কারণ এই আলোচনা পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে ফেব্রম্নয়ারি মাসে রাওয়াল পিণ্ডিতে আমন্ত্রণ জানালে শেখ মুজিব সেটা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি স্পষ্ট করেই বলে দেন যে, তিনি আর পশ্চিমে যাবেন না। সত্যিই নির্বাচনে জনগণের রায় অর্জিত হওয়ার পর শেখ মুজিব আর কখনওই পশ্চিমের পথে পা রাখেননি। বরং ইয়াহিয়া ও ভুট্টোকে পূর্ব পাকিসত্দানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছেন, তিনি এদেরকে "বাংলাদেশের মেহমান" বলেই মনে করেন। লে. জেনারেল গুল হাসান তার স্মৃতিকথার একটি অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন "শেখ সাহেবের পূর্ণ কতর্ৃত্ব"। তিনি এই অধ্যায়ে মার্চ মাসে শেখ মুজিবের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি বিশদ বর্ণনা করেছেন। আমার পাঠকের ধৈর্যচু্যতি ঘটিয়ে আমি এসব উদ্ধৃতির বিশদ এখানে তুলে ধরবো না। কিন্তু কিছু বিশেষ উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের নিবন্ধের ইতি টানবো।
লে. জেনারেল গুল হাসান লিখেছেন, "2 মার্চ সেনা বাহিনীকে জনতার মুখোমুখি করার পেছনে প্রধান ভ্থমিকা ছিল শেখ-এর। 2 ও 3 মার্চ ভারী ৰয়ৰতি হয় জনতার। সেদিন শেখ উপলব্ধি করেন যে, পশ্চিম পাকিসত্দান থেকে সৈন্য আসা বন্ধ না হলে তার অনুসারীরা অত সহজে আর রাসত্দায় নামবে না। কাজেই তিনি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে বললেন, পশ্চিম পাকিসত্দান থেকে সৈন্য আনা বন্ধ করতে হবে। 4 মার্চ তার অনুগামীরা ঢাকা শহরে তৎপর সৈন্যদের দমাতে না পারায় শঙ্কিত হন শেখ। তিনি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে হুমকি দেন যে, ঢাকা শহর থেকে সৈন্য প্রত্যাহার না করলে তার অনুগামীরা তাদের মোকাবিলা করবে। তাকে প্রশ্ন করা হয়, আইন-শৃঙ্খলা কে ফিরিয়ে আনবে। তিনি জবাব দেন যে, আধা সামরিক বাহিনী আর পার্টির নেতৃস্থানীয় লোকেরা এ কাজে ব্যবহৃত হবে। .. .. 1970 এর নশ্বেওে এক অভ্থতপূর্ব সাইকোণ হয় পূর্ব পাকিসত্দান।ে 10 লাখ লোক মারা যায়। কয়েকজন বাঙালি নেতা দাবী করেন যে, মাত্র তিন সপ্তাহ পরে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা তা স্থগিত করা হোক। জবেব গর্জে ওঠেন শেখ, নির্বাচন যদি বানচাল করা হয় তাহলে প্রয়োজনবোধে 10 লৰ নিহত নরনারীর মৃতু্যঋণ শোধ করার জন্য আরও 10 লৰ লোক জীবন দিয়ে হলেও বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের জনগণকে মুক্ত করবে। 1971 সালের ফেব্রম্নয়ারিতে শেখ বার বার ঘোষণা করেন যে, বাঙালিরা রক্ত দিতে শিখেছে। কেউ আর তাদের থামাতে পারবে না। সব দিকেই জয় হয় শেখ মুজিবের। তিনি সেনা বাহিনী আর তার অনুগামী জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়েছেন। পূর্ব পাকিসত্দানে সৈন্য প্রেরণ বন্ধ করিয়েছেন এবং সবচেয়ে সুখপ্রদ বিজয় হচ্ছে এই যে ঢাকার আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বতা অতঃপর তারই হয়ে যায়... .... পূর্বাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টার যেভাবে শেখ মুজিবের প্রত্যেকটি দাবি মেনে নিচ্ছে তাতে জুনিয়র অফিসাররা বিভ্রানত্দ। তারা বিরক্ত। তারা জানে না যে, সবকিছু কে চালাচ্ছে, সামরিক সরকার নাকি আওয়ামী লীগ"।
