আজ কালনী ভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম অনলাই পত্রিকায় আমার একটি স্বাক্ষাৎকার ছাপিয়েছে । স্বাক্ষাৎকারটি হুবহু পোষ্ট করলাম । সেই সাথে ধন্যবাদ জানাচ্ছি কালনী মিডিয়া পরিবারকে ।
একান্ত স্বাক্ষৎকারে লোককবি ফারুকুর রহমান চৌধুরী
-----------------------------------------------------------
ফারুকুর রহমান চৌধুরী একজন সম্ভাবনাময় গীতিকার, সংগ্রাহক ও লেখক,পাশাপাশি একজন গাড়ি চালক । তাঁর জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলায়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দিরাই উপজেলার সুপ্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন। রচনা করেছেন কয়েকশত মরমী গান। সম্পাদনা করেছেন কয়েকটি সংকলন। লেখালেখির সূত্রে সুধী মহলে অর্জন করেছেন পরিচিতি ও সুনাম, পেয়েছেন সম্মাননা। সম্ভাবনাময় এই গীতিকারের এগিয়ে যাওয়া এবং লেখালেখি সম্পর্কিত একটি স্বাক্ষাৎকার নিয়েছে কালনী ভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম।
স্বাক্ষাৎকারটি নিম্নরূপ দেয়া হলো-
কালনী ভিউ: সাম্প্রতিক সময়ে দিরাই উপজেলা থেকে সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। লেখনির সূত্র ধরেই বেশ পরিচিতি ও সুনাম অর্জন করেছেন। দিরাই উপজেলার সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আপনার কর্মকান্ড বেশ প্রশংসনিয়। সঙ্গত করণে আপনার সাথে অভিজ্ঞতা বিনীময় করতে এসেছি। আমাদের সময় দেয়া যাবে ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : আমি অতি নগণ্য একজন মানুষ । আপনি শত ব্যস্ততা রেখে আমার সাথে অভিজ্ঞতা বিনীয়ম করতে এসেছেন, সুতরাং আপনাকে সময় দেয়া আমার কর্তব্য। বলুন কী সেবা করতে পারি ।
কালনী ভিউ : প্রথমেই জানতে চাচ্ছি আপনি কেমন আছেন ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : আমি ভালো আছি।
কালনী ভিউ : আপনার লেখনি কেমন চলছে ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : নিজের অবস্থান থেকে ভালোই চলছে।
কালনী ভিউ : প্রথম দিকে লেখালেখি শুরু হয়েছিল কিভাবে ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : ছাত্র জীবনে নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম । বিশেষ করে বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকি । এই পাতাটি খুব মনযোগ দিয়ে পড়তাম। পড়তে পড়তে একসময় নিজের অজান্তেই দু-চারটি কবিতা লিখে ফেলি। কবিতাগুলো বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার পর তারা আমাকে উৎসাহ দেয়। এভবেই লেখালেখি শুরু হয়েছিল।
কালনী ভিউ : আমরা জানি আপনি কবিতা, গান, ছোট গল্প, গবেষণাধর্মি প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখেন। লেখালেখির জন্য কোন সময়টা আপনার কাছে বেশি পছন্দের ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : সময় আমাদের কারোরই থাকেনা । সময়টা বের করে নিতে হয় । আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি। লেখালিখর জন্য আমার নির্ধারিত কোন সময় নেই। যখনই সময় পাই তখনই লেখালেখি করি। বলতে পারেন লেখালেখি আমার অবসর সঙ্গী। আমার অবসর সময়টুকো লেখনি কাজে ব্যয় করি। কবিতা, গান ? এগুলো লিখার জন্য বিশেষ কোন সময় লাগে না। যখন যেখানে যেভাবেই ভাব আসে তখন সেখানেই কাগজ কলমে বন্দি করে রাখি। পরে, সময় নিয়ে ঘষামাজা করি। এই ঘষামাজা কিংবা প্রবন্ধ লিখার কাজটা রাতে করতে ভালো লাগে । এছাড়াও যখন কোন কাজ থাকে না বিশেষ করে সরকারী বন্ধের দিন লেখালেখি কিংবা বই পড়া কাজেই ব্যয় করি।
