দয়াকরে বস্নগের সবাই তাদের কাঁধে এই অভিযোগটি নেবেন না, যারা এসব করছে তারা ঠিকই বুঝে নেবে এবং নিশ্চিত তারা কঠোর সব মনত্দব্যে তাদের বক্তব্যের প্রতিবাদকারীদের ঘায়েলও করে থাকে। যেমন জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক। গোলাম আজম থেমে আজকের মইত্যা রাজাকার ওরফে নিজামী, তাবিজ-বেঁচা ময়লানা সাঈদী থেকে রাজাকার-তনয় সাকা চেনধুরী _ সবার মুখেই আমরা জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের কথাটি শুনে আসছি। কিন্তু কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানা, এমনকি দেশের বাইরে বেরম্ননো তরম্নণের শ্বাস-প্রশ্বাসেও যদি এই পুরোনো কাসুন্দির গন্ধ পাওয়া যায় তাহলে তা শুধু দুঃশ্চিনত্দারই শুধু নয়, বরং আমাদের এই ভেবে শঙ্কিত হওয়া উচিত যে, এই ''চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া''-ওয়ালাদের হাতেই রয়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যতে 'বাংলাসত্দান'-এ পরিণত হওয়া কিংবা অন্যকথায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরিণতি।
নইলে আজকের বিশ্বে এমন কোনও দেশ কি খুঁজে পাওয়া যাবে যে দেশটির জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের জন্য সেই দেশেরই নাগরিক এরকম মুখে রক্ত তুলে ফেলে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাষ্ট্রের পরিচয় বহনকারী (যেমন জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, মুদ্রা ইত্যাদি) কিছু সম্পর্কে বিরূপ মনত্দব্যকারী কিংবা এসবের প্রতি অবহেলা প্রদর্শনকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহীর শাসত্দির বিধান রয়েছে বহু দেশে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী ইত্যাদি দেশগুলি এখন নতুন নাগরিত্ব গ্রহণে ইচ্ছুকদের নাগরিকত্বের প্রশিৰণ দিচ্ছে এবং রাষ্ট্রের সকল প্রতীকের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থাশীল হওয়ার জন্য শপথ করিয়ে নিচ্ছে। এটা এ কারণেই যে, রাষ্ট্রের এইসব মীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে সেটা গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই নড়বড়ে করে তোলে এবং এর ফলে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ লাভ করে। এমন যে হিটলার, যে ৰমতায় বসে জার্মানীর বহু কিছু পরিবর্তন করেছিল কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতটিকে অৰত রেখেছিল কারণ সেটা বদলালে তার আর ৰমতায় যাওয়া হতো কিনা সন্দেহ, যে কোনও জাতির কাছে রাষ্ট্রেও এই প্রতীক সমূহ এতোটাই মূল্যবান যে, যখনই এর ওপর আঘাত এসেছে তখনই তারা অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছে। মধ্যযুগের জাতিতে জাতিতে যুদ্ধের মূল কারণ ছিল এই স্বাতন্ত্রবোধ, পদানত জাতিসমূহের সকল পরিচিতিমূলক চিহ্নাদি মুছে ফেলে বিজয়ী জাতির উলস্নাস প্রকাশ ছিল তখনকার নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
এই বস্নগে যে সব অতি-মুসলমান রয়েছে তাদেরকে সালাহদিন-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছি একটু। সিরিয়া থেকে জেরম্নজালেম পর্যনত্দ দীর্ঘ পথের যুদ্ধে তিনি অনেক ছোট ছোট জাতিকে জয় করেছিলেন এবং তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে জেরম্নজালেম দখলের জন্য ক্রুসেডে অংশ নিয়েছিলেন। সমপ্রতি 'কিংডম অব হেভেন' নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এই ক্রসেডের ওপর, তাতে দেখা গেছে সালাহদিনের সৈন্যদলের একেকটি ভাগের পতাকার রঙ একের রকম, একটি মূল পতাকার সঙ্গে প্রত্যেক জাতির স্বকীয় পতাকা। ইসলামের শুরম্নতে যা সালাহদিন পেরেছেন, একালের অতি-মুসলমানরা তা কেন পারছে না সেটা ভেবে দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর তো কোনও পথ দেখছি না।
