somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিরাই উপজেলার লোকমানস ও সংস্কৃতি

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দিরাই উপজেলার লোকমানস ও সংস্কৃতি
ফারুকুর রহমান চৌধুরী
১.
বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল গারো পাহাড় থেকে শুরু করে ভৈরব পর্যন্ত বিস্তৃত সাতটি জেলার মোট পঁচিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা হাওরাঞ্চল নামে অভিহিত। উল্লেখিত সাতটি জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলা অতিপ্লাবিত হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। আমাদের হাওরাঞ্চল এককালে সাগর বক্ষে নিমজ্জিত ছিল। কালের পরিবর্তনে তা বসবাস যোগ্য এবং হাওরে পরিণত হয়েছে। সাগর সৃষ্ট হাওরাঞ্চলের এক অংশকে বলা হয় ভাটি অঞ্চল। হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মনবাড়িয়া এই পাঁচটি জেলার সমন্বয়ে ভাটি অঞ্চল বিস্তৃত। ভাটি শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায়- উজান থেকে জল নেমে এসে এই অঞ্চলে জমাট বাঁধে, বিধায় জলের স্রোতধারা কেন্দ্র করে ভাটি শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। তবে মুসলমান ঐতিহাসিকগণ এই অঞ্চলকে ভাটি অঞ্চল হিসেবে আখ্যায়িত করলেও হিন্দু ঐতিহাসিকগণ এই অঞ্চলকেই নিম্নাঞ্চল হিসেবে অভিহিত করেছেন। ভাটি অঞ্চল কিংবা নিম্নাঞ্চল যা’ই বলা হোক না কেনো তৎসঙ্গে মৌলভীবাজার এবং সিলেট জেলা যুক্ত করলে এই শব্দের মতবিরোধ আর থাকে না, বরং বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল গারো পাহাড় থেকে শুরু করে ভৈরব পর্যন্ত বিস্তৃত সাতটি জেলার মোট ৫২টি উপজেলার সমন্বয়ে বিস্তৃর্ন এলাকাকে হাওরাঞ্চল নামে অভিহিত করা যায়। যার আঞ্চলিক নাম আওর অঞ্চল। এই আওর অঞ্চল বা হাওরাঞ্চল লোকসংস্কৃতিতে ভরপুর। এই হাওরাঞ্চলের ৫২টি উপজেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি উপজেলা দিরাই। যদিও দিরাই উপজেলার লোকমাসন ও সংস্কৃতির ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ তবুও এই উপজেলার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যালোচনা করা একটি জটিল ও কঠিন কাজ। কারণ এই উপজেলার উল্লেখিত বিষয়ের উপর এখন পর্যন্ত কোন উপাদান সংগৃহীত হয়নি। তাই অতি-প্রাচীন সাংস্কৃতিক ইতিহাস আলোচনা করার মতো কোন উপকরণ আমাদের হাতে নেই। সংগত করণে দিরাই উপজেলার সংস্কৃতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হলে আমাদের বাধ্য হয়েই হাওরাঞ্চলের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিকে তাকাতে হয়। কারণ দিরাই উপজেলার সংস্কৃতি হাওরাঞ্চলের সংস্কৃতির সাথেই সম্পর্কযুক্ত। অন্যথায়, দিরাই উপজেলায় বিচ্ছিন্ন ভাবে যে উপকরণ পাওয়া যায় তা দিয়ে দিরাই উপজেলার লোকমানস ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করা একেবারেই দুঃসাধ্য।

কোন অঞ্চলের সংস্কৃতি নিয়ে পর্যালোচনা করতে হলে ঐ অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক স্বকীয়তা, আঞ্চলিক বিশেষত্ব, ভাষার স্বতন্ত্র ইত্যাদি নিয়েই কাজ করতে হয়। আমরা যখন এই বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেই তখন দেখতে পাই দিরাই উপজেলার কোথাও কোন প্রকার শিলালিপি, দস্তাবেজ, আদিম মানুষের কঙ্কাল এমন কিছু পাওয়া যায়নি। সংগত করণে এই উপজেলার সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এখানকার স্থানীয় ভাষার প্রতি দৃষ্টি দিয়ে আমরা দেখতে পাই এখানকার ভাষায় বিভিন্ন অঞ্চলের বিশেষ করে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাষার সংমিশ্রণ রয়েছে। সংগত করণেই দিরাই উপজেলার সংস্কৃতি ঐ সমস্ত এলাকার সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। ইতোপূর্বে ‘দিরাই উপজেলার ইতিকথা’ শিরোনামে একটি লিখায় এখানকার স্থানীয় ভাষা নিয়ে স্বল্প বিস্তর আলোচনা করেছিলাম। বিধায় এ পর্যায়ে স্থানীয় ভাষা নিয়ে আলোচনা না করে এখানকার সংস্কৃতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যাচ্ছি।

দিরাই উপজেলার লোকসংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় এই এলাকায় একসময় পীরবাদ বা মুর্শিদবাদ, দেবদেবী, জ¦ীন ভূত, দৈত্য, দানব, লৌকিক ক্রীয়কর্ম ও জাদু মন্ত্রের প্রতি লোকজ বিশ^াস ছিল খুব বেশি। এখানে দেবদেবী, জ¦ীন ভূত, দৈত্য দানব, পীর ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাবিজ কবচ, ঝাঁড়ফুঁক, পানি পড়া ইত্যাদির প্রভাব ছিল। দিরাই উপজেলার কোন কোন এলাকায় বর্তমানে ও এই প্রভাব রয়েছে। একসম এখানকার মানুষ চাষাবাদের প্রয়োজনে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। পাশাপাশি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে শিরনি মানতের মাধ্যমে নানান লৌকিক দেবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকত। বর্তমানে এই প্রভাব একেবারে বিলুপ্ত না হলেও বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যায় লোক মানষ থেকে দূর হতে শুরু করেছে।

