চলুন দেখি এই মামলার দুই পক্ষের বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে বিচারক মনোনয়নে PCA-CPA এর নিয়মাবলী কি ছিল। নিয়ম অনুযায়ী বিবাদকারী উভয় দেশ একজন করে অরবিট্ট্রেটর নিয়োগ দিতে পারে। ভারত নিয়োগ করে ভারতীও ডঃ প্রেম্মারাজু শ্রিনিবাস রাও। আর বাংলাদেশ নিয়োগ দেয় ঘানার বিচারপতি থমাস মেনসা, যিনি ১৯৬২ সালে আইন এর স্নাতক লাভ করেন। বয়স নিদেনপক্ষে ৮০ এর কাছাকাছি। মামলা চলাকালে ভারতে্র আইনজীবী ডঃ রাও দুইবার আদালতের প্রসিডিংসের এর উপর আপত্তি উত্থাপন করলেও জাজ মেনসা কোন আপত্তি উত্থাপন করেন নাই। এভাবে কি মামলা লড়েছেন তিনি? কেন আমাদের দেশে কি এমন কোন যোগ্য লোক ছিলেন না যাকে নিয়োগ করলে সে জানপ্রান দিয়ে নিজ দেশের জন্য লড়াই করত? কেন ডঃ কামাল হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হোল না, যিনি ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামি লীগের হয়েও আইনজীবী হিসাবে নিয়োগ পেয়ে আন্তরজাতিক আদালতে দায়েরক্রিত তেল-গ্যাস সংক্রান্ত মামলায় জয়লাভ করেন। বিএনপি জাতিও স্বার্থে নিজের দলের তোয়াক্কা না করে বিরোধীদলীয় ডঃ কামাল হোসেনকে নিয়োগ দিয়েছিলো, যেটা খুবই জরুরি ছিল।
এবার দেখি প্রধান সলিসিটার হিসাবে কাকে নিয়োগ দেয়া হয়। সলিসিটারের হিসাবে যাকে নিয়োগ দেয়া হয় তিনি ইরানের বংশদ্ভুত প্রফেসর পায়াম আখাভাম। ধর্মীয় ভাবে বাহাই। তার নিজস্ব প্রোফাইল এ লেখ আছে "Professor Akhavan teaches and researches in the areas of public international law, international criminal law and transitional justice, with a particular interest in human rights and multiculturalism, war crimes prosecutions, UN reform and the prevention of genocide." অর্থাৎ ইনি কার্যত একজন মানবাধিকার আইনজীবী। এবং প্রচুর মানবাধিকার কেস লড়েছেন। সেই তুলনায় মেরিটাইম কেস লড়েছেন মাত্র তিনটি, আর তার মধ্য থেকে দুটোই লড়েছেন বাংলাদেশের হয়ে। একটি হোল বাংলাদেশ-মায়ানমারের সমুদ্রসীমা বিষয়ক মামলা, যার রায়ে বাংলাদেশ বেশ কিছু হাইড্রকার্বন ব্লক মায়ানমারকে আংশিক এবং পুরাপুরি ভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তবুও হাসিনা সরকার তাকে দ্বিতীয় কেসটি লড়বার জন্য নিয়োগ দেয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য তিনি ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন এর তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে এ শেখ হাসিনার মুক্তির কেসেরও রিপ্রেসেন্ট করেন। এমন একজন মুলত মানবাধিকার আইনজিবিকে কেন সমুদ্র সীমা বিষয়ক মামলার ব্যাপারে নিয়োগ দেয়া হোল তা পুরাপুরি ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
এবার চলুন দেখি যে ফার্মটি বাংলাদেশের কাউন্সেলর এবং এডভাইসার হিসাবে নিয়োগ করা হয়ে ছিল। ফার্মটির নাম ফলী এলএলপি। এই ফার্ম এর সাথে বাংলাদেশের চুক্তিতে এমন কোন ক্লস ছিল না যাতে স্পষ্ট করে লেখা ছিল যে ফার্ম এর পক্ষ থেকে কোন ভারতীও বংশদ্ভুত কে এই কেসে নিয়োগ দেয়া যাবে না। বা এই কেসের ব্যাপারে ভারতীও বুংশদ্ভুতদের কাছ থেকে সর্বচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে। যার প্রমান স্বরূপ আমরা দেখতে পাই ভিভেক কৃষ্ণামূর্তি নামক একজন কাউন্সেলর ফলীর বাংলাদেশ টীমে ছিল। আর ভারতীয়দের লব্যিং আর ইনফ্লুএন্স এর উপর কার কোন দ্বিধা থাকা উচিৎ নয়। কি নিশ্চয়তা আছে যে কোন ইম্পরট্যান্ট তথ্য পাচার হয়ে যায় নি? হতে পারে হয় নি, কিন্তু তেমন ব্যাবস্থা তো রাখা হয় নি যেখানে নিসন্দেহে বলা যায় যে গোপনীয় তথ্য বিপক্ষের হাতে চলে যায় নি।
মামলার রিপোর্টে দেখ যায় যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ছিল উকিল, উপদেষ্টা, এবং পরামর্শদাতা। পুরা দলে ছিল ৮ জন বাংলাদেশি আর ১৫ জন বিদেশি।এই আট বাংলাদেশির মধ্যে ছিল দিপু মনি, এডমিরাল খুরশেদ আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৫ জন, আর আইন মন্ত্রণালয়ের একজন। এদের মাঝে মাত্র ৩ জন টেকনিক্যাল উপদেষ্টা ছিল।
ভারতের পক্ষ থেকে ছিলো উকিল, প্রতিনিধি, উপদেষ্টা ছাড়াও ৭ সদস্যের এক বৈজ্ঞানিক আর কারিগরিক বিশেষজ্ঞের টীম, এবং ২ সদস্যের এক রিসার্চ টীম। পুরা দলে ছিল ১৬ জন ভারতীও আর ৭ জন বিদেশি।
আপাদদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের টীম অনেক বেশি প্রস্তুত আর শক্তিশালি ছিল। মামলার ময়দানে আমাদের প্রস্তুতি আর শক্তি পর্যাপ্ত না থাকায় আমরা এই মামালায় দক্ষিণ তালপট্টি আর তৎসংলগ্ন জায়গা, আর কিছু গ্যাস ব্লকের পূর্ণ মালিকানা হারিয়েছি। আমাদের সমুদ্র আজ সি-লকড। এই সমুদ্রসীমা মামলায় বাংলাদেশের পরাজয়ের অন্যতম মুল কারন অপর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক/কারিগরিক বিশেষজ্ঞ/রিসার্চ টীম। সঠিক আইনগত টীম এর সাথে সঠিক কারিগরি টীম মামলার ময়দানে থাকলে আমাদের আজ এত কিছু হারাতে হত না।