৭ জুলাই ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য একটি বিতর্কিত দিন। এদিন হঠকারী, অস্বচ্ছ ও ত্রুটিপূর্ণ একটি পদ্ধতিতে সাকিব আল হাসানকে ছয় মাসের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং বিদেশি লিগে তাঁর খেলার ওপর দেড় বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ভবিষ্যতে আচরণগত সমস্যা হলে সাকিবকে চিরতরে নিষিদ্ধ করার হুমকিও দেওয়া হয়।
সাকিবকে এই শাস্তি যে ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) দিয়েছে, তার বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে দেশে রয়েছে নানা বিতর্ক। মাত্র কয়েক মাস আগে বিসিবি বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস বিপন্ন হতে পারে, এমন একটি অকল্পনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এর পরিচালকদের দেশপ্রেম, যোগ্যতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে সারা দেশে নানা সমালোচনা হয়েছিল। সাকিবকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিসিবি ও এর চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান পাপনকে নিয়ে এ ধরনের প্রশ্ন আবারও উচ্চারিত হচ্ছে ক্রিকেটামোদীদের মধ্যে।
এ ছাড়া সমাজে আরও কিছু বিতর্ক রয়েছে সাকিবের শাস্তি নিয়ে। সাকিবের আচরণগত কিছু সমস্যা আছে, এটি কোনো কোনো ক্রিকেটামোদীও মনে করেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এর শাস্তি কেন মাত্রাতিরিক্ত হলো? কেন এই শাস্তি স্বেচ্ছাচারীভাবে আরোপ করা হলো? প্রশ্ন উঠছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর, বিশেষ করে আগামী বিশ্বকাপে এই শাস্তির প্রভাব কী পড়বে, তা কি আদৌ বিবেচনায় নিয়েছে বিসিবি?
দুই
সাকিব বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। ব্যাটসম্যান ও বোলার—দুই ভূমিকাতেই পরিসংখ্যানগতভাবে তাঁর সাফল্য বাংলাদেশের অতীত বা বর্তমান যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে সুস্পষ্টভাবে শ্রেয়তর। তিনি ওয়ানডে ক্রিকেটে বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন বছরের পর বছর। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিজয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে তাঁর। সাকিব না খেলতে পারলে বা উৎপীড়িত অবস্থায় খেললে এর প্রভাব বাংলাদেশ দলে পড়বেই।
প্রশ্ন আসে, সাকিব কি তাই বলে আইনের ঊর্ধ্বে? না৷ তিনি তা নন, কেউই তা নন। কিন্তু তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন, এটি বলার আগে আমাদের জানা প্রয়োজন যে তিনি ঠিক কী আইন লঙ্ঘন করেছেন? এটি কি আজ পর্যন্ত জানি আমরা? জানি না। তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কী অভিযোগ, সেটিও এত দিনে সুস্পষ্ট করে বলেনি বিসিবি।
সাকিবকে কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে শাস্তি দিতে হলে ক্রিকেট পরিচালনা বোর্ডের মতামত এবং শৃঙ্খলা কমিটির শুনানির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাঁকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে এসবের তোয়াক্কাও করা হয়নি। শাস্তি দেওয়া হয়েছে বোর্ডের কয়েকজন পরিচালক নিয়ে তড়িঘড়ি সভা করে। সভা শেষে বিসিবির প্রধান যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট যে সভার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আবেগতাড়িতভাবে, কোনো নিরপেক্ষ বিচার-বিবেচনা থেকে নয়। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুসারে সাকিবকে শাস্তি দেওয়া মিটিং শেষে বিসিবির প্রধান নাজমুল হাসান বলেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এত অমানবিক মনে হয়েছে যে আমরা অনেকে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম—কীভাবে একটা মানুষ এমন করতে পারে!’
