পর্ব ১ লিখেছেন রিম সাবরিনা জাহান সরকার
পর্ব ২ লিখেছেন পদ্ম পুকুর
বাস তখন এয়ারপোর্ট পার হচ্ছে। এইমাত্র টেকঅফ করা নভো এয়ারের একটা উড়োজাহাজকে উড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।
…........।
জানালা দিয়ে এক পলক তাকিয়ে নভোর দিকে ফিরল মৃন-
ঃ তোমাদের কি এয়ারলাইন্সের ব্যবসা আছে?
কিছুটা অবাক হয়ে মৃনের দিকে ফিরলো নভো, চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি । মৃন আবারো চমকে উঠলো। ছেলেটার চোখে তার দৃষ্টি, কিছু একটা মনে আসি আসি করে আসছে না।
নভো দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল, জানতে চাইল-
ঃ আমাকে কিছু বলছিলেন?
মৃন মুচকি হেসে বলল, আমরা একই ক্লাসে পড়ি, একই ডিপার্টমেন্টে। তাই আমাকে আপনি বলার কারন দেখি না। আর বলছিলাম, তোমাদের কি পারিবারিক এয়ারলাইন্সের ব্যবসা আছে?
ভুরু কুঁচকে আবার চাইল নভো, চোখে আগের মতন জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ।
ভুরু কুঁচকানো দেখে হেসে ফেলে মৃন বলল, এই মাত্র একটা উড়োজাহাজ উড়ে যেতে দেখলাম, নভো এয়ার।
নভো আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো, মৃদুস্বরে বলল- না, নেই।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃন ওর পরিচয় দিতে যাবে ভাবল, এমন সময় দেখে ছেলেটা ব্যাগ থেকে হেডফোন বের করে কানে দিলো।
মৃন কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হল। একই সাথে পড়ে, ঘটনাচক্রে পাশাপাশি বসায় আলাপচারিতা শুরু করেছিল, কিন্তু ছেলেটার অনাগ্রহ দেখে নিজের উপর কিছুটা বিরক্ত হল। ছেলেটা বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে খেয়াল করে মৃনের বিরক্তি চাপা রাগে রূপান্তরিত হল।
কিছুক্ষণ বাদেই এক সিনিয়র ভাইয়া এসে দেখল পাশাপাশি দুই সিটে ছেলে-মেয়ে একসাথে বসা। হাবভাবেই বুঝে গেলো ফার্স্ট ইয়ার। সিটটাতে যদিও ছেলেদের বসার কথা কিন্তু অইপাশে বসা অনিন্দ্যসুন্দর মেয়েটাকে তো কিছু বলা যায় না, তাই সে নভোর দিকে ফিরলো-
ঃ এই তুই জানিস না ভার্সিটির বাসে মেয়েদের পাশে বসার নিয়ম নাই?
নভো বলল, ভাইয়া এটা তো ছেলেদের সিট। আর কোন সিট তো খালি নেই।
নভোর জবাব শুনে সিনিয়র ভাই খুব খেপে গিয়ে বলল- তুই আমাকে শিখাতে চাস কোনটা ছেলেদের সিট আর কোনটা মেয়েদের?
নভো কথা বাড়াল না, চুপ করে উঠে গিয়ে পিছন দিকে গিয়ে দাড়িয়ে রইল।
ছেলেটার নিঃস্পৃহ ভঙ্গি দেখে সিনিয়রের গা জ্বলে গেলো, সুন্দর একটা মেয়ের সামনে ভাব দেখিয়ে উঠে গেলো! পিছনে গিয়ে একহাত দেখে নেয়ার উদ্দেশ্যে বলল, তুই আমার কথার জবাব না দিয়ে উঠে গেলি কেন? দুইদিন হয়নাই ভর্তি হয়েছিস, এখনি বেয়াদবি শুরু করে দিয়েছিস!