আজকে জাতীয় সঙ্গীত বদলের কথা বলে নানাজনে নানা যুক্তি দেখাচ্ছেন। একজন খুনীও তার করা হত্যাকাণ্ডের স্বপৰে যুক্তি দিয়ে থাকে কিন্তু বিজ্ঞ বিচারক সেসব যুক্তিকে খন্ডানোর চেষ্টা না করে প্রমাণ দাখিল করে হত্যাকারীর শাসত্দি দিয়ে থাকেন। তেমনই আমার ধারণা এদের এসব যুক্তির সামনে নতুন কোনও যুক্তি খাড়া করা বৃথা, কারণ ''চোরা না শোনে ধর্মেরও কথা'', আগেই বলেছি এদেরকে চাবি মেরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যাও বাবা চরে খাও এবার, তোমাদের শেখনো হয়েছে প্রথমেই বলবে,
ইসলাম গেলো, তাকে বাঁচাও; তারপর
বাঙালিত্ব বলে কিছুই নেই, সবকিছুর ওপরই একটা ধর্মের প্রলেপ দিতে হবে, আরবের বালিতে যা টেকেনি বাংলাদেশের মাটিতেই তা বসাতে হবে এবং কাফের না মারলে বেহেশতে যাওয়া যাবে না অতএব কাফের মারো, জাতীয় সঙ্গীত বদলাও; তারপরও না মানলে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণকারী হও _ এবং এইসব শুনে-মোসলমানরা সেটাই করছে। অথচ এরা জানে না যে, ইরান একটি মুসলিম রাষ্ট্র হলেও সেখানকার ভাষা আরবি নয়, ফারসি, কারণ সেটাই তাদের মাতৃভাষা; তাদের জাতীয় সঙ্গীত কোনও ইসলামি গান নয়, বরং সে দেশের অমিয় সুন্দর প্রকৃতিকে নিয়ে রচিত একটি সঙ্গীত; পারসিক জাতিসমূহের আত্মসম্মানজ্ঞান যে কতোটা প্রবল তা বোঝা যায় যখন তারা আরবিকে ভাষা হিসেবে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, তারা ধর্মকে নিয়েছে কিন্তু আরবি ভাষা গ্রহণ করেনি, করেনি কারণ তারা উজবুক নয়, তারা প্রথমে পারসিক কিংবা ইরানি তারপর মুসলমান।
আসলে এতো কিছু যে লিখছি, লিখে কী হবে? কথা বলতে তো অনেক কিছুই বলা যায়, কিন্তু ''কইতে কথা বাঁধে''। ধরা যাক এই বস্নগের একজন জাতীয় সঙ্গীত বদল করে, ''আমার মনের বেদনা বন্ধু ছাড়া জানে না''-কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে চাইছে, এরপর যদি অন্য কেউ 'হুলার লাডু, হুলার লাডু, হুলার লাডু হু''-কে জাতীয় সঙ্গীত বানাতে চায়, তখন? ক'বার পরিবর্তন করা হবে জাতীয় সঙ্গীত তবে? আসলে জাতি হিসেবে যে, আমরা শুধু শংকরই নয়, নানা বর্ণ-রক্ত-ধর্ম মিশে আমাদের চিনত্দা-চেতনাও যে নড়বড়ে হয়ে গেছে একেবারেই তার প্রমাণ হচ্ছে এটাই। নইলে জাতীয় সঙ্গীত সহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রতীকের জন্যই অঢেল রক্তপাতের পরেও একদল মানুষ এখন আবার এসবকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে , অবশ্য যারা চাইছে তাদের কেউইতো তো রক্ত দেয়নি, বরং বাঙালির রক্ত ঝরিয়েছে, হত্যা-ধর্ষণসহ সকল প্রকার নোংরাতেই তো তাদের শুধু হাত নয়, অসত্দিত্বই মাখামাখি, এদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আর কি আশা করা যায়?
দুঃখ এটাই, ভাবা গিয়েছিল এরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে বুঝি এদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অসত্দিত্বও বিলীন হয়ে যাবে, বাঙালি মুক্তি পাবে, কিন্তু ও বাপ, এরা যে নপুংশক নয় তা বোধহয় বাঙালি ভুলে গিয়েছিল, এদের ঔরষে জন্ম নেয়া কালসাপ এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বাইরেও, এরাই এখন ফণা তুলছে, আর তর্জন-গর্জন করছে। একটা প্রবাদ শুনেছিলাম, ''এতো দেখেছো ভালো, আরো ক'জন আসছে তেড়ে দাড়িতে জড়িয়ে পলো''..........
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০