তিন
কী এসব ‘অমানবিক’ অভিযোগ? সাকিব একবার টিভি ক্যামেরার সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেছিলেন। এই অভিযোগের জন্য তিনি ইতিমধ্যে শাস্তি ভোগ করেছেন। কাজেই এটি নতুন করে বিসিবির সভায় আলোচিত হতে পারে না। সাকিবের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে, তিনি অনাপত্তি না নিয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলতে চলে গিয়েছিলেন। বোর্ড তাঁকে হুঁশিয়ার করে দেশে আসার নির্দেশ দিলে তিনি চলে আসেন। কাজেই এই অভিযোগ আর তাঁর ক্ষেত্রে বহাল থাকতে পারে না।
সাকিবের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ, তিনি ভারতের সঙ্গে একটি খেলা চলার সময় তাঁর স্ত্রীকে উত্ত্যক্তকারী বখাটে কয়েকজন তরুণকে গ্যালারিতে গিয়ে পিটিয়েছিলেন এবং কোচকে না জানিয়ে হোটেলের রুম পরিবর্তন করেছিলেন। এই অভিযোগ এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, এটি বোর্ডের ৭ জুলাইয়ের সভায় আলোচিত হয়েছে বলেও সংবাদ রয়েছে। তাহলে কি সাকিব তাঁর স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করা ব্যক্তিদের পেটানোয় বোর্ড পরিচালকদের কাছে এটি ‘অমানবিক’ মনে হয়েছিল? উত্ত্যক্তকারীদের পক্ষে তাঁরা ‘আবেগপ্রবণ’ হয়ে পড়েছিলেন এবং কোনো তদন্ত ছাড়া সাকিবকে বিসিবির ইতিহাসে কঠোরতম শাস্তি দিয়েছেন?
সাকিব, তাঁকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ লিগে (সিপিএল) খেলতে না দিলে বাংলাদেশের হয়ে খেলা ছেড়ে দেবেন, এমন কথা বলেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এটি খুব সেনসেটিভ একটি অভিযোগ এবং দেশের মানুষকে সাকিবের প্রতি ক্ষুব্ধ করে তোলার মতো। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সাকিব নিজে ‘দেশের হয়ে আর খেলব না’ এ ধরনের কথা কোনো গণমাধ্যমে বলেননি। বিসিবির প্রধান জানিয়েছেন যে সাকিব নাকি বাংলাদেশর সদ্য নিয়োগ পাওয়া কোচকে ক্ষুব্ধ হয়ে এ কথা বলেছিলেন এবং কোচ তা বিসিবি প্রধানকে ই-মেইল করে জানিয়েছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এর কোনো যাচাই-বাছাই না করে এমনকি এ বিষয়ে সাকিবের কোনো বক্তব্য না শুনেই বিসিবির কর্মকর্তারা তা গণমাধ্যমে জানানো শুরু করেন। সাকিবকে শাস্তি দেওয়ার আগে সম্পূর্ণ
অনৈতিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে এই একতরফা প্রচারণা চালানো কেন যৌক্তিক মনে করেছিলেন বিসিবি কর্মকর্তারা?
সাকিব যদি সত্যিই এ কথা বলে থাকেন, দেশে ফেরার পর দেশের পক্ষে খেলার সুস্পষ্ট কমিটমেন্ট প্রকাশ করার মাধ্যমে তিনি ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছিলেন যে তাঁর এই বক্তব্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ লিগে তাঁকে খেলতে না দেওয়ার জন্য একটি অভিমানপ্রসূত প্রতিক্রিয়া ছিল। তিনি এ জন্য নাজমুল হাসানের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেছেন, কোচের কাছে পর্যন্ত ক্ষমা চেয়েছেন। তার পরও সাকিবের এই বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে অনেকের কাছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সাকিবের এই বক্তব্যের দায় শুধু কি তাঁর, নাকি বোর্ডের বিভিন্ন কর্মকর্তারও?
চার
প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাকিবের বক্তব্যে এটি স্পষ্ট যে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলার জন্য বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান আকরাম খানের মৌখিক অনুমতি নিয়েছিলেন এবং তাঁর কাছে থেকেই বোর্ডের অনাপত্তির আশ্বাস পেয়েছিলেন। সাকিবের এই কথা কি মিথ্যা? সাকিবের বর্ণনা মিথ্যা আর গা বাঁচানোর জন্য আকরাম খানের পরবর্তী অস্বীকৃতি সত্যি—এর কি প্রমাণ আছে? আর সাকিবের বক্তব্য সত্যি হলে এনওসি নিয়ে অহেতুক বিড়ম্বনা সৃষ্টি করার দায় তো বিসিবির কর্মকর্তাদের!
