ফারুকুর রহমান চৌধুরী : ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ । এই জেলায় ১১টি উপজেলার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপজেলা দিরাই । ৪২০.৯৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট দিরাই উপজেলায় ৯টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা, ৮১টি য়ার্ড, ৯টি মহল্লা, ২২৪ টি গ্রাম আছে । খাল বিল নদী ও হাওর বহুল দিরাই উপজেলার সাধারণ মানুষের জীবিকা নির্বাহের উৎস এক ফসলি বোরো ধান এবং মাছ । সংগ কারণে এই উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রায় ২,৪৩,৬৯০ জন মানুষ বসবাস করলেও গড় হিসেবে দিরাই উপজেলার মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে । এই উপজেলার মানুষের মনে রয়েছে অপরিসীম দেশপ্রেম । ফলে জাতীয় আন্দোলনের প্রায় সবকটিতেই দিরাই উপজেলার মানুষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে । বিশেষ করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই উজেলা শত শত মানুষ মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল । ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিরাই উপজেলা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ । যার কারণে এই উপজেলা সীমায় অনেকগুলো যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে । সাধারণ মানুষের হয়েছে ব্যাপক ক্ষক্ষতি । এমন গুরুত্বপূর্ণ জনপদে মুক্তিযোদ্ধা ও বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে দীর্ঘদিন পর দিরাই উপজেলা সদরে নির্মিত হয়েছে একটি দর্শনীয় স্মৃতিসৌধ। যা, দিরাই স্মৃতিসৌধ নামে পরিচিত । এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মূখ্য ভূমিকায় ছিল স্বাধীনতা পক্ষীয় দিরাইবাসী। স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ, মূল নকশা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ভূমিকায় ছিলেন দিরাই উপজেলার নন্দিত উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব মোঃ শহীদুল আলম। দর্শনীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি ছিলেন লেকঃ লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট এর স্থপতি জনাব রাজন দাস। নির্মাণ প্রকৌশল সহায়তায় ছিলেন জনাব আব্দুল মতিন উপ-সহকারী প্রকৌশলী এলজিইডি, দিরাই। স্মৃতিসৌধের মূল নকশা পরিকল্পনাকারি জনাব মোঃ শহীদুল আলম দিরাই স্মৃতিসৌধের বিভিন্ন স্থম্ভের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে লিখা আছে-
“স্মৃতিসৌধের বেদী যেন শাস্বত প্রিয় মাতৃভূমি বাংলার আদি জমিন। মূল স্তম্ভের দু’দিকে মাথা নত করে বিপরীত ভঙ্গীমায় উর্দ্ধমূখী ত্রিভূজে বন্ধীত্ব বরণ করে আছে যেন পরাজিত পাক হানাদর বাহিনী ও তাঁদের এদেশীয় দোসর। আবার উক্ত স্তম্ভ দুটির বিপরীত ভঙ্গীমা আপতঃ ভিন্নমতের প্রকাশ ঘটালেও উর্দ্ধমূখী ত্রিভূজের অগ্রসরতা শৃঙ্খল মুক্তির পশ্নে স্বাধীনতার চেতনা ও কামনায় জাতির ঐক্যমতের বহিঃ প্রকাশ। ত্রিভূজের শীর্ষ জাতির এগিয়ে যাবার হাতছানি ও দৃঢ় প্রত্যয়ের অঙ্গীকার। সেই দৃঢ় প্রত্যয়ে, হার না মানা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে মূল স্তম্ভের অগ্রভাগে উদিত হয়েছে টকটকে লাল সূর্য। লাল সূর্যকে বুকে নিয়ে মূল স্মৃতিস্তম্ভটি বহুকাল গেয়ে যাবে শহীদের বীরগাঁথা আর এ জাতির চির উন্নত মমশির।”
বীর শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধারেখে দিরাই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের লক্ষে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব মোঃ শহীদুল আলম ২০০৬ সালের ৩০ এপ্রিল সকাল ১০.০০ ঘটিকায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সম্মেলন কক্ষে ‘দিরাই স্মৃতিসৌধ নির্মান বিষয়ক’ এক সভা আহ্বান করেন। জনাব মোঃ শহীদুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দলমত নির্বিশেষে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হন। সভার শুরুতে সভার সভাপতি প্রস্থাব করেন- মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাসে দিরাইয়ের দামাল ছেলেদের অবদান উল্লেখ করার মতো। মুক্তিযোদ্ধের সময় এই জনপদ ছিল অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ মুক্তিযোদ্ধের ৩৫ বছর পরও দিরাইতে কোন স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। দিরাইবাসীর এ আত্মত্যাগ এবং বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধারে প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে দিরাইতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে চাই। এতে স্থানীয়দের অগ্রণী ভূমিকা ও সহযোগীতা প্রয়োজন। উপস্তি সবাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব মোঃ শহীদুল আলমের প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে মত প্রদান করেন। মতামতের ভিত্তিতে সভায় ‘জেনারেল কমিটি’ এবং ‘ওয়ার্কিং কমিটি’ নামে দুটি কমিট গঠন করা হয়। জেনারেল কমিটিতে ছিলেন :
