তাবলীগ নিয়ে বিভ্রান্তি : আমার কিছু কথা- পর্ব- ০১
গণিত নামক এক মহা গুরুত্বপুর্ন বিষয়টি দেখলে আমার জ্বর এসে যায়। নিজেকে এইবলে ধিক্কার দেই যে- ”আমি হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে গাধা কিসিমের মস্তিস্কের অধিকারী”। নিজের মনের দুঃখের এই কথাটি আমার একজন মান্যবর ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করার পর তিনি দিলেন আরো এক মহা-গুরুত্বপুর্ন তথ্য- বিশ্বখ্যাত মুষ্ঠিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলী নাকি আমার মতই ছিলেন। তার মানে গণিত নামক বিষয়টি দেখলে তিনিও নাকি আপসেট হয়ে যেতেন। তথ্যটা সত্য কিনা জানিনা। তবে সাম্প্রতিক কালে ব্লগে- কয়েকটা পোষ্ট এবং তার সমস্ত ক্যাচাল পড়ে আমারও কিছু গনিতের সুত্র মাথায় এসে গেল- সেই ক্যাচালযুক্ত পোষ্টটির মুল বক্তব্য হলো : তাবলীগ নামক এই কাজটি যা সমস্ত পৃথিবী জুড়ে চলমান এই কাজের মধ্যে শিরক আছে। সেই মহান (?) পোষ্ট লেখক তার পোষ্টে বলেছেন- তাবলীগের ফাজায়েলে আমল নামক পুস্তিকাতে মানুষকে শিরকের দিকে আহবানকারী অনেক মনগড়া কাহিনী আছে- আর সকল দুর্বল হাদিস এর সংকলন দ্বারা এই পুস্তিকাটি ভর্তি। যার ভুলগুলো কাটতে কাটতে কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে তবু তার ভুল কাটা শেষ হবেনা বা পুস্তিকাটির কোন অস্তিত্বই থাকবেনা। বিষয়টা অনেকটা কাটাকাটির অংকের মত। অতএব তাবলীগ নামক এই কর্মটি সমস্তই শিরক বা ভুল।
তার দেয়া সূত্র অনুসারে - চিন্তায় পড়ে গেলাম- অনেক চিন্তার পর অবশেষে আবিস্কার করলাম গণিতের সেই মহা-মূল্যবান সূত্র- যেমন- “ঐ পোষ্ট লেখকের সুত্র অনুসারে-ফাজায়েলে আমল নামক পুস্তিকাতে মানুষকে শিরকের দিকে আহবানকারী অনেক মনগড়া কাহিনী আছে- অতএব তাবলীগ এর সমস্ত কার্যকমেই শিরক আছে" তার সূত্রটি যদি সঠিক হয়- তাহলে আমার বক্তব্য হলো- "তিনি নিজে সামনে এবং পশ্চাৎদ্বেশ দিয়ে নাপাকি নির্গমন করেন’অতএব তিনি নিজেও নাপাক’ আর তিনি নিজে মানুষকে নাপাকীর দিকে ডাকেন-তার নাপাক পোষ্ট মানুষকে পড়তে আহবান করেন- এমনকি তিনি নিজে নাপাক ভক্ষন করেন। তার সমস্ত কাজকর্মই নাপাক। এখানে গণিতের সেই অতএব এর সুত্র কার্যকরী হইবে।
পোষ্টটি এখানেই শেষ হলে ভাল হত। কিন্তু আরো কিছু কথা না বললেই নয় তাই সকল পাঠককে অনুরোধ করছি- আমার মোটা মস্তিস্কের এই বক্তব্য সম্পুর্নটা পড়ার জন্য।
কোন কিছুরই এক্সট্রিম পর্যায়ে চলে যাওয়া ভালনা, আর এর পরিনতি কখনও ভাল হয়না। আমি বলতে চাচ্ছি বেশী বুঝার বিষয়ে। ইসলামের দৃষ্টিতে বেশী বুঝার পরিনতি কখনও ভাল হয়না : এর অসংখ্য উদাহরন আনা যায়- যেমন-