২.
লোকজ বিশ্বাস ও লোকজ প্রথা : হাওরাঞ্চলের অন্যান্য এলাকার মতো দিরাই উপজেলায় ও একসময় ব্যতিক্রমধর্মী লোকজ বিশ্বাস ও লোকজ প্রথা প্রচলিত ছিল। এখানে ছিল বিচিত্র বোধ বিশ্বাস সংস্কার কুসংস্কার। বৈজ্ঞানীক বা যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যায় এগুলো প্রায় উঠে গেলেও একশ্রেণীর মানুষের কাছে তা রয়ে গেছে। যেমন- ২০১০ সালে থানা সদরে লোকজ বিশ্বাস কেন্দ্র করে চিকিৎসা করিয়ে জনৈক বাউলশিল্পীর মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছবিসহ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে ব্যতিক্রমধর্মী এই চিকিৎসা গ্রহণকারী বাউলশিল্পীর নাম বাদল মিয়া। তিনি প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক ভাবে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যান। ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি খাট থেকে মাটিতে পড়ে গিয়ে এক হাত এক পা অবস হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে গ্রাম্য ওঁঝার চিকিৎসা নেন। গ্রাম্য ওঁঝা পরীক্ষা করে দেখলেন বাদল মিয়াকে জ্বীনে ধরেছে তাই জ্বীন ছাড়ানোর নাম ধরে শুরু হয় চিকিৎসা। বাদল মিয়াকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে কূপে ঝাঁড়ফুঁক দেয়া হয়। এতে বাদল মিয়ার শারিরীক অবস্থা ক্রমাগত অবনতির দিকে চলে যায়। একসময় তাঁর মৃত্যু হয়। এমন অসংখ্য লোকজ প্রথা দিরাইতে প্রচলিত ছিল। যেমন- রাতের বেলা জ্বীন ভূত চলাচল করে; একটুকরো লোহা বা আগুন সঙ্গে রাখলে জ্বীন ভূত কাছে আসে না। আচমকা ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠলে বুকে তিন বার থু থু দিতে হয়। মাঠে ভাল ফসল হয়েছে, মানুষের কুদৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হতে পারে; এই কুদৃষ্টি থেকে ফসল রক্ষার করার জন্য মাটির পাত্রে বা একখন্ড টিনে চুন দিয়ে বৃত্তাকার চিহ্ন অথবা শয়তানের ছবি এঁকে টাঙ্গিয়ে রাখলে অথবা ছেড়া জুতা ঝুলিয়ে রাখলে ফসল কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়। বাড়ির আশে পাশে দুপুর বেলা কাক ডাকলে বাড়িতে অতিথি আসে। হাত থেকে থালা চামচ বা কোন বাসন পড়ে যাওয়া অতিথি আসার লক্ষণ। বাড়ির পাশে সন্ধ্যেবেলা প্যাঁচা ডাকলে বাড়িতে অলক্ষি আশ্রয় নেয়। রাত্রে কুকুরের করুণ ডাক অমঙ্গল বা রোগ বালাইয়ের লক্ষণ। কোন বিষয়ে গল্প করার সময় টিকটিকি ডাকলে বুঝতে হবে যে আলোচনা হচ্ছে তা সত্যি; তাই টিকটিকি ডাকার পর তর্জনী আঙ্গুল দ্বারা মাটিতে তিন বার ঠুক দিতে হবে। ঘর ঝাড়ু দেয়ার সময় শরীরে ঝাড়ু লাগলে ঝাড়ুর শলাকা ভেঙ্গে তাতে তিন বার থু থু দিয়ে শরীরে ছুড়ে মারতে হবে, অন্যথায় অমঙ্গল হয় ইত্যাদি লোকজ বিশ^াস যুগযুগ ধরে মনুষের মনে স্থান করে নিয়েছিল। লোকজ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কিছু ডাক্তারি বিষয়াদিও ছিল; যেমন- চন্দ্র বা সূর্য গ্রহণের সময় কিছু খেতে নেই, অন্যথায় পেটে পীড়া হয়। সূর্য গ্রহণের সময় গর্ভবতি মহিলারা কিছু কাটলে পেটের সন্তানের ঐ স্থান কাটা পড়ে। ছোট বাচ্চাদের দাঁত পড়লে ইঁদুরের গর্তে রাখতে হবে, অন্যথায় দাঁত উঠবে না, যদিও উঠে দাঁত বাঁকা হবে। লোকজ চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু লোকজ ছড়া প্রচলিত ছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ছাড়া ছিল-
আতো তিতা, দাঁতো নুন, কানো কচু চৌকো তেল
ইতা থইয়্যা হালারবেটা কেনে ডাক্তরের বাড়িত গেল।
ঝড়-বাদল নিয়ে লোকজ বিশ্বাস ছিল- ফসলের মৌসুমে শীলা বৃষ্টি হলে কুলাতে চাউল নিয়ে তার সাথে মরিচ বাটার শিল এবং ছাই একত্রিত করে এক নিঃশ্বাসে বাড়ির আঙ্গিনায় ফেলতে পারলে শিলাবৃষ্টি কমে। বিয়ের ক্ষেত্রে লোকজ প্রথা ছিল- বর কনে পাশাপাশি বসিয়ে কুলার উপর ধান চাউল চিকন ঘাস রেখে বর কনের সামনে দিতে হয়, অতঃপর চিকন ঘাষের সংমিশ্রণে ধান চাউল বর কনের মাথার উপর দিয়ে ছিটিয়ে সালাম গ্রহণের মাধ্যমে বর কনেকে আশির্বাদ করা। এই রীতিকে বলা হয় ধান-ধূপ। নব দম্পত্তির বন্ধন যেন শক্ত হয় এই কামনায় বৌভাতের সময় কনের ভাই বরের বাড়ির প্রধান দরজায় জালিবেত দিয়ে শক্ত করে বাঁধ দেয়া। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়াকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের লোকজ বিশ্বাস ও লোকজ প্রথা প্রচলিত ছিল। যেমন- নবজাতক ভূমিষ্ট হওয়ার পর কাঁচা বাঁশের গা থেকে নুই বা বাঁশের ছিলকা (ধারালো চাকু) তৈরী করে নবজাতকের নাভীর মূল কাটা। নবজাতক শিশু নিয়ে মা যে ঘরে থাকেন সেই ঘরের নাম আতরি ঘর। নবজাতক শিশুকে মঙ্গল কামনায় আতরি ঘরের দরজার উপরে ভাঙ্গা ঝাড়ুর শলাকায় ডিমের বাকল গেঁথে ঝুলিয়ে রাখা। বেড়ার খাপে ছেঁড়া জুতা, গরুর হার, ছেঁড়া জালের টুকরা, প্রভৃতি টাঙ্গিয়ে রাখা। আতরি ঘরের দরজার সামনে আইল্যা (মাটির তৈরী নতুন পাতিলে তুষের আগুন) জ্বালিয়ে রাখা। আতরি ঘরে কেউ প্রবেশর সময় পাক পবিত্র অবস্থায় হাত, পা, মুখ প্রভৃতি আইল্যার ধোঁয়ায় সেঁকে নেয়া। নবজাতকের মা একুশ দিন স্থান বিশেষ সাত দিন পর্যন্ত মাছ মাংসের পরিবর্তে নিরামিষ খাওয়া। নবজাতক শিশুর বয়স সাত দিন হলে ছডি; স্থান বিশেষ নয় দিনের সময় নুয়াই (একধরণের অনুষ্ঠান) করা। ছডি কিংবা নুয়াইয়ের দিন নবজাতক শিশুকে ধান-ধূপ দিয়ে ঘরের বাইরে নেয়া এবং সূর্যের আলো, আকাশ প্রভৃতি দেখানো। নবজাতক যেন চরিত্রহীন বা লম্পট না হয় এই কামনায় রাতের বেলা দলবেঁধে মহিলা দেখানো। ছডি কিংবা নুয়াইর দিন শিশুর মা’কে আমিষ জাতিয় খাবার খেতে দেয়া। এসময় বিশেষ করে মোরগের মাথা, গলা, ডানা, বুক ইত্যাদির হাড্ডি চিবিয়ে খাওয়া। এতে নাকি নবজাতকের এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো শক্ত হয়, বীরের মতো শক্তিশালী হয়। ছডি কিংবা নুয়াইর রাতে নিকটস্থ মসজিদের ইমামকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো এবং নবজাকের নাম নির্ধারণ করা। লোকজ বিশ্বাস ছিল ছডি/ নুয়াইর রাতে ফেরেশতা এসে নবজাতকের ভাগ্য লিখেন, তাই নবজাতক যেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয় এই কামনায় শিথানে কাগজ কলম রাখা। বিভিন্ন রোগবালাই থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চৌক্কা গোটা (একজাতীয় গুল্ম) কাইতনে (কালো রঙ্গের মসৃন সুতা) বেঁধে তার সঙ্গে ইমাম বা পীর ফকিরের দেওয়া তাবিজ গলায়, কোমরে, পায়ে, হাতের কব্জিতে বেঁধে রাখা। শিশুর চেহারা লাল নীল হওয়া কিংবা খিচুনী হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোমরে বাইট্যা (কালো রঙ্গের মোটা সুতা) বেঁধে দেয়া। টাউকরা টাউকরি ধরলে শিশুর চেহারা লাল নীল হয়। এতে শিশুর মৃত্যু হতে পারে। কোন কারণে শিশুর চেহারা লাল নীল হলে কবিরাজের মাধ্যমে লোহার বড়শী আগুনে পুড়িয়ে লাল করে শিশুর কপালে বা বুকে ছেক দেয়া। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এমন বহু ধরনের লোকজ বিশ্বাস ও লোকজ প্রথা প্রচলিত ছিল। লোক বিশ^াসের মধ্যে অন্যতম ছিল- স্বামীর নাম মুখে আনলে অমঙ্গল হয়। হাতে চুঁড়ি না থাকলে স্বামীকে খাবার পানি দিতে নেই। ৮/১০ বছরের বাচ্চা ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানায় প্রশ্রাব করলে ঘুম থেকে ওঠার পর ঐ স্থানে চাল ফেলে জিহ্বা দিয়ে চেঁটে চেঁটে খাওয়ানে ইত্যাদি।

একসময় কলেরা রোগের প্রকোপ ছিল। এই প্রকোপকে বলা হত ‘মাইলের ভর’। কলেরার প্রকোপ বা মাইলের ভর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাড়ি বন্দনা করা হত। বাড়ি বন্দনা করার জন্য দূরদূরান্ত থেকে স্বনামধন্য ওঁঝা আনা হতো। কখনো কখনো রাতের বেলা গ্রামের লোকজন দলবেঁধে গ্রাম পাহারা দিতেন কলেরা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। তাঁদের বিশ্বাস ছিল রাতে ঠিকঠাক ভাবে পাহারা দিতে পারলে কলেরা রোগ গ্রামে প্রবেশ করতে পারে না। তাই দলবেঁধে গ্রাম পাহারা দিয়ে সুর তুলে গাইতন-
আলীর হাতো জুলফিকার মায়ের হাতো তীর
যেমদি আইচছ মাইল হেমদি ফির।
গ্রামের কোন লোকের কলেরা হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ওঁঝার মাধ্যমে ঝাঁড়ফুঁক দিয়ে চিকিৎসা করা হত। পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে যেন কলেরা আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য ‘ওঁঝা’ দোয়া কালাম বা মন্ত্র পড়ে নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ির চতুর্দিকে ঘুরেঘুরে বাড়ি বন্দনা করা হত। বিশ^াস ছিল, বাড়ি বন্দনা করলে নাকি জ্বীন ভূতের উপদ্রব সহ কলেরা রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বেদেনি চিকিৎসা ছিল উল্লেখযোগ্য। বেদেনিদের দিরাই এলাকায় বলা হয় কুরুঞ্জি। কুরুঞ্জিরা বাস্তুহারা; এরা নৌকায় জীবন যাপন করে। কাপড়ের লম্বা থলে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। বর্ষাকালে এদের বেশি দেখা যায়। বেদেনিরা সাপের খেলা দেখায়, পাশাপাশি চিকিৎসা করে। যেমন, চোখ ও দাঁতের পোকা, বাত রোগ ইত্যাদি। দাঁতে পোকা ধরলে অথবা চোখ চুলকালে কুরুঞ্জিরা সাদা তুলা দিয়ে মন্ত্র পড়ে চোখ ও দাঁত থেকে পোকা বের করে। এতে নাকি চোখ এবং দাঁত পোকার আক্রমণ রক্ষা পাওয়া যায়। বাত রোগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট স্থানে ব্লেড দিয়ে ছিঁড়ে ক্ষত স্থানে গরুর সিং সাদৃশ্য বস্তু লাগিয়ে মুখে টেনে বিষ বের করা হয়। এতে নাকি বাত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

