খেলা দেখলাম। কিছু শিখলাম। অনেক কিছু বুঝলাম। দেখার সময়, বিশেষ করে শেষদিকে মনে হল কেউ একজন তার বড় বড় রোমশ হাত দুটো দিয়ে আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে 'মানসিকভাবে হত্যা' করতে চাচ্ছে। খেলা শেষ রোমশ হাত দুটো ধ্বংস হল। বেঁচে গেলাম এবারের মতো।
আসল কথায় আসি। আমি আম জনতার একজন। উইকেটে সুইং বেশি না কম, উইকেট স্লো না স্পিডি, ডিউ ফ্যাক্টর আছে কি নেই, অতশত আমি বুঝি না। আমি আমার দেশের খেলা দেখি যতটা না ক্রিকেটীয় জ্ঞান দিয়ে, তারচেয়ে বেশি আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে। তাই দেশ যখন হারে, তখন লজ্জায় মরে জেতে ইচ্ছে করে। আবার সেই দেশ যখন গর্জে উঠে, তখন তার গর্জনের সাথে আমিও চিৎকার দিয়ে গলা ভেঙে ফেলি। আমার কাছে ক্রিকেট শুধু খেলা না। শুধু বিনোদন না। শুধু আনন্দ আর মজার উপলক্ষও না। আমার কাছে খেলা মানে দেশের প্রতি তীব্র অনুভূতি। অনুপ্রেরণা দেওয়ার এবং অনুপ্রাণিত হওয়ার চমৎকার মাধ্যম।
বিশ্বকাপ শুরুর পর থেকে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। বাংলাদেশের খেলার কথাই ধরা যাক। ভারতের সাথে আমরা খেললাম। ব্যাটিংটা মোটামুটি প্রত্যাশিত হলেও বোলিং এ কিছুই করতে পারলাম না। এরপর সবগুলো গণমাধ্যমে বোলারদের লাইন লেংথ নিয়ে হাজার রকম প্রশ্ন শুরু হল। এরপর আয়ারল্যান্ডের সাথে জয়। তখন পুরো দেশ আনন্দে ভাসল। তবে কিছুটা হলেও সমালোচনা হল ব্যাটিং নিয়ে। এরপর এল দু:স্বপ্ন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ৫৮ রানের লজ্জা। যার "আফটারম্যাথ" হিসেবে ব্যাটিংকে জাতে তোলা হল। টিভি চ্যানেলগুলো শুরু করল সূক্ষ্মাতিসূক্ষ ব্যবচ্ছেদ। প্রশ্ন আসল সাকিব-সিডন্সের ভূমিকা নিয়ে। দলের মাঝে কোন্দলের গন্ধ পেলেন কেউ কেউ। সাকিবকে নিয়ে মোাটামুটি ভয়ংকর একটা নাটকও হল। তিনি নাকি দর্শকদেরকে তার দু হাতের দুই আঙুল দিয়ে অশ্লীল ভংগি করেছেন। বাংলা ভিশন দেখাল চমকপ্রদ প্রতিবেদন। সাকিবের ঔদ্ধত্য নাকি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সংবাদ সম্মেলন তিনি "ধরাকে সরা জ্ঞান" করেন। পত্রপত্রিকার কলামে সাকিব সাবেক ক্রিকেটারদের নাকি অসম্মান করেছেন।
সত্যি করেই বলি। সাকিব সম্পর্কে এত কিছু শুনে এবং দেখে আমি যে একটুও যে বিচলিত হই নি তা না। তবে মনের মধ্যে খচখচ করছিল সবসময়। খচখচ অনুভূতির কারণেই চোখে পড়ল ব্লগের কিছু লেখা। তারপরই মন থেকে আস্তে আস্তে বিচলিত অনুভূতিকে বিদায় করলাম। প্রার্থনা করলাম সৃষ্টিকর্তার কাছে। দাঁতভাঙা জবাবের অপেক্ষা করতে লাগলাম ওদের কাছ থেকে। এবং আমি তা পেয়েছি।
এখন খুব জানতে ইচ্ছে করছে। যিনি সাকিবের "দুই হাতের দুই আঙুল তোলা"র ছবি ছেড়েছেন, তিনি কি সাকিবের "এক হাতের দুই আঙুল তোলা"র ছবি ছাড়বেন? যে হলুদ সাংবাদিক সাকিবকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন করলেন, তিনি কি এখন সাকিবের অধিনায়কত্বের প্রশংসা করবেন? যে ক'জন সাবেক ক্রিকেটার না বুঝে অসংখ্য বেফাঁস মন্তব্য করলেন, তারা কি এখন চ্যানলে চ্যানেলে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বাংলাদেশের বিজয় সম্পর্কে জ্ঞানী জ্ঞানী মন্তব্য করবেন?
