ইতিহাস প্রশ্নহীন নয়, ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন না তোলা হলে তা প্রামাণ্য হয় না। কারণ ইতিহাসের যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ্ থাকে সেগুলো প্রশ্ন না ওঠা পর্যনত্দ মীমাংসিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু কিছু কিছু ধ্রম্নব ও ইতিহাস-প্রামাণ্য ঘটনাবলী রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন তোলা হলে প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য নিয়েই যে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করবেন। যেমন কেউ যদি এখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের খলনায়ক হিটলারের আগ্রাসন নিয়েই প্রশ্ন তোলেন কিংবা বাবর-হুমায়ুন-আকবরকে মোঘল সম্রাট কি না সন্দেহ প্রকাশ করেন সেৰেত্রে প্রশ্নকারীর প্রতি করম্নণাই হবে। কিন্তু একেবারে সদ্য যা ইতিহাস হয়েছে, যে ইতিহাসের প্রত্যৰদশর্ী কিংবা ইতিহাস-নির্মাণের কলাকুশলীদের কেউ যখন এখনও জীবিত রয়ে গিয়েছেন সেই ইতিহাস বলার জন্য তখন তার কয়েকটি দিক মীমাংসিত হওয়া উচিত, কিংবা অন্যকথায় সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত অনেক বেশি যাতে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় অতি দ্রম্নত এবং আসছে প্রজন্ম তার জাতীয় ইতিহাসকে প্রশ্নহীন ভাবেই গ্রহণ করতে পারে। পাঠক এতোৰণ নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমি কোন্ ইতিহাসের কথা বলছি, হঁ্যা একাত্তর, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের কথাই বলছি। এই ইতিহাস বয়সে যেমন নবীন, তেমনই একে বিকৃতি ও অতিরঞ্জনের চেষ্টাও উদগ্র, নিজের কোলে ঝোল টেনে গোটা ইতিহাসকেই পাল্টে দেওয়ার এই অপচেষ্টায় অনেকেরই বিবমীষা হওয়ার কথা। আজকের নিবন্ধে আমি আমাদের স্বাধীনতা-ইতিহাসের একটি বহুল উচ্চারিত প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করবো। প্রশ্নটি আর কিছুই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-ইতিহাসের শ্রষ্ঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কিত। শেখ মুজিব-বিরোধীদের অনেকের মুখেই আজকাল আকছার শোনা যায় যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন পাকিসত্দানের প্রধানমন্ত্রী হতে। তারা যুক্তি দেন যে, যদি স্বাধীনতাই চাইবেন তাহলে তিনি কেন পাকিসত্দানীদের হাতে ধরা দিয়েছিলেন? কেন তিনি আগে থেকেই পালিয়ে যাননি? বাংলাদেশের স্বাধীনতা-ইতিহাসে এই প্রশ্নটি ভাইটাল, সন্দেহ নেই এবং এর উত্তর জানাটা আমাদের জন্য অত্যনত্দ জরম্নরী। জরম্নরী এ কারণে যে, যে ব্যক্তি একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক পর্যায়ক্রমের ভেতর দিয়ে একটি জাতিকে প্রথম বারের মতো স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দিয়েছেন তিনি শেখ মুজিব। শেখ মুজিব সেই ৰণজন্মা ব্যক্তিদের একজন যিনি একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা এবং তারই ভিত্তিতে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফলতম, তার আগে কিংবা পরে অর্থাৎ এখনও পর্যনত্দ কারো পৰেই এরকম কোনও বিজয় অর্জন সম্ভব হয়নি। বিশ্ব-ইতিহাসে তাই শেখ মুজিব শুধু বাঙালি জাতির পিতা নন, একজন আপোসহীন, গণতান্ত্রিক, সংগ্রামী ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। শাসক শেখ মুজিব সম্পর্কে অনেকেরই অনেক রকম দ্বিধা থাকতে পারে কিন্তু 1947 থেকে 1971 সময়কাল পর্যনত্দ যে শেখ মুজিবকে আমরা দেখি তাতে তার পরিচয়টা পূর্বোক্ত বাক্যেও শেষাংশের যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ বহন করে। গোটা আলোচনায় আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, শেখ মুজিব নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, তিনি ইতিহাসের পাদটীকা নন। এটি এ জন্য বলা যে, দীর্ঘ প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তিনি বাঙালির রাজনীতির সঙ্গে চলেছেন এবং বেশিরভাগ সময়ই হালটা তার হাতেই ছিল। ফলে ইতিহাসের আদলটা তিনি নিজেই গড়ে দিয়েছিলেন, এখন সেই আদলটাই আমাদের ব্যাখ্যায় উঠে আসবে, অন্য কিছু নয়। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা আইয়ুব খানের পদত্যাগ ও ইয়াহিয়া খানের ৰমতা দখল, অর্থাৎ 1969 সালের 25শে মার্চ থেকে একাত্তরের 25শে মার্চের কালরাত্রি পর্যনত্দ সময়টাকে বিশেস্নষণ করবো। পাকিসত্দানের কারাগারে শেখ মুজিব ও বিশ্ববাসী সে সম্পর্কে কি ভাবছে সে বিষয়েও দু'একটি তথ্য এখানে হাজির করবো সেৰেত্রে এই নিবন্ধ-বিষয়ের সময়কালটা হচ্ছে 1969-1971। এখানে একটি বিষয় লৰ্যনীয় যে, আইয়ুব শাহীর হাত থেকে ইয়াহিয়ার ৰমতা গ্রহণ কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। গণ-আন্দোলনের মুখেই আইয়ুব শাহীকে ৰমতা হসত্দানত্দর করতে হয়েছে। যে গণআন্দোলনের অগ্রগামী নেতৃত্বে ছিল পূর্ব পাকিসত্দান এবং বলাই বাহুল্য যে, পূর্ব পাকিসত্দান মানেই হচ্ছে শেখ মুজিব। ফলে আইয়ূব শাহীর এ ধরনের পদ্যাগ সেনা বাহিনীর মনে জন্ম দিয়েছিল বড় ধরনের হীনমন্মন্যতার। কারণ সেনাবাহিনীর অভ্যনত্দরে আইয়ূব খানের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা অনত্দতঃ ইয়াহিয়া খানের চেয়ে বেশি ছিল। তাই সেনা বাহিনীর জুনিয়র অফিসারবৃন্দ আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের যাতে ফাঁসি দেওয়া হয় সেটাই চেয়েছিল। অনেক সেনা কর্মকর্তা পরে তাদের লিখিত বই কিংবা আত্মজীবনীতে বার বার আৰেপ করে বলেছেন যে, শেখ মুজিবকে তখন ফাঁসির দড়িতে না ঝোলানো ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবের অব্যাহতি লাভ এবং আইয়ূব খানের ৰমতা হসত্দানত্দর _ এই দু'টি বিষয়ই পাকিসত্দান সেনা বাহিনীর জন্য ছিল বড় ধরনের অপমান এবং তারা একে সেনা বাহিনীর মনোবল ভঙ্গের জন্যও দায়ী করে থাকেন। যেমন জেনারেল রাও ফরমান আলী তার হাও পাকিসত্দান গট ডিভাইডেড গ্রন্থে লিখেছেন "..... সার্জেন্ট জহুরম্নল হকের মৃতু্য আগুনে বাড়তি ইন্ধন যোগায়। যেখানে যখনই কেন্দ্র দুর্বল হয়েছে সেখানে তখনই প্রাদেশিক শাসকরা নিজেদেও স্বাধীনতার পতাকা তুলে ধরেছেন _ মুসলিম ইতিহাসের এই দিকটির আরো একবার পুনরাবর্ৃত্তি ঘটলো। পশ্চিম পাকিসত্দানে আইয়ুবের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিসত্দানের রাজনীনিতকরা পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিলেন এবং তাদের নিজেদেও আন্দোলন শুরম্ন করলেন। সমগ্র দেশব্যাপী পরিচালিত আন্দোলনের পরিণতিতে আইয়ুব আহুত গোল টেবিল বৈঠক স্থগিত হয়ে গোে। মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার আগে এবং তাকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো না হলে পশ্চিম পাকিসত্দানী নেতৃবৃন্দ গোল টেবিল বৈঠকে অংশ নিতে অস্বীকার করলেন। এভাবেই মুজিব নেতাদের নেতায় পরিণত হলেন। তাকে এক অসমীচীন গুরম্নত্ব দেওয়া হলো এবং এর ফলে পূর্ব পাকিসত্দানে তার অবস্থান আরও ওপরে উঠে গেলো। " মোটকথা পরবতর্ীতে এ নিয়ে অনেক পাকিসত্দানীদেরই আৰেপ করতে দেখা গিয়েছে যে, কেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হলো না, এবং সেটা কার্যকর করা গেলে পূর্ব পাকিসত্দান কখনওই ভাঙতো না। যদি পাকিসত্দানীদের বিশেষ করে পাকিসত্দান সেনা বাহিনীর জন্য ওটা একটি বিরাট ভুল হয়ে থাকে তাহলে বাঙালির জন্য সেটা ছিল সবচেয়ে বড় লাভ কারণ এরপর বাঙালিকে এবং বাঙালির নেতা শেখ মুজিবকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি যে সত্যি সত্যিই 'নেতাদের নেতায়' পরিণত হয়েছিলেন তা আর বলার অপেৰা রাখে না। এরপর তিনি একের পর এক বিজয় অর্জন করেছেন। তিনি নির্বাচনের প্রশ্নে ইয়াহিয়াকে বাধ্য করেছেন, নির্বাচন নিয়েও টালবাহানা কম হয়নি এবং পাকিসত্দান সেনা বাহিনীর পৰ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা হয়েছে ছয় দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারী আওয়ামী লীগ যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় সে জন্য। জাতীয় ইসলামপন্থী দলগুলোকে দেদারছে অর্থ দিয়ে নির্বাচনে প্রচারণা চালানোর সুযোগ দান এবং সেই সঙ্গে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ঘটানোরও পরিকল্পনা গ্রহণ করে সামরিক সরকার। যেমন আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর গ্রন্থে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ". . . ইয়াহিয়া সহ পশ্চিমা নেতারা আশা করিয়াছিলেন যে, 1) সব দল না হইলেও বেশির ভাগ দলই কিছু কিছু আসন পাইবে। 2) যতোই জনিপ্রয় হোক আওয়ামী লীগ ন্যশনাল এ্যাসেমবিস্নর পূর্ব পাকিসত্দানের ভাগের 169টি আসনের মধ্যে একশর বেশি আসন পাইবে না। 3) বাকি আসনগুলির অধিকারী জমাতে ইসলামী, নিযামে ইসলাম ও দুই তিনটা মুসলিম লীগের সকলেই স্ট্রং সেন্টারের শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপাওে পশ্চিমা পার্টিগুলির সাথে থাকিবেন। এমনকি সরকার গঠনেও ব্যাপারেও তারা আওয়ামী লীগের চেয়ে পশ্চিমা দলগুলির সাথেই কোয়ালিশন করিবেন" _ এবং এর ভিত্তিতেই তারা এসব তৃতীয়পন্থী দলগুলিকে দেদারছে অর্থ জোগান দিয়েছে। যে অর্থ জেনারেল রাও ফরমান আলী স্বয়ং বন্টন করেছেন করে তার গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন। যেমন রাও ফরমান আলী তার গ্রন্থে লিখেছেন যে, "যেহেতু পাকিসত্দানের