রাসত্দাটা ভালো করে দেখাও যায় না। কখনও রোদ্দুরের তেজে দৃষ্টি থেমে যায়, কখনও বা কুয়াশায় ঢেকে থাকে এক হাত দূরের অবয়বও, কিন্তু উজিরোন রাসত্দা দ্যাখে, ওর চোখ চোখকে ফেরাতে পারে না। দিনের ভেতর কতোবার যে এই চোখ ওই রাসত্দার ওপর গিয়ে থামে সে হিসেব ও নিজেও বোধ করি জানে না। কিন্তু চোখ বলতে তো সেই সবে ধন নীলমণি বাঁ চোখটি। সেই কোন্ ছেলেবেলায় খেঁজুরের কাঁটার খোঁচা খেয়ে ডান চোখটির মণি ঘোলা হয়ে গ্যাছে। ওর নিজেরই মাঝে মাঝে মনে হয়, দু'চোখ দিয়েই কতো মানুষ পৃথিবীটাকে পুরোপুরি দেখতে পারে না, তার ওপর আবার এক চোখ! ওর কাছে পৃথিবীটা অর্ধেক হয়ে গেছে সেই কবে, এখন আর মনেও পড়ে না। অর্ধেক পৃথিবী নিয়েই উজিরোন বেঁচে আছে, স্বামীর ঘর করছে। এখনও অবশ্য ছেলেপুলে হয়নি, সেটা কেন হয়নি তা ওর জানা নেই। এক চোখের কারণে কারও ছেলেমেয়ে হয় না, সেরকম কোনও কিছু ও কখনও শোনেনি। কিন্তু ছেলেপেলে না হওয়াতে ওকে কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয় না। একেতো চোখ কানা, তার ওপর বাঁজা , উজিরোন মাঝে মাঝে নিজের ভেতরেই মরে যায়, কিন্তু মরে গিয়েও কি করে যেন বেঁচে থাকে। নিজের গাঁয়ে যেমন ছেলেপেলেরা ওকে নিয়ে ছড়া কাটতো তেমনি স্বামীর গাঁয়ের ছেলেমেয়েরাও ওকে নিয়ে ছড়া কাটে, "উজি কানা, বগের নানা, বগ বেইচ্যা খায় চইদ্দ আনা"।
উজি কানা- এই পরিচয় নিয়ে নাকি পরিচয়ের গস্নানি নিয়ে উজিরোন ভর দুুপুরে দূরের রাসত্দার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন সেখান থেকে দৌড় ঝাঁপ দিয়ে উড়ে আসবে কোনও খবর। হয় ওর চোখ ভালো হওয়ার, নয় সনত্দান ধারণের। উজিরোন তাকিয়ে থাকে, ওর হাতে এক লোটা জল, এইমা(ড) ও পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এসেছে, ভেজা কাপড় লেপ্টে আছে শরীরময়। উজিরোনের সেদিকে কোনও খেয়াল নেই, ও তাকিয়ে আছে রাসত্দার দিকে। যেন রাসত্দাটি জীবনত্দ কোনও সত্ত্বা, যে সত্ত্বা ওকে সতত হাতছানি দিয়ে ডাকে। অথচ এই ভর দুপুুরে ওই দূরের রাসত্দা থেকে কোনও সুুখবর ওর জন্য দৌড়ে আসে না।
উজিরোন দেখতে পায় খড়খড়ে রোদ ভেদ করে ওর স্বামী রোগা গাইটিকে টেনে নিয়ে ফিরে আসছে বাড়ির দিকে। উজিরোন ত্বরিতে ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। দবির এসে ওভাবে রাসত্দার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলে আর রৰা থাকবে না। গরম্ন পেটানোর লাঠি এসে পড়বে উজিরোনের পিঠে, ওই লাঠিটি যতোটা না গরম্ন পেটানোর তার চেয়ে অনেক বেশি যেন উজিরোনকে পেটানোর জন্য। অনেক সময় উজিরোনের মনে হয়, ও কি তাহলে একটা গাই? নাহ্, তা কি করে হয়? গাই গরম্ন তো দবিরকে প্রতিদিন সকালে সের খানেক দুধ দেয়, উজিরোন তো তাও দিতে পারে না। তাহলে উজিরোনের মূল্য কোথায়! উজিরোনের তখন অস্থির লাগে খুব, ভাবনাগুলোকে তড়িঘড়ি করে মন থেকে বের করে দিতে চায়, অথচ সেগুলোও কেমন নচ্ছাড়, উজিরোনকে ছেড়ে এক মুহূর্তও কোথাও যেতে নারাজ।
