রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সোহরাওয়ার্দী হলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারী রুস্তম আলী আকন্দ দেশের কলুষিত ছাত্ররাজনীতির সর্বশেষ বলি। ব্যক্তিগতভাবে আমি রুস্তমকে চিনি ও জানি। সে আমার কলেজ বন্ধু ছিল। রুস্তম এবং আমি রংপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে দুই বছর পড়ালেখা করেছি। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুবাদে সে চলে গিয়েছিল রাজশাহী আর আমি চলে এসেছিলাম ঢাকায়। মাঝখানে কয়েকবছর আমাদের মাঝে তেমন যোগাযোগ হয়নি। তবে বছরখানেক আগে জানতে পারলাম, সে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একটি হল শাখার ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি সে। পরবর্তীতে একদিন মোবাইলে আলাপকালে সে আমার নিকট ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার ঘটনাকে সত্য বলে স্বীকার করলো। তাকে সেদিন আমি বলেছিলাম, কি দরকার বাংলাদেশের নোংরা রাজনীতির সং¯্রবে নিজেকে নষ্ট করার। সেদিন সে আমার কথার তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। বলেছিল, “বাংলাদেশের নোংরা রাজনীতিকেই পরিশুদ্ধ করতে চাই আমি। সবাই যদি রাজনীতিকে নোংরা বলে এড়িয়ে যায় তবে রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব নেবে কে?” সেদিন রুস্তম আরো বলেছিলো, “আমাদের প্রথাগত রাজনীতির ধারাটাকে পরিবর্তন করতে হবে আমাদের মত তরুণদেরকেই। আর আমি প্রথাগত স্বার্থভিত্তিক রাজনীতির ধারাটাকে পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর নির্মোহ চেতনার আলোকে দেশটাকে গড়তে চাই।” রুস্তমের সেদিনকার কথাগুলো আজো আমার কানে ঝংকার তুলছে।
নির্মল চেতনার অধিকারী এই রুস্তমকে যেদিন হত্যা করা হল সেদিন আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। বারবার মনে হয়েছে সেদিনকার মোবাইল আলাপের কথা। সাথে সাথে কলেজ জীবনের অতীত স্মৃতিও আমাকে ব্যথাতুর করেছে। যে রুস্তম দেশটাকে নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখতো, যে এই দেশের রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে ছাত্ররাজনীতির মাঠে নেমেছিল, যে বঙ্গবন্ধুর চেতনার আলোকে সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলো, সেই কিনা বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত? রুস্তমকে হত্যার মধ্যে দিয়ে এদেশের পঙ্কিল রাজনীতির নিকট নির্মল রাজনীতির পরাজয় ঘটেছে। রুস্তম রাজনীতিকে স্বার্থের উর্ধ্বে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু স্বার্থভিত্তিক রাজনীতি রুস্তমকে ক্ষমা করেনি। সমাজ পরিবর্তনের চেতনার অধিকারী কোন শিক্ষার্থীকে যদি এভাবে ছাত্ররাজনীতির নিকট বলি হতে হয়, তবে সেই ছাত্ররাজনীতিকে আমরা চাইনা। এমন ছাত্ররাজনীতিকে আমরা ঘৃণা করি।
দলীয় অন্তঃকোন্দ্বলের কারনে ছাত্রলীগের অন্য গ্রুপের নেতারা অথবা শিবিরের ক্যাডাররা যারাই রুস্তমকে হত্যা করুক না কেন সে বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে, তবে রুস্তম ছাত্ররাজনীতির কারণেই বলির পাঠা হয়েছে এ বিষয়ে কারোরই দ্বিমত নেই। ছাত্ররাজনীতিই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন যুক্তিকে উড়িয়ে দেয়ার কোন উপায় নেই।
এভাবে আর কত রুস্তম মরবে? আর কত মায়ের বুক খালি হবে? আর কত রক্ত চাই মোরা? কত ছাত্রের জীবনাবসান হলে আমরা ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাববো? এ প্রশ্নগুলো আমি রাখছি; রাষ্ট্রের নিকট, সমাজের নিকট, সরকারের নিকট, রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি বিবেকবান ব্যক্তির নিকট।
অনেক লড়াই করে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সন্তানকে ঘিরে গড়ে উঠতে থাকে বাবা-মাসহ স্বজনদের স্বপ্ন। আর সেই সন্তান যদি লাশ হয়ে ঘরে ফেরেন তবে সেই ভার না সইতে পারে তার পরিবার, না সইতে পারে তার সতীর্থরা। অথচ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা, দলীয় কোন্দলসহ সাম্প্রতিক নানা কারনে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনা আশঙ্কজনক হারে বেড়েছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবক-শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছেন, অতীতের হত্যাকান্ডগুলোর উপযুক্ত বিচার না হওয়ায় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা এসব হত্যাকান্ডকে নুনভাত মনে করছেন। আর এ কারণেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে শিক্ষার্থীদের লাশের মিছিল। অসুস্থ ছাত্ররাজনীতির কবলে পতিত হয়ে আশির দশকের পর থেকে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন ২৮ জন শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার, দলীয় কোন্দল এবং প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে গিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যকার সংঘাতে এসব হত্যাকান্ডের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে বলে অনেকে অভিমত পোষণ করছেন।
শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই নয় দেশের প্রত্যেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে মাঝেই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। রুস্তম হত্যার পূর্বে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও সায়াদ ইবনে মোমতাজ নামে এক ছাত্রলীগ নেতা প্রতিপক্ষের আক্রমণে নিহত হয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও মাঝে মাঝেই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির নামে একের পর এক সহিংসতা আর শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্টের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। তাই ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। প্রত্যেকটি হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত দুস্কৃতিকারীদেরকে সমুচিত শাস্তি দিতে হবে। প্রচলিত আইনের অধীনে অন্যান্য হত্যাকান্ডের যেমন বিচার হয় তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংঘটিত ছাত্র হত্যাকান্ডেরও বিচার করতে হবে। হত্যাকারী নিজ দলের বা যেকোন দলেরই হোক না কেন আইনকে সকলের জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
সর্বশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট নিবেদন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী রুস্তমের প্রকৃত হত্যাকারীদেরকে আইনের আওতায় এনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। যেহেতু আপনি আপনার পরিবারের স্বজনদেরকে একদিনে হারিয়েছেন, সেহেতু স্বজন হারানোর বেদনা আপনি অপেক্ষা আর কেউ বেশি উপলব্ধি করতে পারবেনা। তাই রুস্তমের বাবা-মা সহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের কষ্ট উপলব্ধি তার প্রকৃত হত্যাকারীদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিন।