মানুষ যেদিন প্রথম গুহা থেকে বেরল শিকারে, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঝর্না দেখে থমকে দাঁড়ালো বিষ্ময়ে! অবুঝ হৃদয় ঈশ্বরের কৃপায় মোহনীয় হল। বিকশিত হল ভালোবাসা। মানুষ ভালোবাসার আজন্ম কৃতদাস হয়ে গেল। পোস্টমর্টেম করে জানা গেল ভালোবাসা সমুদ্রের মতই গভীর, নীল।
মানুষ যুগে যুগে ভালোবেসেছে। প্রকৃতি, নারী সর্বোপরি মানুষ মানুষকে ভালোবেসেছে। ভালোবাসার সঙ্গা দিয়ে কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকেরা বিভিন্ন উপমায় ভালোবাসাকে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ভালোবাসার গভীরতা যেন তলহীন অতলে। কে জানে হয়ত ঈশ্বরের কাছাকাছি।
"ভ্যালেন্টাইনস্ ডে" উদ্যাপন শুরু হয়েছিল রোমান সাম্রাজের শাসনামলে। প্রাচীন রোমে ১৪ই ফেব্রুয়ারী ছিল ছুটির দিন। এই দিনে রোমান দেব-দেবীদের রানী 'জুনো' কে সম্মান জানান হত। রোমানবাসী বিশ্বাস করত 'জুনো' ছিলো নারী ও বিয়ের ভাগ্য নির্ধারক।
প্রাচীন রূপকথায় বর্ণিত আছে ১৪ই ফেব্রুয়ারী, এই দিনে পাখিরা তাদের নিজ নিজ সঙ্গী বেছে নেয়।
কথিত আছে, প্রাচীন রোমে একটি প্রথাগত অনুষ্ঠান ছিলো 'ড্র্যইং' (Drawing)। সন্ধ্যা পরবর্তী সময়ে লুপারকেলিয়া (Lupercalia) আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে রোমান মেয়েদের নাম আলাদা আলাদা কাগজে লিখে একটি জারে রাখা হত। প্রতিটি রোমান পুরুষ একটি করে কাগজ জার থেকে তুলতো এবং কাগজে যে মেয়েটির নাম লেখা থাকত তাকে সেই অনুষ্ঠানের জন্য এমনকি কখনও কখনও এক বছরের জন্য সঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়া হত এবং এভাবে বেশির ভাগ সময়ই তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলতো এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হত।
দ্বিতীয় ক্ল্যডিয়াসের শাসনামলে রোম ছিলো নানাবিধ রক্তাক্ত যুদ্ধ-সংঘাতে লিপ্ত। ক্ল্যডিয়াস চেয়েছিল সর্ববৃহৎ সৈন্যবাহিনী তৈরী করতে। কিন্তু ক্ল্যডিয়াসের জনপ্রিয়তা ছিলনা মোটেই বরং জনমনে তার প্রতি ক্ষোভ ছিলো অনেক বেশি। রোমান পুরুষেরা নিষ্ঠুর ক্ল্যডিয়াসের সৈন্যবাহিনীতে যোগদানে বিরূপ ছিলো। ক্ল্যডিয়াস মনে করত রোমান লোকেরা তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি ভালোবাসার টানে তাদের ছেড়ে সৈন্যবাহিনীতে থাকতে অথবা যোগ দিতে চাইতো না। ফলে ক্ষিপ্ত ক্ল্যডিয়াস তখন রোমে সমস্ত বাগদান ও বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষনা করলো। রোমবাসী কেউই এ সিদ্ধান্ত মন থেকে মেনে নিলনা। কিন্তু ক্ল্যডিয়াসের আদেশ অমান্য করাও সম্ভব ছিলোনা।
ভালোমানুষ সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলো তখন রোমের একজন জনপ্রিয় পুরোহিত। ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন এবং তার বন্ধু সেইন্ট ম্যারিয়াস গোপনে বিয়ের সপক্ষে সাহায্য ও প্রচারনা চালাতে লাগলো। অচিরেই এই সংবাদ ক্ল্যডিয়াসের কাছে পৌঁছাল। তার আদেশ অমান্য করার অপরাধে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন কে বেধড়ক মারধর সাপেক্ষে কয়েদখানায় বন্দি করা হয় এবং তার জন্য শাস্তি বরাদ্দ করা হয় মৃত্যুদন্ড।
জেলে বন্দি থাকাকালীন নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন এক তরুনী মেয়ের প্রেমে পড়ে। কথিত আছে তরুনীটি ছিল জেলারের মেয়ে। কারন কারারুদ্ধ থাকাকালীন তরুনীটি প্রতিদিন ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে আসতো। মৃত্যুর আগেরদিন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন তার তরুনী প্রিয়তমা মেয়েটিকে একটি চিঠি দিয়ে যায় যাতে উল্লেখ ছিল - "Love from your Valentine"। কথিত ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারী সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে প্রথমে নির্মমভাবে মুগুর দিয়ে পিটিয়ে এবং পাথর নিক্ষেপ করে রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। এরপর ফ্লেমিনিয়ান গেটের বাইরে তার ধড় থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
এইসব তথাকথিত প্রেক্ষাপটের ধারাবাহিকতায় আজ আমরা পৃথিবী জুড়ে উদ্যাপন করছি ভ্যালেন্টাইনস্ ডে (Valentine's Day)। কিন্তু দুঃখ এই- অতি আনন্দের উন্মাদনায় বেশির ভাগ সময়ই সেই আত্মত্যাগের আত্মউপলব্ধিবোধের কমনীয়তা যায় হারিয়ে। তাই আসুন আজ এই দিনে আমরা সবাই মিলে আলো দিয়ে মুছে ফেলি সব অন্ধকার। ভালোবাসি কাছের-দূরের জানা-অজানা সব মানুষকে। ভালোবাসা দিয়ে সস্নেহে ভরিয়ে দেই আমাদের অতি পুরাতন বৃদ্ধ এই পৃথিবীটাকে। তবেই স্বার্থক হবে ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগ। তবেই স্বার্থক হবে ভ্যালেন্টাইনস্ ডে। ১৪ই ফেব্রুয়ারী "ভ্যালেন্টাইনস্ ডে" উপলক্ষে সকলের প্রতি রইলো অকৃত্রিম অনন্ত শুভেচছা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ২:২৯