কালনী ভিউ : এ পর্যন্ত কয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে বই গুলো নাম কি এবং কত সালে কোন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : বিভিন্ন ধরণের সাতটি বই প্রকাশিত হয়েছে । প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালের একুশে বইমেলায়, রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা থেকে, প্রকাশক রিয়াজ খান, বইয়ের নাম ‘শিশির ভেজা স্বপ’ এটি ছিলো আমার লেখা ৬৪টি কবিতার বই। দ্বিতীয় বই ‘কালনী তীরের লোকগীতি’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালের একুশে বইমেলায়, বইটি প্রকাশিত করেছে তৃণলতা প্রকাশনী ঢাকা থেকে, প্রকাশক মো. জাহাঙ্গীর আলম। ২০১৪ সালে উড়াল প্রকাশ সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাউল কামালের গান’ প্রকাশক আলী সিদ্দীক। ২০১৫ সালের একুশে বইমেলায় দুইটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, বাউল মো. হেলাল উদ্দিনের গানের বই ‘বাউল মন’ এবং ‘বাউল তছকির আলীর গান’ বইগুলো প্রকাশ করেছে- বইপত্র প্রকাশনী, ঢাকা, প্রকাশক মাহবুবুর রহমান বাবু এবং উড়াল প্রকাশ সুনামগঞ্জ, প্রকাশক আলী সিদ্দীক। ২০১৬ সালের একুশে বইমেলায় ‘মন মানুষের সন্ধানে’ সংকলনটি প্রকাশ করেছে লোকজ প্রকাশনী, সিলেট, প্রকাশক মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী। সর্বশেষ ২০১৭ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে আমার লেখা ২২০টি গানের বই ‘ভাবের পান্থশালা’ । বইটি প্রকাশ করেছে ইন্তামিন প্রকাশনি ঢাকা, প্রকাশক এ এস এম ইউনুস।
কালনী ভিউ : প্রকাশনা জগতে কিভাবে এলেন বা সর্বপ্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো কিভাবে ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : লেখনি জগতের প্রথমদিকে যাই লিখতাম ডাইরিতে তুলে রাখতাম। কাছের বন্ধুবান্ধব এবং স্থানীয় লেখক- মশাহিদ আহমদ সাব্বির, দুলাল হোসেন হেলাল, এস এম সুহেল, এম আর মিজান (রোদ্র মিজান), পি আর চৌধুরী সুমন প্রমুখদের সাথে লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতাম। তখন দিরাই কলেজ রোডে আমাদের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো ; মেসার্স বাবলু ভেরাইটিজ ষ্টোর। সেখানে ওরা আসলে সাহিত্য বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতাম। মিজান আমাকে সাপ্তাহিক মনোরমা ম্যাগাজিনে লিখতে উৎসাহ দেয়। ঐ সময় মনোরমা পত্রিকায় মিজানের কবিতা নিয়মিত ছাপা হতো। মিজানের উৎসাহে মনোরমা পত্রিকার পাঠক ফোরামের সদস্য হলাম। এরপর মনোরমায় আমার লেখাও ছাপা হতো, অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়ও লেখা ছাপা হয়েছে। অপ্রিয় সত্য বলতে তখন থেকেই লেখা প্রকাশের স্বপ্ন দেখতে থাকি। বই প্রকাশের বিষয়টি ভিন্ন । সেক্ষেত্রে পথ দেখিয়েছিলেন নোয়াখালী জেলার সুনাইমুড়ি উপজেলার স্বনামধন্য লেখক ও গবেষক, সিটমহল আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী শ্রদ্ধেয় বড় ভাই এ এস এম ইউনুস।