লোকজ বিশ্বাসের মধ্যে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়- সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ছিল এক ধরনের গুখরা সাপের মাথায় মণি থাকে, এই মণিতে সাত রাজার ধণ থাকে। বর্ষাকালে এক ধরনের ব্যাঙ পেট থেকে আলো বের করে, এই আলোকে বলা হয় ব্যাঙের লাল। এতেও সাতরাজার ধণ আছে। এই লাল সংগ্রহ করা খুব কঠিন, কারণ এটি সংগ্রহ করতে গেলে ব্যাঙ কামড় দেয়, এই কামড়ে মৃত্যু অনিবার্য্য। যিনি নিজেকে সুরক্ষা রেখে ব্যাঙের লাল ছাই বা গোবর দিয়ে ঢেকে রাখতে পারবেন, তিনি সাতরাজার ধণ পাবেন। এ লোকজ বিশ্বাসের ব্যাঙের লাল বা সাপের লাল কেউ কখনো সংগ্রহ করতে পেরেছে কি না কে জানে। তবে এমন বিশ^াস যুগযুগ ধরে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিল।

বিভিন্ন স্থানে গমন বা যাত্রা সম্পর্কেও এখানে প্রচলিত বিশ^াস কাজ করে। যেমন- “সোম শনি, পুবে হানি, বৃহস্পতি যাত্রা নাস্তি। মঙ্গলে উষা, বুধে বাও, যথা ইচ্ছা তথা যাও”। নিঃসন্তান লোককে দেখলে যাত্রা অশুভ। যাত্রার শুরুতেই বানর দেখলে যাত্রা করতে নেই। যাত্রার শুরুতে হোঁচট খাওয়া বিপদের লক্ষণ। এমন অসংখ্য লোকজ বিশ্বাস ও লোকজ প্রথা যুগযুগ ধরে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক যুক্তি ব্যাখ্যার ফলে এগুলো মানুষের মন থেকে উঠে যাচ্ছে। পাশাপাশি আধূনিক বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসার প্রতি সাধারণ মানুষের মনযোগ বাড়ছে।


৩.
লোকসংস্কৃতিকর গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে লোকাচার। দিরাই উপজেলার গ্রামগঞ্জে অনেক ধরণের লোকাচার বর্তমানেও লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে উলেল্লখযোগ্য হচ্ছে ভোলাভুলি উৎসব। কার্তিক মাসের শেষ দিন ভোলাভুলি উৎসবের আমেজে মেতে উঠে কৃষক পরিবারগুলো। এই দিন ঘর দুয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। লেপে মুছে সাফ করা হয় মাটির ঘরগুলোর মেঝে বারান্দা ইত্যাদি। ধোঁয়া হয় ময়লা কাপড় চোপড়। গরু বাছুর মাঠে পাঠানোর আগে তাদের গা ধোঁয়ে, লেজের লোমগুচ্ছ কেঁটে ছেঁটে সুন্দর করা হয়। এই দিন গরু মহিষ কোন কাজে লাগানো হয় না। একসময় ভোলাভুলির দিনে গরু বাছুর মাঠে পাঠিয়ে বিল কিংবা হাওরে জমে উঠত পলো বাইচ। এখন ভোলাভুলির দিন পোলো বাইচ না হলেও, বিকেল বেলা কিশোর তরুণরা কলাপতার পাঁচল বা মুর্তা গোত্রের নরম উদ্ভিদ সংগ্রহ করে কলা পাতার কাঠির মতো অংশটা জোড় করে বেঁধে নিয়ে গেন্ডা বা গাধা ফুল কিংবা অন্য কোনো ফুলে সাজানো হয়। রোদ ফিকে হয়ে আসার সাথে সাথে মাঠে চড়ে বেড়ানো গরু জড়ো করা হয়। গরুর পাল ঘিরে কোনো একজন চারদিকে একটি ডিম হাতে দৌড়াতে দৌড়াতে ছড়া কাটে-
ভোলা ছাড়, ভুলি ছাড়, বারো মাইয়া পিছাইয়া ছাড়
খাইয়া না খাইয়া ছাড়।
অন্যরা ছড়ার পুনরাবৃত্তি করে তার পিছনে পিছনে দৌড়ায়। এভাবে প্রদক্ষিণ শেষে শুরু হবে গরু পিটানো। পাঁচন দিয়ে গরুর গায়ে হালকা ভাবে পিটিয়ে তার শুভ কামনা করা হয়। এই শুভ কামনার মাধ্যমে ভোলাভুলি গরু বাছুরের পর্ব শেষ হয়। আসে মানুষের পর্ব। মাঠ থেকে বাড়িতে ফিরার পর দাদী নানী অথবা ভাবীদের শুরু হয় ছোটাছুটি লুকোলুকি। রং-তামাশা ছোঁয়াছুয়ি আর ঠাট্টা সম্পর্কিত নিকটজনকে পাঁচন দিয়ে আলতো করে পিটিয়ে ছড়া কাটা হয়-
ভোলা ছাড়, ভুলি ছাড়, বারো মাইয়া পিছাইয়া ছাড়
ভাত খাইয়া লড় বড়, পানি খাইয়া পেট ভর।
এরপর পাঁচনটি থু থু দিয়ে অথবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। আনন্দ উল্লাস আর হই হুল্লোড়ের মধ্যে শেষ হয় ভোলাভুলি আচার অনুষ্ঠান। সন্ধ্যে বেলা কিশোর ছেলেরা মুক্ত মাঠে কিংবা নদীর কিনারে মেতে ওঠেন উৎসবের আনন্দে। এক টুকরা পাটের বস্তা দুই হাত পরিমান লম্বা তারের মাথায় বলের মতো পেছিয়ে কেরসিনের সাহায্যে আগুন জ¦ালানো হয়। তার পর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উপর দিকে ছুড়ে মারা হয়। যতক্ষন পর্যন্ত আগুন থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে কিশোরদের এমন দুষ্টমি। এই লোকাচার উৎসব মূলত- দৈত্য দানব বা অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে পালন করা হয়।

যেসকল লোকচার বর্তমানে বিলুপ্তির পথে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাঘাইর শিন্নি। এই লোকাচার একেবারে বিলুপ্ত না হলেও বর্তমানে মাঘ মাসে দিরাই উপজেলার কিছু কিছু গ্রামে পালন করতে দেখা যায়। মাঘাইর শিন্নি লোকাচার অত্যান্ত আনন্দদায়ক। এই লোকাচারের জন্য সংঘবদ্ধ তরুণরা সন্ন্যাসী সাজে। একজনকে বানানো হয় বয়াতী। বয়াতী মাঘারই শিন্নির গান গায় অন্যরা সমবেত কন্ঠে ধুয়াপদ গেয়ে বয়াতীর সাথে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা সংগ্রহ করে। সবার হাতে থাকে একটি করে লাঠি। গানের তালে তালে লাঠিতে ভর দিয়ে সারিবদ্ধভাবে পথ চলে সন্ন্যাসী দল। গৃহকমীরা সাধ্যমতো চাল ডাল অথবা নগদ অর্থ প্রদান করেন। অন্যথায় হাতের লাঠি দিয়ে আঙিনা বারান্দা প্রভৃতি গর্ত করে অন্য বাড়িতে চলে যায়। গ্রামের তরুণীরা উল্লাসিত হয়ে আড়াল থেকে ভাতের ঠান্ডা ফেন, রংমাখা পানি প্রভৃতি ছিটিয়ে সন্ন্যাসী দলকে ভিজিয়ে দেয়। এ জন্য কোন ধরনের অভিযোগ উত্থাপন হয় না। এভাবে বাড়ি-বাড়ি ঘুড়ে যে চাল সংগ্রাহ করা হয় তা দিয়ে মুক্ত মাঠে রান্না করে ধুম ধাম করে খাওয়া হয়। এটি মূলত একটি প্রার্থনা মুলক আচার অনুষ্ঠান। অতিরিক্ত রোদ অথবা অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে তা থেকে মুক্তি লাভের আশায় আয়োজন করা হয়। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি প্রচলিত থাকলেও কোন কোন স্থানে বাঘের শিন্নি নামে পরিচিতি। তাই নিয়মকানুন এবং গানে কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়-
গাও গাও গাও রে ভাই, বাঘেরও পাছালী
ষোল সতের বাচ্চা লইয়া নামছে বাঘুনি,
ষোল সতের বাচ্চা না রে ষোল সতের নাও
আমার বাঘাইরেনি দেখছো কোনো গাঁও।
দেখছি দেখছি দেখছিরে, বুলবুলিয়া ছাগল
বুলবুলিয়া ছাগল না রে, লখিন্দরের পাগল,
লখিন্দর লখিন্দর কি কাম করলি
মাঘ মাসের তেরো তারিখ, আউল্লা চাউল মাগিলি।
(মুসলিম সমাজে প্রচলিত)
---
রাধেরে যাইছ না জঙ্গলায় রে বাঘ আইতাছে।।
গোয়ালিয়ার মা গো বড় বাপের বেটি
বাঘ মারতে লইয়া যায় দুয়ার বেন্দা লাঠি।
বাঘের মাথায় পিংলা চুল চকবগাইয়া চায়
বাঘের পিঠো বাড়ি দিয়া বলছে হায় রে হায়।।
সুবল নেপুর দিয়া পায়
হেলিয়া দুলিয়া সুবল রাধার কুঞ্জে যায়।
গাও গাও গাও রে ভাই বাঘেরও পাছালি
ষোল সতের বাচ্ছা লইয়া নামছে বাঘুনী।।
ষোল সতের বাচ্ছা নারে ষোল সতের নাও
আমার বাঘাইরেনি দেখছো কোনও গাঁও।
আমার বাঘাইর হাতো মুঠমোটিয়া ছাগল
তারে দিখিয়া লখিন্দর হইয়াছে পাগল।।
লখিন্দর লখিন্দর কি কাম করিলি
মাঘ মাসের তেরো তারিখ আউল্যা চাউল মাগিলি।
চাউল নারে শিন্নি হাছি ভরা ঘি
হরি... হরি... হরি...।।
(হিন্দু সমাজে প্রচলিত)

