আমেরিকা ২০০২ সালে যখন ইরাক আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল তখন আমার এক হিন্দু বন্ধু একটা দারুণ মন্তব্য করেছিল। সে বলেছিল মুসলিম বিশ্বের সমস্যা হচ্ছে যে তাদের মধ্যে পশ্চিমের সামরিক শক্তি মোকাবেলা করার জন্য এমনকি ভারতের
কাছাকাছি ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো দেশ নেই।
তার এই কথার বাস্তবতা আছে। কারণ আমেরিকা ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো এখনো পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলোর উপর খবরদারি করে যাচ্ছে। তাদের উপরে কথা বলার মতো শক্তি মুসলিম দেশগুলোর কারোরই নেই।
• ইসলাম তার প্রাথমিক যুগ থেকেই পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বড় বড় সামরিক শক্তিকে পরাজিত করে একটার পর একটা অঞ্চল জয় করে নিয়েছে। পৃথিবীর অর্ধেকটাই তারা এভাবে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসে।
• জয়ের এই ধারা সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে থেমে যায়। এরপর অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করে। আর উনবিংশ শতাব্দীতে এসে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে ক্ষমতা হারালো।
• বিংশ শতাব্দীর সূচনা মুসলমানদের জন্য যেন অভিশাপ হয়ে আসলো। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ও রাশিয়া সাম্রাজ্য প্রায় সব মুসলিম দেশ দখল করে নিল।
• দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে স্বাধীন মুসলিম জাতিগুলোর আবির্ভাব ঘটল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ভূখণ্ড বিভাজনের কারণে মুসলিম বিশ্বে ছোট ছোট স্বাধীন জাতিস্বত্ত্বার বিকাশ ঘটে। এই দেশগুলো যদিও তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছিল, কিন্তু তাদের বেশির ভাগই আজো সার্বভৌম জাতিতে পরিণত হতে সক্ষম হয়নি।
• গত একশ' বছরেও বড় কোনো শক্তির বিপরীতে মুসলমানদের তাৎপর্যপূর্ণ কোনো সামরিক বিজয় নেই। অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিনগুলোতে ১৯১৫ সালে গ্যালিপলির যুদ্ধকে সর্বশেষ ও সর্বাত্মক যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা যায় যেখানে মুসলিম সৈন্যরা বিজয়ী হয়েছিল এবং শত্রু সৈন্যের হাত থেকে ইস্তাম্বুলকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।
কেউ হয়তো বলতে পারেন যে ১৯৭৪ সালে গ্রীক জান্তা সরকার গ্রীসের মূল ভূখণ্ডের সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে সাইপ্রাসের পুরো এলাকা দখলের চেষ্টা করলে সাইপ্রাসে তুর্কি হস্তক্ষেপ ছিল মুসলমান সৈন্যদের একটা তাৎপর্যপূর্ণ সফলতা। গ্রীকদের আক্রমণের কারণে তুর্কিরা দ্বীপটির তুর্কি নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছিল। এতে গ্রীক ও গ্রীক সাইপ্রিয়ট বাহিনী পরাজিত হয়।
• মিশর ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইয়ম কিপারের যুদ্ধের প্রথম পর্বকে বিজয় হিসেবে উদযাপন করে।
• আর পাকিস্তান উদযাপন করে ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধকে।
•• কিন্তু এই দুটো যুদ্ধকে মিশর বা পাকিস্তানের সামরিক বিজয় হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। মিশরকে এই যুদ্ধে অনেকটা জমি হারাতে হয়েছে। আর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফল যুদ্ধের আগে যা ছিল এখনো তাই আছে।
১৯৮০ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা এবং আমেরিকার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের অতি সাম্প্রতিক যুদ্ধের মধ্যেও বড় কোনো বিজয়ের বৈশিস্ট্য দেখা যায় না।
আফগানিস্তানের যুদ্ধে আফগান মিলিশিয়া বাহিনী দখলদার বাহিনীকে দেশ থেকে তাড়াতে সফল হয়েছিল। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়েছিল দেশের মানুষ ও অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হওয়ার পর।
আজ মুসলমানরা দেখছে যে তাদের শাসকরা সব দুর্নীতিগ্রস্ত এবং চরম কর্তৃত্বপরায়ণ। মুসলমানরা এখন পশ্চিমের গণতন্ত্র ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশংসা করছে। সম্মান ও মর্যাদা হারিয়ে মুসলমানরা এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তারা এখন মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত যে তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে কম পরিসরে হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। আর এর মধ্যেই তারা শান্তি খুঁজে নিচ্ছে।
