সে হিসেবে বিচার করে দেখতে গেলে 7ই মার্চ হচ্ছে ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রৰণ যে ৰণে একটি জাতি শৃঙ্খলাবরম্নদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি প্রত্যাশায় অস্ত্র হাতে নেওয়ার ডাক দেয়। এখানে শেখ মুজিব আসলে একজন বক্তা মাত্র, ইতিহাস-বিনির্মাণের নবী (পথ প্রদর্শক _ আরবি ভাষায় এই শব্দটির অর্থ তাই)। এবং আজকে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সে ইতিহাসের জনক তিনিই, তাই আজকের এই দিনে সকল শ্রদ্ধা বিনম্রচিত্তে তারই উদ্দেশে।
এবার এই বস্নগীয় দু'একটি বিষয় নিয়ে কথা। আমার শেষ লেখাটিতে আমি কতর্ৃপৰের কাছে একটা ব্যাখ্যা দাবী করেছিলাম (অনেকেই করেছেন), একটি উপন্যাসের দু'টি অধ্যায় মুছে দেওয়ার কারণ কী সেটাই জানতে চেয়ে। ধরে নিন, অধ্যায় দু'টির লেখক মাসুদা ভাট্টি নয়, অন্য কেউ। সেৰেত্রেও আমি একই দাবী জানাতাম সন্দেহ নেই, কারণ এখানে লেখক কে সেটা তুচ্ছ ব্যাপার, লেখকের কলম থেকে কী বেরিয়েছে সেটাই মূল বিবেচ্য। যে কারণে ব্যক্তি মওদুদী কী ছিলেন সেটা বিচারে না এনে তার বই পাঠে আমার যেমন কোনওই আপত্তি নেই তেমনই অন্য কারো হলে সেটা আমাকে সহ অন্য অনেককেই যথেষ্ট পীড়া দেবে বলে বিশ্বাস করি।
একটা ব্যাপার কেউ লৰ্য করেছেন কি? ধর্ম নিরপেৰতা কিংবা উদার মতের বিরোধীতা করে, কিংবা এসব মতবাদীদের জঘন্য ভাবে আক্রমণ করে বাংলাদেশেই অনেক বই বেরিয়েছে, অনেক প্রবন্ধ বেরিয়েছে কিন্তু সে জন্য কি সেকু্যলারিস্টরা তাদের ওসব বই কিংবা লেখা নিষিদ্ধ ঘোষণার কখনও কোনও দাবী জানিয়েছেন? কিংবা তাদের মসত্দক বিদীর্ণ করার জন্য মূল্য ধার্য করেছেন? আমার জ্ঞাত ইতিহাসে করেনননি। তাহলে কেন সেকু্যলারিস্টদের মতবাদকে বা সমালোচনাকে কেউ নিতে পারেন না? আমি নিশ্চিত যে, এটা আর কোনও কারণে নয়, যুক্তির অভাব। একটি শিশু যখন কোনও অন্যায় করে এবং ধরা পড়ে যায় তখন সে লজ্জাবনত হওয়ার বদলে কখনও কখনও আগ্রাসী হয়ে ওঠে, হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে শুরম্ন করে, যদি এ জন্য তার অপরাধকে বড়রা ভুলে যায় সে জন্য (চাইল্ড সাইকোলজির বইতে বিষয়টি বিসত্দারিত পাবেন)। সেৰেত্রে এই কট্টরপন্থীরা খানিকটা শিশুর মতোও, কারণ তারা যুক্তি মানেন না, তাদেরটাই যে শ্রেষ্ঠ, তারাই যে একমাত্র বিশ্বাসী, সেটা প্রমাণের জন্য কোনও যুক্তির ধারই তারা ধারতে চান না। এটা এক ধরনের রোগও, তাই আমার মনে হয় এদের আসলে চিকিৎসা হওয়া উচিত।
এই যেমন আজকেই লৰ্য করম্নন, অপ বাক নামের বস্নগ-বন্ধুর একটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একে নিষিদ্ধ করার জন্য কতর্ৃপৰের কাছে দাবী তোলা হয়েছে। কিন্তু এর আগে বহু বিবাহের পৰে মতামত রাখা সম্পর্কে কিন্তু সেরকম কোনও দাবী তোলেনি। বহু বিবাহ একটি ভয়ঙ্কর ও নিম্নরূচির বিষয়, ধর্ম যতোই তাকে অনুমোদন করম্নক না কেন, কোনও ব্যক্তির ভালোবাসাকে বহুধা করা