পুলু,
কেমন আছিস? ভালো?
বড় তাড়তাড়ি নিভে যাচ্ছে এই কলমের আলো।
মাঘ কুয়াশার চেয়েও ঝাপসা হচ্ছে অক্ষর,
কোথা দিয়ে কেটে গেল রে... এত গুলো বছর!
যেন রেলের চাকায় বেঁধেছিল কেউ দিনঘড়িটার কাঁটা;
অনেক কষ্টে যোগাড় করেছি তোর ঠিকানাটা।
এই দ্যাখ- পরিচয়টাই দেওয়া হয় নি কথায় কথায়...
চিনতে পারছিস? রোল ফর্টি সিক্স, অপূর্ব কুমার রায়।
তোর সাথে শেষ দেখা নাগপুর কোলিয়ারি;
তারপর জানিস খুলনা গিয়েছিলাম- অপর্ণাদের বাড়ি।
খুলনা তো এখন বাংলাদেশ, ওখানে কে থাকে?
আমি ছাড়া তোকে এখনও কেউ 'পুলু' বলে ডাকে?
কাজল এখন বিয়ে করেছে, চাকরি করছে কলকাতায়।
সেসব যাক- এবার আসি যেজন্য চিঠি সেই কথায়-
জানি না কোত্থেকে শুরু করব, ঠিক কোন দুঃখভোগ-
তোর সাথে প্রায় তিরিশ বছর পরে তো যোগাযোগ।
তুই বলবি আমার দোষ, রাখিস নি কেন যোগাযোগ?
যোগ আর যোগ রাখব কোথায়, আয়ুস্কালে শুধুই বিয়োগ;
ছয়ে দিদি, দশে বাবা, সতেরোতে গেলেন মা;
আর বাইশ বছর; ফাগুন মাস; যেদিন গেল অপর্ণা।
আর শুধু ওরাই নাকি- কয়লার ট্রেন, দুঃখ পুকুর,
গরুর গাড়িটাও ছেড়ে দিয়েছে কাশফুলে ঢাকা নিশ্চিন্দিপুর।
বাবার ওপর টান বলতে খুব রোগা আর পলকা দড়ি,
রোগা দড়ি হেঁটে নামত কাশী ঘাটের চৌষট্টি সিঁড়ি।
বাবার আর লেখা হল না গ্রাম জাগানো মহৎ পালা,
দীর্ঘশ্বাসের চাপা সংলাপ শুধু শুনতে পেল গণেশ মহলা।
এখন মাঝে মাঝে স্বপ্নে আসেন হরিহর- পালা গীতিকার-
আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন 'ওই যায় শবযাত্রা আমার-
হরিধ্বনি দাও হে সবে দুহাতে ওড়াও বিন্নি খই-
বাঁশের মাচায় শুয়ে চলেছেন না লিখতে পারা আমার বই।
ফিরে এলাম দেশের বাড়ি, ঘুরল আবার রেলের চাকা,
সম্বল বলতে গলার পইতে, মা'র জমানো ছত্রিশ টাকা।
পল্লী বাড়ি একই আছে: ধোঁয়াটে মাঠ, কাশের বন-
নতুন একটা শব্দ শিখলাম , স্যারের কাছে: 'অ্যাম্বিশন'
লিভিংস্টোন পড়ছি তখন কবে যাব আফ্রিকায়!
দেবতাকে অভুক্ত রেখে এই পুরুতের ছেলে জলপানি পায়,
মা'কে ছেড়ে, পল্লী ছেড়ে, পুরুতের ছেলে দূর পালালো।
দূর বলতে কলকাতা: তেতলা বাড়ি, ইলেকট্রিক আলো।
অখিলবাবুর রয়্যাল প্রেসে সারারাত জেগে কাজ করতাম।
নতুন বইয়ের মলাট দেখলেই ইচ্ছে হত লিখি বাবার নাম।
একদিন একটা চিঠি এল- মায়ের নাম লেখা তাতে,
মা লিখছেন ভাঙা ছন্দে, মা লিখছেন কবিতাতে:
'অপু, আমার মাথার ওপর উড়ছে জানিস রাতের আকাশ,
কদিন পরেই গনেশ পুজো, তোরা কলেজে ছুটি কি পাস?
চারাগাছটা পুঁতে গেছ্লি, কদিন হল দিইনি জল।
গনেশ পুজোয় না এলেও তুই অঘ্রান মাসে আসবি বল?
কদিন ধরেই জ্বরটা আসছে, বলা হয়নি কথায় কথায়,
তোর তেতলা জানলা থেকে গ্রামের রাতটা দেখা যায়?