মাঘাইর শিন্নির মতো আনন্দদায়ক লোকাচার হচ্ছে ব্যাঙাব্যাঙির বিয়া। এটি বর্তমানে বিলুপ্ত। বৃষ্টি প্রার্থনায় এই লোকাচার পালন করতেন গ্রামের মেয়েরা। তাঁদের বিশ্বাস ছিল ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টি নামবে। তাই কিশোরী মেয়েরা ঘরে ঘরে বৃষ্টি মাগনে বের হত। মাগন শেষে ব্যাঙ ধরতেন। পর্যাপ্ত কাদামাটি দিয়ে তৈরী করতেন ব্যাঙের ঘর। ঘরের কুণায় কুণায় ব্যাঙ বেঁধে রাখাতেন। এরপর ব্যাঙের ঘরের চার পাশে চক্রাকারে ঘুরেঘুরে সমবেত ভাবে তালি বাজিয়ে ব্যাঙা ব্যাঙির বিয়া গান গাইতেন। নেচে গেয়ে ব্যাঙের বিয়ে দিতে গিয়ে অনেক সময় রং মাখামাখি ও করা হত। এই লোকাচারের মাধ্যমে নাচ গানে মুখরিত হত পাড়া মহল্লা। অনুষ্ঠানে ধুমধাম করে খাবারেরও আয়োজন করা হত। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি প্রচলিত থাকলেও নিয়মকানুন এবং গানে কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়-
ব্যাঙা-ব্যাঙির বিয়া কুলা মাথাত দিয়া
ও ব্যাঙ মেঘ আনো গিয়া
খালও নাই রে পানি, বিলও নাই রে পানি
আসমান ভাঙ্গিয়া পড়ে ফোঁটাফোঁটা পানি।
অথবা
ব্যাঙাব্যাঙির বিয়া ষোল মডুক দিয়া
আইজ ব্যাঙের অধিবাস, কাইল ব্যাঙের বিয়া
ষোল মডুক দিয়া ব্যাঙাই রইদ তুলো গিয়া
ডেঙ্গা ক্ষেত ঝেঙ্গা ফুল, ছেংছেঙ্গাইয়া রইদ তুল
হুরহুরি দেপ্তা মুক্তার ভাই
এক ছিটা মেঘ দে মেঘে ভিইজ্যা যাই
ব্যাঙের নানী ঘরো গো, ব্যাঙে তরে ডাকে গো
অতো আদরের ব্যাঙ পানিত পঁইচ্যা মরে গো
মেঘ ও ...., মেঘ ও ....।।

৪.
দিরাইবাসী বিনোদন প্রিয়। এই অঞ্চলের অধিকাংশ ভূমি বৎসরে সাত মাস পানির নীচে লুকিয়ে থাাকে। তাই বৎসরের অধিক সময় এলাকার মানুষ অবসর থাকেন। সংগত করণে সহজিয়া সংস্কৃতির উর্বর ভূমি দিরাই উপজেলার মানুষ একসময় বিভিন্ন ধরণের বিনোদন নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রশ্নে আমাদের অনেক সংস্কৃতি আজ বিলুপ্ত হয়েছে। এছাড়াও সময়ের পরিবর্তনে এলাকার মানুষ কাজের সন্ধানে ছুটে চলছে বিভিন্ন শহরে। ইত্যাদি কারণে আমাদের লোকসংস্কৃতির অনেক কিছু আজ বিলুপ্ত। দিরাই উপজেলার বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যাত্রাপালা। এই অনুষ্ঠান গ্রামের মানুষের অন্তরে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল। এখানকার সংস্কৃতিমনা মানুষগুলো চিত্ত বিনোদনের জন্য পেশাদার যাত্রাদলের অনুকরণে নিজেদের মত করে সামাজিক, ঐতিহাসিক কিংবা পৌরনিক বিভিন্ন কাহিনী অবলম্বনে তৈরী করতেন যাত্রাপালা। এই উপজেলায় কোন অপেরা দল ছিল না। তবুও গ্রামের উদ্যোগী ব্যক্তি আর কিছু লোকের সমন্বয়ে নিতান্তই শখের বশে যাত্রাপালা আয়োজন করে অনেক সময় নিজেরাই অভিনয় করতেন। কখনো কখনো বাহির থেকে নিয়ে আসতেন বিভিন্ন অপেরা দল। যেমন- শাল্লা উপজেলার মাহমুদ নগরের জুনু বাবুর নিউ রয়েল অপেরা, জগন্নাথপুরের আপ্তাব উদ্দিনের শিল্পী অপেরা, আজদ উল্লার স্বপ্তরূপা অপেরা, হবিগঞ্জের খান সাহেবের হারুন অপেরা, ব্রহ্মণবাড়িয়া নাসিরনগরের রবীন্দ্র দে’র মিনু অপেরা, কানাইলাল চক্রবর্তীর জয় দূর্গা অপেরা, হবিগঞ্জের মান্নান সাহেবের বিশ^রূপা অপেরা, হবিগঞ্জ নবীগঞ্জের লিপাই মিয়ার কুহিনুর অপেরা ইত্যাদি দল মাতিয়ে রেখেছিল দিরাই উপজেলার গ্রাম-গঞ্জ। এছাড়াও দিরাই উপজেলায় কালনী, উদিচি, ভাটিবাংলা, গীতিমালঞ্চ নামে সংগঠনের নেতৃত্বেও অনেক যাত্রাপালা আয়োজন করা হয়েছে। মা মাটি, একটি পয়সা, জেল থেকে বলছি, মেঘে ঢাকা তারা, অশ্রু দিয়ে লেখা, নাম মহল, রমজানের চাঁদ, কলঙ্কিনী বধু, রক্ত তিলক পণমুক্তি, চাষার ছেলে, দানবীর হরিশচন্দ্র, অর্জুনের পুত্র পরিচয়, গঙ্গাপুত্র বিশ^ ইত্যাদি নামে এসব যাত্রাপালায় বিভিন্ন সময় অভিনয় করে দর্শক মাতিয়েছেন রাশবিহারী চক্রবর্তী, রামকানাই দাশ, কৃষ্ণ চক্রবর্তী, উন্দভোষণ চক্রবর্তী, রাখেশ দাশ, মনোরঞ্চন তাং, সুনিল বিশ^াস, হরেন্দ্র দাস, কৃপাময় মাষ্টার, গণেন্দ্র বাবু, মাধু বাবু, কুতুব মাষ্টার, তমিজ মিয়া, সিরাজুল ইসলাম সর্দার, ক্ষিতিশ নাগ, আকল বাবু, রাখেশ বাবু, আতাউর রহামন, উৎপল, বাতির মিয়া, কাজলী রানী সাহা, আলীরব, আলীনূর, আঃ শহীদ, নানু মিয়া, আঃ মতিন, দিন বন্ধু মিত্র, অশোক নাগ, খোকা বাবু, যিশু বাবু, রানু বাবু, রাখেশ বাবু, দিলরাজ মিয়া, বাবুল সর্দার, অকিল চক্রবর্তী, স্বাধীন মাষ্টার, বাছিত মিয়া, প্রশান্ত, ময়না মাষ্টার, রানু বাবু প্রমুখ যাত্রাশিল্পীগণ। দিরাই উপজেলার গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো যাত্রা পালার জন্য বিখ্যাত ছিল। মুসলমান সমাজে এর জনপ্রিয়তা থাকলেও ইসলামের শরীয়তি বিধিবিধান দেখিয়ে যাত্রাপালা নিষিদ্ধ করা হয়েছে অনেক আগেই। তবে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে মাঝেমধ্যে যাত্রাপালা আয়োজনের সংবাদ বর্তমানেও পাওয়া যায়।

পুঁথি পাঠ : দিরাই উপজেলার মানুষ একসময় মনোরঞ্জনের জন্য পূঁথি পাঠ নামক এক ধরনের লৌকিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। পূঁথি পাঠের আসর খুবই জনপ্রিয় ছিল। সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর গ্রামের মানুষ রাতের বেলা বাড়ির উঠানে পুঁথি পাঠের আসর জমাতেন। পাড়া প্রতিবেশী সহ বাড়ির সবাই শীতল পাটি বিছিয়ে একত্রে বসতেন। বালিশের উপর রাখা হত পুঁথির বই। পাশেই কেরসিনের কুজি জ¦ালিয়ে রাখা হত মাটি কিংবা কাঠের তৈরী গাছার উপর। কুপির আলোয় কোন একজন সুর তুলে পাঠ করতেন- গাজীকালু, চম্পাবতী, ইউসুফ-জুলেখা, হানিফা ও সোনাভানু ইত্যাদি পূঁথি। বর্তমানে দিরাই উপজেলার কোথাও পূঁথি পাঠের আসর দেয়া হয়েছে এমন সংবাদ পাওয়া যায় না। এই সংস্কৃতি বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত।

