মৃণালিনী দাস, মাইমুনা খাতুন হয়েছে আজ প্রায় ৩৫বছর। যদিও মাইমুনা জানেনা, মৃণালিনী কিংবা মাইমুনা কোনটায় তার বিশেষ কোন সুবিধা হয়েছে কি না! সে শুধু জানে হেরে যাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে তার নামটা লেখা থাকবে। সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে....বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে জ্বরটা বাড়ছে তার। বারান্দায় বসে নরম মাটিতে বৃষ্টির জলের এলোপাতাড়ি আঘাতগুলো দেখছিল সে।৩৫ বছর ধরে বয়ে চলা কষ্টগুলো আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। আজ নিজেকে বাধা দেয়না সে। খানিকটা খুচে আগুন উসকে দেবার মত করে নিজেকে উসকে দেয় আজ। ক্লান্ত শরীরটা গুলিয়ে উঠে জানান দেয় সময় বেশি নেই। বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসটা অবশেষে বেরিয়েই আসে। চাপাস্বরে "মা" ডাকটা শুনে উঠতে হয় মাইমুনাকে। তার একমাত্র ছেলে কবির বিছানা নিয়েছে আজ প্রায় ২মাস হল। ছোটখাটো একটা স্ট্রোক করেছিল। মাত্র ২৯বছরে কবির উচ্চরক্তচাপের রোগী। যে মেয়েটিকে ভালোবেসে সুন্দর একটা জীবনের আশা করেছিল কবির, সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল ২ মাস আগে। সেই রাতেই স্ট্রোক করে কবির। অহনা কে অভিশাপ দেয়নি মাইমুনা। সবাই তো তার মত হতে পারেনা...................
৩৫ বছর আগে............
মৃণালিনী(মাইমুনা) তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী। সদ্য ভারত থেকে ফিরেছে সে আর তার বড় বোন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভীষণ সুন্দরী দুইবোনকে তার বাবা সুধেন দাস ভারতে পিসির বাড়ি পাঠিয়ে দেন। দেশে ফিরে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয় মৃণাল। হামিদদের বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে যেত সে। হামিদ প্রায়ই উঠোনে বসে গলা ছেড়ে গাইতো "মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দেব খোপায় তারার ফুল"। কতদিন কতবার মৃণাল স্বলজ্জ চোখে হামিদকে চেয়ে দেখেছে, খোপা বাড়িয়ে দিতে চেয়েছে তারার ফুল পরবার জন্য তার হিসেব নেই। হামিদের চোখেও সে দেখতে পেত সেই মায়া, সেই অগাধ টান। বাংলার ছাত্র হামিদের গান আর আবৃত্তির কন্ঠ ছিল অসাধারন। প্রায়ই মৃণালের বাবা সুধেন দাসের সাথে বসে আবৃত্তি করতো হামিদ। সুধেন কাকাই তার কাব্য প্রতিভার গুনমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন। কতদিন পর্দার আড়াল থেকে মৃণাল সে কন্ঠের ঝাঝ শুনে মুচকি হেসেছে! হামিদ ছিল মুক্তিযোদ্ধা। সেসব দিনের গল্প শোনাত সে সুধেন কাকাকে। মৃণাল মুগ্ধ হয়ে শুনতো আড়াল থেকে সে সব!
হামিদও জানতো মৃণাল শুনছে। তাই গাইবার সময়, আবৃত্তির সময় কিংবা গল্প বলার সময় কন্ঠে ঢেলে দিত কিছু অতিরিক্ত দরদ। সে দরদ কবে যে দরিয়া হয়ে মৃণালের বুকে বইতে শুরু করলো সে খবর মৃণালের অগোচরেই থেকে গেল! সময় বয়ে যায়। হামিদ আর মৃণাল চোখের ভাষায় নিজেদের সমর্পণ করে একে অন্যের কাছে। একদিন সকালে স্কুলের পথে রওনা দিল মৃণাল। হঠাৎ সাইকেল চালিয়ে কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে এলো হামিদ। মৃণালের সামনে দাড়িয়ে বললো " মৃণাল, যেখানে যাব, যেমন করে রাখব সে ভাবেই তেমন করেই থাকতে পারবে?" হকচকিত মৃণাল প্রথমটায় কোন কথাই বলতে পারলো না। কোনভাবে মাথা কাৎ করে সম্মতি জানালো। হামিদ আবার বললো "তবে চলো আমার সাথে, এখনই"! কোথা হতে এক উন্মাতাল শঙ্খিনী ভর করলো মৃণালের ওপর। পাশের পুকুরে বই খাতা ছুড়ে ফেলে হামিদের হাত ধরে চলে গেল ঘর ছেড়ে! সেই রাতে মৃণালিণী দাস হয়ে যায় মাইমুনা খাতুন! তারপর কতদিন কত রাত পালিয়ে থাকা। সেই দিনগুলো আজও কেমন যেন জীবন্ত হয়ে আছে মাইমুনার স্মৃতিতে!
:মা?