নভো শান্ত স্বরে বলল, মেয়েদের পাশে বসার নিয়ম নেই এটা আমার জানা ছিল না ভাইয়া, ওটা যে মেয়েদের বসার জন্যে সেটাও আমি জানতাম না।আমি দুঃখিত।
এরকম শান্ত জবাবের পর সিনিয়র ভাই আর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে নভোর সামনে থেকে চলে গেলো। নভো চুপচাপ দাড়িয়ে গান শুনতে লাগলো। মৃন অবাক চোখে এই অদ্ভুত ছেলেটাকে দেখতে লাগলো।
ফার্মগেটের কাছাকাছি এসে হঠাৎ করে বাস দাড়িয়ে গেলো। সামনে কিসের যেন খুব শব্দ হচ্ছে, অনেক মানুষের আওয়াজ আর ভাংচুরের শব্দ। মনে হয় কোথাও মারামারি হচ্ছে! ছেলেরা অনেকেই বাস থেকে নেমে গেলো সামনে কি হয়েছে দেখার জন্যে। মৃন জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো। কৌতূহলের বশে পিছন তাকিয়ে দেখল ছেলেটা একইভাবে কানে হেডফোন গুঁজে দাড়িয়ে আছে। কি অদ্ভুত ছেলেরে বাবা! ভাবল মৃন, এই উত্তেজনাতেও কোন বিকার নেই!
হঠাৎ সামনে হুটোপুটি শুরু হল, দলে দলে লোকজন এদিক সেদিক ছুটতে লাগলো। ভাঙচুরের শব্দ বাড়তে লাগলো। পরিস্থিতি দেখতে যাওয়া ছেলেদের মধ্যে কয়েকজন দৌড়ে এসে বাসচালককে তাড়া দিতে লাগলো গাড়ি ঘোরানোর জন্যে।
বাসচালক বাস ঘুরাতে গিয়ে দেখল পাশে গাড়ি ঘুরানোর কোন জায়গা নেই। সব গাড়ি একসাথে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় সব গাড়ি আটকে গেছে, কারোরই আর বের হওয়ার উপায় নেই।
সবার আতঙ্কিত কথার মাঝে মৃন বুঝতে চেষ্টা করলো কি হয়েছে সামনে। শুনতে পেলো, বেশ কিছুদিন ধরেই তেজগাঁও কলেজের ছেলেদের সাথে ঢাকা ভার্সিটির ছেলেদের কিছু একটা নিয়ে ঝামেলা চলছে। কয়েকদিন আগে নীলক্ষেতে তেজগাঁও কলেজের কয়েকটা ছেলেকে ঢাকা ভার্সিটির ছাত্ররা বেশ মেরেছে। আজকে ওরা নিজেদের এলাকায় অপেক্ষা করে ছিল, জানত যে ঢাকা ভার্সিটির বাসগুলো এদিক দিয়েই যাবে। সামনে ভার্সিটির একটা বাস ভাঙচুর করেছে ওরা, আশেপাশের অন্য গাড়িগুলোও রেহাই পাচ্ছে না। দুই পক্ষে বেশ মারামারিও হচ্ছে । পথচারী সহ অনেকেই আহত হয়েছে।
হঠাৎ সামনের একটা গাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। নতুন করে কোথা থেকে যেন আরও অনেকে এসে ভাঙচুরে যোগ দিলো। রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেলো পুরো এলাকাটা। একজন খবর নিয়ে আসলো, তেজগাঁও কলেজের দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই খবর শুনে তেজগাঁও কলেজের ছাত্ররা অনেকেই বের হয়ে এসেছে। এবং ওরা এইদিকেই আসছে, শুনেছে যে পিছনে নাকি ঢাকা ভার্সিটির আরও বাস আছে। শুনে পুরো বাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো।
