[৪৮ তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড, ভিয়েতনাম
আমার এই লেখাটা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হবার কথা ছিল। বিশেষ একটা কারণে সেটা হয়নি....এখানে গতবছর ড্রাফট করে রাখা ছিল এবছর প্রকাশ করে দিলাম ]
২২ জুলাই রাত ১১:৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে আমাদের যাত্রা শুরু ভিয়েতনামের পথে।সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে চার ঘন্টা বিরতির পর আমরা বাংলাদেশ সময় দুপুর ১১:৩৫ এ পৌছালাম হ্যানয়ের নই বাই বিমানবন্দরে।কিন্তু বিমান থেকে নেমে শুরুতেই আমরা একটা ধাক্কা খেলাম।আমাদের গাইড বিমানবন্দরে উপস্থিত নেই।আমাদের সাথে সিঙ্গাপুর,দক্ষিন আফ্রিকা এবং আরও বেশকিছু দল ছিল।তাই সিঙ্গাপুর দলের গাইড থোয়াই এ যাত্রায় আমাদের ভরসা।আমরা সবাই বিমানবন্দরের বাইরে আমাদের জন্য নির্ধারিত বাসে চেপে বসলাম।মুনির হাসান স্যারকে আরেকটি হোটেলে রেখে প্রায় মিনিট চল্লিশ পরে আমরা পৌছে গেলাম আমাদের প্রতিকযোগীদের জন্য নির্ধারিত লা থান হোটেলে।শুরুতেই এত সুন্দর হোটেল দেখে অভিভূত হলাম।হোটেলে পৌছেই তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় আরেকবার অভিভূত হতে হল।বলে রাখা ভাল যে, হেটেলটি একটি তিনতারা হোটেল।এই হোটেলটি যথেষ্ট বড় হবার কারণে ৯৫টি দেশের প্রায় ৫২২ জন প্রতিযোগী এবং আরও অনেক অবজারভারদেরকে রাখতে কোন সমস্যাই হয়নি।হোটেলটি ৫ টি ভবনে বিভক্ত। ই ভবনটি সবচেয়ে সুন্দর এবং মূল ভবন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।আমরা ই ভবনে পৌছাতেই আমাদের গাইড না আসার জন্য সবাই দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং আমাদের জন্য নির্ধারিত এ ভবনে নিয়ে যাওয়া হল।প্রতিটি রুমে ২ টি করে বিছানা।তাই আমাদেরকে তিনটি রুম দেওয়া হল।১১৫ নং রুম দেওয়া হল তানভির ভাই এবং সৌমেন ভাইকে;১১৬ নং রুম দেওয়া হল আমাকে এবং রাব্বান ভাইকে এবং ১১৭ নং রুম দেওয়া হল নাজিয়া এবং আমাদের আন্টি (নাজিয়া’র মা)কে।আমরা সবাই রুমে আমাদের ব্যাগ রেখে গোসল করতে গেলাম।এমন সময় এক মজার ঘটনা ঘটল।রাব্বান ভাই বাথরুমে গীজার(পানি গরম করার যন্ত্র) চালু করে গোসল করতে গেলেন।উনি বের হয়ে এসে বললেন যে,শুরুতে পানি ঠান্ডা থাকলেও শেষে খুব গরম ছিল।আমি বাথরুমে ঢুকে পানির কল চালু করতেই টের পেলাম যে আগুনের মত গরম পানি বের হচ্ছে;গায়ে ফোস্ড়্গা পড়ে যাবার মত অবস্থা।তখন আমি তাড়াতাড়ি গরম পানি বন্ধ করে গোসল সারলাম।
তারপর আমরা সবাই ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়লাম।প্রায় দুইঘন্টা ঘুমের পর আমরা হোটেলটা ঘুরে দেখতে বের হলাম।স্পোর্টস রুমে ঢুকেই দেখি নানা ধরনের খেলাধুলার সামগ্রী।আমরা সবাই তাই ব্যাডমিন্টন খেলতে নেমে গেলাম।ব্যাডমিন্টনের কোর্ট আমাদের এ ভবনের ঠিক পেছনে।সেখানে একটা দারুণ ফোয়ারাও আছে।আমরা বসনিয়া দলের কিছু প্রতিযোগীর সাথে ব্যাডমিন্টন খেললাম।কয়েকঘন্টা পর ক্লান্ত হয়ে রুমে ফিরে গোসল করলাম;তবে এইবার আর গরম পানিতে নয়! এরপর আমরা সবাই মিলে রাতের খাবার খেতে বের হলাম।
খাবার খেতে এসে আমরা বেশ আনন্দিতই হলাম।কারণ সেখানে ভাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের মাছ,মাংস,সবজি এবং নানা ধরনের সামুদ্রিক খাবার ছিল।আমাদের সবার ভিয়েতনামের খাবার সম্পর্কে একটা ভয় ছিল।এমনকি বাসা থেকে সাপ,ব্যাঙ খেতে মানাও করে দিয়েছিল! সেখানে খাবার নিজেকেই নিয়ে খেতে হয় অর্থাৎ সেল্ফ সার্ভিং।খাবার রুমটি আমাদের এ ভবনের ডানপাশে।আর তার সামনে ভলিবল খেলার কোর্ট।হোটেলে ঢোকার পর থেকেই অনেক প্রতিযোগীকে প্রায় সারাদিন ভলিবল খেলতে দেখেছি।(তবে পরে আবিষ্ড়্গার করলাম যে, এদের মধ্যে অনেকে স্বর্ণপদকও পেয়েছে!)