একই কথা লিখেছেন, মেজর জেনারেল ফজলুল করিম, তিনি তার পাকিসত্দানস ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ গ্রন্থে লিখেছেন, "এটা ছিল একটা কৌশলগত ভুল। আর্মি ক্যান্টমেন্টে ফিরে যাওয়ায় জনতা ও তাদের নেতা উলস্নসিত হয়। তারা স্বভাবতই ধরে নেয় যে, সৈন্যরা পালাচ্ছে, এ কাজটিকে একটা দুর্বলতা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।" কিন্তু জেনারেল গুল হাসান জেনারেল মুকিমের সঙ্গে একমত নন বলে জানান যে, "তিনি যেটাকে কৌশলগত ভুল বলেছেন তার ফলে শেখ নতুন ও উচ্চতর মর্যাদা অর্জন কএবং তার অনুগামীদের সাহস বেড়ে যায়।" শেখ মুজিবের জন্য এই অচলাবস্থা সৃষ্টি ও পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনাটা সর্বাধিক প্রয়োজন ছিল কারণ তিনি জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসেবে যদি পাকিসত্দানী শাসকগোষ্ঠীর (যাদেরকে তিনি নিজে আগ্রাসী ও জবরদখলকারী হিসেবে জনসম্মুখে উলেস্নখ করেছেন) ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করতে না পারেন তাহলে জনমনে হতাশার জন্ম নেবে এবং তারা যে গোপন নির্দেশে সর্বাত্মক যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করছে সেটাও বানচাল হবে। তিনি একই সঙ্গে জনগণকে পথে নামান, অফিস-আদালত অচল করে দেন এবং পূর্ব পাকিসত্দানের সামগ্রিক দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে ধানমণ্ডির বত্রিশ নাম্বারের বাড়ি থেকে 'বাংলাদেশ' পরিচালনা করতে থাকেন এবং সেখান থেকে বেরিয়েই 7ই মার্চের ভাষণে জনগণকে দিক-নির্দেশনা দেন।
7ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কে আমরা আবার আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর গ্রন্থেও দ্বারস্থ হবো। তিনি লিখেছেন, " প্রথমতঃ উপসংহারে (বক্তৃতার) শেখ মুজিব বলিলেন, আজিকার সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, আজিকার সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,। দ্বিতীয়তঃ কিছুদিন ধরিয়া তিনি সব বক্তৃতা শেষ করিতেন এক সঙ্গে জয় বাংলা ও জয় পাকিসত্দান বলিয়া। এই দিনকার সভায় প্রথম ব্যতিক্রম করিলেন। শুধু জয় বাংলা বলিয়া বক্তৃতা শেষ করিলেন।" এবং 7ই মার্চের পরে শেখ মুজিবের অবস্থান যে সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল সে কথা রাও ফরমান আলী লিখেছেন এভাবে _ শেখ মুজিবের মতে ছয় দফার তত্ত্ব তখন পুরোনো ও অচল হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে এবার তিনি যে প্রসত্দাব দিলেন তা ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিসত্দানের কনফেডারেশন গঠন করার প্রসত্দাব", যার প্রধান শর্তদ্বয় হচ্ছে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিসত্দানের প্রধানমন্ত্রীদের কাছে ৰমতা হসত্দানত্দর এবং পৃথক পৃথক সংবিধান প্রণয়নের জন্য অধিবেশন আহ্বান। রাও ফরমান আলীর মতে, "শেখ মুজিব আরও অগ্রসর হয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কথিত মানবাধিকার অস্বীকারের ব্যাপারে হসত্দৰেপের আবেদন জানিয়ে জাতিসংঘের সেক্রেচারি জেনারেল উথান্টের কাছেও চিঠি লিখেছিলেন" _ আসলে এর পরে আর কিছুই বাকি থাকে না। একদিকে দেশের জনগণকে নির্বাচন, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন (পল্টন ময়দানে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে