এক
নতুন গড়ে উঠা বিশালাকার এক শপিং মল; গ্রাউন্ড ফ্লোরে বেশ কয়েকটি দেশীয় ব্র্যান্ডের কাপড়ের দোকান- এগুলোকে অবশ্য দোকান বললে যেন ঠিক ম্যাচ করে না; আউটলেট বা শপ বললেই বোধ করি, ব্লাউজের সাথে কপালে পরা একই রঙের টিপের মত মিল হয়।
মাসুদ এখানে এসেছে নিজের জন্য কিছু জামা-কাপড় কিনতে। বৈদ্যুতিক আলো দিয়ে “Entry” লেখা’র নিচের পথ দিয়ে অবলীলায় ঢুকে পড়ে সে। সাধারণত, অনেকক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজির পরই কেবল কোন পোশাক হয়ত তার পছন্দ হয়, তবে আজকে সেটার ব্যতিক্রম ঘটল; হ্যাঙ্গারে ঝোলানো কাপড়-চোপড় থেকে নয়, প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়া সেলস বয়ের পরনের সার্ট মনে ধরে গেল তার। কোন পোশাক পছন্দ হয়ে যাওয়া, তার কাছে অনেকটা প্রেমে পড়ার মতই। এরপর অন্য যত সুন্দর কাপড়-চোপড়ই সে ঘুরে ফিরে দেখুক না কেন, প্রথমে ভালো লেগে যাওয়া পোশাকটি বাদে অন্য কিছুতে সে মন লাগাতে পারে না। প্রথমে একটা অন্যথা হল বলেই হয়ত ব্যত্যয়টিকে পুষিয়ে নিতে এই ব্যাপারে সে অন্য দিনের চেয়ে আজকে একটু বেশী একরোখা। আউটলেটটির ভেতরে বেশ কয়েকটি লাইনে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো সার বেঁধে রাখা সার্টগুলোর মধ্যে সেলস বয়টির গায়ের সার্টের অনুরূপ সার্ট খুঁজতে লাগল সে। পরীক্ষায় ফেল করা কোন ছাত্র যেমন আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও তার রোল নাম্বার রেজাল্ট শীটের কোথাও দেখতে পায় না, মাসুদও ঐ নির্দিষ্ট ধরনের সার্ট খুঁজে পেল না।
যাহোক, কি আর করা, এখন ছেলেটির সাথেই কথা বলতে হবে। সে একজন কাস্টমারের পিছ পিছ ঘুরছিল। একপর্যায়ে লোকটি চলে যেতে ছেলেটি ফ্রী হওয়ামাত্রই সে এক নিমিষে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, এরকম দেখতে সার্ট কোন সারিতে আছে, বলুনতো। আমি তো হয়রান হয়ে গেলাম, কোথাও পেলাম না, বলল।
তারপর একটু থেমে, এটার স্টক কি এরমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে, তাড়া দিয়ে জানতে চাইল সে।
এই মুহুর্তে ছেলেটির মুখভাব দেখবার মত, যেন কাদা মাখা গ্রাম্য-পথ দিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেছে!
