আশির দশকের শেষভাগ থেকেই ড. ইউনুস বাংলাদেশে একজন উলেস্নখযোগ্য ব্যক্তি। সেনাপতি এরশাদের বদান্যতায় তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকেই শনৈ শনৈ নাম করতে থাকে। এবং তারপরের ইতিহাসতো ড. ইউনুসের আনত্দর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা। সাবেক মার্কিন-প্রেসিডেন্ট বিল কিনটনের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সুবাদে ড. ইউনুসের মাইক্রো-ক্রেডিট বিপুলতর খ্যাতি লাভ করে। যদিও দেশের ভেতরেই এমনকি যে গ্রামের মানুষকে নিয়ে তার এই মাইক্রো-ক্রেডিট ব্যবসা তাদের মধ্যেও এর বিপৰে ব্যাপক মতবাদ রয়েছে। অনেকে তো একে নয়া ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী হিসেবেও সমালোচনা করে থাকেন। কিন্তু সমালোচনা যাই-ই থাক, ড. ইউনুস কিন্তু এগিয়ে গিয়েছেন। তবে সমালোচকরা একথাও বলতে ছাড়েন না যে, নব্বইয়ের দশকে বিএনপি ৰমতায় বসার পর থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি বাড়ে, এর সত্যমিথ্যা খুব একটা জানিনে। যা হোক, এই গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে ড. ইউনুস শুধু যে বিখ্যাত হয়েছেন তাই-ই নয়, অর্থনীতিতে তার নোবেল পাওয়ার কথাও শোনা গিয়েছিল এবার। যদিও অর্থনীতিতে সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীদের তালিকায় তার নামটি বিদেশের কোনও পত্রিকায় আলোচিত হয়নি, শুধুমাত্র বাংলাদেশেই এটা নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যাহোক এতো কথা বলা একারণেই যে, ড. ইউনুস একই সঙ্গে আলোচিত এবং সমালোচিত, অর্থাৎ তিনি বা তার কর্মকাণ্ডও সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। অতএব, এই মুহূর্তে তাকে ত্রাতার ভ্থমিকায় যারা দাঁড় করাতে চাইছেন তাদেরকে এই বিষয়টি মাথায় রেখেই এগুতে হবে বলে মনে করি।
ড. ইউনুস এখন নতুন করে আলোচনায় এসেছেন ডেইলি স্টারের পনের বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে একটি বক্তব্য রাখার পর। তাঁর দীর্ঘ বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকাটিতে এবং তার বাংলা অনুবাদ ছেপেছে পত্রিকাটির সহোদরা দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা। ইত্তেফাকেও এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বলে শুনেছি। বিষয়টি লৰ্যনীয় যে, অন্য কোনও পত্রিকা ড. ইউনুসের এই বক্তৃতাটি প্রকাশ করেনি, কিন্তু এর আগে ড. ইউনুসের বিভিন্ন লেখা কিংবা বক্তৃতা একই সঙ্গে দেশের বেশ কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। আরও বড় কথা হচ্ছে, এই প্রথম ড. ইউনুস সরাসরি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখলেন। এর আগে যখন তাকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনের কিংবা 'ড. ইউনুস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হচ্ছেন' জাতীয় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তখন তিনি নিজেই সংবাদপত্রের কাছে সাৰাতকারে বার বারই বলেছেন যে, রাজনীতিতে আসার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। কিন্তু একই সঙ্গে তার নিজের সৃষ্ট গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে পদত্যাগের খবর এবং ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তৃতা ড. ইউনুসকে তার সাবেক অবস্থান থেকে সরিয়ে একেবারে রাজনীতির মাঠে এনে ফেলেছে_ অতএব বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে হলে তাকে বাদ দিয়ে সেটা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে তিনটি রাজনৈতিক ধারা, এক) বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার; দুই) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে 14 দলীয় জোটের বিরোধী দল এবং তিন) ড. ইউনুসের নতুন রাজনৈতিক অবস্থান।