০১. ইসলামের ইতিহাস আর মানব জাতির ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায়- শয়তানের উদাহরন। প্রত্যেকটি মুসলিম মাত্রই জানেন- সে বেশী বুঝেছিলো- যার পরিনতিতে সে হয়েছে অভিশপ্ত শয়তান। এই ঘটনাটি পবিত্র কোরআনেও অত্যন্ত সুন্দর ভাবে বর্ননা করা হয়েছে।
০২. প্রাসঙ্গিকভাবে সমসাময়িক অন্য একজন লেখকের কথা না লিখে পারলাম না। আমি এই লেখকের অত্যন্ত ভক্ত ছিলাম। মেজর কাজী জাহান মিয়া। তিনি আল-কোরআন দ্যা চ্যালেঞ্জ মহাকাশ পর্ব-০১, একই বিষয়ে পর্ব ০২, ও পর্ব-০৩, গ্রন্থগুলি লিখেছেন: কোরআন আর বিজ্ঞানের আলোকে চমৎকার সব বিশ্লেষন আমার সত্যিই ভাল লাগে- এমন গবেষনাধর্মী কোন লেখা অদ্যাবধি আমার নজরে পড়ে নাই এবং এই লেখকের ১ম পর্বের সমস্ত লেখাই যুক্তিগ্রাহ্য আর গ্রহনযোগ্য মনে হয়েছে। যার ফলে কিনলাম ২য় পর্ব- বরাবরের মত এটাও অসাধারন উপস্থাপনা। কিন্তু পুস্তিকাটির তৃতীয় পর্বের : শেষদিকে এসে কেমন যেন হোঁচট খেতে হলো। তিনি এই বিষয়ের পুস্তিকাটি রচনা করতে গিয়ে তার ব্যক্তিগত জীবনে যে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তার বর্ননা দিয়েছেন। অব্যশ্যই ভাল লাগার মত কথা- সেই সাথে কষ্ট লাগার মতও। অনেক ত্যাগ তিনি অনেক স্বীকার করেছেন এই তিনটি পর্ব রচনা করতে গিয়ে- একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু একটা অধ্যায়ে এসে একটা হাদিসের রেফারেন্সে তাবলীগকে নিয়ে এক প্রকার আক্রমনের চেষ্টা তিনি করেছেন। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত হলো আমার। কারন জীবনে অনেক পথের গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করে- অনেক বিষয় দেখে, শুনে, বুঝে, যাচাই করে, অনেকটা আধ্যাতিক ইশারায় যে পথটিকে সঠিক মনে করলাম সেই কাজটিই কিনা- ভুল! ভাবলাম নাহ বিষয়টিকে আবার যাচাই করব। কিন্তু সকল কষ্টি পাথরেই এই কাজটিকে আমার কাছে সঠিক বলে ধরা দিয়েছে। যার জন্য বিরক্ত হয়ে একবার অবশেষে চিন্তা করলাম এতবড় একজন গবেষক এমন কথাঠি বললেন কেন? মনের দুদুল্যমান অবস্থায় আবারো মনে এলো- আর এক সূত্র আর সেটা হলো “ এক্সট্রিম কোন কিছুই ভাল না” এ বিষয়ে পরে কোনদিন সময় হলে আলোচনা করার ইছ্ছা আছে। ধৈর্য ধরে সাথেই থাকার অনুরোধ।
০৩. অপরদিকে বর্তমানের সেই মহান পোষ্ট লেখক বলতে নেমেছেন- তাবলীগের মধ্যেও শিরক আছে, তাবলীগের প্রায় সকল কাজকর্মেই শিরকের দিকে আহবান করে মানুষকে অজ্ঞতার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইত্যাদি।
এবার আমার বক্তব্য হলো: পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ বলেন : ঔ ব্যক্তির কথার চেয়ে ভাল কথা আর কার হতে পারে- যারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে- আর এই ডাকার কাজটি তাবলীগের মত এত নির্মোহ ভাবে, ব্যাপক আকারে, আর সংঘবদ্ধভাবে বিশ্বে আর কোন দল করতে পারে বলে আমার জানা নেই। একমাত্র তাবলীগ-ই সকল বয়সের মানুষের জন্য ইমান শিক্ষার একটি পাঠশালার মত কাজ করছে।