যে কোন কিছুরই একটা প্রতিক্রিয়া থাকে। এটা পুরোপুির স্বাভাবিক। তাই আমার দেশ খারাপ খেললে বা ৫৮ রানের দু:স্বপ্ন উপহার দিলে সমর্থক হিসেবে আবেগের বশে আমি অনেক কিছুই বলব, অনেক কিছুই করব। তাই এদেশের সমর্থকেরা যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে খেলার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাল, তখন অামি বিস্মিত বা বিরক্ত হই নি। কারণটা খুবই সহজ। এদেশের ক'জন মানুষ খুব ভাল ক্রিকেট বুঝেন? সংখ্যাটা আগের চেয়ে বেশি হতে পারে কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় নিশ্চয়ই অনেক কম। এই যে অসংখ্য মানুষ ক্রিকেট কম বুঝেও এত উল্লাস কিংবা হতাশা প্রকাশ করছেন তার উৎস শুধুই আবেগ এবং অনেক বেশি ভালবাসা। তাই ওরা যখন আত্মসমর্পণ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে, ওদের মতো আমরাও হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ করি। আর ওরা যখন ইংলিশ সিংহগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে, আমরাও হতাশার চাদরকে কেটে কুচিকুিচ করি।
কিন্তু কিছু ব্যাপার বাড়াবাড়ি যে হয়ে যায় নি, তা না। বাংলাভিশনের নোংরামী, ফালতু ছবি আর লেখা প্রকাশ, সাবেক ক্রিকেটারদের বেফাঁস মন্তব্য কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাসে পাথর ছোড়া- একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমার কাছে এসব গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমি আমার দাঁতভাঙা জবাব পেয়েছি। সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তিনি আমার দোয়া কবুল করেছেন।
খেলা নিয়ে কিছু বলি। বোলিং চমৎকার লেগেছে। লাইন- লেংথ চরম ছিল। ইংল্যান্ডের খেলা দেখে মনে হয়ছিল তারা উইকেট হাতে রেখে শেষ ওভারগুলোতে স্ট্রোক করবে। কিন্তু আমরা এখানে তাদেরকে আটকাতে পেয়েছি। শেষ ওভারগুলোতে ওদের উইকেট পড়েছে বেশি। আমাদের ফিল্ডিং নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। মনে হয় এই ফিল্ডিং ইংলিশদের সাথে আমাদের কিছুটা পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।
ব্যাটিং ভাল লেগেছে বেশ। তামিমের ব্যাটিং দেখে খুশি হয়েছিলাম। তবে সে আরো কিছুক্ষণ উইকেটে থাকতে পারত। ইমরুল-সাকিবের ব্যাটিং অসাধারণ দায়িত্বশীল ছিল। তবে দুজনের আউটই অনাকঙ্ক্ষিত এবং দুর্ভাগ্যজনক। মুশফিক-রকিবুল-নাইম এ তিনজন দলের জন্য কিছু করতে পারতেন। বিশেষ করে মুশফিক। তার কাছ থেকে বাংলাদেশ অনেক কিছুই আশা করে। আমাদের কয়েকটা বিজয় কাহিণীর অন্যতম নায়কও সে। বিশ্বকাপের মতো আসরে তার ব্যাট জ্বলে ওঠা উচিত।
মাহমুদুল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছে। খেলোয়াড় হিসেবে ওকে আমার কিছুটা অদ্ভুুত লাগে। কারণ সহজ। ওর মধ্যে কেমন জানি একটা নির্লিপ্ত ভাব আছে। দলের কঠিন মুহুর্তের চাপ ওকে স্পর্শ করতে পেরেছে কি পারে নি সেটা তার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই! উইকেট ধরে রেখে ঠাণ্ডা মাথায় খেলাটা অসাধারণ লেগেছে। আশরাফুলের পরের ম্যাচগুলোতে স্থান পাওয়া মনে হয় কঠিনই হয়ে গেল!
বাকি থাকল শফিউল। ভয়ানক চাপের মুখে এরকম সুন্দর শট খেলতে আমি বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যানকে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। আর সেখানে শফিউল তো বোলার! সত্যি করে বললে, আমার বিশ্বাস করতে কিছুটা কষ্ট করতে হয়েছে যে ঐ স্ট্রোকগুলো শফিউলের নেওয়া!
শেষ কথা একটাই। সামনে আরো খেলা আছে। হয়তো আমরা জিতব। কিংবা জিতব না। বিজয়ী হলে আনন্দে উদ্বেলিত হব সবাই। আর প্রত্যাশা পুর্ণ না হলে হতাশায় নিমজ্জিত হব। কিন্তু কখনো যেন সীমার বাইরে কেউ কিছু না করি। আর অবশ্যই যেন দেশটার পাশে থাকি। শত হোক, দেশটা তো আমাদেরই।