somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমকালে প্রকাশিত একটি গল্প

১৮ ই মার্চ, ২০০৬ সকাল ৮:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেগমের জানাজা

নামটি তাহার বেগম, আগে পেছনে রহিমা, আমেনা কিংবা ফাতেমা কোনও কিছুই নাই, শুধুই বেগম। তাহাও জানা যাইতো না যদি বেগমের পুত্র দারা এলাকার বড় হুজুরের বিরম্নদ্ধে একটা মামলা ঠুকিবার জন্য থানা পর্যনত্দ না দেঁৗড়াইতো। এমনকি দারাও থানা পর্যনত্দ দেঁৗড়াইয়া যাইতো না যদি এলাকার একটি এনজিও তাহাকে পরামর্শ না দিতো যে, তাহার মাকে জানাজা না পড়াইয়া বড় হুজুর অন্যায় করিয়াছে; পনের বৎসর আগে বেগমের জীবনে কী ঘটিয়াছিল সে কারণে তাহাকে কবরে শুয়াইবার পূর্বে পৃথিবীর সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক কর্মটুকু সম্পাদন না করিবার কোনও অর্থই থাকিতে পারে না। এসব নানাবিধ কারণেই মানুষে, এমনকি সংবাদপত্রের কল্যাণে গোটা দেশই জানিতে পারিয়াছিল যে, যে মরিয়া গিয়াছে তাহার নাম বেগম, মৃতু্যকালে যাহার বয়স হইয়াছিল পঞ্চাশ বৎসর।
বাঙালি নারীর বিশেষ করে অশিৰিত গ্রাম্য নারীর নামের প্রয়োজন ফুরাইয়া যায় বিবাহ হইবার পর পরই। স্বামীর পরিচয়ের সঙ্গেই মেয়েটি পরিচিত হইতে থাকে, খালেকের বউ কিংবা 'মাইজ্যা ভাবী' এবং তাহার পরে দারার মা এবং তাহারও পরে নাসিরের দাদী হিসেবেই বেগমের মরিয়া যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সমসত্দ গোল বাঁধাইলো বড় হুজুরের দেওয়া ফতোয়া।

বিবাহিত জীবনে বেগমের সুখ কিংবা অসুখ কেমন ছিল তাহা জানা যায় না, জানার প্রয়োজনও নাই। তাহার স্বামী আব্দুল খালেক দিন মজুর, এলাকার জমির মালিকদিগের ৰেতে মজুর খাটিয়াই সংসার প্রতিপালন চলিতো। তাহাতে সংসার যে চলিতো সে কথা বলা যায় না, কারণ সংসার চলা অথবা থামিয়া থাকা কোনওটাই বাহির হইতে বুঝিবার কোনও উপায় নাই।

তবে একথা সত্যি যে, জীবন ঠিকই চলিয়া যাইতো, কোনও বেলা খাইয়া, কোনও বেলা উপোস দিয়া; বর্ষায় বৃষ্টি, আশ্বিনে বন্যা, বৈশাখে ঝড়, মাঘে শীত _ এই সব কিছুই উপেৰা করিয়া জীবনটা কাটিয়া যাইতো। কিন্তু এর চেয়েও বড় সত্যি কথা হইলো, এসব কোনও কিছুই আব্দুল খালেকের জৈবিক চাহিদাকে দমাইয়া রাখিতে পারে নাই। পেটে দানা না পড়িলেও রাতে বিছানায় শুইয়া বউয়ের ওপর চড়িয়া বসিতে খালেকের কখনও অনীহা দেখা যায় নাই, বরং ৰিদা পেটে থাকিলেই দুই পায়ের মাঝের বাড়তি অঙ্গটার তাগদ বুঝি বাড়িয়াই যাইতো। যতোৰণ সেই তাগদ শরীর জুড়িয়া থাকিতো ততোৰণ ৰিদার কষ্টটাও বুঝি ভুলিয়া থাকা যাইতো।