শেষোক্তটিকে ঠিক কী হিসেবে বলা উচিত এটাই বোঝা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দল, জোট বা পস্ন্যাটফরম _ এর কোনওটিই এর সঙ্গে খাপ খায় না। তবে পত্রপত্রিকাতেই একথা আলোচিত হচ্ছে যে, ড. ইউনুসের নেতৃত্বে একটি জাতীয় সরকার গঠনের পাঁয়তারা চলছে। আলোচনার সুবিধার্থে এই ধারাকে ড. ইউনুসের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট হিসেবেই উলেস্নখ করছি। আগেই উলেস্নখ করেছি যে, বাংলাদেশে বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের বাইরে হামিদ কারজাই টাইপ একটি জাতীয় সরকার গঠনের কথা বেশ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে। এতে সম্ভাব্য কে কে যুক্ত থাকবেন এ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে জোট সরকার যখন পরবতর্ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে একজন দলীয় প্রাথর্ীকে ইতোমধ্যেই প্রস্তুত করে রেখেছে এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে একজন দলীয় ব্যক্তিকেই নিয়োগ দিয়েছে তখন বিগ ব্রাদার আমেরিকা কিংবা অন্যদাতা ইউরোপিয় ইউনিয়নের সমর্থনে একটি দীর্ঘমেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এন্টিবায়োটিক হিসেবে কয়েক বছর ৰমতায় রেখে দেশের গণতন্ত্রের বর্তমান গ্যাংগ্রিন সারানোর পরিকল্পনার কথাই মূলতঃ আলোচিত হয়েছে। কিন্তু সেই আলোচনা এতোদিন তাত্তি্বক থাকলেও ড. ইউনুসের ডেইলি স্টার শীর্ষক বক্তৃতার পর তা আর তাত্তি্বকতো নেই-ই বরং আশঙ্কামূলক বাসত্দবে পরিণত হয়েছে। সেই আশঙ্কাটি ড. ইউনুস নিজেই সৃষ্টি করেছেন তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত মশিউল আলমের অনুবাদকৃত বক্তৃতাটির শিরনাম 'প্রতিবেশী দুই বিশাল অর্থনীতির সাথে আমাদেরও বেড়ে ওঠা'। এতে ড. ইউনুস বাংলাদেশের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত প্রতিটি বিষয়ই তুলে এনেছেন একজন রাজনৈতিক নেতার মতোই, এতে গবেষণার গভীরতা নেই, নেই নিরপেৰতা বরং নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের খানিকটা প্রশসত্দি ছাড়া মোটামুটি পুরে বক্তৃতাটিই রাজনীতির ঠাস বুননে গড়া। আর এ কারণেই মানুষের সন্দেহ স্পষ্ট হয় যে, ড. ইউনুস তাহলে সত্যি সত্যিই একটি মিশন নিয়ে এগুচ্ছেন। কারণ এতোদিন তিনি একজন ব্যাবসায়ী কাম সমাজসেবী ছিলেন। ব্যাবসায়ী, কারণ তার গ্রামীণ ব্যাংক বিনা সুদে কাউকে কিছু দেয়নি, গ্রামীণ ব্যাংক কোনও সেবা সংস্থাও নয়, এটা আর দশটা বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো না হলেও তার চেয়ে কোনও অংশে কম সেটা বলা যাবে না। বরং বলা যেতে পারে যে, আর দশটা বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই সে টিকে আছে এবং বেশ ভালো ভাবেই টিকে আছে। সে টিকে আছে কারণ তার বাণিজ্যিক তৎপরতার সঙ্গে সমাজসেবার তকমাটিও সেঁটে আছে। ফলে তার এই বক্তব্যের মাঝে আমরা তাকে একজন ঝানু রাজনীতিবিদ হিসেবেই দেখতে পাচ্ছি। শুধু পার্থক্য এটুকুই যে, তিনি অর্থনীতির কিছু সূচক ব্যবহার করেছেন, যা তার নিজের গবেষণা নয়, অন্যের গবেষণালব্ধ ফলাফলই তিনি সংযোজন করেছেন মাত্র। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, ড. ইউনুস তার এই বক্তব্য রেখেছেন ডেইলি স্টার পত্রিকার বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে, কোনও মেঠো বক্তৃতায় নয়। দেশের সুশীল সমাজের মাথাদের সামনেই তিনি তার অবস্থানটিকে স্পষ্ট করেছেন সরাসরি, যাতে তিনি তাদের সমর্থন পেতে পারেন। বলাবাহুল্য, গণতন্ত্রের অস্থিতিশীলতা নিয়ে এই শ্রেণীটি সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন এবং আরও বড় কথা হচ্ছে, সেনাবাহিনী-আমলা-কালো টাকার মালিক ফড়ে ব্যবসায়ী ও ধর্মবাদী গোষ্ঠীর হাত থেকে শাসনৰমতা নিজেদের হাতে ফিরিয়ে আনার জন্য এই শ্রেণীটি দীর্ঘদিন ধরেই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
