ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক প্রয়াত পিয়াস করিম বেড়ে উঠেছে স্বাধীনতা বিরোধী পারিবারিক আবহের মধ্য দিয়ে। এই ব্যাপারটি নিশ্চিতভাবেই তার অপরাধ নয়, কারন মানুষ কখনই তার জন্মের নিয়ন্তা নিজে হতে পারে না। তবে পরবর্তী সময়ে লেখা-পড়া শিখে শিক্ষিত হওয়ার কালে বা অধ্যপনাকালীন সময়ে যখন তার বিভাগে ভর্তি হওয়া তরুণ-তরুণীদের শিক্ষিত করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল তখন নিশ্চয়ই তার চিন্তা-চেতনার নিয়ন্তা সে নিজেই ছিল। তবে সে তার কৈশোরকালের স্বাধীনতা বিরোধী বলয় থেকে বের হয়ে আসে নাই বা মুক্তযুদ্ধ বিরোধী অপচেতনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার ন্যুনতম চেষ্টাও করেছে বলেও তার পরবর্তী কার্যকলাপ দেখে মনে হয়না। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে কিছুদিনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগে যোগাদান করলেও(বলা হয়ে থাকে, দালাল আইনে আটক তার বাবা এম এ করিমকে মুক্ত করাই ছিল তার ছাত্রলীগে যোগাদানের মূল উদ্দেশ্য।) বেশীদিন সম্পৃক্ত থাকেননি। পরবর্তীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা আরম্ভকালীন সময়ে তেল-গ্যাস-বিদ্যুত-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাথে যুক্ত হয়েছিল। তার এই যুক্ত হওয়ার পিছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল নিশ্চয়ই, কারন আমৃত্যু স্বাধীনতার চেতনা-বিরোধী একজন লোকের পক্ষে চেতনাগত কারনে এই ধরনের একটি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কথা নয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়াস করিম সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে জামাতী ও হেফাজতী অনেকটা বলা চলে ধর্মীয় মৌলবাদী তোষণমূলক বক্তব্য দেওয়া, স্বাধীনতা বিরোধী চেতনার প্রচার ও প্রসার, সচেতনভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে নস্যাৎ করার নিমিত্তে বিভ্রান্তিকর আলোচনা, সহ-আলোচকদের সাথে যুক্তিতে পেরে না উঠে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠা বা তাদেরকে ব্যাক্তিগতভাবে আক্রমণ করা, যৌক্তিক আলোচনার পরিবর্তে ঝগড়ার পরিবেশ তৈরী করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে শাহবাগের প্রজন্ম-চত্বরে জেগে উঠা সর্বস্তরের জনগণের স্বতস্ফূর্ত আন্দলোনকে অবৈধ আখ্যা দেওয়া ইত্যাদি নানাবিধ কারনে বেশ কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। অনেকের, যাদের মধ্যে স্বাধীনতা বিরোধী অপচেতনা খানিকটা হলেও আছে, তার এই কুখ্যাত হয়ে যাওয়ার ঘটনাটিকে খ্যাতি লাভ বলে অভিহিত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। যেমন, আমাদের কাছে কুখ্যাত হিসেবে পরিচিত গোলম আযমও জামাতী বা স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যাক্তিত্ব হিসেবে মর্যাদা পায়।
পিয়াস করিম মারা যাওয়ার পর অরাজকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বা স্বাধীনতা বিরোধী চেতনাকে সামনে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে তার অপচেতনার শরীকরা তার লাশ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে। সাথে সাথেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। এই বিতর্কে অনেক প্রগতির বেশধারীদের মুখোশ অবলীলায় খুলে পড়তে দেখা যায়। তারা বিরুদ্ধমতকে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যাপারটিকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে পিয়াস করিমের লাশ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে নিজেদের জোরালো অভিমত পোষণ করতে থাকে। তবে বিরুদ্ধমতকে শ্রদ্ধা জানানোর আগে সেই বিরুদ্ধ মত কোন বিষয়টিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে তা নজরে আনাটা জরুরী। পিয়াস করিম তার বিভিন্ন আলোচনায় গণজাগরণ মঞ্চকে অবৈধ আখ্যা দেয়া এবং সরাসরি জামাত ও যুদ্ধাপরাধীদের তোষণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার মূল চেতনার বিরোধীতা করেছে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রথম আমরা দেশের মাটিতে স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ রোপন করেছিলাম, সেই স্বপ্নের বীজই চারা হয়ে গজিয়ে একাত্তরে মহীরুহের আকার ধারণ করে। নানাধরণের সূক্ষ্ণ ছল-চাতুরীর সাহায্যে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করার প্রয়াসের মাধ্যমে একজন ব্যাক্তি নিশ্চিত ভাবেই আমাদের স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ভাষা আন্দোলনের বিরোধী একজন লোক আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতির বিরোধী নয়, এমন কথা মেনে নেওয়া কঠিন। শহীদ মিনার হচ্ছে আমাদের ভাষা আন্দোলনের একমাত্র স্মারক, যা আমাদের সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পিয়াস করিমের মত স্বাধীনতা বিরোধী লোকদের- যারা আসলে এক অর্থে আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতিরও বিরোধী- উচিত আমাদের ভাষায় কথা বলা থেকে বিরত থাকা এবং আমাদের সমাজের বাইরে অবস্থান করা। সুতরাং তার মত একটি লোক মারা গেলে তার লাশকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শহীদ মিনারে নিয়ে আসার ব্যাপারটি দুঃস্বপ্নের ঘোরেও জায়গা পাওয়ার উপযুক্ত নয়!