চমকে ওঠে মাইমুনা। তাকায় কবিরের দিকে।
:বল বাবা
:শুয়ে শুয়ে বড় বিরক্ত হয়ে গেছি মা। কতদিন আকাশ দেখিনা!জানলা টা খুলে দাও না একটু।
জানলা খুলে দিলো মাইমুনা। জানলার পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লো নিজেও। ছাদের পানি চুঁয়ে পড়ছিল জানলার ধার ঘেষে। সেদিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে।
:মা? কাল রাতে বাবা বাড়ি ফেরেনি?
:নাহ। শেখের চরেই ছিল বোধ হয়।
দীর্ঘশ্বাস নেয় কবির। তখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে সে। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে মা খুব কাঁদছে, আর দাদি তাকে শান্তনা দিচ্ছে। সে দাদিকে জিজ্ঞেস করলে মুখ ঝামটি দিয়ে রাগে গর গর করতে করতে দাদি জবাব দেয় "তর বাপে আরেকখান বিয়া করছে, এক বেডীতে পোষায় না তর বাপের! এমুন কালসাপ প্যাটে ধরছিলাম আমি"! বাবার উদ্ধত আচরণ, মায়ের কান্নায় কবির ভুলে গিয়েছিল সুখের সংজ্ঞা। বাড়ির দখল সংসারের দখল মায়ের হাতে থাকলেও বাবার দখলটা তার দ্বিতীয় স্ত্রীই পায়। তাকে বুকে নিয়েই তার মা বেঁচে থাকে। একদিন ওর জীবনে আসে অহনা। ভীষণ প্রাণ চঞ্চল মেয়েটি প্রাণহীন কবিরের ভেতর প্রাণের সঞ্চার করে। ঘুমহীন রাতগুলো কবিরের কবিতা আর অহনার গানে কেটে যেত। মুঠোফোনের প্রতি অসামান্য কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে নিত্যদিন মুঠোফোন কোম্পানির পসার বাড়াতো ওরা দু'জন! সেই অহনা চলে গেছে দু'মাস আগে, অন্য কোন রাজত্বে, অন্য কারও স্বপ্ন সাজাতে! পেছনে ফেলে গেছে কবিরকে, প্রাণহীন সেই কবির! আবার দীর্ঘশ্বাস পড়ে কবিরের।
:কি হয়েছে বাবা?
:কিছু না মা। তোমার জ্বরটা কি কমলো?
:তা কমেছে বৈ কি। শুধু শরীরটা বড় ক্লান্ত।
কবির আর কোন কথা বলেনা। মাইমুনা আবার ডুবে যায় ভাবনায়। ৩৫ টি বছর কেটে গেল। সে আর কখনও মৃণাল হয়ে উঠতে পারেনি। জাতিচ্যুত সেদিনের সেই মেয়েটিকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মেনে নিলেও মেনে নেয় নি বাবা। বাবার মৃত মুখটাও দেখার অধিকার হারিয়েছিল সে। তাকে ছেড়ে হামিদ কত সহজেই নিজের এক ছাত্রীকে বিয়ে করে ফেলেছিল। সে ঘরে এক মেয়েও হয়েছে, নাম বিভা! কত জল গড়িয়ে গেল হামিদ ফেরেনি। একলা মাইমুনা প্রতিদিন আগের দিনের চেয়ে আরেকটু বেশি একা হয়ে গেছে। অভিযোগ করার কেউ ছিলনা, থাকলেও কোরত কি না সে জানেনা! আজ প্রায় বাইশটি বছর হামিদের মুখে হাসি দেখেনি সে। হাসিমুখের একটা কথারও যোগ্য নয় মাইমুনা। যেন অবশ্যম্ভাবি এক শাস্তি দিচ্ছে হামিদ তাকে। শুধু অপরাধটা কি সেটাই জানা হলনা তার! মাইমুনা জানে সে জ্বলছে, ভালোবেসে, স্বপ্ন দেখে। কবিরও জ্বলছে। সবাই জ্বলে। ভালোবেসে সবাই জ্বলে। এক একজন একেকরকমভাবে জ্বলে।
:মাগো কয়ডা ভাত হবে, বড় ক্ষিদা.....
বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে এক ভিখেরী দরজায় দাড়িয়ে মাইমুনার মুখে চেয়ে আছে....
"পোড়া স্বপ্ন আছে, নেবে?"...মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় মাইমুনার কিংবা মৃণালিণীর। ভিখেরী অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। আজ আরেকবার মাইমুনার মৃণালিণী হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে...........................(সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা)
(পুনশ্চ: কবির বিয়ে করেছে, একটা মেয়ে আছে, নাম মৃত্তিকা। অহনাকে ভুলতে পারেনি, সব জেনে বউ মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকে। অহনার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, কি কারনে সেটা অজানাই থাক। প্রতিদিন প্রতিক্ষন অপরাধবোধে পুড়ে ছারখার হয় অহনা। বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তার ছিলনা। মনে মনে প্রার্থনা করে মৃত্যুর আগে হলেও একবার যেন কবিরের কাছে ক্ষমা চাইতে পারে! মাইমুনা ক্ষমা করে দিয়েছে অহনাকে, খুব বেশি কষ্টে কবিরকে বুকে নিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে.....অবশেষে ভালোবেসে সবাই জ্বলে!)