সুতরাং ড. ইউনুস তার সঙ্গে কাদেরকে পেতে চাইছেন এটা স্পষ্ট হয়ে যায় তার এই বক্তব্য রাখার স্থান নির্বাচন করার মধ্য দিয়েই। এবং ইতোমধ্যেই তার প্রতি সমর্থক ব্যক্তকারীদের দীর্ঘ তালিকা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এতে আরেকটা ব্যাপার স্পষ্ট হলো যে, ড. ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হলেও, গ্রামের নিরৰর জনগণ তার এই ব্যাংকের কায়েন্ট হলেও তিনি তার রাজনৈতিক বক্তব্য শোনানোর জন্য এদেরকে ধর্তব্যে আনেননি। আনেননি কারণ তিনি জানেন যে, এই পৰটির সমর্থন পেলে সাধারণ মানুষকে আর প্রয়োজন হবে না। কারণ এরাই হচ্ছে দেশের মাথা, গণতন্ত্রের প্রতিপালক। এদেরকে পাশে পেলে তিনি বা তাকে ঘিরে কথিত পরিকল্পনা সাধনে সফলকাম হওয়া অসম্ভব হবে না। ফলে এখানেই স্পষ্ট হচ্ছে যে, ড. ইউনুসের এই অবস্থান আসলে গণতন্ত্রের মৌলিক সংজ্ঞার পরিপন্থী। নির্বাচনহীন একটি সরকার গঠণই যে এর অনত্দর্নিহিত উদ্দেশ্য তার প্রমাণ হচ্ছে গরিষ্ঠসংখ্যক ভোটারদের কাছে এই বক্তব্য অজ্ঞাত থাকা; কতিপয় ব্যক্তিকে নিয়ে একটি সিন্ডিকেটই যে দেশটার আসল কর্ণধার হবে এটাও এর মাধ্যমেই পরিষ্কার বোঝা গেলো।
রাজনীতির ভাষা সব সময়ই নানাবিধ উদ্দেশ্যব্যঞ্জক _ রাজনীতিবিদদের কেউই সোজাসুজি কিছু বলেন না, তারা সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলেন এবং নানা পৰ তাদের সুবিধামতো তার ব্যাখ্যা করে নেন। ড. ইউনুসের এই বক্তব্যও নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এবং এতে দোষেরও কিছুই নেই। যেমন নির্বাচন বিষয়ক তার বক্তব্য এবং ভোটারদের প্রাথর্ী মনোনয়নে ভ্থমিকা রাখার বিষয়টিকে যদি কেউ তার ভবিষ্যত রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখেন তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে কী? অথবা ভারত বা চীনের অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রসঙ্গটি টেনে আনতে গিয়ে ভারত-বিদ্বেষ বা প্রীতি নিয়ে তার মনত্দব্যকে যদি কেউ তার ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতি হিসেবেও ব্যাখ্যা করতে চান তাহলে তাকেও ঠেকানো যাবে কি? এরকম আরও উদাহরণ টেনে আনা যায় ড. ইউনুসের সামপ্রতিক এই বক্তব্য নিয়ে, কিনত্দু তার জন্য এই নিবন্ধের পরিসর অত্যনত্দ স্বল্প। তবে এটা সত্যি যে, একটি মাত্র বক্তৃতাই ড. ইউনুসকে রাতারাতি একজন প্রথম সারির রাজনীতিবিদে পরিণত করেছে, যা অনেক রাজনীতিবিদই দীর্ঘদিন রাজনীতি করেও অর্জন করতে পারেননি। বাংলাদেশে এর আগেও রাতারাতি রাজনীতিক হয়ে যাওয়ার ইতিহাস আমরা দেখেছি, যদিও তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল কিন্তু তাতে বাংলাদেশের রাজনীতির কোনও উপকার হয়নি বরং অপকারই হয়েছে ঢের। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাহীন রাজনীতিবিদদের তালিকায় যদি এই ব্যাংকার-অর্থনীতিবিদও যুক্ত হন তাহলে সেই অপকারের মাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না।
ফিরে আসি জাতীয় সরকার বিষয়ক কথায়। যদি সেরকম কোনও জাতীয় সরকার গঠন করা হয়ই এবং ড. ইউনুস যদি সত্যি সত্যিই তার প্রধান হয়ে বসেন তাহলে সেই সরকারকে কোনও ভাবেই বৈধ বলা যাবে কী? অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সামরিক কু্য করে জেনারেল জিয়া কিংবা এরশাদের অবৈধ ভাবে ৰমতা দখলের সঙ্গে এর মৌলিক কোনও পার্থক্য থাকবে কি? সেৰেত্রে খুব দুঃখ লাগবে যদি অবৈধ ভাবে ৰমতা দখলকারী হিসেবে জেনারেল জিয়া ও এরশাদের নামের পরে ড. ইউনুসের নামটিও আমাদের উচ্চারণ করতে হয়। আমি নিশ্চিত যে, সেরকম কিছু হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কোনও উপকারতো হবেই না বরং গণতন্ত্রের কবরই হবে এখানে, জনসমর্থনহীন এবং চাপিয়ে দেওয়া কোনও সরকারের হাতে কোনও কালেই কোনও দেশের জনগণই কখনও উপকৃত হয়নি_ এই সত্য জানার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেটধারী হওয়ার দরকার নেই, অৰরপরিচয় থাকাটাই যথেষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০