উজিরোন ওর ভাবনাগুলোকে এক(িড)ত করে উড়িয়ে দিতে চায়, ওই বিধবার সিঁথির মতো রাসত্দার দিকে ছুঁড়ে দিতে চায়, কিন্তু ওরা যায় না, দাঁড়িয়ে থাকে ওকে ঘিরে। মুহূর্তে মুহূর্তে ওকে আক্রমণ করে বসে। এই এখনও উজিরোন ওর স্বামী দবিরকে দেখে ভাবনাগুলোকে উঠোনে রেখে ঘরে ঢুকে যায়। রান্না হয়নি কিছুই, খুঁদ বেটে চাপাতির মতো বানিয়েছিলো সেই সকালে, তাই-ই এখন ঠান্ডা হয়ে দড়া মেরে গেছে। শুকনো মরিচ রসুনের সঙ্গে বেটে রেখেছিল, পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এসে সেটাই দবির খাবে। ঘরের বাঁশে ফুটো করে তার ভেতর জমানো টাকা আছে, ইচ্ছে করলেই চাল কিনতে পারে দবির, কিন্তু কিনবে না। ওদিকে উজিরোনকেও ছাড়বে না, এই ভর দুপুরে যদি চাপাতিটা ওর মনোমত না হয় তাহলে "কানি মাগি" বলে বেধড়ক পেটাবে ওকে। উঠোনে পড়ে উজিরোন গড়াগড়ি খাবে, আর ঘরের দাওয়ায় বসে সেই চাপাতিই মনের আনন্দে গিলবে দবির। উজিরোনের এসব গা সওয়া হয়ে গেছে, তবে মাঝে মাঝে উজিরোনও একটা স্বপ্ন দেখে বটে। অত্যাশ্চর্য এক স্বপ্ন, উজিরোন সেই স্বপ্ন নিয়ে অবশ্য বেশিদূর এগুতে পারে না, কিন্তু দ্যাখে তো!
দবির যখন গোয়ালে গাই বেঁধে ডুব দিয়ে গা-মাথা মুছতে মুছতে উঠনো এসে দাঁড়িয়ে "ওই মাগি" বলে হাঁক দেয় তখন উজিরোন মাটির খোরায় চাপাতি সাজিয়ে এসে দাঁড়ায় ঘরের দাওয়ায়। দবিরের চোখ দু'টো কেমন লাল হয়ে আছে। উজিরোন ওই চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পায়, আবার ভয়টাকে গিলেও ফেলে। জীবন যাকে কিছু দেয় না, তার ভয়ডর কোথায় যেন উবে যায়, উড়ে যায়, উজিরোনের তেমনই মনে হয়। 'উজি কানা বগের নানা'র যে কখনও একটা আসত্দ পুরম্নষ মানুষের সঙ্গে বিয়ে হবে, সে যে সংসার করবে এমনটাইতো ও কখনও কল্পনা করেনি।
ওর মনে আছে রাজিয়ার কথা। ভাতের মাড় গালতে গিয়ে এক পাতিল ভাত ওর ওপর ঢেলে পড়েছিল। কতই বা বয়স তখন রাজিয়ার, বছর সাতেক। কচি চামড়ায় আঠা আঠা মাড় রাজিয়ার সঙ্গে লেপ্টে ছিল। হাঁসের ডিম ভেঙে দিয়েও কিছু হয়নি। শেষ পর্যনত্দ ইলিয়াসের দাদির দেওয়া সেই ধন্বনত্দরী মলমেও রাজিয়ার ৰত সারেনি। মাঝ খান থেকে খলিল কাকার এক গাদা টাকা নষ্ট। কোর্(েব)কে ধূপ, সন্ধক লবন, বাসক পাতা আরও কতো কি জোগাড় যন্ত্র করে আনতে হলো। তাও আবার এক দামে কিনতে হবে, দোকানি যে দাম চাইবে সেই দামে। কিছুতেই কিছু হলো না, ইলিয়াসের দাদির মলমে ঘা সারলো বটে কিন্তু রাজিয়ার কপাল থেকে পেট অবদি চামড়া রইলো কুঁচকে। কি বীভ"স দেখাতো রাজিয়াকে। মাঝে মাঝে যখন এক ঘাটে নাইতে যেতো তখন রাজিয়ার বুক দু'টোর দিকে তাকিয়ে অাঁতকে উঠতো উজিরোন। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও নিজের ঘোলাটে ও দৃষ্টিশক্তিহীন ডান চোখের কথাটি ভুলে থাকা যেতো। সেই রাজিয়ার বিয়ে হলো না, বড় বোনের বরের কাছ থেকে পেট বাধালো। এখন এর বাড়ি একবেলা থাকেতো, অন্য বেলা অন্য কারো বাড়ি। একজন কুঁচকে যাওয়া বুকে হাত দেয়তো আরেকজন পাট ৰেতে টেনে নিয়ে যায়। উজিরোনতো তবু একজন মা(ড) পুরম্নষের ঘর করতে পারছে। এই পাওয়াও কি খুব কম কিছু? মেয়ে মানুষের আর চাওয়া কি, বারো দুয়ারে ঘোরার চেয়ে একজনের লার্(িব)-ঝাটা খেয়ে জীবন পার করে দেওয়াটাইতো, নাকি?
