শীতের বিকেল । ক্যাম্পাস থেকে ফিরছিলাম। প্রচণ্ড ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে একসময় বাসে উঠতে পারলাম। বাসের সামনের দিকের ভিড়টা আমার একদমই পছন্দ না, তাই একটু ঠেলে জায়গা করে নিয়ে বরাবরের মতো পিছন দিকে চলে আসলাম। একটু পরেই পরের স্টপেজ থেকে আরও একদল লোক উঠে গেলো। পুরো বাসে একদম গুমোট অবস্থা, নিঃশ্বাস নেয়া কষ্ট। যাই হোক, তারপরের স্টপেজে এসে ভিড় কিছুটা কমলো, আমি বসার জায়গা পেলাম একদম পিছনের সারির সর্ব ডানের আসনে। কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, যাক বসে যাওয়া যাবে অন্তঃত।
ওই স্টপেজ থেকে একজন বয়স্ক মানুষ উঠলেন। ভিড় ঠেলে এসে ঠিক আমার সামনের সারির আসনের পাশে দাঁড়ালেন। প্রথমে উনাকে খেয়াল করিনি, আমার গানে মগ্ন ছিলাম। পরে বোটকা গন্ধ ও লোকজনের বিরক্তিসূচক শব্দে উনাকে খেয়াল করলাম।
বেশ বয়স্ক, মাঝারি উচ্চতার, হালকা গড়নের মানুষ। পরনে অবিন্যস্ত পুরনো ময়লা কাপড়, সেখান থেকেই বোটকা গন্ধ আসছে। ভিখিরিসুলভ চেহারা হওয়ায় সবাই বেশ বিরক্ত তার বাসে উঠায়। বেশ বয়স্ক হওয়ায় অভ্যাসবশত আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলাম, উনাকে বসার অনুরধ করলাম। কিন্তু পাশের আসনে বসা লোকের আপত্তিতে উনি বসতে রাজি হলেন না। আমি হালকা তর্ক করার পরে পাশের আসনে বসা লোকটি চুপ করে গেলো, কিন্তু বয়স্ক মানুষটি আর বসতে চাইলেন না। একটু অবাক হলাম, কিন্তু বেশি আর কথা বাড়ালাম না।
বাস ফাঁকা রাস্তা পেয়ে যখন জোরে টান দিলো, শনশন করে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে লাগলো। বেকায়দা দেখে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম । একটু পরেই বয়স্ক মানুষটা বললেন জানালা খুলে দিতে। আমি বললাম যে বাইরে অনেক বাতাস হচ্ছে, এখন জানালা খুলে দিলে সবার অসুবিধা হবে। শুনে উনি একটু খেপে গেলেন, রাগত স্বরে জানালা খুলে দিতে বললেন। আমি বললাম আপনি বয়স্ক মানুষ, আপনার শীতের কাপড়ও নেই, ঠাণ্ডা লেগে যাবে ।
উনি বললেন আমার রক্ত যথেষ্ট গরম আছে, মাঘের শীতে সারারাত খালে বিলে আর্মির অপেক্ষায় ছিলেন বহুবার ।
ঃ আপনি কি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন?
- হ্যাঁ ।
ঃ আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা?