যায় না, তাতে ব্যক্তিসত্ত্বার অপমান হয়। কিন্তু ধর্মতো ভালোবাসার স্বীকৃতি দেয় না, ধর্ম বরং একে সংকুচিত করেই ৰানত্দ হয় না, একে বন্ধের জন্য রক্তপাতেও ধর্মের আপত্তি নেই। আমার মনে হয়, আমার উপন্যাসের দু'টি অধ্যায়কে মুছে দেওয়ার ফলে এই বস্নগে একটি নতুন রীতির সূচনা হলো, এবং এর মাধ্যমে সামনে যার লেখাই একটু ব্যতিক্রমী হবে, তাই বন্ধের আবেদন জানানো হবে এবং কতর্ৃপৰও হয়তো তাই-ই করবেন। সেৰেত্রে অপকারটা কিন্তু পাঠকেরই হলো, দায়িত্ব ও বোধ সম্পন্ন পাঠাকের এই লোকসান ঠেকানো যেতো যদি এখানে সুস্থবুদ্ধির সম্মিলন ঘটতো। কিন্তু সেটা যে হয়নি তা বলাই বাহুল্য। তারপরও মত প্রকাশের আর সৃজনশীলতার পৰেও যে সোচ্চার কণ্ঠ রয়েছে তার প্রমাণ তো আমরা দেখেছি, যুগে যুগে এরা এসেছেন এবং আসবেনও। বিদ্যাসুন্দরের মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে সেকালে অশস্নীলতার ধূয়া তোলা হয়েছিল, যে কেউ পাঠ করলেই বুঝবেন তাতে শারীরিয় বর্ণনা এসেছে অত্যনত্দ সচেতন ভাবেই কিন্তু তাতে ঘটনার কোনও ৰতি হয়নি, হয়তো ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের অাঁতে ঘা লেঘেছে, কারণ তারা নিভৃতে, লোকচুর অনত্দরালে, মন্দির থেকে বেরিয়েই বারবণিতার সঙ্গে যে সব কীর্তি করে থাকে, তার বর্ণনা যখন ভরতচন্দ্রেও কলম থেকেও বের হয়, তখন তাদের শরীর তেলে বেগুন পড়ার মতোই সঁ্যাত করে ওঠে _ ভরতচন্দ্রের আমলের ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ আর একালের মোলস্নাতন্ত্রের নৈকট্য যে কোনও যুক্তিবাদী মানসকেই অবাক করবে।
আমার লেখা সম্পর্কে সাফাই গাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই বা সে সুযোগও আমি নেবো না। কারণ সে সুযোগ নেবেন আমার লেখার পাঠক। অসংখ্য পাঠকের মাঝে একজনেরও যদি সেটা ভালো লাগে তাহলেও লেখকের কাছে সেটা বিরাট পাওয়া। তাতে কোনও কোনও প্রগতিবাদীর অাঁতে ঘা লাগে কারণ তাদের ইস্ত্রি ছাড়া পরিধান আর রাবারের চপ্পল পায়ে শহর চষে বেড়ানোর ভণ্ডামির যে কোনও দাম থাকে না তাতে। আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, কর্মস্থান ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত প্রগতিবাদের যে মানসিকতাও বদলায় সেটা সত্যিই জানা ছিল না। নইলে গোপনে পর্ণগ্রাফি পড়ে স্ত্রীর সামনে ধরা পড়ে কানমলা খাওয়ার মধ্যে আর যাই-ই থাক পৌরম্নষ নেই, বরং নিজের সততা প্রকাশের দ্বিধাহীন সাহসই মনুষ্যত্ত্ব। জঁ্যা পল সার্ত বা কিংবা সিমোন ডি বোভোয়া কিংবা ডি এইচ লরেন্স-এর যৌন বিবরণই সাহিত্য আর তসলিমা লিখলেই সেটা পর্ণ, এই মতবাদে যে সব প্রগতিবাদীরা বিশ্বাস করেন তাদের জন্য করম্নণা ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার নেই। কথ্য রীতিতে (তাও আঞ্চলিক) বাংলা লিখে সাহিত্যকে যাদের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার দাবি করা হয় তাদের যে অৰর পরিচয়ই নেই সেকথা কে