলো ব্যাপক। সপ্তদশ শতকে ইউরোপে পালকি পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিলো। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ সালে রামায়ণে পালকির কথা তুলে ধরা হয়েছে। গত ত্রিশের দশকে চাকাচালিত রিকশার প্রচলন ঘটার কারণেই হয়তো পালকি তার গুরুত্ব হারাতে শুরু করে।
পালকির চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার এদেশে আসা ভ্রমণ কাহিনীতে। তার রচনায় পাওয়া যায়, তিনি পালকি বহনের দৃশ্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
নানাদেশে নানারূপে
ইউরোপের মিউজিয়ামে পালকির মতো যানবাহন কাচঘরে সাজানো দেখেছে নাহিয়ান। সেখানে পালকিকে বলা হয় ‘প্যালেনকুইন’। তবে ইউরোপের পালকিগুলো দেখে মনে হয়, সেগুলো নির্মিত হয়েছে অনেকটা শোবার উপযোগী করে। কোনো কোনোটি আবার ছাদবিহীন উন্মুক্ত। সে পালকি টেনে নেয়া হতো শক্ত দু’টি খুঁটির মাধ্যমে ভারবাহী পশু দিয়ে। নির্মাণকাঠামোও বেশ মজবুত। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখতে উভয় খুঁটিতে চামড়ার বর্মের আবরণ চোখ এড়ায় না। লন্ডনে তো ছিলো পালকির রাজকীয় বাহার। পালকিকে ‘সিড্যান চেয়ার’ নামে আখ্যায়িত করা হতো সেখানে। অনেক সময় একটা চেয়ার অথবা জানালাসহ ক্যাবিন রাখা হতো সেখানে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে নাহিয়ান দেখেছে, ১৯৭৫ সালে রবার্ট অ্যাডামের আঁকা সিড্যান চেয়ারে বসা রাণী চার্লোতের চিত্রকর্ম।
প্রাচীন রোমেও পালকির ব্যবহার ছিলো বহুল। সেখানে পালকিকে বলে ‘লেটিকা’। এছাড়া কেবল নামের তারতম্য শুনলেই বোঝা যায় আরো কতদেশে পালকি স্বরাজ করেছে দীর্ঘ সময়। রূপের বাহারেও পার্থক্য ছিলো নিশ্চিত। চিনের ভাষায় পালকি হলো ‘জিয়াও’ আর ভিয়েতনামে ‘কিউ’। স্পেনে ‘লিটারা’, ফ্রান্সে ‘প্যালেনকুইন’, পর্তুগালে ‘লিটেইরা’, থাইল্যান্ডে ‘ওহ’। কোরিয়ার ‘গামা’ পালকি তো পৃথিবীজুড়ে খ্যাতিও কুড়িয়েছিলো বেশ। এরপর জাপানে ‘নোরিমোনো’ আর তুরস্কে ‘টাহটিরেভান’ নামে পালকির পরিচিতি আছে আজো।
রাজার পালঙ্ক, প্রবেশ নিষেধ
এককালে এদেশের জমিদার-নবাবসহ সমাজের বনেদি ঘরের সন্তানেরা কোথাও যাতায়াত করলে পালকি ছাড়া তাদের চলতোই না যেনো। খাসমহল থেকে ঘোড়ার পিঠ পর্যন্ত বা পানসি ঘাট পর্যন্ত যেতেও পালকি ব্যবহার করা হতো। এরা ছাড়াও সমাজের জ্ঞানী-গুণী মানুষদের বরণ করতে তৎকালে পালকির বিকল্প ছিলো না। সে আমলে বিদেশি কোনো মেহমান এলেও তাকে পালকিতে সংবর্ধনা দেয়া হতো। গ্রাম-গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্গম পথে জমিদার জোতদার বা মোড়লরা পালকি চড়ে যেতেন গন্তব্যে, যা ছিলো আভিজাত্য প্রদর্শনের অন্যতম একটি মাধ্যম। সালিশি বিচারের আসরেও বড় বড় বিচারকেরা পালকি চড়ে হাজির হতেন বেশ আয়েশের সাথে। বড়মাপের প্রবীণ ও বয়োবৃদ্ধ মওলানারা পালকি চড়ে ওয়াজ মাহফিলে অংশ গ্রহণ করতেন, আবার পীর মুর্শিদেরাও পালকি চড়ে যাতায়াত করতেন তাদের ভক্ত অনুরক্ত মুরিদানের বাড়িতে নিতান্ত