পরদিন ২৪ তারিখ সকাল সাতটায় ঘুমথেকে উঠে সকালের নাস্তা করে আমাদের আর কোন কাজ নাথাকায় সবাই গেলাম ইন্টারনেট রুমে।ইন্টারনেট রুমটি খাবার ঘরের ঠিক উপরে।সেখানে প্রায় ২০-২৫ টি কম্পিউটার আছে।ভিয়েতনামে ইন্টারনেট অত্যন্ত দ্রুতগতির এবং প্রতিযোগীদের জন্য সম্পূণ্য বিনামূল্যে।এবং অনেক প্রতিযোগী ল্যাপটপ দিয়ে তারহীন ইন্টারনেটও ব্যবহার করেছে।তবে প্রতিযোগীরা ইন্টারনেটের চেয়ে গেম খেলায় বেশি ব্যস্ত ছিল!দুপুরের খাবার শেষে আমরা সবাই গেলাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে রাতের খাবার খেয়ে আমরা সবাই ঘুমাতে গেলাম।কারণ পরদিন ছিল মূল প্রতিযোগীতা।
২৫ তারিখ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আমরা প্রতিযোগীতার জন্য চলে গেলাম।প্রতিযোগীতা থেকে ফিরে এসে আমাদের আর কারও খাবার মানসিকতা ছিল না।তারপরও দুপুরের খাবার খেয়ে আমি ইন্টারনেট রুমের দিকে গেলাম ম্যাথলিংকসে সমস্যার সমাধান দেখতে।১ নং সমস্যা কেন চেষ্টা করিনি ভেবে দুঃখ হল।এরপর আবার ঘুরতে বের হলাম।এরমধ্যে ই ভবনে আমার পূর্বপরিচিত ইন্দোনেশিয়ার এক বন্ধুকে পেয়ে গেলাম।(আমার এ বন্ধুটি রৌপ্যপদক পেয়েছে!) তারসাথে অনেকক্ষণ গল্প করে আবার রুমে ফিরে এলাম।কিছুক্ষণ পর আবার রাতের খাবার খেয়ে ইন্টারনেট রুমে গেলাম সমস্যাগুলোর সমাধান দেখতে।তারপর রুমে ফিরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ২৬ তারিখ ছিল প্রতিযোগীতার দ্বিতীয় দিন।তিনজন একটি সমস্যা সমাধান করতে পারায় আমাদের সবার মন একটু হালকা ছিল।আমরা সবাই তাই স্পোর্টস রুমের দিকে গেলাম।সেখানে সৌমেন ভাই আর রাব্বান ভাই বিলিয়ার্ড খেলতে লেগে গেলেন।আমি এই ফাঁকে টেবিল টেনিস খেলার চেষ্টা করলাম।আমি যদিও তেমন পারতাম না, ভিয়েতনাম দলের সদস্যরা আমাকে টেবিল টেনিস খেলা শিখিয়ে দিল।যদিও তাদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী বুঝতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছিল।সেদিন তানভির ভাই,সৌমেন ভাই এবং রাব্বান ভাই নেমে পড়লেন সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতে।বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের সাথে তারা অনেকক্ষণ লাফালাফি করলেন! সুইমিংপুলটি ই ভবনের ঠিক পেছনে।
সেদিন রাতে ছিল সবচেয়ে মজার একটা পর্ব; সোস্যাল অ্যাকটিভিটি।এই অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ভলিবল কোর্টে।সব দেশের প্রতিযোগীরা সেখানে বিভিন্ন ধরনের অভিনব এবং মজার মজার সব খেলায় অংশগ্রহণ করল।প্রথম খেলাটি ছিল বস্তা দৌড়।তারপর ছিল আরেকটি মজার খেলা।বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীর মধ্যে একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে নিয়ে পা বেঁধে দিয়ে ফুটবল খেলা।এ খেলায় সৌমেন ভাই এর সঙ্গী ছিল রাশিয়ার মারিয়া (মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৪ স্ড়্গোর করেছেন এবং স্বর্ণপদক!)।এই ফাঁকে আমি আর নাজিয়া ছবি তুললাম এবং ভিডিও করলাম।তারপর ১০ জন করে প্রতি দলে নিয়ে শুরু হল দড়ি টানাটানি খেলা।এই খেলায় এক দলে আমাদের দেশের ৩ জন ছিলাম এবং আমরা খেলায় জিতলাম। পুরষ্ড়্গার হিসেবে পেলাম ভিয়েতনামের ঐতিহ্যবাহী টুপি এবং রেশমের টাই।সবশেষে নাচ ও গানের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হল।