এতো গেলো আব্দুল খালেকের ৰিদার কথা। কিন্তু বেগমের অবস্থাটা কী? না খাইতে পাইয়া, মানুষের বাড়িতে কাজ করিতে করিতে কিংবা দিনমান রোদ মাথায় নিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে বেগমের শরীর ভাঙিয়া যাইবার কথা ছিল। উপরনত্দু বিবাহের প্রথম বছরের মাথায়ই যখন তাহার কুড়ে ঘর আলো করিয়া পুত্র দারা আসিয়া পড়ে তখন সকল কষ্টই ভুলিয়া গিয়া তাহাকে লইয়া কিছুদিন বেশ আনন্দেই কাটিয়াছিল। কিন্তু তাহার পরে দুই পেট যখন তিনটা হইলো তখন আনন্দে খানিকটা ভাটা পড়িলেও বেগমের শরীরে ভাটার টান দেখা গেলো না।

এমনকি যখন তাহার দ্বিতীয় পুত্র মনিরের জন্ম হইলো তখন তাহার বয়স এক কুড়ি ছাড়াইয়া গেছে; এই হিসাব অবশ্য তাহার নয়, আড়াপাড়াপ্রতিবেশীর। কিন্তু তাহাতে কী, আব্দুল খালেকের জৈবিক জোশ্-এর কারণেই হোউক অথবা আলস্নাহ্র কুদরতেই হোউক একে একে তাহাদের ঘরে পাঁচটি ছেলে-মেয়ের জন্ম হইলো। ততোদিনে বেগম পঁয়ত্রিশে পেঁৗছাইয়া গিয়াছে। আর আব্দুল খালেকেরও তখন বয়স প্রায় আড়াই কুড়ি বৎসর।

আর ঠিক সেই সময়ই এলাকায় কালো ডাক্তারি বাঙ্ হাতে লোকের যাতায়াত যেনো হঠাৎ করিয়াই বাড়িয়া গেলো। প্রথমে সবার ঘরে একটা করে বিজ্ঞাপন ধরাইয়া দেওয়া হইলো, তাতে একটা মহিলা আর পুরম্নষের কোলে দুইটা শিশুর ছবি, তাহার নীচে কী লেখা আছে তাহা কেহই পড়িতে পারিলো না; পড়িতে জানিলে তো পড়িবে। ফলে সেইসব ছাপার অৰরের বিজ্ঞাপনে কিছুই হইলো না।

তাই দেখা গেলো কিছুদিন পরে শাড়ির ওপর শাদা একখানা আলখালস্নামতো পরিয়া মহিলারা এলাকায় আসিয়া মহিলাদেরকে ফুঁসলাইতে শুরু করিলো। প্রথমে তাহারা আসিয়া ঘরের দাওয়ায় বসিতো, বেগম তখন হয়তো গোবর দিয়া উঠোন লেপিতেছে।

''উঠান ল্যাপোনি দারার মা? কি রইদে দিবা?''_ অলখালস্নাওয়ালীর প্রশ্ন।

ঃ কী আর রইদে দিবো আফা, রইদে দেওয়ার কিছু আছেনি, হেই কপাল লইয়া কি দুন্ন্যায় আইছি? _ বেগমের আৰেপ টুকরো টুকরো হইয়া উঠোনময় ছড়াইয়া পড়িতো।

ঃ এখন নাই তো কী হইছে, পরে হইবো। আলস্নায় দিলি তোমার তিন তিনটা পোলা, ডাঙ্গর ওইয়া কামাই কইরা আনার আর বেশি তো দেরি নাই। তুমি কও কি, মনে দুঃখ রাইখো নাগো বইন।

ঃ নাহ্ দুঃখু কইরা আর কী হইবো কন আফা? আপনেতো কইলেন বড় ওইয়া কামাই করবো, কিন্তু বড় তো করা লাগবো, নাকি? দুইবেলা দুইমুঠ ভাত তুইলা দিবার পারি না পাতে, পাঁজরের হাড্ডি গুনা যায় এহন না খাইতে খাইতে_ আবারও বেগমের দীর্ঘশ্বাস গোটা উঠোনের বাতাসটাকেই ভারি করিয়া তোলে, আর ঠিক তখনই আলখালস্নাওয়ালি আসল কথাটা পাড়িয়া ফেলে।

ঃ ও দারার মা, আবার মাসিক বন্ধ ওইছেনি তোমার? মুখটা জানি কেমুন ফোলা ফোলা লাগে?