গ্রাম্য কবিতা : একসময় দিরাই উপজেলায় গ্রাম্য কবিতা খুব জনপ্রিয় ছিল। এটি সুর করে পড়া হত। গ্রাম্য কবিতার সুর ছিল পূঁথির মতো তবে একটু ভিন্ন। গ্রামের অল্প শিক্ষিত কবি বিভিন্ন ঘটনা অবলম্বনে ছন্দে ছন্দে লিখতেন গ্রাম্য কবিতা। ছয়, আট কিংবা দশ পৃষ্ঠার গ্রাম্য কবিতা বিভিন্ন বাজারের গলিতে দাড়িয়ে সুর করে পড়তে পড়তে বিক্রি করতেন গ্রাম্য কবিগণ। লোকজন আনন্দচ্ছলে কিনে নিতেন বাড়িতে গিয়ে পড়ার জন্য। দিরাই উপজেলার কার্তিকপুরের গ্রাম্য কবি মহিম উদ্দিনের লেখা কবিতা ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। এসব কবিতা বর্তমানে কেউ লিখেন না। আনন্দচ্ছলে দলবেঁধে গ্রাম্য কবিতা শুনার দৃশ্যও চোখে পড়ে না।

গ্রাম্য কেচ্ছা : রূপকথা অবলম্বনে দিরাই উপজেলায় অসংখ্য গ্রাম্য কেচ্ছা প্রচলিত আছে। এধরণের কেচ্ছা গ্রামের পরিবেশে অবসর বিনোদনের অন্যতম একটি অধ্যায়। রাতের বেলা বাড়ির সবাই একত্রিত হয়ে কিংবা কাঁথার নীচে শুয়ে শুয়ে অনেক ধরনের কেচ্ছা বলেন। এসব কেচ্ছা বিশেষ করে ছোট শিশুদের আনন্দ দেওয়া কিংবা বিয়ের আচার অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে অতিথিদের সময় কাটানো অথবা রসিকতার জন্য বলা হয়। এছাড়াও রামায়নের কাহিনী অবলম্বনে কিছু কেচ্ছা প্রচলিত আছে। গ্রামের অশিক্ষিত নারী পুরুষগণ যুগযুগ ধরে এসব কেচ্ছা মুখে মুখে ধরে রেখেছেন। এই কেচ্ছাগুলো কবে কে রচনা করেছিলেন সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারেন না। দিরাই উপজেলার গ্রামাঞ্চলে অগনিত গ্রাম্য কেচ্ছা পাওয়া যায়। তন্মধ্যে কিছু কেচ্ছা অত্যান্ত দীর্ঘ। এগুলো একেকটি কেচ্ছায় পুরো রাত শেষ হয়ে যায়। এই কেচ্ছাগুলো ধাঁধাঁ দিয়ে শুরু হয়। যেমন-
মামায় আনছইন মামী, তাঁন থাইক্কা জন্মিছি আমি
বিধির বিপাক, মামার বৌ আমার বাপ।

কেচ্ছাপালা : দিরাই উপজেলায় বিনোদনের ক্ষেত্রে কেচ্ছাপালার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ছিল। কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গ্রামে গ্রামে আসর জমিয়ে আয়োজন করা হত কেচ্ছাপালা। কেচ্ছাপালার জন্য প্রয়োজন হয় একজন বয়াতী এবং ৩/৪ জন বাদক। কেচ্ছাপালা গাইতে সময় লাগে ৪/৫ ঘন্টা। আলমাস কুমার-গুলবাহার, ইউনুস বাদশা-লাল পড়ি, জাহাঙ্গীর বাদশা-আলপিনা পরী, রামচাঁন বাদশা-শ্রীরাম বাদশা, চেরাগ রৌশন-মতিলাল বাদশা ইত্যাদি কেচ্ছাপালা একসময় দিরাই উপজেলায় খুব জনপ্রিয় ছিল। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ফয়েজ উদ্দিন, মজনু পাশা, তাহিরপুরের সুরুজ আলী, জগদলের কমল মিয়া প্রমুখ কেচ্ছাশিল্পীগণ দিরাই উপজেলায় জনপ্রিয় ছিলেন। বাউল সফিকুন্নুরের কন্ঠে অডিও ক্যাসেট বিনোদের কেচ্ছাপালাটিও বেশ জনপ্রিয় ছিল। বর্তমানে কেচ্ছাশিল্পী পাওয়া না গেলেও দিরাই উপজেলার একমাত্র কেচ্ছাশিল্পী জকিনগর গ্রামের তারা খান এই সংস্কৃতিটি ধরে রেখেছেন।

ঘাটু গান : লোকসাহিত্যের অন্যতম একটি অধ্যায় ঘাটুগান। এই গান এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। বর্ষাকালে দুটো বড় নৌকা একত্রিত করে মধ্যখানে আসর বসিয়ে গ্রামের ঘাটে ঘাটে গিয়ে বিশেষ এক ধরনের দলগত গান পরিবেশিত হত। ঘাটুগানের জন্য অল্প বয়সী কিশোরদের ব্যবহার করা হত। এই গানের প্রধান চরিত্রটি লম্বা চুল রেখে মেয়ে সেজে আসরে গানের সাথে বিশেষ অঙ্গভঙ্গি দ্বারা গানের অর্থ প্রকাশ করত নৃত্যের ছন্দে ছন্দে। দিরাই উপজেলায় জনপ্রিয় এই ঘাটু গান বর্তমানে বিলুপ্ত।

হোলি গান বা উরি গান : দিরাই উপজেলা হোলি গান বা উরি গান ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই গান মূলত হিন্দুধর্মীয় দোলযাত্রা কেন্দ্র করে গাওয়া হত। বসন্তকালে ঐ পর্বের দিনটি কেন্দ্র করেই প্রায় সকল হিন্দু প্রধান গ্রামে উরি গানের দল গড়ে উঠত। দোলযাত্রা আজো হিন্দু সমাজের একটি মূখ্য পর্ব হিসেবে বিদ্যমান থাকার কারনে উরি গান টিকে আছে। কিন্তু আগের মতো ব্যাপকতা নেই।

মালজোড়া গান : মালজোড়া গান দিরাই উপজেলা একেবারেই দেখা যায় না। এই গান ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। গ্রামে গ্রামে আয়োজন করা হত মালজোড়া গান। কালের কিংবদন্তি মালজোড়া গানের আসরে শিল্পী কুশলীবৃন্দ পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে বসতেন। এক পক্ষের গায়ক তার গানের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের প্রতি ছুঁড়ে দিতেন হাড়-মাংস গুড়ো করা প্রশ্ন। প্রতিপক্ষের বিজ্ঞ গায়ক তার মধুর সুরে অকাট্য যুক্তি প্রমাণ সহকারে সে প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতেন এবং পাল্টা আরেকটি প্রশ্ন করতেন। যেমন-
প্রশ্ন- মানব দেহ আল্লাহ তালা কয় চিজে বানায়
তাহার বিবরণসহ বলেবেন সভায়।
সকল শ্রোতারা বসে আছেন উত্তরের লাগিয়া
দেখি আমার প্রতিপক্ষ কী যান বলিয়া।

উত্তর- বেশ ভালো প্রশ্ন করলেন প্রতিদ্বন্ধী ভাই
শুনেন তবে প্রশ্নের উত্তর আসরে জানাই।
চার চিজে মাবুদ আল্লা আদম বানাইয়া
আগুন পানি মাটি হাওয়া দিলেন মিশাইয়া।

এভাবেই রাত ব্যাপী চলত মালজোড়া গান। প্রতি বছর দিরাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে আয়োজন করা হত মালজোড়া গানের অসংখ্য আসর। এসব আসরে আমন্ত্রণ করে আনা হত বিশেষকরে ময়মনসিংহ অঞ্চলের রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, আব্দুল মজিদ তালুকদার, আব্দুস সাত্তার, চাঁন মিয়া, ছাতকের দূর্বিন শাহ প্রমুখ সাধকদের। তাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে গাইতেন ভাটিপাড়ার কামাল উদ্দিন (কামালপাশা) এবং শাহ আবদুল করিম। এই সাধকগণ মালজোড়া গান গেয়ে মাতিয়ে রাখতেন দিরাই উপজেলা সহ বৃহত্তর হারাঞ্চল। কালের পরিবর্তনে জনপ্রিয় এই মালজোড়া গান আজ বিলুপ্তপ্রায়।

গাজীর গান : গ্রাম-গঞ্জে, পথে-ঘাটে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে আলোচনার ঝড় ছিল গাজীর গান। গাজীর গানের কথা উল্লেখ করে বাউল স¤্রাট শাহ আবদুল করিম লিখেছেন- “বর্ষা যখন হইত গাজীর গান আইত/ রঙ্গে-ঢঙ্গে গাইত আনন্দ পাইতাম” শাহ আবদুল করিম বর্ণিত আনন্দ মুখর গাজীর গান আজ বিলুপ্ত। এসব গানের জন্য দিরাই উপজেলা এক সময় বিখ্যাত ছিল। কিন্তু সঠিক পৃষ্টপোষকতার অভাবে গাজীর গান দিরাই উপজেলায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

