ইতিহাসের বিকৃতি যে একটি জাতির জন্য কতোটা ভয়াবহ হতে পারে সেটা আমাদের তরম্নণ প্রজন্মের দিকে তাকালে নিদারম্নণ ভাবে ফুৃটে ওঠে। এজন্য যে তারা দোষী সেটা কিন্তু নয়, এর জন্য দায়ী রাষ্ট্র স্বয়ং, যদিও রাষ্ট্র বলতে এখানে সরকারকেই বোঝানো হচ্ছে কারণ রাষ্ট্র একটি স্থায়ী অবয়ব আর সরকার পরিবর্তনশীল। একটি মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে যখন রাষ্ট্র ৰমতার পরিবর্তন ঘটলো তখন দেখা গেলো, এই রাষ্ট্রটির ৰমতা দখলের জন্য ছুঁচোর লড়াই শুরম্ন হয়েছে। পঁচাত্তরের অক্টোবর-নভেম্বরেই মোট 17টি কু্য সংঘঠিত হয়েছে। যদিও এই কু্য-তে জনগণের অংশগ্রহণ মোটেও ছিল না, তারা ছিল পুরোপুরি অন্ধকারে। সদ্য স্বাধীন দেশটি তখন যেনো একটি পাউরম্নটির টুকরো, যাকে নিয়ে চলছিল নিরনত্দর কামড়াকামড়ি। এই কামড়াকামড়ি জনগণের প্রিভিলেজড্ অংশ, যাদের হাতে বৈধ অস্ত্র ছিল তারাই করেছে। এবং এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল জনগণের এলিট অংশ যারা বঙ্গবন্ধুর আমলে ৰমতার ভাগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল (যেমন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পুত্রদ্বয়, এনায়েতুলস্নাহ্ খান, নুরম্নল ইসলাম শিশু, এমনকি মাওলানা ভাসানীও এই দলে ছিলেন) তারা। ভারতের অর্থায়নে ও প্রশিৰণে যে রাজনৈতিক শক্তিটি তখন দাঁড় করানো হয়েছিল সেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের নেতৃত্বও কিন্তু সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল। এরকম বেশ ক'টি ফেনামেনা বা প্রপঞ্চ মিলে যে রক্তপাতের ইতিহাসের জন্ম দিলো তার ধারাবাহিকতাই বাঙালিকে এনে ফেলে দিলো ইতিহাসহীনতার জঙ্গলে। (এই সময় ও তার বিশেস্নষণ নিয়ে কেউ যদি পড়তে চান তাহলে লরেন্স লিফশুলট্জ-এর 'বাংলাদেশ ঃ দি আনফিনিশড্ রেভুলু্যশন; এ্যান্থনি ম্যাসকারহ্যানস্-এর 'বাংলাদেশ ঃ এ লিগ্যাসি অব বস্নাড' ; বিক্রমাদিত্যের 'কনফিডেন্সিয়াল ডায়েরী', ড. আলী রীয়াজ-এর 'বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য' ইত্যাদি গ্রন্থগুলো সংগ্রহ করতে পারেন)।
এরপর ধারাবাহিক ভাবে দু'দু'টি সামরিক শাসন আমাদের নতুন প্রজন্মকে আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের চেয়ে ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাসই গিলিয়েছে বেশি। শাহ্জাহান কিংবা সিরাজউদ্দৌলার ছবি আমাদের পাঠ্য বইতে সংযোজিত হয়েছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা বলতে এমন কয়েকজনের জীবনী পাঠ করতে বাধ্য করতে হয়েছে যারা সেনা বাহিনীর সদস্য ছিল। অথচ এই সেনাবাহিনীই যারা বৈধ অস্ত্র দিয়ে অবৈধ ভাবে দেশের দু'দু'জন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে। কিন্তু তারপরও তাদের নামের আগে আমাদের উচ্চারণ করতে হয় দেশপ্রেমিক শব্দটি। এরপর কী আর এই শব্দটির আদৌ কোনও মর্যাদা থাকে?