প্রগতির লেবাস গায়ে জড়িয়ে যারা পিয়াস করিমের মরদেহকে শহীদ মিনারে নিয়ে আসার পক্ষে মত দিয়েছে, আরেকটু সাহসী হয়ে উঠতে পারলে বোধ হয় তারা গোলাম আযমের লাশও শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার কথা উত্থাপন করত। গোলাম আযম সহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের সাথে পিয়াস করিমের চেতনাগত জায়গায় তো তেমন কোন ধরণের মতদ্বৈততা নেই। তারা একই চেতনার ধারক ও বাহক। পার্থক্য শুধু কাজের ভঙ্গিতে। গোলাম আযমরা একাত্তুরে পাক বাহিনীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বন্দুক, কামান, গ্রেনেড, বেয়োনেট হাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর পিয়াস করিম ২০১৩ সালে এসে খোড়া যুক্তিতে তার কন্ঠ শানিয়ে ঝগড়াটে ভঙ্গিতে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে অভিহিত শাহবাগে জেগে উঠা সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে তার আক্রমণের মূল লক্ষ্যে পরিণত করেছিল স্বাধীনতা বিরোধী অপচেতনাকে উর্ধ্বে উত্তোলন করার জন্য। যুদ্ধাপরাধীরা যদি জেলে বন্দী না থেকে যদি বাইরে থাকত তাহলে পিয়াস করিম এই সময়ে এসে যা করেছে, তাদের দ্বারা ঠিক একই ধরনের কাজ সম্পন্ন হত। কারন পাক বাহিনী এই মুহুর্তে দেশে না থাকায় বিশাল শক্তি নিয়ে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়াটা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, যদিও এই ধরনের নাশকতা মূলক কাজও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের দ্বারা বেশ সংখ্যক সংগঠিত হয়েছে। এমনকি এই মুহুর্তে পাক বাহিনী দেশে থাকলে পিয়াস করিমও যে অস্ত্র হাতে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত না, তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। টকশোগুলোতে সে যেমনভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর তাগিদে সহ-আলোচকদের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠত, সেটা দেখে এমন সন্দেহ মনে জাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যে ও বিজ্ঞান-দর্শনে বিশেষ রকমের অবদান রেখেছেন, উন্নত চিন্তার অধিকারী বা দেশ রক্ষায় বড় ধরনের আত্মত্যাগ করেছেন - এমন মানুষদের মরদেহই কেবল শহীদ মিনারে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধার জন্য নিয়ে আসা হয়। দেশে প্রতিনয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে, তাদের সকলের মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয় না বা সেটা করা সম্ভব নয়। পিয়াস করিমের স্বাধীনতা বিরোধী ব্যাপারটি মুলতবি রেখেও বলা যায়, সে দেশ-সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান যেমন রাখেননি ঠিক তেমনিভাবে বড় ধরনের কোন আত্মত্যাগ করেছেন বলেও মনে হয় না বা এমন কোন লেখা বা বক্তব্য রেখে যাননি যা আমাদের মুক্ত চিন্তার খোরাক যোগাতে পারে। এই বিবেচনায়ও পিয়াস করিমের মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নটি উত্থাপিত হতে পারেনা। পিয়াস করিমের লাশ যদি শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে অনেকের এরকম বলাটা খুবই স্বাভাবিক, “আমার দাদা-দাদী মারা গেল, আমার নানা-নানী মারা গেল, আমার বাবা-মা মারা গেল; তাদের লাশও তো তাহলে আমরা সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধার জন্য শহীদ মিনারে নিয়ে আসতে পারি”। তারা যদি পিয়াস করিমের লাশ নিয়ে আসায় উৎসাহিত হয়ে এরকম শুরু করে তাহলে শহীদ মিনারে স্বল্প পরিসরে শুধুমাত্র লাশ রাখার জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে মারামারি কাটা-কাটি লেগে থাকাটা প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে উঠবে! সাধারনভাবে মৃত্যু একটি শোকাবহ ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও এরকম ব্যাপার ঘটতে শুরু করলে তা একটা হাস্যকর ব্যাপারে পর্যবসিত হবে।
যাহোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনাগত অনমনীয় অবস্থান ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসের ফলে শহীদ মিনারকে অপবিত্র করার চক্রান্তকে আমরা নস্যাৎ করে দিতে পেরেছি। পিয়াস করিমের অপচেতনার শরীক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতারা তার বাসায় গিয়ে তার মরদেহকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে, জামাতীরা বায়তুল মোকারমের জানাজায় অংশগ্রহণ করেছে। তো, এখন অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন- ব্যাপারটি ফয়সালা হয়ে যাওয়ার পর এই বিষয় নিয়ে লেখার দরকারটা কি? এই প্রশ্নের উত্তরে আমার বক্তব্য হচ্ছে, স্বাধীনতা বিরোধীরা এবারের মত এই ব্যাপারে পরাজিত হলেও বিতর্কটি কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। ফলে, পিয়াস করিমের মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত প্রদানকারী লোকদের চিনে রাখাটা জরুরী। কারন তারা যেকোন সময় আবার প্রগতির মুখোশ খুলে দুর্দান্তরকম উলঙ্গ হয়ে উঠতে পারেন। একজন পিয়াস করিম মৃত্যুবরণ করলেও অন্যরা এখনও জীবিত। আমাদের সকলকেই যেহেতু মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে সেহেতু অন্য পিয়াস করিমরাও এক সময় মারা যাবে। তাদের মরদেহও শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত হতে পারে। সেই ব্যাপারে আমাদের পূর্ব থেকেই সচেতন থাকাটা অত্যাবশ্যক।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৩১