ঃ নাগো আফা, এইতো পরশুই শুরম্ন ওইছে, আমাবইশ্যা চলে তো, শইরলে ব্যাদনা, তাই মনে হয় মুখটা ফুলা ফুলা লাগে।

ঃ ওইবার পারে। কিন্তু তুমারে তো আগেই কইছি আরেকবার মাসিক বন্ধ হওয়ার আগে নাড়িটা কাইটা ফালাও। আর ও ঝামেলায় যাইও না। পাঁচটারেই খাওয়াবার পারো না, আরও যদি আসে তাইলে খাওয়াবা কী?

ঃ সেইটা কি আর আমি বুঝি না আফা? আপনে কী কন? আমি বুঝি, সবই বুঝি। কিন্তু ইসলামে যে মানা আছে, বেডিগো শইরলে অস্ত্রর ছুঁয়ানো মানা। আর আলস্নায় যা দিবার চায় তার আসার পথ বন্ধ করা বলে কবিরা গুনাহ্?

ঃ তোমারে কে কইছে এসব? কবিরা গুনাহ্ তো হইলো এই পৃথিবীতে একজন মানুষরে আইন্যা তারে ঠিকমতো খাওয়াইতে পরাইতে না পারা, তারে কষ্ট দিয়া আবার মাইরা ফালানোর চাইতে তারে না আনাই ভালা না নি?

ঃ মাইনষে যে কতো কথা কয়. নাড়ি কাটা বলে হারাম? নাড়ি কাটলে বলে কোনও দিনই বেহেশতে যাওন যাইবো না? খুঁইতা মাইয়া মাইনষেরে বলে বেহেশতে ঢুকপার দিবো না?

ঃ তুমি খুঁইতা কও কারে? কিয়ের খুঁৎ? তোমার শইরলে কুনও চিহ্নও থাকবো না। শুধু ওই নাড়িটা কাইটা একটা গিঁট দিয়া দিবো যাতে তোমার স্বামীর বীর্য তোমার ভিতরে না যাইতে পারে। ওই বীর্য গিয়াইতো বাচ্চার জন্ম দেয়।

ঃ হুনছি ওই বীয্য ভিতরে ডুকতে না পাইরা আলস্না আলস্না করবো আর আলস্নার কাছে পানাহ্ চাইবো। তারা যতোৰণ না মরবো ততোৰণ ধইরা বলে আমার বিরম্নদ্ধে আলস্নাহ্র কাছে নালিশ জানাইতে থাকবো? আর হেই গুনা নাকি মাফ হইবো না?

ঃ এসব কথা তোমারে কে কইছে দারার মা? যারা এসব কথা কয়, তারা মিছা কথা কয়।

ঃ আমি জানি না আফা। কে মিছা আর আর কে হাছা। আমারে দারার বাপে কইছে আপনারা আইলে আপনাগো লগে কথা না কইতে। কইছে আপনারা নাকি বেতন লইয়া বেডিগোর নাড়ি কাইটা দেন, যতো বেশি নাড়ি কাটাইতে পারবেন আপনারা ততো বেশি পয়সা পাইবেন, হাছা নি?

ঃ নাগো বইন হাছা না। আমরা বেতন লই, এইটা হাছা কতা কিন্তু আমরা কাউরে জোর কইরা নাড়ি কাটাই না। আমরা সবেরে বুঝাইয়া কই, রাজি ওইলে নাড়ি কাটাইতে লইয়া যাই, তারপর কিছুদিন দেহি তার কোনও অসুবিধা ওইছে কিনা, এপরেই আমাগো দায়িত্ব শ্যাষ।