যে ছায়া সরকার গঠন করেছিলেন), সেই সরকারের নির্দেশে দেশ পরিচালনা এবং সেই সরকারের পৰ থেকে জাতিসংঘ জেনারেল সেক্রেটারিকে সেটা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেওয়া যে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন একটি দেশ জন্ম নিয়েছে, যা জাতিসংঘের স্বীকৃতির অপেৰায় রয়েছে _ এর পরে একটি দেশ ও জাতির স্বাধীনতার জন্য করণীয় আর কিছুই কি বাকি থাকে? যুদ্ধকালীন বন্দী শেখ মুজিবের জন্য জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের উদ্বেগ ও তাকে হত্যা না করার জন্য পরিচালিত কর্মকাণ্ড একথাই প্রমাণ করে যে, বন্দী হওয়ার আগে বাঙালির নেতা শেখ মুজিব যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তাকে পত্র দিয়েছিলেন সেটাই ছিল মহাসত্য, এর চেয়ে বড় কোনও সত্যকে মেনে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
শেষ করার আগে সেই পুরোনো কথাটিতে ফিরে যাই, শেখ মুজিব এ কারণেই পাকিসত্দানী কতর্ৃপৰের হাতে ধরা দিয়েছিলেন যে, একদিকে বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার গঠনের মাধ্যমে পাকিসত্দানীদের দখলদারী শক্তি হিসেবে বিশ্বের সামনে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে, বিশ্ববাসীকে এও জানানো হয়েছে যে পাকিসত্দানী সামরিক বাহিনী বাঙালির ওপর অস্ত্র প্রয়োগ করতে যাচ্ছে, অপরদিকে বাঙালিকেও প্রস্তুত করা হয়েছে রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবে এবং তৃতীয়তঃ ভারতে পালিয়ে আশ্রয়গ্রহণকারী একজন গেরিলা নেতা শেখ মুজিবের চেয়ে পাকিসত্দানের কারাগারে বন্দী বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবের শক্তিতে আকাশ-পাতাল ফারাখ থাকবে এবং পরবতর্ীতে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। শেখ মুজিব একথাটিই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, পাকিসত্দান গঠিত হয়েছিল শতকরা 95 ভাগ বাঙালির প্রত্যৰ ভোটে আর পাকিসত্দান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশও গঠিত হয়েছে শতকরা 98 ভাগ বাঙালির প্রত্যৰ ভোটে _ মাঝখানে পাকিসত্দানী সেনা বাহিনীর অস্ত্র ও শক্তি প্রয়োগ ছিল নিতানত্দই অনাকাঙ্খিত ঘটনা এবং বাঙালিও অস্ত্রের ভাষাতেই তার জবাব দিয়েছে (সেই অর্থে বাকি দুই ভাগ বাঙালিই পাকিসত্দানের বিরোধিতা করেছিল এবং দুঃখজনক ভাবে এই দুইভাগই এখন রাষ্ট্র ৰমতায়); বন্দী শেখ মুজিব এটা প্রমাণ করেই বিজয়ীর বেশে পাকিসত্দানের কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন আর বাঙালি জাতি লাভ করেছিল তার কাঙ্খিত স্বাধীনতা, সত্যিকার অর্থে যে স্বাধীনতা এসেছিল 70-এর নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়েই। অর্থাৎ একথা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাঙালি ভোটের মাধ্যমেই পাকিসত্দান গড়েছিল আবার ভোটের মাধ্যমেই পাকিসত্দান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল _ চরিত্রগত ভাবেই বাঙালি গণতন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সে কারণেই একজন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক নেতা ও প্রশ্নাতীত ভাবে বাঙালি জাতির পিতা।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০০৬ বিকাল ৫:৪৩