somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিজের একটি কামরা

২৩ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আপনাদেরকে বলা উচিত যে আমার খালা মেরি বাটন,মারা গিয়েছিলেন বম্বে শহরে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানোর সময় ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে।আমার এই উত্তরাধিকারের সংবাদ যে রাতে পেলাম সে দিনই নারীদের ভোটাধিকার সংক্রান্ত আইন পাশ হয়।উকিলের এক চিঠি আমার বাক্সে পড়ল এবং আমি খুলে দেখি খালা আমাকে আজীবন বার্ষিক পাচঁশত পাউন্ডের আয় দান করে গিয়েছেন।আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে, ভোটাধিকার এবং অর্থ-এই দুটোর মধ্যে টাকাটাই আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল।তার আগে আমার জীবিকা ছিল সংবাদপত্রের জন্য টুকিটাকি খবর পরিবেশন করা,কোন এক ঘোড়া প্রদর্শনী কিংবা কোন বিয়ের আসর নিয়ে লিখতাম।এছাড়া আমি খামের উপর ঠিকানা লিখে,বৃদ্ধাদের বই পড়ে শুনিয়ে,কৃত্রিম ফুল বানিয়ে,স্কুলে বাচ্চাদের হাতেখড়ি শিখিয়ে ইত্যাদি কত উপায়ে সামান্য কিছু রোজগার করেছি।১৯১৮ সালের পূর্বে নারীদের জন্য এই কয়েকটি পেশাই ছিল উন্মুক্ত।এসব কাজের কষ্টসাধ্যতা আপনাদের হয়ত বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই,কারন আপনারা সম্ভবত এমন পেশায় কর্মরত মহিলাদের চেনেন;এসব কাজে উপার্জিত আয়ে জীবন নির্বাহ করা যে কত দুঃসাদগ্য তাও হয়ত আপনারা চেষ্টা করে দেখেছেন।কিন্ত আজ পর্যন্ত আমার কাছে এই দুই কষ্টের চেয়ে বেশি বেদনাদায়ক মনে হয় সেই দিন গুলি আমার অন্তরে ভীতি আর তিক্ততার যে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, ফেরত টাকা ব্যাগে ভরতে ভরতে বিগত দিনের তিক্ততা স্মরন করে আমি ভাবছিলাম একটি নির্দিষ্ট আয় থাকলে মানসিকতার কি অবাক করা পরিবর্তনই না ঘটে।পৃথিবীর কোন শক্তিই আমার পাচঁশত পাউন্ড কেড়ে নিতে পারবে না।চিরদিনের মত আমার খাদ্য,বাসস্থান আর পোশাকের কোন চিন্তা নেই।সুতরাং, শুধু যে আমার পরিশ্রম আর উদ্যম কমেছে তা নয়,তিক্ততা আর ঘৃণাও কমেছে।কোন পুরুষকে ঘৃণার প্রয়োজন আমার নেই,সে আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।কোন পুরুষের মন রক্ষা করে আমায় কথা বলতে হবে না,আমাকে দেয়ার তার কিছুই নেই।এ কারনে অচেতনভাবে মানব জাতির অপর অর্ধাংশের প্রতি আমার দৃষ্টভঙ্গির পরিবর্তন ঘটতে থাকল।যে কোন শ্রেণী বা লিঙ্গকে সামগ্রিকভাবে দোষী মনে করা বাতুলতা।বড় একটি জনগোষ্ঠী কখনই তাদের কর্মকান্ডের জন্য দায়ী নয়।তাদের নিয়ন্ত্রন নেই এমন প্রতিন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।কোন কোন দিক থেকে তাদের শিক্ষা আমার শিক্ষার মতই ত্রুটিপূর্ণ ছিল।তাদের মধ্যেও সমান মারাত্মক বিকলতা লালিত হয়েছিল।
......................................................................................................

কিংবা বসন্তের রৌদ্রভরা সকালে স্টক ব্যবসায়ী আর নামজাদা উকিলের দিকে তাকান,অফিসে ঢুকে টাকা, আরও টাকা এবং আরও টাকা উপার্জন করছে,যখন এটা প্রমাণিত সত্য যে বছরে পাচঁশত পাউন্ড একজন মানুষকে রৌদ্রালোকে রাখতে পারে।ভাবলাম এমন প্রবণতা মনে লালন করা খুবই অপ্রীতিকর।এদের জন্ম জীবনের বাস্তবতা থেকে,সভ্যতার অভাব থেকে,ভাবতে ভাবতে
আমি Duke of Cambridge - এর মূর্তির দিকে তাকালাম,বিশেষ করে তার মাথার হেলানো টুপিতে গোঁজা পালকের দিকে,এর আগে কেউ বোধহয় অমন অপলকভাবে এদের দিকে তাকিয়ে থাকেনি।আর এসব সীমাবদ্ধতা উপলব্ধির সাথে সাথে ভীতি আর তিক্ততা ধীরে ধীরে সহনশীলতা আর করুনায় রূপান্তরিত হল; আরও দুই-এক বছর পরে সহনশীলতা আর করুনাও গেল, আর সবচেয়ে বড় মুক্তি এলো - যে কোন জিনিসকে অন্য বস্তু হতে পৃথক করে চিন্তা করতে পারার স্বাধীনতা।যেমন ঐ দালানটি কি আমি পছন্দ করি না অপছন্দ করি? এই ছবিটি কি সুন্দর?আমার মতে বইটি কি ভাল না মন্দ? আসলেই খালার উত্তরাধিকার আমার জন্য আকাশকে অবারিত করে দিয়েছে ,এবং পুরুষের বিশাল ক্ষমতাধর অবসরকে,যা মিল্টন আমার চিরন্তন আনুগত্যের জন্য অনুমোদন করেছিলেন তা প্রতিস্থাপিত করেছে।
.....................................................................................................