আলখালস্নাওয়ালি তাহার কথা শেষ করেন একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে। সেদিনের মতো যে তিনি ব্যর্থ হইয়াছেন, বেগমকে যে তিনি বুঝাইয়া রাজি করাইতে পারেন নাই তাহা বুঝিতে তাহার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। কিন্তু বেগমের কথাটাতো মিথ্যা নয় যে, একেকজন মহিলাকে লাইগেশন নামের ওই ছোট্ট অপারেশনে রাজি করাইতে পারিলে তাহাদের মূল বেতনের ওপর প্রায় দুইশ টাকা বোনাস দেওয়া হইয়া থাকে, সেদিনের মতো তাহা হইলো না বলিয়া তাহার দুঃখটা বুঝি উথলাইয়াই ওঠে। সেদিনের মতো আলখালস্নাওয়ালি বিদায় লইয়া চলিয়া যান।

কিন্তু এলাকায় তাহাদের আনাগোনা থামিয়া থাকে না। এর আগেও পুরম্নষ আলখালস্নাধারীরা এলাকায় আসিয়া পুরম্নষদের বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। তাহারা বিনামূল্যে রাবারের টুপি বিতরণ করিয়াও গিয়াছেন, এমনকি কাষ্ঠ-তৈরি একটি শিশ্নবৎ দন্ডের গায়ে তাহা পরাইয়া দিয়া পুরম্নষদিগকে বুঝাইয়াও দিয়াছেন কী করিয়া তাহা ব্যবহার করিতে হয়। কিন্তু কেহই তাহা ব্যবহার করিয়াছে বলিয়া মনে হয় না। কারণ এলাকার মাঠকমর্ীদের দ্বারা তৈয়ার করা লিস্ট অনুযায়ী যেসব পুরম্নষকে ওই রাবারের টুপি পরিবার জন্য দেওয়া হইয়াছিল তাহাদের ঘর আলো করিয়া আবারও সনত্দান হওয়ায় এটা স্পষ্ট হইয়া যায় যে, বিনামূল্যে ওইসব রাবারের টুপি সেইসব পুরম্নষের শিশুদের ফানুষ উড়াইবার কাজেই ব্যবহৃত হইয়াছে। একজন আলখালস্নাধারীতো ইহাও স্বচৰে দেখিয়া আসিয়াছেন যে, এক বাড়ির কয়েকটি শিশু কয়েকটি রাবারের টুপি মধ্যে জল ভরিয়া বিমল আনন্দে খেলা করিতেছে, তাহাদের সরল মুখের দিকে তাকাইয়া তাহারও বাল্যকালের কথা মনে পড়িয়া গিয়াছিল, আহা তখন যদি এইসব রাবারের টুপি থাকিতো!

প্রশ্ন করিয়া জানা গিয়াছে যে, এই সব রাবারের টুপি ব্যবহার করিলে নাকি মিলন সুখের হয় না। তাছাড়া সব সময় তাহা পরিবার কথা মনেও থাকে না। মনে থাকিলেও তাহা পরিয়া বীর্য নষ্ট করিবার পাপ খন্ডাইবে কী দিয়া? সত্তর ফোঁটা রক্ত এক ফোঁটা বীর্যে পরিণত হইয়া থাকে, অতএব একবার মিলনের পরে যতোটুকু বীর্য নির্গত হয় তাহা হইতে কতো ফোঁটা রক্তের প্রয়োজন হয়? আলস্নাহ্র নির্দেশ হইতেছে এই বীর্য নারীর দেহাভ্যনত্দরে পতিত হইবে, কিন্তু তাহা না হইয়া যদি ইহা রাবারের জামার মধ্যে নষ্ট হইয়া যায় তাহা হইলে ইহার চাইতে বড় পাপ আর কী হইতে পারে? সুতরাং বহু চেষ্টা করিয়াও কোনও পুরম্নষের শিশ্নে রাবারের টুপি পরানোয় সফলতা্ অর্জন করিতে পারিলো না কেহ, না সরকার, না বেসরকারী সংস্থাগুলি। কিন্তু বাংলাদেশ টুপি পরা মাথায় ছাইয়া গেলো।