কালনী ভিউ : গানের জগতে কিভাবে এসেছিলেন ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : আমার নানা মরহুম মমরুজ খান একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ি ছিলেন। তিনি পালাগানের নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। পালাগানের জন্য জীবনের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন, প্রচুর অর্থ খুইয়েছেন। সঙ্গত কারণেই শিল্পী সাধকদের সাথে নানার ছিলো নিবিড় সম্পর্ক। আমার শৈশব কেটেছে নানাবাড়িতে। নানা আমাকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। তাই নানার কাছেকাছে থেকেছি খুব বেশি। আমি দেখেছি আমার নানা অবসর সময়ে বাড়িতে বশে নিজেই হারমুনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে। আমি শৈশবে কোন কিছু না বুঝেই লালনগীতি, পল্লীগীতি, ভক্তিগীতি শুনতে পছন্দ করতাম। এ বিষয়ে একটা কথা আলোচনায় আনতেই হয়- আমার জন্মের প্রথম দিন আব্বা তিন বেন্ডের একটা রেডিও কিনেছিলেন। এই রেডিওতে আমি ছোট বেলায় গান শুনতাম। ছাত্রজীবনেও রেডিও বাজানো আমার সখ ছিল। আমার মা সঙ্গীত প্রেমি মানুষ। আম্মার সাথে বশে রেডিওতে পল্লীগীতি নিয়মিত শুনতাম। এভাবেই ধীরে ধীরে গানের জগতে কখন চলে এলাম নিজেও জানিনা।
কালনী ভিউ : কার কার গান আপনার বেশি ভালো লাগে ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : তত্ত্বে অর্থে যারা ভালো লিখতে পারে তাদের গানই ভালো লাগে। তবে পূর্বসূরী যাদের গান আমাকে গান লিখা শিখিয়েছে তাঁরা হচ্ছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, দূর্ব্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিম, কামাল উদ্দিন, উকিল মুন্সি, রশিদ উদ্দিন, সৈয়দ শাহনূর, শিতালং শাহ, আরকুম শাহ, দীনহীন, জালাল উদ্দিন খাঁ, লালন সাঁইজি প্রমুখ।
কালনী ভিউ : এ পর্যন্ত কতগুলো গান লিখেছেন ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : এগুলো কখনো হিসাব করিনি। তাই নির্ধারণ করে বলতে পারব না। আমি ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি করি। যখন যা লিখি সংরক্ষণ করে রাখার চেষ্টা করি। যদিও সব লেখা সংরক্ষন করে রাখা সম্ভব হয় না তবুও লিখার সংখ্যা নির্ণয় করার ব্যাপারে আমি একেবারেই উদাসীন। সংখ্যা নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে কখনো লিখিনি, এমনকি সংখ্যা নির্ণয়ের প্রয়োজনও মনে করিনি। কারণ আমি লিখি একান্তই মনের তাগীদে। এটি আমার নেশা। রচনা সংখ্যা কত হলো না হলো এ নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। শুধু এটুকো জানি- আমার প্রকাশিত গীতিগ্রন্থ ‘ভাবের পান্থাশালা’য় ২২০টি গান আছে। এর বাইরেও গান আছে।
কালনী ভিউ : আপনার গানের বই ‘ভাবের পান্থশালা’ বেশ প্রশংসা পেয়েছে, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বইটি নিয়ে কথা বলেছেন, মাননীয় মন্ত্রী পরিষদ সচিব মহোদয় সহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন বইটি মোড়ক উন্মোচন করেছেন, বিশেষ করে এই বইয়ের গান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে । এগুলো বিশেষ প্রপ্তি । বিষয়গুলো আপনার কাছে কেমন লাগে ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : কোন কাজের স্বীকৃতি পাওয়া গেলে যে কারো ভালো লাগে, কাজ করতে উৎসাহ জাগে, আমার ক্ষেত্রেও তাই ।