মুসলিম বিশ্বের স্বৈরশাসকরা তাদের নিজ জনগণের অধিকারকে খর্ব করার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত এবং আধুনিক যুগের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অচেনা সর্দারের মত কাজ করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হেজবুল্লাহ, হামাস, ইসলামিক জিহাদ, মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট এবং আফগান মিলিশিয়াদের মত বিদ্রোহী বাহিনীর উত্থানকে মুসলমানরা স্বাগত জানাচ্ছেন এই কারণে যে তাদের সরকার জনগণের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে।
এমনকি সম্প্রতি দা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া নামের বিভিন্ন আধা সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যোদ্ধাদের মসুল দখলকে স্বাগত জানিয়েছে ইরাকে বৈষম্যের শিকার সুন্নী মুসলমানরা।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যত উত্থান হবে রাষ্ট্রযন্ত্র ততটাই দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তারা বিদেশি আগ্রাসন থেকে জনগণের অধিকার রক্ষায় অক্ষম হবে।
মুসলিম বিশ্বের শাসকদের ব্যথর্তার আরো কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া বেশিরভাগ দেশই শাসন করছে সামরিক স্বৈরশাসকরা অথবা উত্তরাধিকারী স্বৈরাচাররা। এসব শাসকরা তাদের জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ঔপনিবেশিক প্রভুদের মত একই রকম অথবা তার চেয়েও বেশি অত্যাচারী শাসন চালাচ্ছেন রাজা ও স্বৈরশাসকরা। মুসলিম দেশগুলোর স্থানীয় শাসকরা শুধু ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রতিভূ, তারা সুশাসন চালু করেনি।
• মুসলিম বিশ্বে মালয়েশিয়ার মাহথির মোহাম্মদ ও তুরস্কের রিসেপ তাইয়েব এরদোগানের মত স্বাধীনচেতা নেতার খুবই অভাব। এই দুই নেতার নিজ দেশে যেমন সত্যিকার সমর্থন আছে তেমনি মুসলিম বিশ্বেও তারা প্রশংসিত।
শাসকদের অদূরদর্শিতা বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সরকারি নেতাদের কারণে মুসলিম বিশ্বের জনগণ নৈতিকভাবে হতাশাগ্রস্ত এবং তারা এমন বীরদের খুঁজে বেড়ান যারা তাদের হারানো গৌরব ও সম্মান ফিরিয়ে আনবে সক্ষম।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দরকার বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাকথিত মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক একত্রীকরণ নেই বললেই চলে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থাও (ওআইসি) তার সদস্যদের স্বার্থ রক্ষায় অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
সামরিকভাবে দেশ দখলে রাখা যখন কঠিন হয়ে পড়ল তখন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো পরোক্ষ শাসন বজায় রাখার জন্য বিভক্ত করো এবং শাসন করো নীতি গ্রহণের পরিকল্পনা করে।
ক্ষমতা ছাড়ার আগে তারা মুসলিম দেশগুলোতে ছোট স্বাধীন রাষ্ট্রে ভাগ করে যায়।
এসব দেশের ক্ষমতা কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তারা জনগণের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে স্বৈরাচারী শাসকদের সমর্থন দেয়।
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মুসলমানদের গণতন্ত্র ও আত্মমর্যাদার দাবিকে দমিয়ে রাখতে প্রতিবিপ্লব ঘটিয়েছেন আরব স্বৈরাচাররা। মুসলিম দেশগুলোতে গণতন্ত্রের সুযোগকে সুপরিকল্পিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ধ্বংস করেছে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো।
খুব কম মুসলিম দেশই অর্থনৈতিক অগ্রগতি লাভ করেছে। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও সৌদি আরব জি টুয়েন্টি অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর সদস্য হলেও সামরিক শক্তির দিক থেকে তারা তাৎপর্যপূর্ণ কিছু অর্জন করতে পারেনি। তথাকথিত মুসলিম বিশ্ব ন্যাটো এবং চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সাংহাই সহযোগীতা সংস্থার মত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর নির্ভরশীল।
মুসলিম দেশগুলোর সমস্যার জন্য শুধু সাবেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করলেই চলবে না। এসব দেশের বিশৃঙ্খলার জন্য অবশ্যই একনায়ক এবং রাজাদের দায়ী করতে হবে।
অবহেলিত মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের তারকা খেলোয়াড় অথবা বিদ্রোহী বাহিনীর সামান্য সামরিক সফলতা অর্জনে শান্ত্বনা খুঁজে পায়। বস্তুত এখন দরকার এমন একটি কেন্দ্রীয় শক্তির উত্থান যা মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।
কার্টেসি টুঃ মোহাম্মদ পারভেজ বিলগ্রামী
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৬