দাওয়ায় দাঁড়িয়ে উজিরোন নিজেকে খানিকটা সৌভাগ্যবতীই মনে করে, ওর সদ্য স্নান সেরে আসা শরীরে বেশ একটা পুলকিত অনুভূতিও আসে বুঝি। সেটা যদিও স্থায়ীত্ব পায় না, কারণ দবির 'চুুতমারানির মাগি' বলে ডাক ছেড়ে খাবার চেয়ে বসে। উজিরোন বুঝতে পারে আজ দবিরের মাথা গরম, পান থেকে চুুন খসলেই গরম্ন পেটানোর লাঠিটি ওর পিঠে পড়বে। উজিরোন আড় চোখে দাওয়ার ছনের চালের দিকে তাকায়, ওখানে লাঠিটি গোঁজা থাকে। এখনও সেখানে ওটা গোঁজা আছে দেখতে পেয়ে উজিরোন কাঁপা পায়ে ঘরে ঢোকে। মাটির বাসনে চাপাতি রাখে, মরিচ-রসুন বাটা রাখে, তারপর এগিয়ে আসে। এগিয়ে আসার সময় আর একবার লাঠিটি দেখতে চায় ও। কে জানে ''উজি কানা" যদি ভুল দেখে থাকে? উজিরোন দবিরের সামনে খাবার নামিয়ে জল আনতে যায় ভেতরে। দবির মাটিতে পাতা তালপাতার পাটিতে পা ছড়িয়ে বসে খেতে থাকে। পাতের মরিচ থেকে খানিকটা ঝাল যেন ওর চোখেও গিয়ে ওঠে, ওর চোখ দুু'টো আরও লাল দেখায়, উজিরোন জলের গেলাস নামিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে থাকে সামনে।
দবির খেতে শুরম্ন করেছিল। বোয়াল মাছের মতো হা করে শ্বাস নিতে হচ্ছিল ওকে, ঝালের জন্য। ঝাল-দুপুর-রোদ সব মিলিয়ে আচমকাই দবিরের ভেতর কি যেন কি হয়, ওর সামনে দাঁড়ানো উজিরোনের দিকে পানির গস্নাসটি প্রথমে ছুঁড়ে দেয়, তারপর নিজে উঠে এসে জোর এক লার্(িব)তে উজিরোনকে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর বদরাগি মোষের মতো গোঙাতে গোঙাতে বলে, "কানি মাগি, মরিচটা পর্যনত্দ ঠিক মতো পিষতে পারিস না। একটু শুকনো মরিচ আর রসুন মিহি করে বেটে রাখবি, তা না দাঁতের নিচে কুটোর মতো চিবোতে হচ্ছে। এই কানি মাগি দিয়া আমার চলবো না আর। তরে আমি, তরে আমি ছাইড়া দিমু"। উজিরোন জানে মুখে তিন তালাক না বলা পর্যনত্দ ছাড়া হবে না, মার খেতে খেতে উজিরোন প্রাণপণ দোয়া করতে থাকে, আজ যেন সেই দিনটি না আসে। আজ যেন দবির এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, বাইন তালাক না বলে; একদিন বলবে যে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু আজ নয়, আজ নয়। প্রতিবারই মার খাওয়ার সময় ওর মনে হয় এ কথা। উজিরোনের বিবাহিত জীবনটি এখন যেন সার্কাসের সুতোর ওপর দিয়ে যাচ্ছে, যে কোনও মুহূর্তে সুতো ছিঁড়তে পারে অথবা পা ফস্কেও যেতে পারে। উজিরোন ওর ভেতরকার ঈশ্বরকে কতো ডেকেছে এ জন্য, ঈশ্বর সে কথা শোনেন কি না কে জানে? উজিরোনের তো মনে হয়, ঈশ্বরও বোধ হয় ওরই মতো এক চোখো। একথা মনে করে উজিরোন ছেলেপেলেদের মতো ছড়া বানাতে চেষ্টা করে, "ঈশ্বরকানা, বগের নানা, বগ বেইচ্যা খায় চইদ্দ আনা"। গভীর রাতে এই ছড়া কাটতে কাটতে উজিরোন কাঁদে। আবার সেই এক চোখে কান্না, ওর ডান চোখ দিয়ে জলও ঝরে না।