জাঁকজমকের সাথে। পালকিতে গিলাফ লাগিয়ে সওয়ারিতে রূপান্তরিত করে মহিলারা যেতেন বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়িসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মেজবানিতে। চলাচলের জন্য বৃদ্ধ বা অসুস্থ মহিলাদেরও একমাত্র আদর্শ বাহন ছিলো পালকি। সে যুগে রক্ষণশীল হিন্দু মহিলাদেরকেও পালকি করে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাওয়া হতো বেশ ঘটা করে। অনেক মন্দিরেই পালকি সহযোগে দেবতাদের বহনের দৃশ্যমালা ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরার দৃশ্য চিত্রিত করা হয়েছে।
ইউরোপীয় উচ্চ শ্রেণির সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও ভদ্রমহিলাগণ ভারত উপমহাদেশে রেলগাড়ি প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত চলাফেরা করতেন পালকি যোগে। অতএব জনসাধারণকে পালকি ব্যবহারের জন্যে আগে থেকে নিবন্ধন করতে হতো। পাশাপাশি করও প্রদান করতে হতো। সরকারি কর্মকর্তারা এ পালকিতে কতজন বেহারার দরকার হতে পারে তা নির্ধারণ করতেন। পরবর্তীকালে গুরুতর অসুস্থ রোগি ও আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকেও পালকি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। প্রাচীন রোমের সম্রাজ্ঞী ও সিনেটরদের স্ত্রীদের ন্যায় অভিজাত বংশীয় এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যে বরাদ্দ ছিলো পালকি। এবং সাধারণের জন্যে এ পরিবহন ব্যবহার ছিলো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
ছোট্টবেলার সে কথা
ছেলেবেলায় নাহিয়ান অনেক গল্পই শুনেছে দাদিমার মুখে। চাঁদনী রাতের আবহে মিশে থাকা সব গল্প হয়তো তার মনে নেই। তবে রবিঠাকুরের একটি গল্প এখনো মনে আছে। কবিগুরুর ছেলেবেলার গল্প শুনিয়েছিলেন তিনি। সে গল্পের পালকির বর্ণনাটা এমনই–
‘পালকিখানা ঠাকুরমাদের আমলের। খুব দরাজ বহর তার, নবাবি ছাঁদের। ডাণ্ডা দু’টো আট আটজন বেহারার কাঁধের মাপের। হাতে সোনার কাঁকন, কানে মোটা মাকড়ি, গায়ে লাল রঙের হাত কাটা মেরজাই-পরা বেহারার দল সূর্য-ডোবার রঙিন মেঘের মতো সাবেক ধনদৌলতের সঙ্গে সঙ্গে গেছে মিলিয়ে। এই পালকির গায়ে ছিলো রঙিন লাইনে আঁকজোক কাটা, কতক তার গেছে ক্ষয়ে; দাগ ধরেছে যেখানে-সেখানে, নারকোলের ছোবড়া বেরিয়ে পড়েছে ভিতরের গদি থেকে। এ যেন এ কালের নাম-কাটা আসবাব, পড়ে আছে খাতাঞ্চিখানার বারান্দার এক কোণে। আমার বয়স তখন সাত-আট বছর।’
গল্পের তোড়েই নাহিয়ানের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে বাড়ির অলিন্দে পড়ে থাকা সেই আট বেহারার পালকির নিখুঁত একটি চিত্র। বলা যায়, ছোটখাটো ঘরই ছিল সেটা। পাশের দেয়াল, ছাদ, দু’পাশ সবই ছিলো কাঠের তৈরি। হ্যাঁ, মজবুতই ছিলো সেই কাঠ। দরজাওয়ালা ও দরজাবিহীন দু’ধরনের পালকিই দেখার সুযোগ পেয়েছে নাহিয়ান। সবই আগাগোড়া কাঠের তৈরি। বিশাল পালকিগুলোর প্রতিপাশে চারজন করে মোট আটজনের কাঁধে থাকতো পালকির সঙ্গে যুক্ত বড় কাঠের দণ্ড। এই দণ্ড খানিকটা বাঁকানো হতো আবার অনেক সময়ই দ-টা থাকতো সোজা। তবে সবসময়ই তা ছিলো আনুভূমিক সজ্জায়। পালকি নিয়ে আসার পর বিয়ে বাড়ির কিশোর কিশোরিরা রকমারি পাতলা রঙিন কাটা কাগজে সাজাতো পালকিকে মনের মতো করে। উপরের চারি কোনে দিতো চারটি ঝাণ্ডা। কেউবা বাহারি ডিজাইনের রঙিন বেলুন ফুলিয়ে পালকিতে বাঁধতো সৌন্দর্যটা আরেকটু বাড়িয়ে দিতে।