এই বক্তৃতার মধ্যে আমি বলেছি যে শেক্সপীয়রের একটি বোন ছিল;তবে স্যার সিডনী লীর লেখা জীবনীতে তাকে খুজেঁ পাবেন না।তিনি অল্প বয়সে মারা যান-হায় একটি বাক্যও তিনি লিখে যাননি।তিনি শায়িত 'Elephant and Castle'- এর বিপরীতে,সেখানে এখন বাস থামে।আমার বিশ্বাস এই কবি,যিনি কখনও কিছু লেখেননি এবং চৌরাস্তায় যাকে করব দেয়া হয়েছে,তিনি এখনও বেঁচে আছেন।তিনি বেঁচে আছেন আমার এবং আপনার মাঝে, এবং আরও অন্য নারীর মাঝে, যারা আজ রাতের এই সভায় আসেননি,কারন তারা বাসন ধুচ্ছেন এবং সন্তানদের ঘুম পাড়াচ্ছেন।কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন কারন মহান কবিরা মরেন না; তাদের উপস্থিতি চিরন্তন; তারা শুধু আমাদের মাঝে রক্ত-মাংসের দেহ ধারন করার সুযোগ খোঁজেন।
আমার মতে,সেই সুযোগ তাকে দেয়ার ক্ষমতা এখন আপনাদের আয়ত্তে আসছে।

আমার বিশ্বাস ,আমরা যদি একশত বছর বাঁচি-আমি সার্বজনীন জীবনের কথা বলছি, সেটাই প্রকৃত জীবন,ব্যক্তি হিসাবে আমরা যে পৃথক পৃথক সংক্ষিপ্ত জীবন যাপন করি তা নয়-এবং আমাদের প্রত্যেকের বছরে পাঁচশত পাউন্ড আর নিজের কামরা থাকে,আমরা যদি স্বাধীনতায় অভ্যস্ত হই এবং যা চিন্তা করি অবিকল তাই লেখার সাহস অর্জন করি ;আমরা যদি বৈঠকখানা থেকে বের হই এবং মানুষকে একে অপরের যোগসূত্রে নয়,বরং বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত রুপে দেখতে পারি ; এবং আকাশকেও দেখি,আর গাছপালা বা অন্য যেকোন কিছু আপন আপন রুপে দেখতে পাই; আমরা যদি মিল্টনের ভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে পারি, কারন কোন মানুষেরই বাইরের দৃশ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত নয়; আমরা যদি এই বাস্তবতা স্বীকার করি যে আঁকড়ে ধরার মত কোন বাহু নেই।
কারন এটাই সত্য, আমরা একা পথ চলি এবং আমাদের সম্পর্ক হল বাস্তব পৃথিবীর সাথে,শুধুমাত্র নারী ও পুরুষের পৃথিবীর সাথে নয়,তাহলে সেই সুযোগ আসবে এবং শেক্সপীয়রের বোন সেই মৃত কবি,আকার ধারণ করবে,যা সে এতবার পরিত্যাগ করেছে।তার জীবনীশক্তি আসবে তার অজানা সব পূর্বসূরীদের জীবন থেকে,যেমনটি ইতিপূর্বে তার ভাই পেয়েছিল।এই পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া, আমাদের এই প্রচেষ্টা ছাড়া,এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছাড়া যে আবার তিনি যখন জন্ম লাভ করবেন,তখন তার পক্ষে বেঁচে থাকা এবং কবিতা লেখা সম্ভব হবে,আমরা আশা করতে পারি না যে তিনি আসবেন,কারন এটা অসম্ভব।কিন্তু আমি নিশ্চিত যে তিনি আসবেন যদি আমরা তার জন্য পরিশ্রম করি,আর সেজন্যই দারিদ্র্য ও অখ্যাতির মাঝেও কাজ করা যথার্থ হবে।

**************************************************

ভার্জিনিয়া উলফ-এর বিখ্যাত রচনা A Room of One’s Own (১৯২৯) এর অংশবিশেষ
অনুবাদ:সামিনা চৌধুরী
'নারী প্রশ্ন প্রসঙ্গে' গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত


সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১১:০৪
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×