কালনী ভিউ : আপনি নিজ এলাকায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রাম আয়োজন করেন । আপনার প্রোগ্রামগুলো স্থানীয়দের ভালো লাগে । আপনার কাছে কেমন লাগে এবং এ কাজে কার উৎসাহ বেশি পেয়ে থাকেন ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : শুধুমাত্র সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই আয়োজনগুলো করি সম্পূর্ণ নিজের উৎসাহে এবং নিজের সাধ্য অনুযায়ি। প্রোগ্রামগুলো মানুষের ভালো লাগলে আমারও ভালো লাগে। আমি চাই সাংস্কৃতিমনা মানুষ গড়ে উঠুক। কারণ সাংস্কৃতিমনা মানুষগুলো সমাজকে ভালো কিছু উপহার দিতে জানে বিনীম হিসেবে কিছু নিতে জানে না।
কালনী ভিউ : সাতিহ্য সাংস্কৃতি অঙ্গনে কাজ করতে গিয়ে পরিবার থেকে কতটুকো উৎসাহ পেয়ে থাকেন ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : আমার পরিবারের সবাই নামাজ পড়ে, রোজা রাখে। সবাই ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। বিশেষ করে আমার বাবা এগুলো একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই আমার বাবার ভয়ে এগুলো প্রকাশ্যে করতে পারিনি দীর্ঘদিন। আমার মা লক্ষ্য করেছে আমি এগুলো খুব বেশি পছন্দ করি। এরপর থেকে মায়ের উৎসাহ পেয়ে আসছি। আমার বাবার কারণে বর্তমানেও আমার বাসায় গান বাজনা চলে না। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরাও বাসায় এগুলো পরিহার করে চলি, লেখনি কাজটা অতি সম্প্রতি প্রকাশ্যে করতে পারছি আমার মায়ের সহায্যে। তবে গান বাজনা নিয়ে বাসায় কোন আলোচনা সমালোচনা করি না। বাইরেও যা করছি, বলতে গেলে বাবার চোখে ফাঁকি দিয়ে। এভাবেই সহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড যেটুকুই করতে পারছি তার সম্পূর্ণ আমার মায়ের উৎসাহ এবং সহযোগীতায়। সম্প্রতি আমার ছোট ভাই আমাকে এ কাজে যথেষ্ট উৎসাহ দিচ্ছে এবং সহযোগীতা করছে।
কালনী ভিউ : আপনি একজন গীতিকার, সংগ্রাহক ও লেখক পাশাপাশি একজন গাড়ি চালক। লেখনির সূত্র ধরে কয়েকটি সম্মাননা, পরিচিতি ও সুনাম অর্জন করেছেন। সঙ্গত কারণেই জানতে ইচ্ছে করছে, লেখালেখি করে গাড়ি ড্রাইভ করতে কোন সমস্যা হয় না ?
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : এখন পর্যন্ত কোন সমস্য হয়নি, আশাকরি হবেও না। আমাকে সাহিত্যিক, গীতিকার কিংবা লেখক যাই বলুন না কেন সেটা বলতে হবে গাড়ি গ্যারেজে রাখার পর। করণ, যখন আমার হাতে ষ্টিয়ারিং হাকে তখন আমি নিজেকে একজন পেশাদার গাড়ি চালক ছাড়া অন্য কিছুই ভাবি না। এসময় সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনা ? প্রশ্নই ওঠে না।
কালনী ভিউ : আমরা চাই আপনি অনেক দূর পৌছে যান। আপনার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভকামনা। আমাদের সময় দেয়ায় আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
ফারুকুর রহমান চৌধুরী : আপনার মূল্যবান সময় আমাকে বরাদ্দ দেয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আপনিও ভালো থাকুন প্রতিটি দিন রাত্রী। শুভ কামনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১০:০৩