লোকসংগীত : লোকসংস্কৃতির অন্যতম ও প্রসিদ্ধ একটি শাখা লোকসংগীত। এই লোকসংগীতে দিরাই উপজেলা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রেখেছে। দিরাই উপজেলায় যুগযুগ ধরে জন্ম নিয়েছেন শতশত লোককবি। তাঁরা রচনা করেছেন জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, মুর্শিদী, মারফতি, ধামাইল, বিয়ের গান, বিচ্ছেদ সহ অনেক ধরণের গান। এখানকার লোককবিদের রচিত গান হাওরাঞ্চলের গ্রামগঞ্জে মানুষের মন জয় করেছে। লোকসংগীতের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে এই দিরাই জনপদের নাম বিশ^দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন- একুশে পদক প্রাপ্ত বাউল স¤্রাট শাহ আবদুল করিম। তাঁর রচিত অসংখ্যা গান জনপ্রিয়তা লাভের মাধ্যমে দেশ ছাড়িয়ে বর্হিবিশে^ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দিরাই উপজেলার আরেক কৃতিসন্তান সংগীতে ওস্তাদ পন্ডিত রামকানাই দাশ শিল্পকলায় একুশে পদক লাভ করে দিরাই উপজেলার লোকসংগীতের ইতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন। দিরাই উপজেলার বাউল কামাল উদ্দিন (কামালপাশা) মালজোড়া এবং তত্ত্ব গানের জন্য বৃহত্তর হাওরাঞ্চলে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও এই উপজেলার আব্দুর রাজ্জাক কালা শাহ, কাওসার আহমদ ছেগেন শাহ প্রমুখ গান রচনার মাধ্যমে আমাদের লোকসংগীতের ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ করেছেন। কামাল, করিম পরবর্তী সময়ে দিরাই উপজেলার বাউল সফিকুন্নুর, রুহি ঠাকুর লোকসংগীত শিল্পীগণ বৃহত্তর সিলেটে জনপ্রিয়তার উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছিলেন। বর্তমানে বাউল সিরাজ উদ্দিন, বাউল রণেশ ঠাকুর প্রমুখ শিল্পীগণ বৃহত্তর সিলেটে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান দখল করেছেন। সমকালীন সময়ে দিরাই উপজেলা থেকে দেড় শতাধিক লোকগীতিকার লোকসংগীত রচনা করছেন। তাঁদের মধ্যে শাহ নূরজালালের গান দেশ বিদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এছাড়াও ভাবুক মাজু মিয়ার গান স্থানীয় ভাবে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।


৫.
লোকজ মেলা : লোকসংস্কৃতির অন্যতম অধ্যায় হচ্ছে মেলা। দিরাই উপজেলায় একসময় প্রচুর মেলা হত। কিন্তু বর্তমানে মেলা তার পূর্বের ঐতিহ্য হারিয়েছে। দিরাই উপজেলায় বর্তমানে যে কয়েকটি মেলা হয় তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ধল মেলা। ধল গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালনী নদীর দক্ষিণ তীরে আছে পরমেশ্বরী দেবীর আখড়া। এই আখড়া কবে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা কেউ বলতে পারে না। এই পরমেশ্বরী দেবীর আখড়ায় বাৎসরিক উৎসব হয়। সেখানে পূজারীদের পদচারণায় মুখরিত হয়। সুমেশ্বরী আখড়া প্রাঙ্গনে হিন্দু ধর্মীয় অনুভূতির সাথে যে মেলা বসে সেই মেলাটিই ধল মেলা নামে পরিচিত। প্রতি বৎসর পহেলা ফাল্গুন এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ধল মেলা একটানা তিন দিন চলে। মেলায় হিন্দু মুসলমান সকল ধর্মের লোকজনের পদচারণায় মুখরিত থাকে। সুমেশ্বরী আখড়ার মতো ধল মেলার উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। বর্তমানে অপসংস্কৃতির কালো থাবায় ঐতিহাসিক ধল মেলা তাঁর ঐতিহ্য হারিয়েছে। ধল মেলা ছাড়াও দিরাই উপজেলায় প্রতি বৎসর বেশ কিছু মেলা হয়। যেমন- সিংহনাথের মেলা, শ্যামারচরের মেলা, মেঘনার মেলা, ভরারগাঁওয়ের মেলা, বারঘরের মেলা, দিরাইর মেলা, মকসদপুরের মেলা, মাতারগাঁওয়ের মেলা, বাংলা বাজারের মেলা, স্বজনপুরের মেলা, সরমঙ্গলের মেলা, কল্যানীর মেলা, জকিনগরের মেলা, সাকিতপুরের মেলা, মাতারগাঁও’র মেলা।

লৌকিক খেলা : দিরাই উপজেলায় অনেক ধরনের লৌকিক খেলা আছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লৌকিক খেলা হচ্ছে নৌকা বাইচ, লাঠি, কুস্তি, ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, লাই, কাবাডি বা হাডুডু, দারিয়াবান্দা বা রেডি, গোল্লাছুট, গাছ গোল্লা, ইচিংবিচিং, কানামাছি, লুকোচুরি, ষোলঘুঁটি, বাঘবেড়, সাতচাড়া, পেক বা কাদামাটি, ঘুড়ি উড়ানো, দশ পঁচিশ, ওপেন টু বায়োস্কোপ, লুডু, পাশা, কুৎকুৎ, মোড়গ লড়াই, দড়িলাফ ইত্যাদি। আলোচ্য খেলার অধিকাংই বর্তমানে বিলুপ্ত। এস্থানে কয়েকটি বিলুপ্ত খেলা নিয়ে আলোচনা করা হলো-

ষাঁড়ের লড়াই : বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি ষাঁড়ের লড়াই। এই ষাঁড়ের লড়াইয়ের জন্য একসময় দিরাই উপজেলা উল্লেখযোগ্য ছিল। কোথাও ষাঁড়ের লড়াই আয়োজন হলে আশপাশের গ্রামে ঢোল পিটিয়ে জানানো হত। নির্ধারিত তারিখে মাঠ সাজিয়ে আয়োজন করা হত ষাঁড়ের লড়াই। ষাঁড়ের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতকৃত মাঠকে বলা হত থলা। সৌখিনরা ষাঁড় নিয়ে থলায় হাজির হতেন লড়াইয়ে অংশগ্রহণের জন্য। ষাঁড়ের লড়াইয়ে বিজয়ের মালা পাওয়ার আশায় টুটকা কবিরাজি তাবিজ কবচ কিংবা পানি পড়া ঝাঁড়ফুঁক সংগ্রহ করা হত। ষাঁড়ের লড়াই আয়োজন হলে চারিদিকে সাজসাজ রব পরে যেত। ষাঁড়ের লড়াই ছিল আত্মসম্মানের বিষয়। তাই সৌখিনদের প্রত্যেকেই সাধ্য অনুযায়ী বড় এবং শক্তিশালি ষাঁড় নিয়ে প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করতেন। লড়াইয়ের জন্য নির্বাচিত ষাঁড়কে বিভিন্ন ভাবে সাজিয়ে নিয়ে আসা হত মাঠে। লড়াই দেখার জন্য মানুষের ঢল নামত খেলার মাঠে। অনেকটা উৎসবের মতো জমে উঠত ষাঁড়ের লড়াই। বর্তমানে ষাঁড়ের লড়াই বিলুপ্ত হলেও লড়াইয়ে বিজয়ী ষাঁড় নিয়ে বাড়ি ফেরার উল্লাসমুখর শ্লোগান আজো মানুষের মুখে মুখে পাওয়া যায়-
শারফিনের দোয়ায় রে, বিছাল লইয়া আইলাম রে
ডাইন সিং দিয়া ওয়াসে রে, বাউ সিং দিয়া মারে রে...

ঘোড়দৌড় : ঘোড়া দৌড় বা ঘোড়দৌড় পৌষ মাঘ মাষে গ্রামঞ্চলের সৌখিন মুরব্বীগণ মিলেমিশে আয়োজন করতেন ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগীতা। বিভিন্ন গ্রামের সৌখিনদের আমন্ত্রণ করা হত ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণের জন্য। ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগীতা কেন্দ্র করে আশপাশের লোকজন সমবেত হতেন। বাড়ি বাড়ি অতিথিদের পদচারণায় মুখরিত হত। গ্রামে গ্রামে বিরাজ করত ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ। ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগীতা বর্তমানে দিরাই উপজেলার কোথাও দেখা যায় না।