চিরায়ত গ্রামীণ জনপদের ছয় বেহারার থাঞ্জান পালকিও দেখেছিলো নাহিয়ান। পালকির আয়তন অনুযায়ীই বেহারার সংখ্যায় পার্থক্য হতো বোঝা যায়। সবচেয়ে ছোট ছিলো দুই বেহারার পালকি। এটি বহন করতে সামনে পেছনে একজন করে মোট দু’জন বাহকেই হয়ে যেতো। একটু জড়োসড়ো হয়ে কেবল একজনের বেশি জায়গা হতো না। এছাড়া অপেক্ষাকৃত বড় ছিলো চার ও ছয় বেহারার পালকি। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে এ ধরনের পালকির চল ছিলো। চার বেহারার পালকিতে মায়ের সঙ্গে শিশুও যেতে পারতো। আট বেহারার পালকি সাধারণত ব্যবহার করতো বিত্তশালী জমিদাররা।
আদুল গায়ে যাচ্ছে কারা
হ্যাঁ, বেহারা। পালকিকে ঘিরেই চলতো যাদের জীবন ও জীবিকার সব আয়োজন। কোথাও তাদের বলা হতো কাহার, আবার কোথাও বেহারা। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলে মালি। সে একটা দিন ছিলো তাদের! প্রয়োজনের সময় আগেভাগে বায়নাস্বরূপ মোটামাইনে পেতো তারা। বিয়ে-অনুষ্ঠানে খাওয়ানো হতো জামাই আদরে। এছাড়া বরপক্ষ থেকে থাকবে আলাদা বকশিশ।
বেহারাদের হাতে থাকতো কষ্ট লাঘবের জন্য মাটিতে ভর দেবার লাঠি। বোঝা বহনের শ্রান্তিতে অঝোর ধারায় নির্গত হওয়া ঘর্মাক্ত শরীরের একেকজন বেহারাকে দেখা যেতো জল্লাদের মতো। চলতে চলতে স্থানভেদে পালকি মাটিতে রেখে খানিকাটা জিরিয়ে নিতো তারা। শরীর চাঙ্গা করার জন্য সাথে রাখতো চুরুট, আর মুখের বোল ‘উহুম নারে, উহুমনা’ কিংবা ‘হুন হুনা হুন হুনা’।
পূর্বপুরুষ থেকেই পালকি বহন বা বেহারার কাজকে পেশা হিসেবে ধরে রাখায় অনেক অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বেহারা পল্লী। কিন্তু রাজসিক জাঁকজমক আর জমিদারির ঠাঁটবাট বিদায় নেয়ার ফলে বেহারাদের হয়েছে এখন বেহাল দশা। ভিন্ন পেশা বেছে নেয়ার গত্যন্তর নেই কারো। মূল সমাজের বাইরে দীর্ঘদিন জীবন যাপন করার খেসারত দিতে গিয়ে ভিটেমাটি হারাও হতে হয়েছে অনেক বেহারা পরিবারকে। বিদেশের মাটিতে বসেই খবরের কাগজে দেখেছে নাহিয়ান, ‘বেহারাদের উচ্ছেদ করতে আলটিমেটাম দিয়েছেন পৌর কমিশনার।’ সেই কুষ্টিয়া, ধুনট উপজেলা সদর থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে দুর্গম জোলাগাতি, যেখানে নাহিয়ানের গ্রামের বাড়ি, সেখানকার আদিবাসী পরিবারের সদস্যরা তাদের আদিপেশা ডুলি-পালকি ছেড়ে মোড়া তৈরি করে জীবিকানির্বাহ করছেন আজকাল। এ অঞ্চলেও পালকি আজ বিলুপ্ত প্রায়। অথচ আজো মানুষের মুখে মুখে রটে চলা পালকিকাব্য ‘বীরপুরুষে’র জনক রবিঠাকুর এ জনপদেই জমিদারী পরিচালনা করতে এসে পালকি ব্যবহার করতেন।
পায়রা টায়রা সবই আছে, নেই শুধু..
