বেঁচে থাকার কারন
আমি আর সে অফিসের মাইক্রোবাসে চড়ে ব্যাস্ত রাজপথ ধরে গন্তব্যের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম। যা ভাবছেন তা নয়, অত সৌভাগ্য আমার হয়নি; মাইক্রোবাসটিতে সে আর আমি একা ছিলাম না, চালক তো ছিলই, সাথে আমাদের আরো অনেক সহকর্মী ছিল। আমি বসে ছিলাম পিছনের সিটের একেবারে বামপাশে, আর সে ছিল আমার ঠিক সামনে। তার শরীর থেকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া ঘ্রাণ আমার নাকের ছিদ্র পথ দিয়ে প্রবেশ করে পুরোটা সময়জুড়ে আমাকে আবেশিত করে রেখেছিল। ওদিকে আমাদের পাশের জানালাটি খোলা পেয়ে হু হু করে ঢুকতে থাকা বাতাস তার নরম, রেশমী চুলগুলোকে নিয়ে আপন মনে খেলা করে চলছে। বুকের ভেতরে হঠাৎ একটা শঙ্কা জেগে উঠায় আমি এক টানে জানালাটা বন্ধ করে দেই। তৎক্ষণাৎ সে এক মোচড়ে শরীরটা কোনাকুনি বাঁকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার চোখে চোখ রাখে। চেড়া পটল নয়, পাখির বাসা নয়, ও চোখ যেন সূর্য, মুহুর্তেই আমার অন্তর-বাহির ঝলসিয়ে দিল! লাল লিপস্টিকে রঞ্জিত ঠোঁট নেড়ে সে বলল, “শুধু শুধু জানালাটা বন্ধ করে দিলেন কেন? দেখছেন না কি ভীষণ গরম পড়েছে। ভালোই তো বাতাস আসছিল।”
কন্ঠস্বরে মিনতির রস মিশিয়ে বললাম, “জানালা খোলা পেয়ে শুধু যে বাতাস আসবে তাই নয়, বাতাসে ভর করে ধর্মঘটীদের ছুড়ে দেওয়া দু-একটা পেট্রোল বোমাও তো চলে আসতে পারে। তখন আর রেহাই থাকবে না, নির্ঘাত সবাইকেই জীবন্ত দগ্ধ হতে হবে!”
সে উপহাসের অভিব্যাক্তি মুখে ফুটিয়ে তুলে বলল, “বেঁচে থাকার এত সাধ কেন আপনার, বলুন তো। আমার তো একদমই বাঁচতে ইচ্ছা করে না। এক্ষুনি মরে গেলেই যেন ভাল।” তার দুই ঠোঁটের মাঝখানের সামান্য ফাঁক দিয়ে এক চিলতে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে গেল।
মুখে প্রাণের আভা ছড়িয়ে আমি বললাম, “বেঁচে থাকার জন্য আমার হাজারটা কারন আছে।”
উপহাসের সবটুকু রেশ ঢেলে দিতে দিতে সে বলল, “হাজারটার মধ্য থেকে অন্তত একটা কারন বলুন তো শুনি, বেঁচে থাকার কেমন আপনার কারন।” এবার আরো কয়েক টুকরা টুকরা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল তার ঠোঁট বেঁয়ে।
হঠাৎ তার এমন জিজ্ঞাসায় থতমত খেয়ে বিড়বিড় করে, “তা তো আপনাকে আমি বলতে পারব না,” বলেই ঠোঁট দুটো চেপে ধরে, নমস্কারের ভঙ্গীতে একত্র করে রাখা দুই হাতের তালু দুই থাইয়ের চিপায় ঢুকিয়ে, থুতনীটা খানিকটা উপরের দিকে তুলে, মনযোগটাকে নীচের দিকে ঠেলে পাঠিয়ে এমনভাবে বসে রইলাম যেন আমার ভেতরে গরম বালিতে ফুটন্ত খইয়ের মত ছোটাছুটি করতে থাকা কোন কিছুকে প্রাণপণে চেপে ধরার চেষ্টায় আছি। সম্মুখে অভিমানের পর্দা ফেলে ও দুটো চোখ সরে গেল।
আফসোস! বলাও হবে না আর সে হয়ত কোনদিন বুঝতেও পারবেনা যে, “আমার বেঁচে থাকার অনেক বড় একটা কারন সে নিজেই।”
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:০৪