নৌকা বাইচ : দিরাই উপজেলায় বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতির অন্যতম একটি হচ্ছে নৌকা বাইচ। ভাটি অঞ্চলে নৌকা বাচই ছিল উল্লেখযোগ্য। নৌকা বাইচের সাথে সারি গান ছিল অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। জানাযায় সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা প্রভৃতি এলাকার প্রভাবাধীন লোকজীবনের সাংস্কৃতিক উৎস থেকেই সারি গানের উৎসারন হয়েছিল। আগের দিনে ধনী ও সৌখিন লোকগণ চল্লিশ পঞ্চাশ হাত লম্বা নৌকা তৈরী করতেন নৌকা বাইচের জন্য। এটাকে বলা হত খেলুয়া বা বাইচের নাও। রং বে-রঙে সাজানো হত দৌড়ের নাও বা খেলুয়া নাও। নানা রঙের ‘বাইচের নৌকা’ সাজানো হত ‘মন পবনের নাও’র মতো। সাজ সাজ রব পড়ে যেত ভাটির মূল্লুকে। পাইকগণ রং বে-রঙ্গের বাহারি সাজ পোষাকে সজ্জিত হয়ে খোলা করতালের তালে, হাতে পায়ে ঘুঙ্গুর পড়ে নৃত্যের ছন্দে অপরূপ অঙ্গভঙ্গি সহযোগে সারি গানের, আওয়াজ তুলতো। নৌকা বাইচের পাইকগণ সারি বেঁধে আগাপিছা বসে সমান তালে বৈঠা মারার সাথে সাথে কন্ঠে আওয়াজ তুলতেন ঐক্যতানে। নৌকা বাচই সম্পর্কে বাউল স¤্রাট শাহ আবদুল করিম লিখেছেন- “বর্ষা গত হয়ে যখন আসতো শরৎকাল।/তখন আরম্ভ হইত নৌকা বাইচের তাল।।/ নৌকা বাইচে সারি গান ভাদ্র আশ্বিন মাসে।/ প্রাণ খোলে গাইত সবে আনন্দ উল্লাসে।।/ রাজহংস ময়ুর পংখী বিভিন্ন নামে।/ দৌড়ের নৌকা ছিল তখন প্রতি গ্রামে গ্রামে।।/ নৌকা নিয়া লোকজন বাইচের থলায় যাইত।/ শীল্ড-কাপ, পাটা-খাসি উপহার পাইত।।/ নৌকাতে পাইক সাজিত গ্রামের নৌজোয়ান।/ মনানন্দে মিলে মিশে হিন্দু মুসলমান।।/ ঢোল করতাল নৌকায় নিয়া তালে বৈঠা বাইত।/ নৌকা বাইচ, সারিগান সবাই ভালা পাইত।।

লাঠি খেলা : দিরাই উপজেলার বিলুপ্ত সংস্কৃতি লাঠি খেলা। গ্রামগঞ্চে একসময় লাঠি খেলার খুব বেশি প্রচলন ছিল। গ্রামের লোকজন ঐক্যবদ্ধ ভাবে খেলার আয়োজন করতেন। খেলার দিন গ্রামাঞ্চলের মানুষ কেউই ঘরে বসে থাকতেন না। দূরদূরান্তর থেকে ছুটে আসতেন খেলা দেখার জন্য। লাঠি খেলায় পক্ষ বিপক্ষ দুইজন খেলোয়ার অংশগ্রহণ করতেন। মৌসুমি লাঠি খেলা ছাড়াও বিয়ের অনুষ্ঠানে লাঠি খেলার আয়োজন করা হত। প্রায় ষাট বর্গফুট বৃত্তাকারের জায়গায় দাগের বাইরে দাড়িয়ে থাকত দর্শক। পোষাক পরিহিত খেলোয়াড়ের কোমরে গামছা মাথায় লাল কাপড় বেঁধে হাতে লাঠি নিয়ে শারীরিক কসরত প্রদর্শন করতেন। মাঠে বাজতো ঢোল, করতাল, ঘুংঘুর ইত্যাদি। এক পর্যায়ে উভয় খেলোয়াড়ের মধ্যে শুরু হত লাঠি খেলা। খেলোয়ার তাঁর হাতের লাঠি দ্বারা প্রতিপক্ষকে আঘাত করলে প্রতিপক্ষ সেই আঘাত ফিরিয়ে কৌশলগত ভাবে পাল্টা আক্রমণ করতেন। কৌশলগত আঘাতের মধ্যে যার হাত থেকে লাঠি পড়ে যাবে বা ছিটকে পড়বে তিনি হেরে গেলেন। খেলা শেষে বিজয়ি খেলোয়াড়কে নিয়ে চলতো আনন্দ উল্লাস। দিরাই উপজেলায় বর্তমানে লাঠি খেলা বিলুপ্ত। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন র‌্যালী অথবা নদী পথে বিয়ের নৌকায় অপেশাদার লাঠিয়ালকে শারিরীক কসরত প্রদর্শন করতে দেখা গেলেও দিরাই উপজেলায় বর্তমানে কৌশলগত লাঠি খেলোয়ার নেই।

মার্বেল খেলা : গ্রামগঞ্জে তরুণদের জনপ্রিয় খেলা ছিল মার্বেল। মার্বেল খেলার জন্য বিস্তীর্ণ মাঠের প্রয়োজন হত না। সমতল ভূমি বা গ্রামে পায়ে চলার পথে দু’তিন জন একত্রিত হয়ে মার্বেল খেলতেন। মার্বেল খেলার বেশ কয়েকটি নিয়ম ছিল। এই খেলা এতই জনপ্রিয় ছিল যে, মার্বেল খেলার নিশায় কিশোর ছেলেরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে দিনভর মার্বেল খেলতেন। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে মার্বেল খেলা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

গাছ গোল্লা : গাছ গোল্লা স্থান বিশেষ গাউচ্চা খেলা অথবা ডান্ডী নামে পরিচিত। এই খেলা খেলত গ্রামের রাখাল ছেলেরা। একসময় বিস্তীর্ণ হাওরের কাঁন্দিতে ছিল অগনিত হিজল আর করচ গাছ, কান্দির চার পাশে ছিল বিন্না ছন। বিস্তীর্ণ হাওরে গ্রামের রাখালরা গরুকে ঘাস খাওয়ানোর ফাঁকে দলবেঁধে গাছ গোল্লা খেলত। সবাই মিলে উঠত গাছের ডালে আর একজন থাকত গাছের নীচে, গাছ থেকে একটু দুরে বিন্নার ছুবায় বা কর্তনকৃত বিন্না ছনের অবশিষ্ট অংশের পাশে। এরপর গাছের নীচে থাকা ছেলেটি সবাইকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করত আর গাছের ডালে থাকা রাখাল ছেলেরা উত্তর দিত- প্রশ্ন : গাউচ্চারে গাউচ্চা গাছে কেরে ? উত্তর : বাঘের ডরে, প্রশ্ন : বাঘ কই ? উত্তর : মাটির তলে, প্রশ্ন : মাটি কই ? উত্তর : অইনু এরে, প্রশ্ন : গাউচ্চা রে গাউচ্চা তরা কয় ভাই ? উত্তর : সাত ভাই, প্রশ্ন : এক ভাই দিবে ? উত্তর : ছইতা পারলে নিবে। এই কথা বলে রাখাল ছেলেরা সবাই গাছ থেকে নেমে বিন্নার ছুবা ছুঁয়ার জন্য ছুটে যেত, তাঁদের বাধা দিত নীচে থাকা ছেলেটি। তাকে ফাঁকি দিয়ে বিন্নার ছুবা স্পর্শ করতে পারলেই এক গুল্লা, আর যদি তাঁদের কোন একজনকে প্রতিপক্ষ ছেলে স্পর্শ করে তবে পরবর্তী খেলায় ঐ ছেলেটি গাছের নীচে থাকবে। বর্তমানে দিরাই উপজেলার হাওর এলাকায় বিন্না ছন, হিজল এবং করচ গাছ প্রায় নেই। গ্রামের রাখাল ছেলেদের ও এই খেলা খেলতে দেখা যায় না।

লাটিম খেলা : দিরাই উপজেলায় লাটিম খেলাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় লাডুম খেলা। গ্রামাঞ্চলে এই খেলাটি শিশুদের অত্যান্ত প্রিয়। কাট কেটে চমৎকার লাটিম তৈরি করা হত। লাঠিমের গায়ে শক্ত সুতা প্যাঁচিয়ে ধম করে ছেড়ে দিলে লাটিম ঘুরতে থাকে মাটিতে। ঝিম ধরে আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ার পর তুলে আবার একই কায়দায় ফেলা। দল বেঁধে খেলার সময় ঘুর্ণয়মান লাটিমের ওপর আরেকজনের লাটিম ছুড়ে ঘা মারা হত। এটি ছিল তরুণ ছেলেদের খেলা। বর্তমানেও গ্রাম গ্রামে লাটিম খেলার প্রচলন আছে।

৬.
লোকজ হস্তশিল্প : দিরাই উপজেলায় অনেক ধরণের হস্তশিল্প তৈরী হত। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শীতলপাটি। গ্রামের অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর একসময়ের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম একটি উৎস ছিল এই শীতল পাটি। দিরাই উপজেলায় গ্রামে গঞ্জে রাস্তার পাশে, বাড়ির সীমানা, পতিত জমি ইত্যাদিতে একসময় প্রচুর পরিমান মূর্তা নামে এক ধরনের উদ্ভিদ পাওয়া যেত। কেউ কেউ মূর্তা চাষ করতেন। শীতল পাটি তৈরি করার জন্য মূর্তা থেকে বেত বা ছাল বিশেষ কায়দায় ছাড়িয়ে নিয়ে রোদে শুকানো হত। মুর্তার এই ছাল যত মসৃণ এবং চিকন হত শীতল পাটি তত উৎকৃষ্ট এবং আরমদায়ক হত। পাটি বুননের আগে প্রয়োজনমতো নানান রঙে বেত রঙিন করে নিতেন পাটিতে ফুল পাখি গ্রামের দৃশ্য প্রভৃতি আঁকার জন্য। দিরাই উপজেলার গ্রামগঞ্চে ছিল নিপুণ পাটিশিল্পী। মূর্তা থেকে বেত তৈরী করে গ্রামের মহিলা পাটি শিল্পীগণ নিপুন হাতে অনুপম কারুকাজের তৈরী করতেন শীতল পাটি। কিন্তু বর্তমানে গ্রাম গঞ্জে আগের মতো মূর্তা পাওয়া যায়না তাই এই শিল্পটি হারিয়ে যাচ্ছে।