জামায়াতে ইসলামীর একজন লোক তাবলীগের প্রতি আমার আনুগত্য দেখে বিরক্ত হয়ে তার অভিযোগ আমার কাছে পেশ করে: তাবলীগ যদি প্রকাশ্যে ঘোষনা করত বা জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন দিতো- তাহলে জামাতের শক্তি শতগুণে বৃদ্ধি পেত। তাদের মধ্যে জেহাদের সেই জোস নাই আর এজন্যই তাবলীগ হলো- ভ্রান্ত পথের যাত্রী। আমি এ বিষয়টিকে নিয়ে আমার সেই মান্যবর ব্যক্তিটিকে প্রশ্ন করলে যা জবাব পাই তা রীতিমত বিশ্ময়কর: তিনি বলেন- জামায়াতের সুত্রকে যদি ধরে নেই সঠিক, আর জামায়াতের বলা ইসলামী শাসন ব্যবস্থাটিই যদি বাংলার জন্য একমাত্র প্রয়োজন হয় তাহলে বলতে হয় আমরাও তা চাই- কিন্তু আমাদের চাওয়ার পথটি একটু ভিন্নভাবে। জামায়াত চায় যে ব্যক্তি ক্ষমতায় আছে- তিনি যেহেতু ইসলাম কায়েম করতে পারছেনা বা করছেনা। অতএব তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে আমরা ক্ষমতায় যাব এবং ইসলামিক শাষন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ফেলব। কিন্তু তাবলীগের ভাবধারটি হলো- যিনি ক্ষমতায় আছেন- তার অন্তরে আমরা আমাদের নির্মোহ দাওয়াতের মাধ্যমে- ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য ঢুকিয়ে দিব। এজন্য আগে আমাদের নিজস্ব চরিত্রের সংশোধন প্রয়োজন। আর তার জন্য প্রয়োজন- চলমান প্রকৃয়ার দাওয়াত। দেশের ম্যাক্সিমাম জনগোষ্ঠি যদি প্রকৃত ঈমান ওয়ালা হয়ে যায় তাহলে এদেশে ইসলাম এমনিতেই চলে আসবে। জানিনা তথ্যটি কতটুকু সত্য। তার পরেও আমার মোটা মাথায় যে চিন্তাটি এসেছে- কথাটিতো এক দৃষ্টিতে সঠিক- কারন ইসলামে জবরদস্তির-তো কোন বিষয় নাই। ব্যক্তি জীবনে ইসলাম আসলে তা সমাজ ব্যবস্থায় এমনিতেই চলে আসবে-সমাজ থেকে রাষ্টে। আর প্রথমত তাবলীগ একটা আন্তর্জাতিক কাজ- সমগ্র মানব জাতিকে নিয়ে এর চিন্তাধারা। এখানে শুধুমাত্র বাংলাদেশকে নিয়ে আলাদা ভাবে চিন্তা করার কোন অবকাশ নেই।
যাক, অনেক বেশী বলে ফেলেছি। এবার সেই মহান (?) পোষ্ট লেখককে নিয়ে আমার একটি গবেষনার রিপোর্ট-
প্রথমেই এই স্ক্রিনসটটি দেখে নেবার অনুরোধ-
যেখানে একজন মন্তব্যকারী বলেছেন- তাবলীগের কিতাবে ভুল থাকলে আপনি নিজে ভুলগুলো শুধরানোর জন্য বলেন। জবাবে তিনি জানের নিরাপত্তা চাইলেন। জবাবটি পড়ে আমি হাসতে হাসতে শেষ। এ পর্যন্ত কেউ শুনেছেন- তাবলীগ কারো উপর আক্রমন করেছে। আর যিনি নিজে শিরক মুক্ত হবার দাওয়াত দিচ্ছেন তাবলীগকে- তিনি জানের নিরাপত্তা চান একজন মন্তব্যকারীর কাছে। হায়রে শিরক- হায়রে জেহাদী....