২৭ ও ২৮ তারিখ আমাদের ভিয়েতনামের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখানো হল।প্রথম দিন আমরা রাতের আগেই ফিরে আসলাম।এদিন আবার টেবিল টেনিস খেলতে বের হলাম।সার্বিয়ার এক প্রতিযোগীকে তার স্ড়্গুলের কথা জিজ্ঞেস করেতেই সে বলল যে সে ম্যাথমেটিকাল স্ড়্গুলে পড়ে,অথাৎ তাকে গণিত ছাড়া অন্যান্য বিষয় খুব কমই পড়তে হয়! আমরা রাতে খাবার পর আমাদের গাইড জুং এর সাথে ভিয়েতনামের মার্কেটে গেলাম কিছু কেনাকাটা করতে।
তার পরের দিন অর্থাৎ ২৮ তারিখ আমাদের হ্যালং বে থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল।রাতের খাবার পর আর্মেনিয়ার এক প্রতিযোগীর কাছ থেকে জানতে পারলাম যে,ম্যাথলিংকসে আমাদের আংশিক স্ড়্গোর জানা যাচ্ছে।এটা শুনেই আমরা সবাই ইন্টারনেট রুমের দিকে ছুটলাম।অনেকরাত পর্যন্ত আমরা সবাই পূণাঙ্গ ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করলাম।
পরদিন আমাদের হ্যানয় শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে নিয়ে যাওয়া হল।সেদিন ফিরে এসে আমরা রাতের খাবার পর শেষ দিনের স্যোশাল অ্যাকটিভিটির জন্য প্রস্তুত হলাম।সেদিন বিভিন্ন দেশের অনেক প্রতিযোগী তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এসেছিল।আমাদের মধ্যে একমাত্র নাজিয়া আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি পরে এসেছিল।আমি সেরকম কোন পোশাক নিয়ে যাইনি বলে আমার বেশ দুঃখ হল।এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীরা গান-নাচ প্রভৃতি পরিবেশন করল এবং সবশেষে আমরা বাঁশ নাচে অংশগ্রহণ করলাম (এটা অনেকটা আমাদের উপজাতিদের নাচের মত)।
পরদিন আমাদের তেমন কোন কাজ ছিল না।আমরা সবাই সুভেনিয়র বিতরণ করলাম।আমাদের বাংলাদেশের পতাকা আঁকা এবং গণিত অলিম্পয়াডের চিহß আঁকা রুমাল,বাংলাদেশের কয়েন,পোস্টকার্ড,মাটির ঘন্টা এসব আমরা বিভিন্ন দেশকে সুভেনিয়র হিসেবে উপহার দিলাম।অন্যান্যরাও আমাদের বিভিন্ন উপহার দিল।বিকালে ছিল সমাপনী অনুষ্ঠান।সেখান থেকে ফিরে এসে আমরা আমাদের বাকি সুভেনিয়র বিতরণের কাজে লেগে গেলাম।এরপর সবাই নিজ নিজ ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।আমি এক ফাঁকে আমার জাপানী বন্ধুদের সাথে দেখা করলাম এবং তাদের সাথে খিউএন (বৃত্তস্থ চতুর্ভুজ বের করার খেলা খেললাম)।
এই হোটেলে আমাদের যে সবচেয়ে ভাল লেগেছে সবার বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার এবং সহযোগীতা।তাছাড়া সারা ভিয়েতনামে আমরা লক্ষ্য করেছি যে এখানে পুরুষের পাশাপাশি সকল ক্ষেত্রে নারীরা কাজ করে এবং ভিয়েতনামীরা অত্যন্ত কর্মঠ।যার ফলে তারা আজকে উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে।
দেখতে দেখতে আমাদের নয় দিন শেষ হয়ে আসল।৩১ তারিখ সকালে আরও অনেক দলের সাথে আমরা বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুতি নিলাম।ভারত দলের সাথে একই বাসে চড়ে আমরা যখন বিমানবন্দরে পৌছালাম তখন সাবার অনুভূতি ছিল মিশ্র; একদিকে দেশে ফেরার আনন্দ,অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের বন্ধুদের সাথে বিদায় নেবার দুঃখ। ৩১ তারিখ সকাল ৯ টায় আমরা যখন বাসে চড়ে বসলাম তখন পেছন ফিরে একবার তাকিয়ে মনে মনে বললাম বিদাল লা থান,বিদায় ভিয়েতনাম।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০০৮ সকাল ১১:৫৬