সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপাজেলার চরনরচর ইউনিয়নের লসিমপুর গ্রামে একটি জলাশয়ের নাম পদ্মবিল। পদ্মফুলের প্রাচুর্যতা কেন্দ্র করেই জলাশয়টির নাম হয়েছিল পদ্মবিল। জানাযায়, শাতাধিক বছর আগে লছিমপুরের অদূরে বড়কুড় নামক জলাশয়ে প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নেয় পদ্ম। ধীরে ধীরে এটি বিস্তৃতি লাভ করে বড়কুড় জলাশয় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এরপর এটি প্রাকৃতিক ভাবেই বড়কুড় জলাশয় হতে গাংপাড়া জলাশয়ে স্থানান্তরিত হয়। তখন থেকেই গাংপাড়া জলাশয়টি পদ্মবিল নামে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। পদ্মবিল ও লসিমপুর গ্রাম প্রশাসনিক ভাবে দিরাই উপজেলায় হলেও এর ভৌগলিক অবস্থান চাকুয়া মৌজা তথা শাল্লা উপজেলায়। সংগত কারণে এই বিলের ভূমি ব্যবস্থাপনা শাল্লা উপজেলায়। জলজ ফুলের রাণীর দেশ খ্যাত পদ্মবিলে শীতকালে ঝাকেঝাকে অতিথি পাখি নামে। তখন বালিহাসের কলকাকলিতে মুখরিত থাকে পদ্মবিল সহ লসিমপুর গ্রাম। গ্রামের চিরসবুজ বৃক্ষরাজির ফাকে সায়াহ্নের সূর্য তলিয়ে যাওয়ার লালচে আভা এই পদ্মবিলের তীরে দাঁড়িয়ে দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হবেন। তাছাড়া পূর্ণিমারাতে পদ্মবিলের অপরপ্রান্থে গিলিট্টার হাওরে নৌকা ভ্রমণ আর জ্যোৎস্না বিলাসে মুগ্ধ হতেই হবে। শতাধিক বছরের অহমিকা নিয়ে ৭.৩৩ একর সরকারি এবং ততোধিক ব্যক্তিমালিকানাধীন জলাভূমিতে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই পদ্মবিল একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তা হচ্ছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা প্রভৃতি জেলা হতে সনাতন ধর্মাবলম্বী অসংখ্য মানুষ, দুর্গাপূজার সময় এখানে আসেন পদ্মফুল নেয়ার জন্য। তবুও এটি রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি কেউ। মাস কয়েক আগে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক প্রকৃতি প্রেমি মো. সাবিরুল ইসলাম বিপ্লব প্রশাসনিক কাজে শাল্লা উপজেলার চাকুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়ে যাচ্ছেন। পদ্মবিলের কাছাকাছি আসার পর তার জীপগাড়িতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এসময় তিনি গাড়ি থেকে নেমে প্রকৃতির ডাকে সারাদিয়ে পদ্মবিলে চলে যান। ক্যামেরা বন্দি করে নেন বেশ কিছু ছবি। সেই সঙ্গে দিরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মঈন উদ্দিন ইকবালকে নির্দেশ দেন কিছু পদ্ম গাছ ডিসি বাংলোয় প্রেরণের জন্য। পরের দিন চরনারচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রতন কুমার দাস এঁর সহযোগিতায় ডিসি বাংলোর পদ্ম ফুলের চাড়া প্রেরণ করা হয়। এভাবেই পদ্মবিলের ভাগ্যে পরিবর্তন আসে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নেয় পদ্মবিল সংরক্ষণের। তৎপ্রক্ষিতে দিরাই উপজেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় ও ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহিদুল আলমের অক্লান্ত পরিশ্রমে জলজ ফুলের রাণীর দেশ পদ্মবিলে নির্মাণ করা হচ্ছে ভ্রমণ ও অবকাশ কেন্দ্র। যা, আগামী ১০ আগস্ট ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করবেন জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম। এতে দিরাই উপজেলায় তৈরি হচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে এখানে নামতে পারে হাজারো পর্যটকের ঢল। তৈরি হতে পারে কর্মসংস্থান। লসিমপুর পদ্মবিলে এই মুহুর্তেও পদ্মফুল আছে। ইচ্ছে করলে ঈদের ছুটিতে যে কেউ আসতে পারেন জলজ ফুলের রাণীর দেশ পদ্মবিলে। পদ্মবিল ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছোটছোট নৌকার ব্যবস্থা আছে। সেক্ষেত্রে আলোচনা সাপেক্ষ নৌকার ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজন মনে করলে এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় টুরিস্ট গাইড নেয়া যাবে। মনে রাখবেন পদ্মবিলের আশেপাশে থাকার ভাল ব্যবস্থা নেই, তবে ১৫ কিলোমিটার দূর অর্থাৎ দিরাই সদরে থাকার ব্যবস্থা আছে। কেউ আসতে চাইলে গাড়ি নিয়ে সরাসরি চলে যেতে পারেন লসিমপুর পদ্ম বিলে। দিরাই শ্যামারচর রাস্তার পাশেই পদ্মবিল। মনে রাখবেন পদ্মবিলে শীতকালে ঝাকেঝাকে অতিথি পাখি নামে। বিলের পাশেই গিলিট্টার হাওর। জ্যোৎস্না রাতে হাওরে জ্যোৎস্না বিলাসেরও ব্যবস্থা আছে। পর্যটকদের সবধরণের সুবিধা দিতে আমরা প্রস্তুত।
কিভাবে যাবেন : যেকোনো স্থান থেকে দিরাই বাসস্ট্যান্ড আসার পর সেখান থেকে ভাড়ায় চালিত যাত্রীবাহী লেগুনা, মোটর সাইকেল, অথবা অটোরিক্সায় সরাসরি লসিমপুর পদ্মবিল। যাওয়ার পথে রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ গাছপালার অপরূপ মেলবন্ধন আর পাখিদের কলকাকলি দুচার লাইন কবিতার জন্ম দিতেও পারে।
ঢাকা থেকে আসতে চাইলে, সায়দাবাদ হতে নুর, মামুন, রুপসী বাংলা, লিমন, শাহজালাল পরিবহন অথবা গাজিপুর চৌরাস্তা থেকে বিএম পরিবহনের গাড়িতে সরাসরি দিরাই আসতে পারবেন। গাড়ি ছাড়ার সময় : রাত দশটা, ভাড়া মাত্র চারশো টাকা। একই নিয়মে দিরাই থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
সিলেট থেকে আসিতে চাইলে : কুমারগাও বাসস্ট্যান্ড হতে প্রতি ত্রিশ মিনিট পর একটি গেইটলক বিরতিহীন বাস এবং প্রতি পনের মিনিট পর একটি লোকাল বাস দিরাইয়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। একই নিয়মে দিরাই থেকে ছেড়ে যায়।
সুনামগঞ্জ থেকে আসতে চাইলে : পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতি দশ মিনিট পর একটি লেগুনা দিরাইয়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে একই নিয়মে দিরাই থেকে ছেড়ে যায়।
কোথায় থাকবেন : পদ্মবিল থেকে ১৫ কিমি দূর, দিরাই সদরে একটি সরকারি ডাকবাংলা এবং কয়েকটি আবাসিক হোটেল আছে।
কোথায় খাবেন : পদ্মবিল থেকে ৩ কিমি দূর শ্যামারচর বাজারে কিছু খাবার হোটেল আছে। সেগুলোর মান তেমন ভালো না লাগলে আসতে পারেন দিরাই বাজারে। এখানে বেশকিছু সাধারণ রেস্টুরেন্ট আছে। এগুলোর মধ্যে জনতা, রাজ, আপ্যায়ন, সূপসী বাংলা রেস্টুরেন্ট উল্লেখযোগ্য। কমদামে ভালো খাবার খেতে ইচ্ছে করলে যেতে পারেন সুরঞ্জিতের জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টে।
বিশেষ সুবিধা : দিরাই উপজেলায় ভাড়ায় চালিত প্রায় ৭০টি মাইক্রোবাস, কার ইত্যাদি আছে। এগুলো ভাড়া করে যেতে পারেন বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে। ভাড়া আলোচনা সাপেক্ষ।
-----
ফারুকুর রহমান চৌধুরী, গীতিকার, লেখক, সংগ্রাহক, দিরাই, সুনামগঞ্জ।