অসত্দিত্বেও প্রশ্ন জড়িত রয়েছে, তাই নির্বাচনকে পাকিসত্দানের প্রতিরৰার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। পাকিসত্দান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনগণের ভোটে, সেই জনগণের ভোটেই এর ভাঙনও ঘটতে পারে (পাঠককে এই মনত্দব্যটি বিশেষ ভাবে মনে রাখার অনুরোধ জানাই। আমার নিবন্ধের মূল কথাও এটিই) পাকিসত্দানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রৰার দায়িত্ব যাদেও ওপর ন্যসত্দ রয়েছে, তাদের উচিত পরিস্থিতির প্রেৰিতে দেশের সংহতির প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী সকল অভ্যনত্দরীণ ও বৈদেশিক শক্তির বিরম্নদ্ধে পদৰেপ গ্রহণের মাথ্যমে প্রতিরৰা নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সরকার অবশ্যই নিরপেৰ থাকবে। কিন্তু 1970-এর নির্বাচন কোনও স্বাভাবিক বিষয় থাকছে না। এতে একটি প্রধান রাজনৈতিক দল দেশের ভাঙন ঘটানোর উদ্দেশ্যে জনগণের রায় চাচ্ছে। পাকিসত্দানকে রৰা করতে হলে এই দলটির ৰমতায় আসার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে আমি প্রসত্দাব করি, দ্বিতীয় সত্দরের বাহিনীর জন্য প্রাপ্ত তহবিলের অর্থ থেকে পাকিসত্দানপন্থী দলগুলোকে সাহায্য দেওয়া হোক"_ তিনি অবশ্য অস্বীকার করেছেন যে, কোনও সাহায্য দেওয়া হয়নি কিনত্দু সেটা পাকিসত্দানী জেনারেলদের মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই নয়, যতোদূর জানা যায় তাতে জঙ্গি শাসক এইসব তৃতীয় কাতারের দলগুলিকে বিপুল অর্থ সাহায্য তো করেইছিল সেই সঙ্গে নির্বাচন বিজয়ের জন্য অন্যান্য সহযোগিতা যেমন ভোট কারচুপি ইত্যাদির জন্যও সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছিল। কিন্তু বাঙালি জনগণের স্বতঃস্ফ্থর্ততা এবং নির্বাচনে যাতে কোনও প্রকার কারচুপি না হতে পারে তার প্রতি সজাগ ও সর্বময় দৃষ্টি রাখার ফলে তারা এই ষড়যন্ত্রে সফল হতে পারেনি। কারণ ছয় দফাকে সামনে রেখে নির্বাচনী প্রচারণায় শেখ মুজিব ও আওয়ামী নেতৃত্ব 1970-এর নির্বাচনকে গণভোট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ছয় দফাকে সামনে রেখে প্রচারণা যে একটি বড় ধরনের কৌশল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার লৰ্যে তা তখনই প্রমাণিত হয়েছিল। পাকিসত্দানের মধ্যে সকল প্রকার বৈষম্য তুলে ধরার মাধ্যমে পূর্বাংশের নিজেদের স্ব-অধীনতার ৰমতালাভের ইচ্ছাকে জাগিয়ে তোলাই ছিল ছয় দফার মূল লৰ্য, কিন্তু এই লৰ্যের পেছনেও যে অন্য লৰ্য সুপ্ত ছিল সেটা শেখ মুজিব নিজেই স্বীকার করেছেন পাকিসত্দানপন্থী এক সাংবাদিকের কাছে। পাকিসত্দানী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার অফিসার সিদ্দিক সালিক যেমন তথ্যটি তার উইটনেস টু সারেন্ডার গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন তেমনই গত বছর ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত ব্রিটিশ লেখক ওয়েন বেনিট জোনস্-এর পাকিসত্দান : আই অব স্টর্ম গ্রন্থেও এর উলেস্নখ রয়েছে এভাবে,
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০০৬ বিকাল ৫:২৯