ডানে, বামে একবার করে তাকিয়ে নিয়ে ছেলেটি শুরু করল, এখান থেকে দুই-তিনটা জামা-কাপড় কিনলেই সামান্য কয় টাকা বেতনের প্রায় সবটাই ফুরিয়ে যাবে। তারপর ঢাকা শহরে থাকা-খাওয়া চলবে কিভাবে। এইটুকু বলার পর ছেলেটা একটু থামল।
এবার ছেলেটার ভ্রু খানিকটা উপরের দিকে উঠে গেল, কপালে ফুটে উঠল কয়েকটা সুক্ষ্ণ রেখা। ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে নাকের ডগা স্পর্শ করাতে তালুতে ঢেকে গেল মুখ; চোখ দুটি আপনা থেকেই পিটপিট করতে আরম্ভ করল।
এই সার্টটা আমি বঙ্গবাজার থেকে কিনেছি, ওখানেও অনেক ভালো ভালো জামা-কাপড় পাওয়া যায়। দোকান ভাড়া কম বলেই সস্তায় বিক্রি করতে পারে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা দ্রুত গতিতে বলে গেল ছেলেটি।
ছেলেটা যেন এখন আর বিশাল শপিং মলের দামী ব্র্যান্ডের শপের সেলস বয় নেই, বঙ্গবাজারের কাপড়ের দোকানের বিক্রেতায় পরিণত হয়েছে।
শেষের কথাগুলো বলার সময় ছেলেটি মুখে ফুটে উঠা অভিব্যাক্তি দেখে মাসুদের মনে হল, বঙ্গবাজার থেকে সার্ট কেনার ব্যাপারটি হয়ত মিথ্যা। সার্টটি সে সম্ভবত একশ টাকা দরে কোন ফুটপাথ থেকে কিনে নিয়েছে।
চলে আসার সময় সহানুভূতি-সূচক ছেলেটির পিঠে হাত স্পর্শ করাতে গিয়ে সার্টটি যে বেশ নিম্ন মানের কাপড় দিয়ে তৈরী, তা টের পাওয়া গেল।
দুই
মাসুদের কেনাকাটা করার ইচ্ছাটি নিস্পৃহ হয়ে গেছে; তবে এতদূর থেকে এসেছে, এখনই চলে যেতে মন সরল না। সে ভাবলো, এবার তাহলে নানান শপ ঘুরে বিভিন্ন তরুণী সেলস গার্লদের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাক; সুযোগ পেলে খানিকটা মজা লুটতেই বা দোষ কোথায়!
অন্য আরেকটা বিখ্যাত ব্র্যান্ডের আউটলেটে ঢুকে পড়তে বিলম্ব করল না সে। কপাল তার খারাপ না; অগোছালো মনযোগে একটা জিন্সের প্যান্ট নাড়াচাড়া করছে- এমন সময় একজন সেলস গার্ল তার পেছনে পড়ল। মেয়েটির সামনে তার অস্তিত্বকে খানিকটা বেপরোয়া করে তোলার প্রত্যাশায় সে বৃথা কাজে এদিক-সেদিক করতে শুরু করে। মজবুত শারীরিক কাঠামোর মেয়েটি ওদিকে পোষা বিড়ালের আদর্শ হয়ে তাকে অনুসরণ করে চলছে।
চলতে চলতে মাসুদ এক পর্যায়ে প্যান্টের পকেট থেকে ক্যামেরা সংযুক্ত মোবাইল ফোনটি বের করে কাপড়-চোপড়ের ছবি তুলতে শুরু করে। পিছন থেকে নাচের ভঙ্গীতে একটা ঘূর্ণি দিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে স্বরটাকে মোলায়েম আবরণের ভেতরে যতটুকু পারা যায় কঠিন করে তুলে তরুণী সেলস গার্লটি বলে উঠল, স্যার, শপের ভেতরের কোন প্রডাক্টের পিক তোলা একদম নিষেধ।
তাহলে, আপনারই একটা ছবি তুলে ফেলি, কি বলেন? পেঁপে গাছের ডাঁটির আকারে সামান্য উপরের দিকে বেঁকে সামনে এগিয়ে আসা হাতে ধরে রাখা মোবাইল ফোনটি ইতিমধ্যেই কাপড়-চোপড়ের দিক থেকে ঘুরে এসে মেয়েটির মেকাপ করা মুখের দিকে তাক করা হয়ে গেছে।
নদীর পানিতে ভেসে উঠা মাছ- তার দিকে শিকারীর কোচ নিক্ষিপ্ত হচ্ছে বুঝতে পেরে যেমন ভাবে জলের গভীরে ডুবে যায়, ঠিক তেমনি দ্রুততায় মেয়েটি লেন্সের ফোকাস-সীমানার বাইরে চলে গেল।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৩৪