- হ্যাঁ ।
মুক্তিযোদ্ধা শুনে বেশ কয়েকজন ঘুরে তাকালেন, বেশিরভাগের চোখে দেখলাম বিরক্তি, বোধকরি উনার পোশাক একটি কারন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা শুনে উনার চোখের হঠাৎ জ্বলে উঠা আলোটুকু আমার চোখ এড়ালো না।
আমি বসা থেকে উঠে গিয়ে উনার হাত ধরে আমার আসনে বসালাম। উনি জানালাটা অল্প খুলে দিলেন। খেয়াল করলাম উনার চুল জট পাকানো, শরীর বেশ নোংরা, অনেকদিন হয়ত গোসল করা হয়না। প্রচণ্ড কৌতূহলে অনেক প্রশ্ন করলাম, উনিও কিছুটা সহজ হয়ে এলেন।
রহমত মৃধা, বাড়ি রাজশাহীতে, ৭ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। একান্নবর্তী পরিবার ছিল, কিন্তু যুদ্ধ শেষে মা ছাড়া আর কাউকেই ফিরে পাননি। পালিয়ে যুদ্ধে যাওয়া, ক্যাম্পে ট্রেনিং, সম্মুখযুদ্ধের গল্প, বাড়িতে লেখা চিঠি, কত গল্প। ব্যক্তিগত হাহাকারের গল্প, পরিবার হারানো, মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়া, পরবর্তীতে স্বাধীনতাবিরোধীদের ও ভিলেজ পলিটিক্সের খপ্পরে পরে বসত ভিটা, জমিজমা হারানোর গল্প চোখ আদ্র করে দিলো। আমার যুদ্ধের বর্ণনা শোনানোর অনুরধে উনি খুব অবাক হয়ে বললেন এসব আমি কেন শুনতে চাই । আমি বললাম একজন মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি বসে তার মুখে যুদ্ধদিনের কথা শুনবো এমন সৌভাগ্য আমার আগে কখন হয়নি ।
উনার এবং সহযোদ্ধাদের অনেকের গল্প শুনলাম, ব্রিজ উড়ানো, স্কুলঘরের ক্যাম্প উড়ানো, নৌকা ফুটো করে রাখা ইত্যাদি অনেকগুলো ঘটনা শুনলাম। অদ্ভুত এক শিহরন খেলে গেলো শরীরে, দেখলাম মানুষটা উত্তেজনায় কাঁপছেন। এর মাঝে পাশের আসনের একজন বিরক্তস্বরে বলে উঠলেন “আজাইরা গল্পের আর জায়গা পায়না”। আমি প্রতিবাদ করলাম,বেশ বিরক্তও হলাম, বললাম, উনার আবেগটা একটু দেখুন, আর এই বয়সে কোন মানুষ এতোটা মিথ্যে কেন বলবেন? আর কিছু না পারুন একজন বয়স্ক মানুষকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু তো দিবেন? উনি আর কথা বাড়ালেন না।
উনার সাথে গল্প করার সময় আমার বারাবার হলিউডের মুভিগুলোর কথা মনে পড়ছিল । ওদের মুভিতে দেখি দেশের কৃতি-সন্তানদের সবাই স্যালুট করে আর বলে “থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইউওর সার্ভিস”। আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এমন করতে। গন্তব্যস্থল আসতেই মুক্তিযোদ্ধা রহমত মৃধা উঠে দাঁড়ালেন। আমি হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, দেশের জন্যে, আমাদের ভবিষ্যতের জন্যে আপনারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার কোন তুলনা হয় না। আপনাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু আমরা দিতে পারিনি । তবে আপনি মনে কষ্ট রাখবেন না, আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা আপনাদের অবদান এখনও শ্রদ্ধা ভরে মনে করে, এবং ভবিষ্যতেও করবে । জানি উনি ইংরেজি বুঝবেন না, তারপরেও বললাম- থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইউওর সার্ভিস, স্যার।
আমার কথা শুনে উনার চোখে পানি চলে আসলো। আমার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে উনি তাড়াতাড়ি করে নেমে গেলেন।
পাদটীকাঃ আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল উনার জন্যে কিছু করি। ছোট্ট একটা টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতাম।মাসের শেষদিক, পকেটে মাত্র সত্তর টাকা! এই টাকায় একবেলা ভালো খাবারও হবে না, একটা কাপড়ও হবে না । উনার অবস্থা খুবই খারাপ, আমার অনুমান এই পরিমান টাকাটাও উনার জন্যে অনেক। ভাংতি সত্তর টাকা দিলে উনার অপমান হবে কিনা সেটাও বুঝতে পারতেছিলাম না । উনার বাসার ঠিকানা বা ফোন নাম্বার দিতে উনি খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। অভিমানী যোদ্ধা কারও সাহায্য নিতে চান না। ফলে আমি ইতস্ততঃ করতে করতে উনি চলে গেলেন। তবে উনার বাস ভাড়াটা দিতে পেরেছিলাম। একটা আফসোস থেকে গেলো উনার জন্যে কিছু করতে না পেরে। পরবর্তীতে উনি যেখানে নেমেছিলেন সেখানে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও উনার খোঁজ বের করতে পারিনি ।
আমাদের বীর নায়কেরা শেষ সময়টুকুতে একটু সম্মান নিয়ে থাকতে পারলো না এইরকম একটা দেশ আমরা কেমন করে বানালাম?!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০২০ রাত ১:০৮