যাহা হোউক, ইহার পর একদিন আলখালস্নাওয়ালীরা নতুন এক প্রসত্দাব লইয়া বেগমের দরোজায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। তখন তাহাদের মনে যেনো খানিকটা বল সঞ্চার হইয়া থাকিবে কারণ সেই বল তাহাদের কথা-বার্তায় ফুটিয়া উঠিতেছিল। নতুন সেই প্রসত্দাবে বলা হইলো যে, যাহারা নাড়ি কাটাইয়া আসিবে তাহাদিগকে একখানা করিয়া কাপড় আর নগদ দুইশত করিয়া টাকা দেওয়া হইবে। এবং ইতোমধ্যেই কাহারা কাহারা এই কাজটি করিয়া আসিয়াছে তাহার একটা দীর্ঘ তালিকা বেগমের সামনে উপস্থিত করিলেন আলখালস্নাওয়ালীরা।

আলখালস্নাধারী পুরম্নষরাও আব্দুল খালেকের নিকটে আসিয়া বলিলেন যে, খালেক যদি তাহার পুরম্নষাঙ্গ হইতে বাহির হওয়া একটি ছোট্ট নাড়ি কাটিয়া ফেলিতে রাজি হয় তাহা হইলে তাহাকে একটি লুঙ্গি ও দেড়শত টাকা দেওয়া হইবে। কিন্তু খালেককে কোনও মতেই সেই প্রসত্দাবে রাজি করানো গেলো না। শুধু খালেক কেন এলাকার কোনও পুরম্নষই এই প্রলোভণে রাজী হইলো না, এমনকি ষাট বছর বয়েসী সোনা মিয়াও ইহা শুনিয়া আলখালস্নাধারীদের মুখের ওপরেই বলিয়া দিল, ''কবরে শুইয়াও খাড়া ধন দিয়া বাচ্চা পয়দা করিতে না পারালে পুরম্নষ জন্মে কিবা লাভ, তার চাইয়া নারী হওয়াও অনেক ভালো''। বোঝা গেলো, লুঙ্গি কিংবা নগদ অর্থের চেয়ে পুরম্নষের কাছে সনত্দান উৎপাদনের ৰমতা অনেক বেশি গুরম্নত্ববাহী, কারণ এটাই নাকি পৌরম্নষত্বের প্রতীক।

কিন্তু নারীর ৰেত্রে বিষয়টার ভিন্নতা লৰ্য করিয়া এলাকায় পুরম্নষ আলখালস্নাধারীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমিয়া গেলো। তাহাদের চাকুরি চলিয়া গেলো কি না তাহা অবশ্য জানা যায় না, এৰেত্রে নারীর চাহিদা বাড়িয়া যাওয়ায় এলাকারই বেশ কিছু নারীর চাকুরি হইলো। এমনকি প্রথম দিকে যে দুই এক জন নারী নাড়ি কাটাইয়াছিল তাহাদের কারো কারো চাকুরি হওয়ায় উৎসাহ আরও বাড়িয়া গেলো, কারো কারো মনে হইলো, যদি ইহার পর তাহাকেও এই সুযোগ দেওয়া হয় তাহা হইলে সেও অনেক নারীকে বুঝাইয়া নাড়ি কাটাইতে লইয়া আসিতে পারিবে। তাহারও শাদা আলখালস্না পরিয়া গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া বেড়াইবে এবং মহিলাদের নাড়ি কাটার জন্য উদ্বুদ্ধ করিবে।

বেগমকে যেদিন একজন আলখালস্নাওয়ালি তাহাদের গ্রাম হইতে সাড়ে পাঁচ মাইল দূরের ছোট্ট থানা শহরটাতে লইয়া আসিলো সেদিন বেগমের বুকের ভেতরটা ভয়ে আর পরিশ্রমে শুকাইয়া এতোটুকু হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু হাসপাতালে পেঁৗছানোর পর সেখানকার ডাক্তার ও নার্সগণ তাহার সঙ্গে যে ভালো ব্যবহারটুকু করিলো তাহাতে সে মুগ্ধ না হইয়া পারিলো না। মনে মনে ভাবিলো, আহারে তাহার ছেলেমেয়েদের কেউ যদি এরকম ডাক্তার কিংবা নার্স হইতো? কিন্তু তাহাতো হইবার নয়, ইতোমধ্যেই তো তাহার ছেলেমেয়েরা ৰেতে-খামারে কাজ আরম্ভ করিয়া দিয়াছে, সেখান হইতে তাহাদের ফিরাইয়া আনিবার তো কোনও উপায় আর নাই।