অপর একজন মন্তব্যকারীর অভিযোগ হলো- আপনার প্রিয় পোস্টের তালিকায় মেয়ে পটানোর মহামূল্যবান বাণী- কাজে লাগলে জানাবেন-ইত্যাদি আর আপনি কিনা তাবলীগের ভুল ধরছেন- পোষ্ট লেখকের জবাবটি পাঠকবৃন্দ নিজ দায়িত্বে পরখ করার অনুরোধ।
এবার শেষকথা- একটি উদাহরন দেই- এক কুকুর গ্রেহস্তের ঘরে কলসীর মধ্যে গলা ঢুকিয়ে চুরি করে কিছু খেতে গিয়ে গলা আটকে যায়- অপারগ হয়ে শেষে মাথা নাড়িয়ে কোন রকমে কলসী ভেঙ্গেই জীবন নিয়ে পলায়ন- কিন্তু কলসীর কান্দাটি শক্ত হওয়ায় সেটি আটকে যায় তার গলায়। অপারগ হয়ে কলসীর কান্দাটি নিয়েই চলতে থাকে তার জীবন যাপন- আর অশান্তিযুক্ত দৌড়। পথিমধ্যে তারই এক পুরাতন বন্ধুর সাথে সাক্ষাত হলে- বন্ধুটি প্রশ্ন করে “ কিরে দুস্ত তোর এই হাল কেন?
-- কলসীর কান্দা যুক্ত কুকুরটি জবাব দেয়-
”ছুচ-মুছ ছাইড়া দিয়া, ধর্মে দিলাম মন,
কলসীর কান্দা গলায় দিয়া, চলছি বৃন্দাবন।
সুধী পাঠক, আমাদের এই ব্লগের মহামুল্যবান (?) একজন ব্লগারের প্রিয় পোষ্টের তালিকায় “মেয়ে পটানোর মহামূল্যবান বাণী” আর সাম্প্রতিক তাবলীগের মধ্যে শিরক অনুসন্ধানকারী কার্যক্রম, আর নিরীহ সব কমেন্টের আক্রমনাত্মক জবাব- সব মিলিয়ে কুকুরের সেই উদাহরনটির সাথে কেন জানি মিলে যায়... দুঃখিত আমার এই অদ্ভুত চিন্তার কারনে। অবশ্য তিনি আমাকে আমার আগের পোষ্টে বলেছেন: গীবত করা নাকি ভালনা.. তাঁর কাছে আমার সবিনয় প্রশ্ন হলো: গীবতের সংজ্ঞা ভাল করে জানেন তো? আর নিজে তার উপর আমল করেন তো? যদি আমল করতেন তাহলে তাবলীগের মত এই মহান কার্যক্রমের দোষ অনুসন্ধান করার আগে আর একটু চিন্তা করতেন।
এতক্ষন ধরে যারা পড়েছেন তাদের কাছে একটা প্রশ্ন রেখে আমার আজকের লেখা শেষ করলাম- প্রথম বলা গণিতের সেই অতএব এর সূত্র যদি সঠিক হয়- তাহলে প্রশ্নটি হলো- “পেশাবের রাস্তা দিয়ে হঠাত কোন কারনে শরবত বের হতে থাকলে- জেনে শুনে কে কে সেই শরবত পান করবেন- হাত তুলেন দেখি।
ক্ষমা চাইছি আমার কোন কথায় যদি কোন পাঠকের মনে কষ্ট আসে। তবে আমি অনেক মর্মাহত হয়েছি- তার পোষ্টের বিরোদ্ধ মতামত দানকারী সকল পাঠককে সহ তাবলীগের কার্যক্রমকে সাম্প্রতিক এই আক্রমনে। ... আমি ভাই তাবলীগে সময় দিতে পারিনা- সেই ১৯৯৮ সন থেকে- সেই হিসেবে আজ প্রায় ১৪ বছর- তাই হয়ত তাবলীগের সেই ধৈর্য আমার মধ্যে আর নাই- যার জন্য এই লেখা। আবারো ক্ষমা চাইছি আল্লাহ্ যেন সকলকে অহঙ্কার মুক্ত জীবন যাপন করার তৌফিক দেন। আর সকল বিষয়ে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করার তৌফিক দেন।
(চলবে)
তাবলীগ নিয়ে বিভ্রান্তি - আমার কিছু কথা-পর্ব-০৩
তাবলীগ নিয়ে বিভ্রান্তি - আমার কিছু কথা-পর্ব-০৪
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৫৮