অপু, আমার মাথার ওপর আকাশ ভাঙছে-উফ্ কি কালো!
পাঠাবি রে জোনাকি ঘুম, পাঠাবি রে ইলেকট্রিক আলো?'
সেই থেকে তো শ্মশানের কাঠ গার্হস্থ্যে আমার হল অক্ষয়।
যারা চলে যায়, কে বলল- শুধু তাদেরই শব দাহ হয়?
প্রথমে প্রথমে পুড়ে যেতাম নতুন বিয়োগ, চড়া আঁচে-
দ্যাখ, 'সন্তাপ' কথাটাতেই তাপ কথাটা লুকিয়ে আছে।
একদিন তখন হবিষ্যি চলছে, এঁটো ছিটিয়ে ডাকছি কাক-
হঠাৎ মনে হল: এ কি করছি? আমি না হিমাদ্রিনন্দন মৈনাক।
সেই থেকে তো পালানো শুরু, থাকতে দেবে বৃক্ষবন-
তোমার সবুজ পাতার ভিড়ে রাখবে আমায়, রাখবে গোপন?
গাছ দেখলেই ভয় করে যে, চিতাকাঠ বড্ড ভয়-
শরীর জুড়ালো হঠাৎ করে, হঠাৎ শরীরে সূর্যোদয়।
মা, অপর্ণা মুছে গেল-
ওদের মুখের টুকিটাকি...
বলেই ফেলল অপর্ণার ছবি: 'হাঁ করে দেখছ, আমি নতুন নাকি!'
পুলু, একটা সত্যি কথা এবার তবে বলি তোকে,
আমি মরে যাচ্ছি যন্ত্রনাতে, আমি মরে যাচ্ছি বিচ্ছেদ শোকে।
দিদি, বাবা, মা, অপর্ণা - এরা না, কার কথা বলছি জানিস?
একটু ভালো করে মনে করে দ্যাখ: তুইও ওদের খুব কাছ থেকে চিনিস
মনে পড়ে সেই খুলনা যাওয়া: পদ্মা নদী, ছবির সেট
হঠাৎ তুই ডাকলি আমায়- 'হাতটা দে না ইডিয়েট!'
হ্যাঁ, ওই গল্পের পাতা- আমার অপ্রকাশিত প্রথম বই
গল্পের শুরুটা তুইও জানিস, গল্পের শেষটা গেল কই!
সেদিন গল্পে ঝিঁঝিঁ ডাকছিল, মাথার ওপর বৃক্ষ ছাতা
সূর্যোদয়কে সামনে পেয়ে উড়িয়েছিলাম গল্পের পাতা
ওরা কি সব ওখানেই আছে? চালে-ডালে পাতা সংসার
সংসার না বৈরাগ্য- কি জীবন হয় ছেঁড়া পাতার?
এসব আমার জানা দরকার, এসব আমার জানা প্রয়োজন,
ব্যর্থ লেখক অপূর্ব রায়ের ওরাই হল আত্মাস্বজন,
ওরা আমার সাথে বাসে ওঠে, আমার সাথে অফিস করে।
শুধু পেছন ফিরে দেখতে গেলেই ওরা বৃক্ষবনে লুকিয়ে পড়ে।
আর যখন ঘুমিয়ে পড়ি, ওরা স্বপ্নে আসে অহরহ,
আসলে শুধু ছেড়ে এসেছি তো- কখনও ওদের করিনি দাহ।
এখন আমার মায়ের বয়স: সন্ধ্যে হলেই আসে জ্বর।
বাবা বসে জলসেঁক দেয়- বলে 'অপু, লেখাটা শেষ কর!'
পশ্চিমের টিকিট কেটেছি; ভোর হলেই রওনা হব।
খেলনা, মুখোশ, কলের গাড়ি- ওদের জন্যে কি কি নেব?
গল্পটা যদি জিজ্ঞেস করে: এতদিন পর তুমি এদিকে?
আমি তাহলে সেদিনের সেই অবাক করা সূর্য ডেকে-
সব অধিকার ছেড়ে দেব: লেখক, পিতা - সব... সব
লেখকসত্ত্ব বিনিময়ে ফিরে পাবে ওরা শৈশব!
গোপন বলতে নিজের কাছে একটা নাম রাখব শুধু- একটা নাম রাখব শুধু:
পিতা নয়, লেখক নয়, স্বার্থ নয়- শুধু 'বন্ধু'
চললাম পুলু, জানাব তোকে- কি দেখলাম ছেঁড়া পাতায়-
ভালো থাকিস, বইটা ছাপিস-
ইতি অপু, অপূর্ব রায় ।।