এসব ভাবিতে ভাবিতেই বেগম শাদা চাদর বিছানো একটা বিছানার ওপর শুইয়া পড়িলো এবং দুই দিকে দুই পা উঠাইয়া দম বন্ধ করিয়া পড়িয়া রহিলো। কতোৰণ কী হইলো তাহার মনে নাই, কিন্তু যখন সে আবার সবকিছু ঠিকঠাক বুঝিতে শুরম্ন করিলো তখন সে নিজেকে দেখিতে পাইলো হাসপাতালের বারান্দায় একটা বেঞ্চিতে বসা অবস্থায়। একজন নার্স আসিয়া তাহার হাতে গাঢ় লাল পাড় আর পাড়ের চেয়ে একটু হালকা লাল রঙের জমিনের একখানি শাড়ি দিয়া বলিলো, ''আপনি বসুন, নার্গিস এুণি চলে আসবে। ওর বাড়িতেই আপনি আজ থেকে যাবেন। কাল ওই আপনাকে পৌছে দেবে বাড়ি। খবরদার আজ অতোটা পথ হাঁটতে যাবেন না যেন, তাহলে অসুবিধে হবে''।

নার্স মেয়েটির কথাগুলো বেগমের এতোটাই মিষ্টি লাগিলো যে, সে শেষের দিকে তাহার কথা শুনিতে পারিলো না, ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিলো। যদিও তাহার শরীরের ভিতরে তখনও একটা ব্যাথা মিশ্রিত ভোঁতা অনুভ্থতি কাজ করিয়া যাইতে ছিল। কিন্তু এটা সে আরও বেশি করিয়া বুঝিতে পারিলো যখন নার্গিস নামের আলখালস্নাওয়ালী আসিয়া তাহার বাড়িতে বেগমকে লইয়া যাওয়ার জন্য ধীরে ধীরে হাঁটিতে শুরম্ন করিলো। বেগমের তখন মনে হইতেছিল পৃথিবী আর আকাশ বুঝি এক হইয়া গিয়াছে, ইহাতে আর কোনওই পার্থক্য নাই। ইহাই কী তবে তাহার পারের শাসত্দি? এই প্রথম বেগমের মনে হইলো, নাড়ি কাটাইয়া সে যে পাপ করিয়াছে তাহাতে আর কোনওই সন্দেহ নাই।

এই নিঃসন্দেহ হওয়াটা তাহার বাড়ি আসিয়া অবধি মনের মধ্যে গিজগিজ করিতেছিল। তাই বেগম আগে যাহা করিতো না তাহাই শুরম্ন করিলো, সে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ধরিলো এবং কোনও অবস্থাতেই আর তাহা কাজা হইতে দিতো না। কিছুদিন নিজেকে সকলের হইতে আলাদা মনে হইলেও ধীরে ধীরে বেগম সকলের মধ্যে জীবনের মধ্যে মিশিয়া গেলো। গ্রামের কোনও ঘটনাই কাহারও কাছে গোপন থাকে না, বেগমের এই নাড়ি কাটিবার কথাও সবার জানা হইয়া গেলো। কেহ কেহ এটা নিয়া কথা বলিলেও কথা থামিতেও সময় লাগিলো না। কারণ ততোদিনে বেগমদের পাড়ার আরও দুই একজন ইহা করিয়া আসিয়াছে।
কিন্তু খানিকটা গোল বাঁধিলো বেগমের দুই মেয়ের বিবাহ দিবার সময়, তখন কেউ কেউ বেগমের এই নাড়ি কাটার বিষয়টি লইয়া ভাঙানি দিবার চেষ্টা করিলো বটে তবে তাহাতে কোনও বড় অসুবিধার সৃষ্টি হইলো না। যদিও তখন সময়টা বদলাইয়া গিয়াছিল, দেশটাও অনেকটাই বদলাইয়া গিয়াছিল। সময়টাও বেগমের জন্য থামিয়া থাকে নাই, আব্দুল খালেক গত হইয়াছে। তাহার তিন ছেলে এখন তিন সংসারে আলাদা হইয়া বসবাস করে। তাহাদের সনত্দানাদি হইয়াছে, বেগমের একটুখাটি ভিটায় এখন তিন তিনটা ঘর, তিনটা আলাদা চুলোয় তিনটা আলাদা হাঁড়িতে রান্না হয়। এসব দেখিয়া বেগমের কষ্ট হয় খুব।