তাদের বোঝাবে। ভাবশিষ্য হওয়া ভালো কিন্তু যে বিদ্যা দ্বিগগজ রাতে কলাম লেখার আগে তার অধীনস্থ কর্মচারীদের দিয়ে গোলাপের পাপড়ি সহযোগে নিজদেহ মর্দন করিয়ে নেন, তারপর অনেককে নিয়ে স্নান করেন তারপর লিখতে বসেন তার ঐসলামী মার্কসবাদ _ তাকে ভন্ড আখ্যা দিতেও আমার কষ্ট লাগে। এককালের বামপন্থী বর্তমানে এনজিও কাম শাড়ীর ব্যবসায়ী, যিনি বিদেশি অতিথিনীকে জোর করে শয্যায় নিতে চান, পরে আমাদের বাঘা বাঘা সম্পাদকের হসত্দৰেপে সেই কাহিনী চাপা দেওয়া হয় , তার শিষ্যত্ব বরণ করে শস্নীলতা কিংবা অশস্নীলতার কোনওটাই বিচার করা সাজে না।
যা হোক, বিষয়টি নিয়ে আর লিখতে ইচ্ছে করছে না, সময়ও নেই, হাতের সামনে আর মাথার ভেতরে অনেক লেখা পড়ে আছে। সেগুলো শেষ করতে হবে। লেখা মুছে দেওয়া যায় ইচ্ছে করলেই কিন্তু লেখককে কি থামিয়ে রাখা যায়? লেখা লেখকের সত্ত্বার অংশ, লেখক বেঁচে থাকলে কলমটাও চলবে, কালি কিংবা কাগজের অভাব হয় না। লিবার্টাইন যুগের ফরাসি এক লেখককে লিখতে দেওয়া হতো না, তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, কাগজ-কলম দেওয়া হতো না, তিনি আঙুল কেটে দেয়ালে, বিছানার চাদরে লিখতেন। এরকম একজন নন, আরও অনেক কবি-লেখক রয়েছেন, যারা এভাবেই অমর গাঁথা লিখেছেন। তাদের নোখের যুগ্যিও নই আমি, কিন্তু আমি দাবী করি যে, আমি তাদের উত্তরসূরি অবশ্যই। শুধু আমি কেন, এই বস্নগের অনেকেই। তাদেরকে আমার অকুন্ঠ অভিনন্দন। অভিনন্দন তাদেরও যারা আমার উপন্যাসের অধ্যায় দু'টিকে বন্ধের জন্য কতর্ৃপৰকে উস্কেছেন, কিংবা আমার বিরম্নদ্ধে গরল ঢেলেছেন। কারণ আপনাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আমি অবশ্যই শ্রদ্ধা করি, আপনাদের ভালো লাগেনি কিন্তু আপনারা পড়েছেন, সেখানেই একজন লেখকের স্বার্থকতা। সেই অর্থে উপন্যাসের দু'টি অধ্যায় এখানে পোস্ট করাটা ছিল একটা লিটমাস টেস্ট; লাল আর নীল-এর পার্থক্য তো আপনারাই দেখলেন। এবার বাকিটুকু পড়বেন (যদি চান) বইতে, বাংলাদেশেরই প্রকাশক শুধু নয় বইটি প্রকাশে আরও অনেক প্রকাশক আগ্রহী হয়েছেন _ বেরম্নলেই জানতে পারবেন।
সবাইকে আবারও শুভেচ্ছা, যারা আমাকে নয় আমার লেখার পৰে দাঁড়িয়েছেন, যারা আমার লেখা ও আমার উভয়েরই বিপৰে দাঁড়িয়েছেন তারা এবং যারা আমার লেখা নয় শুধু ব্যক্তিগত আমাকে গালি দিয়েছেন তারাও, সমাজে প্রত্যেকেরই প্রয়োজন আছে _ তবে এর মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, বন্ধুত্বও তথাকথিত হয় আর প্রগতিশীলতাও হয় একটা ভান, যে ভান ধরা পড়ে ইস্ত্রি ছাড়া পরিধান, রাবারের চপ্পল আর কথ্য রীতিতে লেখা বাংলায়. . . .হায়!!!! এরা কথায় কথায় ৰণা কিংবা গাগর্ীর (এখানে তাদেও প্রকাশভঙ্গীর কথা বলা হচ্ছে) কথা বলে অথচ একালের কোনও লেখককে তারা দণ্ড দেয় নোংরামির, ভন্ডামির চূড়ানত্দ রূপ তাহলে এটাই।
লন্ডন 7ই মার্চ, 2006
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০