ইতিহাস বিকৃতি আর সংযোজন-বিয়োজনের আরোপিত শব্দাবলীর পরিণতি আমাদের আজকের অবস্থার জন্য দায়ী_ যেখানে একটি সেকু্যলার রাষ্ট্রের পতন ঘটিয়ে একটি উগ্র ধর্মবাদী রাষ্ট্রের জন্ম হতে চলেছে। যেখানে মইত্যা রাজাকার, মুজাহিদ্যা (একাত্তরে তাকে এই নামেই সবাই চিনতো), আজাহারম্নল ইসলাম কিংবা ময়লানা মান্নানরা একাত্তরে কী করেছিল তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছে আমাদের তরম্নণ প্রজন্মের বিভ্রানত্দ অংশ। আগেই বলেছি, আমি এদেরকে দোষ দেই না, কারণ এদেরকে শেখানো হয়েছে এভাবে। ভুল ইতিহাস শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রশিৰণ দেওয়া হয়েছে রগ কাটার, গুলি করে মানুষ হত্যা করার এবং শেষ পর্যনত্দ আত্মঘাতী বোমাবাজ হওয়ার।
আমার দুঃখ নেই এই বস্নগে আমার একটি লেখার জন্য আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণ করে কেউ কেউ লিখেছেন। শিবির সম্পর্কে আমার রিপোর্ট সম্পর্কে যিনি লিখেছেন, তিনি নিজেই হয়তো জামায়াত ইসলামীর অর্থায়নে বাইরে পড়তে এসেছেন। একথা তো সত্যি যে, জামায়াত এখন সরকারী ও বেসরকারী প্রশাসনের সর্বসত্দরে তাদের লোক নিয়োগ করে চলেছে। আর ব্রিটেনে যে বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে পাঠানো হয়েছে উচ্চশিৰার জন্য একথা অসত্য হলে জামায়াত প্রকাশিত সেই রিপোর্টের প্রতিবাদ করলো না কেন? এসব যুক্তি অবশ্য তারা বোঝে না, তারা বোঝে রগ কাটা, বোমাবাজির ভাষা, তাই তারা ভীতি প্রদর্শন করে দেখে নেওয়ার। এখন জামায়াতীরা নতুন সুর ধরেছে, তারা বলছে তারা পাকিসত্দান রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার জন্য হানাদার বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়েছিল কিন্তু তাদের বিরম্নদ্ধে হত্যা-ধর্ষণ-অগি্নসংযোগের কোনও অভিযোগ ছিলো না। কী নিদারম্নণ কৌতুক!! যদি তাদের বিরম্নদ্ধে এসব নাই-ই থাকবে তাহলে তারা বাহাত্তর থেকে ছিয়াত্তর পর্যনত্দ পলাতক ছিল কেন? মইত্যা রাজাকার, মুজাহিদ্যা, গোলাম আজম, ময়লানা মান্নান_ এরা সকলেই তখন দেশের বাইরে বিশেষ করে সৌদি আরবে ও পাকিসত্দানে পলাতক ছিল। 2005 সালের 12-17ই ডিসেম্বর ভোরের কাগজ ও দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার এদের অপকর্ম সম্পর্কে প্রকাশিত রিপোর্টগুলোয় একবার কেউ চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।
অবশ্য এখন এদের নবকুমার শিষ্যবৃন্দ বলতে পারেন যে, তখন প্রয়োজনে তারা বাঙালি-নিধন করেছিল, যেমনটি একজন এখানে বলেছেন যে, চট্টগ্রামে নাকি প্রয়োজনেই শিবিরকমর্ীরা রগ কেটেছিল আর মানুষ খুন করেছিল কারণ তখন র্যাব ছিল না। হায়রে, এদেরকে কী দিয়ে কী বোঝাবেন!! অধুনালুপ্ত বিচিনত্দা পত্রিকায় ময়লানা মান্নানের সাৰাতকার প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে ময়লানা মান্নানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ''আপনাকে সবাই রাজাকার বলে, আপনার খারাপ লাগে না?'' উত্তরে ময়লানা কী বলেছিল জানেন? বলেছিল, ''এ্যাতো খোঁচান ক্যান, রাজাকার কি আমি এ্যাকলা নি?'' _ এখন এই মইত্যা-গোলামের এই নবকুমার শিষ্যরা হয়তো আর এভাবে বলবেন না, বলবেন, ''এ্যাতো খোঁচাইয়েন না, ধর থাকি মাথাটা সোন্দর কইরা নামাইয়া দিমু, টেরও পাইবেন না''।
তবে আমি আশাবাদী, এই বস্নগে এসে সেই আশাবাদ আরও দৃঢ় হয়েছে। ইতিহাসের সত্য অসত্য দিয়ে ঢাকা যায় না, বেরিয়ে আসে এবং তার আলোয় আলোকিত করে ভবিষ্যত প্রজন্মকে। হাজারও বিভ্রানত্দির মাঝে আপনাদের মতো অনেকেই আছেন যারা স্বাধীনতা, মুক্তিযোদ্ধা আর জাতীয়তাবাদ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, এই নবকুমার রাজাকার-বংশদের বক্তব্যের উত্তর দিচ্ছেন, প্রয়োজনে তারাই আবার নামবেন যুদ্ধে, সেই যুদ্ধ রক্তৰয়ী হলে রক্ত দেবেন ও নেবেন, আর সেই যুদ্ধ যদি মেধার হয় তাহলে মেধা দিয়ে লড়বেন _ আপনাদের প্রতি আমার এই আশাবাদ। মুক্তিযুদ্ধ একবার নয়, একটি জাতির জন্য বার বার আসে, নানা ফর্মে, নানা ভাবে_ সুতরাং এতে ভয় পাবার কিছুই নেই।
সবাইকে ফাগুন-শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০