নভো শান্তভাবে কানে হেডফোনে গুঁজে রাখলেও ও এখন আর গান শুনছে না। চারপাশের পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। জানালা দিয়ে খেয়াল করলো অনেকগুলো ছেলে গাড়ি ভাঙতে ভাঙতে এদিকেই আসছে, মনে হল ওরা ‘ক্ষণিকা’ দেখতে পেয়েছে। হঠাৎ ঘুরে ছেলেগুলো দৌড়ে ফিরে গিয়ে আরও অনেককে ডাকতে থাকে। বিপদ ভালভাবেই টের পেলো নভো। বাসে তাকিয়ে দেখল বেশিরভাগই মেয়ে, শুধু অল্প কয়েকজন ছেলে।
হেডফোনটা পকেটে ভরে রেখে নভো সবাইকে পরিস্থিতি ব্যাখা করলো। ওর কণ্ঠে এমন কিছু একটা ছিল যাতে সবাই ওর কথা গুরুত্ব সহকারে নিলো। নভো সবাইকে বলল এখানে থাকাটা আর নিরাপদ হবে না, বের হয়ে যেতে হবে। তবে সবাই একসাথে না, একসাথে এতো মানুষ যদি ছুটে যায় ওরা বুঝে ফেলবে। তিন থেকে চারজনের ছোট ছোট গ্রুপে ওরা ভাগ হয়ে গেলো। নভো বামপাশের ফুটপাত দেখিয়ে সবাইকে ওটা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যেতে বলল, কিছুদূর হাঁটলেই সামনে বামপাশে একটা ছোট গলি পড়বে, ওখান থেকে রিক্সা নিয়ে সহজেই শাহবাগ চলে যেতে পারবে। নভোর কথামতো সবাই এসে যখন গলিতে রিক্সা ঠিক করছিলো আর স্বস্তি প্রকাশ করছিলো, তখন মৃন খেয়াল করলো নভো ওদের পাশে নেই। পিছনে তাকিয়ে দেখল ছেলেটা আবার বাসের দিকে ফিরে যাচ্ছে। দূরে দেখতে পেলো ওদের বাস ভাঙচুর শুরু হয়েছে। অজানা আশঙ্কায় মৃনের বুকে ধাক্কা মতন লাগলো। সকালের সিনিয়র ভাইটা বলে উঠলো, এখান থেকে তো ওকে ডেকে ফেরানো যাবে না, আমি গিয়ে ওকে নিয়ে আসি, বলেই সে দৌড়ে এগিয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পরে ওদের দুজনকেই দেখা গেলো কাউকে ধরে নিয়ে আসছে। কাছে আসতেই বোঝা গেলো সে আর কেউ না, ক্ষণিকার বাস চালক। নভো দূর থেকেই খেয়াল করেছিল যে চালক বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেছে। বেকায়দায় পড়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছে, তাকে ফেলে তো আর আসা যায় না। তাই সে ফিরে গিয়েছিলো। শুনে কেন যেন অদ্ভুত ভালো লাগায় মৃনের মন ভরে গেলো।
এখন ফেরার পালা, দুইজন দুইজন করে একেকটা রিক্সায় করে রওনা হয়ে গেলো। মৃনের হঠাৎ ইচ্ছে করতে লাগলো এই অদ্ভুত ছেলেটার সাথে এক রিক্সায় যেতে। শেষে দেখা গেলো, রিক্সা একটি কিন্তু ওরা যাওয়ার বাকি রয়েছে তিনজন।
হঠাৎ কোন কথা না বলেই নভো হাটতে শুরু করলো। তীব্র রোদ, পিচঢালা পথটা আজকে বেশ তেঁতে উঠেছে।
(অসমাপ্ত)
পাদটীকাঃ
ব্লগার রিম সাবরিনা জাহান সরকার ও ব্লগার পদ্ম পুকুরের ‘পিলো পাসিং’-এ অনুপ্রাণিত হয়ে গল্পটির তৃতীয় অংশ লেখার ক্ষুদ্র অপচেষ্টা। লিখার মান যেমনই হোক, আশা করি এর ধারাবাহিকতায় চতুর্থ পর্ব কেউ লিখে ফেলবেন।
পর্ব ৪ লিখেছেন খায়রুল আহসান
পর্ব ৫ লিখেছেন [link|https://www.somewhereinblog.net/blog/akhenaten|আখেনাটেন
পর্ব ৬ লিখেছেন পুলক ঢালী
পর্ব ৭ লিখেছেন নিয়াজ সুমন