গ্রামবাংলার, না না, কালক্রমে বাঙালি ঐতিহ্যের ধারকই তো ছিলো পালকি। কিন্তু কী করে যে সেই পালকি হারিয়ে গেলো, ভাবতে খারাপ লাগে নাহিয়ানের। একেবারেই হারিয়ে হয়তো যায় নি। হয়তো কোনো কোনো খানদানি বাড়িতে অচল হয়ে পড়ে আছে। কিংবা মিউজিয়াম পিস হয়ে কালের স্থানু সাক্ষী হয়ে আছে জাদুঘরে। তবু সেই কিনু গোয়ালার গলি ঘুরে মাঠ প্রান্তর পেরিয়ে গন্তব্যের কাছে কিবা দূর থেকে বেহারাদের দেখা আর মিলছে না। তাদের ছন্দিত লয়ে হাঁটার সাথে সাথে, সুর করা গানের তালে তালে এ-গাঁও থেকে ও-গাঁয়ে নাইয়র, বিয়ের বর-কনে কিংবা মান্যগণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য কেবলই স্মৃতি। সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায়, হেমন্তের গানে, ভূপেন হাজারিকার মাদল মাদক তানে চলা পালকির কথা মনেও রাখে নি কেউ। সেই ন্যাংটা পুঁটো ছেলেটা ছড়াকেটে আর বলে না– ‘পালকি চলে, পালকি চলে, গগন তলে আগুন জ্বলে। স্তব্ধ গাঁয়ে, আদুল গায়ে যাচ্ছে কারা, রৌদ্রে সারা।’ দাদা তার সদ্য বিয়ে হওয়া বোনটিকেও বলতে শোনে না কেউ– ‘আর ক’টা দিন থাক না দিদি, দু’দিন বাদে তো নিয়েই যাবে পালকি সাজিয়ে।’ দেওয়ানা মদিনাও ছুটছে না পালকিতে আবের পাঙ্খা নিয়ে আর।
কেবলই বইয়ের পাতায় আর খুকুমণিদের ছড়ায় ছড়িয়ে আছে– বউ সাজবে কালকি, চড়বে সোনার পালকি! না সোনার বরণীকন্যা আজকাল আর পালকির বদ্ধ পরিবেশে চড়তে চাইছে না, চড়ছে নকল ফুলে সাজানো ফুলেল এয়ারকন্ডিশন্ড কারে। বাকবাকুম পায়রা আছে, টায়রা মাথার বউও আছে, কিন্তু সোনার পালকি তো দূরে থাক, একটা কাঠ, অন্তত বাঁশের পালকিও কি বেঁচে আছে আজ?
এখনো জোনাকি জ্বলে
কে যায়রে পালকি চড়িয়া...। ভাবতেই অবাক লাগে, এভাবে যদি আমার বিয়েটাও পালকিতে চড়ে হতো, ভাবে নাহিয়ান। এতক্ষণে বাড়ির কাছাকাছি আসতে আসতে নাহিয়ানের মনটা সত্যিই বেজায় খারাপ হয়ে গেছে। সন্দেহ নেই, বিয়ে করবে বলেই এতোকাল পরে তার দেশে আগমন। কিন্তু এ যুগের বউ কি রাজি হবে? বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বউয়ের তরফ থেকেই মেসেজটা পেলো সে– আপনার ঘরে আমি পালকি চড়ে যেতে চাই।
আর কি! খোঁজ খবর শুরু হয়ে গেলো। জানা গেলো, ঢাকায় এখনো পালকি পাওয়া যেতে পারে। শাহবাগের ফুলের দোকানদার বললেন, পাওয়া যাবে। তবে ভাড়া লাগবে আড়াই থেকে তিনহাজার টাকা। ডিপোজিট সমপরিমাণ। আর কনেবাড়িতে যাওয়ার ভাড়া বাবদ আরো পাঁচশ’ টাকা। যদি নিজেই পালকি নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয় তাহলে আরেকটু কম।
সবকিছুই ঠিকঠাক, কিন্তু সমস্যা হলো, বেহারা কোথায় পাবে? আরে, তাইলে পালকি বইবে কে? দোকানদারের সাজেশন, চারজন কামলা ভাড়া করে তাদের দিয়ে পালকি বহন করানো যায়। কিন্তু পোশাক? সেই ঐতিহ্যবাহী পালকিবেহারার পোশাক? সেটারও সমাধান মিললো। কমদামি চারটা ফতুয়া আর শাদা লুঙ্গি কিনে ফেললেই হলো।
মন মানলো না, নাহিয়ানের। কথা বলা হলো, ঘোড়ার গাড়ি বা টমটমের মালিকদের সাথে। টাকা একটু বেশি, তবে কোনো ঝামেলা নেই। পালকি ছয়হাজার টাকা। বেহারার জন্য কোনো পয়সা লাগবে না। তাদের নিজস্ব পোশাকও রয়েছে। সঙ্গে আছে ব্যান্ডপার্টির ব্যবস্থা। ঘোড়ার গাড়ি সাথে নিলে হাজার দুই টাকা বেশি পড়বে। তবে বেহারাদের বকশিশ এই হিশাবের মধ্যে রইলো না। সেটা নাহিয়ানের ইনসাফের ওপরই ছেড়ে দেয়া হলো।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৩