আর সবচাইতে বেশি কষ্ট হয় দেশ আর দেশের মানুষের বদলানো দেখিয়া। বেগমের দিন দিনই ইহা মনে হইতেছিল যে, দেশটা যেনো আর আগের সেই দেশ নাই। বদলাইয়া গিয়াছে। আগে মানুষ ধার্মিক ছিল আর এখন যেনো মানুষ ধর্মকে লইয়া বেশি বাড়াবাড়ি শুরম্ন করিয়া দিয়াছে। আগে মানুষ আলস্নাহকে ভয় পাইয়া মনের ভেতর এবাদত করিতো আর এখন যেনো আলস্নাহকে নয়, অন্য কাহাকে বুঝিবা কোনও মানুষকে ভয় পাইয়া প্রকাশ্যে এবাদত দেখাইতে বেশি আগ্রহী হইয়া উঠিয়াছে। ছেলের বউরা বেগমকে ঠিকমতো খাবার দেয় না, কিংবা একটা শীত পাতলা ন্যাকড়ার মতো একখানা শাড়ি শরীরে জড়াইয়াই কাটিয়া যায় বেগমের তবু দুঃখ হয় না তার কিন্তু সময় বদলাইয়া যাওয়ায় বেগমের যেনো দুঃখের সীমা নাই।

এই সীমাহীন দুঃখ লইয়াই বেগম একদিন মরিয়া গেলো। ছেলেরা খানিকটা কাঁদিলো, মনের দুঃখ মাকে ঠিক মতো কোনওদিন খাওয়াইতে-পরাইতে পারে নাই, মেয়েরা আসিলো, মাকে বরই পাতা গরম জলে গোসল করাইয়া দিলো কাঁদিতে কাঁদিতে। কিন্তু তাহার পরই ঘটিলো সেই ঘটনা যাহা বেগমকে রাতারাতি দেশের সকলের কাছে পরিচিত করাইয়া দিলো।

বেগমের জানাজা পড়াইতে অস্বীকৃতি জানাইলো এলাকার মসজিদের বড় হুজুর। এমনকি এলাকার কবরস্থানে বেগমের দাফন করিতে দেওয়া হইবে না বলিয়া ফরমান জারি করা হইলো। বেগমের অপরাধ কী? পনের বৎসর আগে বেগম লাইগেশন করাইয়াছিল। হাদীস শরীফে বলা হইয়াছে, স্বামী ছাড়া অন্য কারো হাতে নারী শরীরের কোনও অঙ্গ-হানি ঘটিলে সেই নারী জানাজা পাইবার যোগ্য নহে, তাহার কবর কোনও ঈমানদার মুসলমানের পাশে হইতে পারিবে না।
বড় হুজুর এই কথা বলিয়া বেগমের জানাজা পড়াইলো না, কিন্তু লাশতো ফেলিয়া রাখা যায় না। তাই বেগমের বাড়ির পাশেই ছেলেদের এক চিলতে গম ৰেতের এক কোণে জানাজা ছাড়াই বেগমের কবর হইলো। বেগমের পার্থিব দুঃখগুলি একত্রিত হইয়া তাহার সহিত সেই গম ৰেতের এক কোণে কবরে ঢুকিয়া গেলো। ইহার পর বেগমের নাম বাংলাদেশের সংবাদপত্রের পাঠকগণ জানিলো কি জানিলো না তাহাতে কাহার কী আসিলো আর কী বা গেলো?
(প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের গল্পরূপ)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×