পাটের শিকা : পাটের শিকার আঞ্চলিক নাম ছিক্কাই। ছিক্কাই তৈরী করা হয় পাট থেকে। পাটের ছিক্কাই রূপশৈলী চারুশিল্পের জগতে একটি বিশেষ পদ্ধতি। যা গ্রামীন মহিলাদের সৃষ্টিশীলতা ও উঁচু শিল্পনৈপূণ্যের পরিচায়ক একটি লোকশিল্প। ছিক্কাই’র গিরো বা গিট বিভিন্ন ধরন ও বৈচিত্রের। এটি দেখতে খুব সুন্দর, হাতের মুঠোয় রাখা যায়। ছিক্কাই বর্তমানে শহরের অভিজাত দোকানে লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও অভিজাত বাড়ির বারান্দায় ছিক্কাই ঝুলিয়ে ফুলের টব রাখা হয়। এই ছিক্কাই একসময় গ্রামের বাড়িতে রান্না ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হত হাড়ি-পাতিল ইত্যাদি রাখার জন্য। একেকটি ছিক্কাইতে চার পাঁচটি হাড়ি রাখা যায়। তাই এর ব্যবহার ছিল গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি ঘরে। বর্তমানে এই নিপুণ চারুশিল্পের ব্যবহার বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে।

নকশিকাঁথা : কাঁথার আঞ্চলিক নাম খেতা। যে খেতা বা কাঁথায় নকশি আঁকা হয় সেই খেতা বা কাঁথার নাম নকশিকাঁথা। নকশিকাঁথা সূচিকর্মের একটি অঙ্গ। সেলাই কাজে শিল্পবোধ ও নৈপুণ্য যুক্ত হলে পৃথক রুচি ও সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। দিরাই উপজেলায় একসময় হরেক রকম কাঁথার প্রচলন ছিল। এই কাঁথা সেলাই করে অনেকে সংসারের আয় করতেন। তাই গ্রামের গৃহিনী মেয়েরা পুরাতন শাড়ির পাড় থেকে রঙিন সুতা ছাড়িয়ে নিয়ে তৈরী করতেন কাঁথা। তবে নকশিকাঁথায় ফুল, নদী, লতাপাতা, পশুপাখি ইত্যাদির চিত্র আঁকতেন নিপুণ হাতে। কেউ কেউ ফুলের সঙ্গে দু’চার পংক্তির পদ্য ছন্দ ইত্যাদি রঙিন সুতায় বুনতেন। গ্রামাঞ্চলে কারো বাড়িতে নতুন মেহমান এলে বিছানার ওপর বিছিয়ে দেয়া হত নানান রকম কারুকাজে আঁকা সবচেয়ে সুন্দর কাঁথাটি। এতে রুচিবোধের পরিচয় ও ফুঁটে উঠত। বর্তমানে দিরাই উপজেলায় এই নকশিকাঁথার ব্যবহার কমে গেছে।

৮.
প্রবাদ-বচন : লোকসংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হচ্ছে প্রবাদ-বচন। দিরাই উপজেলায় হরেকরকম প্রবাদ-বচন পাওয়া যায়। যেমন- ১.আগের আল যেমদি যায় পিছের আল হেমদি যায়। ২. আগে মাতে যে দুয়ার গুছায় হে। ৩. আগে খেশ পরে দরবেশ। ৪. আসমানো চাঁন উঠলে লুকাইয়া রাখা যায় না। ৫. আসে উনা, মোরগে দুনা, ছাই¹ে পিন্দায় কানের সোনা। ৬. ইল্লত যায় না ধইলে, খাছলত যায় না মইলে। ৭. ইচ্ছা থাকলে উপায় অয়। ৮. ইন্দুর মুখো দাড়ি, গাং পড়ের বাড়ি, বিদেশি ভাই, এই তিনের বিশ্বাস নাই। ৯. উজির তলে গুজি, কাঁঠলের তলে মুজি। ১০. এখজাতো তিন জাত তারে কয় কমিন আর কমজাত। ১১. কতা মাঞ্জাইলে মোটা অয়, সুতা মাঞ্জাইলে চিকন অয়। ১২. কপাল নারে করাতের গুড়া, হাই ধরলামতে আধা বুড়া। ১৩. নাইয়ার এক নাও, নি নাইয়ার শতেক নাও। ১৪. নিজে বাঁচলে বাপের নাম। ১৫. পুরুষ নষ্ট হাটে নারী নষ্ট ঘাটে, জোয়ান পোলা নষ্ট হয় পড়শি বাড়ির খাটে। ১৬. ভালা মাইনষ্যে মাইর খায় ধুলা ঝাইরা বাড়িত যায়, কমিন কমজাতে মাইর খায় পথে পথে গাইয়া যায়। ১৭. হখল আগে রান্দে বেইট্টে জামাইর আগে খায় আল্লার আতও গেলে বেডির জিবরা কাটা যায়। ১৮. বাপ ভালা তার বেটা ভালা মা ভালা তার ঝি, গাই ভালা তার বাছুর ভালা দুধ ভালা তার ঘি। ১৯. হালে ভালা দামা, কুটুম ভালা মামা। ২০. তেলে পানিয়ে পুয়া, মেঘে পানিয়ে রুয়া।

কথার-কথা : ১. আক্কলরে ইশারা বেআক্কলরে ধাক্কা (বুদ্ধিমান লোক অল্পতেই বুঝে, বোকা লোকে বুঝে না)। ২. খাজুইরা আলাপ (বাহুল্য প্যাঁচাল)। ৩. বাঘের উপরে টাগ আছে (প্রভাবশালীর উপরে প্রভাবশালীর উপস্থিতি)। ৪. হাতারঅ পানি তিরাশ (একই জিনিসের ছড়াছড়ি কিন্তু কাঙ্খিত জিনিসটি নেই)।

ছিলক বা লোক ধাঁধাঁ : ১. টানলে বাট্টি অয়- বিড়ি। ২. ফালাইলে ধলা গাই তুলবার ইচ্ছা নাই- থুথু। ৩. লাগ লাগ কইলে লাগে না লেম্বু আর টেম্বু কইলে লাগি যায়- ঠোঁট। ৪. কাটলে বাট্টি অয়- পুকুর। ৫. এক জনে লড়েছড়ে, দুই জনে চেপ্টা করে- চিড়াকুটা। ৬. জলো থাকে জল কুমারি জলো বাস করে হাড্ডি ও নাই গুড্ডি ও নাই তার এতো গুসা- জোঁক। ৭. কান্দার উপরে কান্দা লাল কাপর দি বান্দা- কলার থুর। ৮. ভাতো থাকে পাতো মুতে- লেবু। ৯. কালিদাস পন্ডিতে বলে ছোট কালের কতা এক কুড়ি তেতই গাছে কতটা পাতা- চল্লিশটা। ১০. তিন অক্ষরে নাম তার জলে বাস করে, মাঝের অক্ষর বাদ দিলে আকাশেতে উড়ে- চিতল এবং চিল।

লোকছড়া : ১. শীত করে গো বুড়া মাই, খেতার তলে জাগা নাই/ খেতা নিছে হিয়ালে, আইন্না দিব বিয়ালে। ২. নানী গো নানী তোমার চাঙ্গে কিতায় লড়ে/ মাতিছ না লো ফতিন বিলাইয়ে উন্দুর ধরে/ ঘরের জিনিস কাইট্টা কুইট্টা, কি জাত বিনাশ করে। ৩. মাদাইন্যা রইদও খেতা উরে তারে কয় জ্বর/ ঘরের কথা বাইরে কয় তারে কয় পর/ পরে আফনে বুঝে যে তারে কয় সাউদ/ দুই হাতে খাউজ্জায় তারে কয় দাউদ। ৪. নরম নরম তিন নরম বড় মাছের পেটি/ তার চেয়ে অধিক নরম ভালা মাইনষের বেটি/ তার চেয়ে অধিক নরম মানুষের মন/ ভাংলে জোড়া লয় না থাকতে জীবন। ৫. দাঁত পরা গেলো বাজারো, বইছে গাছের গুড়িত/ পাতি কাউয়ায় বিইট্যা দিছে, ভাঙ্গা দাতের গুড়িত। ৬. দা’র মিঠা বালু, কুঁড়ালের মিঠা হিল/ বালা মাইনষ্যের জবান মিঠা, রঘুর মিঠা কিল। ৭. গাঙ্গে দিয়া বাইষ্যা যায় এক ছড়ি কলা/ হউরি বউয়ে কাইজ্যা করে কার কতও গলা। ৮. কার হগদা খাছলো বান্দি ঠাকুর চিনস না। ৯. কই থাকি আইছে উমাইন্না বেটা, হে পায় মাউগের বাটা, আমি যে চাচার ঘরের ভাই, আমার লাগি মাউগ নাই।

৯.
সার্বিক আলোচনায় লক্ষ্য করা যায় দিরাই উপজেলার লোকমানস ও সংস্কৃতি বৃহত্তর হারাঞ্চলের লোকমানস ও সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু দিরাই উপজেলা কেন্দ্রীক পৃথকভাবে এগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। আলোচ্য বিষয়ের বাইরে লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদান দিরাই উপজেলার গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা আলোচনা করতে গেলে একটি বৃহৎ বই রচনা করা সম্ভব। এ নিয়ে বৃহদাকারে কাজ করার জন্য সচেতন মহল এগিয়ে আসবেন এমনটাই আশা করি।

লেখক : ফারুকুর রহমান চৌধুরী, গীতিকার, লেখক ও সংগ্রাহক। দিরাই, সুনামগঞ্জ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×