পৃথিবীতে তারকা খেলোয়াড়েরা বিদেশি লিগে খেলে থাকেন। সাকিব ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার লিগে খেলেছেন। সাকিবের এই বিশ্বব্যাপী সাফল্য বহু তরুণকে উদ্বুদ্ধ করেছে, গর্বিত করেছে, দেশকে সম্মানিত করেছে। যে দেশের একজন মন্ত্রী শাহরুখ খানের অনুষ্ঠান দেখার জন্য মাটিতে বসে পড়েন, সেই দেশেরই ক্রিকেটার সাকিবের খেলার ভক্ত হিসেবে উচ্ছ্বসিতভাবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন শাহরুখ খান। সাকিব বিদেশে খেলে বাংলাদেশকে এভাবে সম্মানিত করেছেন আরও বহুভাবে।
তাহলে এবার হঠাৎ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তাঁকে নিয়ে এত নাটক হলো কেন? নাকি এটি আসল ঘটনা নয়, নাকি আগেই অন্য কোনো কারণে সাকিবের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন বিসিবিপ্রধান ও তাঁর অনুসারীরা? সোশ্যাল মিডিয়া ও কিছু গণমাধ্যমের অভিযোগ রয়েছে যে সাকিবের স্ত্রীকে উত্ত্যক্তকারীদের একজন ছিলেন বিসিবিপ্রধানের বন্ধুস্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন সাংসদের ছেলে। এ ধরনের এমপিপুত্রদের বহু অকাণ্ডের ঘটনা আমরা বাংলাদেশে দেখি, তাদের দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য শাসক দলকে মরিয়া হয়ে উঠতে দেখি। সাকিব উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন, অভিযোগ রয়েছে যে মামলা প্রত্যাহারের চাপে সাকিব রাজি হননি বলে বিসিবিপ্রধান ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তাঁর প্রতি? এর প্রতিশোধ কি নেওয়া হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ লিগে খেলাকে উপলক্ষ করে? এ দেশে এসব ঘটা বিচিত্র বা অসম্ভব কী? প্রশ্ন হচ্ছে, এর খেসারত কেন দেবেন সাকিব, বাংলাদেশের ক্রিকেট ও বাংলাদেশের গর্বিত তারুণ্য?
পাঁচ
আমরা বিশ্বকাপ ফুটবলে লুইস সুয়ারেজের কামড়–কেলেঙ্কারির পরও সারা উরুগুয়েকে তাঁর পক্ষে দাঁড়াতে দেখেছি। এর আগে জিনেদিন জিদান বিশ্বকাপে ঢুস দেওয়ার পরও ফ্রান্স তাঁকে সর্বতোভাবে রক্ষা করেছে। ইয়ান বোথাম, শেন ওয়ার্ন ও ব্রায়ান লারার মতো বিশ্বসেরা ক্রিকেটারদের আচরণগত সমস্যা ছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সময় তাঁদের দেশ ও ক্রিকেট বোর্ড বহুবার তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ সহানুভূতি দেখানোর চেষ্টা করেছে।
তাঁদের তুলনায় সাকিবের বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগগুলো কোনোভাবেই বেশি গুরুতর নয়। কিন্তু বিসিবি তাঁর বিরুদ্ধে শুধু শাস্তি প্রদান করেই থেমে থাকেনি, শাস্তির আগেপরে তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণায় নেতৃত্ব দিয়েছে এবং কোচের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা অনৈতিকভাবে গণমাধ্যমে জানিয়েছে।
বিসিবি সাকিবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে শৃঙ্খলা ও ক্রিকেটের দোহাই দিয়ে। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে ঈর্ষাপ্রবণ, ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যাকুল ও স্বেচ্ছাচারী কিছু লোক সাকিবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করছে। আগামী ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর, আগামী বিশ্বকাপ, বাংলাদেশের ইমেজ, ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ—কিছুই তাদের মূল বিবেচ্য বিষয় নয়।
আমাদের আশঙ্কা, ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া মিলে বাংলাদেশসহ কিছু দেশের টেস্ট স্ট্যাটাস কেড়ে নেওয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তাকেও নানাভাবে সাহায্য করবে সাকিবের বিরুদ্ধে দেওয়া এই মাত্রাতিরিক্ত শাস্তি। সাকিব নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বার্থেই এই শাস্তি রহিত করা বা বহুলাংশে হ্রাস করা উচিত বিসিবির। নজর দেওয়া উচিত তাদের নিজেদের কার্যক্রম নিয়ে ক্রিকেট জগতে বিরাজমান নানা অসন্তোষ দূর করার প্রতি।
কার্টেসি আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।