উপদেষ্টা- ১) জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মাননীয় সংসদ সদস্য, ২) জনাব নাসির উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য। সভাপতি- জনাব মোঃ শহীদুল আলম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, দিরাই, সুনামগঞ্জ, সদস্য- ১) জনাব হাজী আহমদ মিয়া- চেয়ারম্যান, দিরাই পৌরসভা, ২) সভাপতি/সম্পাদক, সকল রাজনৈতিক দল, ৩) অফিসার (সকল), দিরাই, ৪) অধ্যক্ষ (সকল) দিরাই, ৫) ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান (সকল) দিরাই, ৬) কমান্ডার, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, দিরাই, ৭) ওয়ার্ড কমিশনার (সকল), দিরাই পৌরসভা, ৮) প্রধান শিক্ষক (সকল) উচ্চ বিদ্যালয়, দিরাই, ৯) প্রধান শিক্ষক (সকল) প্রাথমিক বিদ্যালয়, দিরাই, ১০) ইউনিয়ন কমান্ডার (সকল) মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, দিরাই, ১১) চেয়ারম্যান, কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি, ১২) সভাপতি/সম্পাদক, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি, দিরাই, ১৩) সভাপতি/সম্পাদক, প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, দিরাই, ১৪) সভাপতি/সম্পাদক (সকল) ব্যবসায়ি সমিতি, দিরাই, ১৫) সভাপতি সম্পাদক (সকল), সাংস্কৃতিক সংগঠন, দিরাই, ১৬) সাংবাদিক (সকল), দিরাই।
ওয়ার্কিং কমিটিতে ছিলেন; সভাপতি- জনাব মোঃ শহীদুল আলম- উপজেলা নির্বাহী অফিসার, দিরাই। সদস্য যথাক্রমে- ১) জনাব হাজী আহমদ মিয়া, চেয়ারম্যান দিরাই পৌরসভা, ২) জনাব আব্দুল কুদ্দুস, সভাপতি, বিএনপি দিরাই উপজেলা শাখা, ২) জনাব আলতাব উদ্দিন, সভাপতি, আওয়ামীলীগ দিরাই উপজেলা শাখা, ৩) সহকারী কমিশনার (ভূমি), দিরাই, ৪) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, দিরাই থানা, ৫) উপজেলা প্রকৌশলী, দিরাই, ৬) উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, দিরাই, ৭) উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, দিরাই, ৮) উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, দিরাই, ৯) জনাব আব্দুল কাইয়ুম, মুক্তিযোদ্ধা কামান্ডার, দিরাই উপজেলা শাখা, ১০) জনাব রশিদ আহমদ বাচ্চু, দিরাই, ১১) জনাব হাজী চান্দ আলী, দিরাই, ১২) জনাব আম্বর আলী, দিরাই, ১৩) জনাব আব্দুর রশিদ, দিরাই, ১৪) সভাপতি প্রেসক্লাব, দিরাই, ১৫) উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, দিরাই।
কমিটি গঠন শেষে স্মৃতিসৌধ নির্মণের জন্য তহবিল গঠনের জন্য তাৎক্ষণিক ভাবে সেচ্ছায় চাঁদা প্রদান করেন- ১) জনাব আব্দুল কাইয়ুম, ২) জনাব হাজী চান্দ আলী, ৩) জনাব হাজী আম্বর আলী, ৪) জনাব মতিউর রহমান, ৫) জনাব আব্দুর রশিদ, ৬) জনাব রশিদ আহমদ বাচ্চু, ৭) প্রেসক্লাবের পক্ষে জনাব টিপু সুলতান, জনাব সামছুল ইসলাম সরদার খেজুর।
দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে সাথে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব মোঃ শাহীদুল আলম দিরাই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু করেন । তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের ১৬ নভেম্বর দিরাই উপজেলা অডিটরিয়ামের সামনে দিরাই স্মৃতিসৌধের ভিত্তি স্থাপন করেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব মোঃ শহীদুল আলম । কাজটি সম্পন্ন করার জন্য গঠিত কমিটির সহযোগীতায় এগিয়ে আসেন স্থানীয় এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ স্বাধীনতার চেতনানোরাগী মানুষ সহ জেলা পরিষদ সুনামগঞ্জ, দিরাই পৌরসভা, উপজেলার সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এবং বুলবুল চৌধুরী, সৈয়দ চান্দ আলী সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। সকলের সার্বিক সহযোগীতা এবং অর্থায়নে সর্বমোট ৭,৫০,৩৯০/- (সাত লক্ষ পঞ্চাশ হাজার তিনশত নব্বই) টাকা ব্যয়ে দিরাই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ সফল ভাবে সম্পন্ন হয় । ২০০৭ সালের ১৫ আগষ্ট দিরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সম্মেলন কক্ষে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় দিরাই স্মৃতিসৌধ উদ্ভোধন ও স্থাপতি রাজন দাসকে ধন্যবাদ জানানোর লক্ষ্যে অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । সর্বোপরি ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর দিরাই স্মৃতিসৌধটি আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্ভোধন করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব সাবের হোসেন। উদ্বোধনের পর স্থানীয় ব্যাংকে দিরাই স্মৃতিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি ডিপোজিট চালুক করা । এভাবেই নির্মাণ করা হয় দিরাই উপজেলার দর্শনীয় স্মৃতিসৌধ ।
লেখক : ফারুকুর রহমান চৌধুরী, লোকগীতিকার ও সংগ্রাহক, দিরাই, সুনামগঞ্জ ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৪:৩৯