অনেকৰণ ধরে কিল, লাথি, চড় মেরে মেরে কানত্দ হয়ে দবির বেরিয়ে যায়। উজিরোন পড়ে থাকে দাওয়ায়। কাপড় ঠিক নেই, ছেঁড়া চুল দুপুরের ধুলোয় পড়ে আছে, গস্নাশ থেকে জল পড়ে খানিকটা কাদাও জমে গেছে। উজিরোন পড়ে আছে, পড়ে থাকে অনেকৰণ। তারপর এক সময় উঠে গাইটাকে আগে থেকে ভিজিয়ে রাখা খড় দেয়, হাঁস-মুরগিগুলোকে খুঁদ-কুড়ো দেয়, আনাজ গাছে জল দেয়- প্রাত্যহিক এসব কাজ সূর্য্যকে নিয়ে যায় পশ্চিমের দিগনত্দে। উজিরোন এবার বাড়ির পশ্চিম পাশ্বর্ে গিয়ে খানিকটা দাঁড়ায়। অদ্ভূত, বর্ণনার অতীত এক লাল রঙে ছেয়ে আছে পশ্চিম আকাশ। পূব পাশে যেমন সিঁথিচেরা রাসত্দা এ পাশে তেমনি বর্ণিল আকাশ। উজিরোন তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে।
ওদের গ্রামের সমানত্দরালে যে গ্রামটি তার ওপাশে চপলার বিল, সেখানে নেমে গেছে সূর্য। ওই গ্রামের মাথা ছাড়িয়ে যে দেবদারম্ন গাছ, তার পাতায় খানিকটা রঙ লেগে আছে শুধু। উজিরোন তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সেই রঙটুকুও মুছে যায়। অাঁধারে দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে, উজিরোন ফিরে যায় রান্না ঘরের দিকে। মুঠো খানেক চাল থাকলেও থাকতে পারে। উজিরোন দেখে নিয়ে যত্ন করে চাল ধুয়ে বসিয়ে দেয় চুলোয়। পাটখড়ির আগুন দ্রম্নত ধরে যায়, জল ফুটে ওঠে। মেটে আলু তোলা হয়েছিল কয়েক দিন আগে। উজিরোন চিনত্দা করে কিছুৰণ তারপর মেটে আলু ফেলে দেয় চুলোর ভেতর। ভাত হতে হতে ওগুলোও পুড়ে নরম হয়ে থাকবে। তারপর রসুন-মরিচ দিয়ে বেটে ভর্তা করা যাবে। কে জানে দবিরের ভালো লাগবে কি না, আজ অবধি দবিরের ভালো লাগা অথবা না লাগাকে উজিরোন বুঝতে পারেনি। যে ট*ক* স্বার্থের জন্য কানি উজিরোনকে দবির বিয়ে করেছিল তা বছর পেরম্নতে না পেরম্নতেই শেষ হয়ে গেছে। এখন যে কোনও মুহূর্তেই হয়তো সেই অমোঘ ও অবশ্যম্ভাবী বাক্য(ড)য় বেরিয়ে আসবে দবিরের মুখ থেকে।
উজিরোন চুলোর ভেতর আরও কিছু পাটখড়ি ঠেলে দেয়, দাউ দাউ করে আগুন। উজিরোনের ইচ্ছে করে পাটখড়ি নয়, একদিন এই চুলোয় প্রথমে ও বাঁ পা ঠেলে দেবে, তারপর ডান পা, বাঁ হাত, ডান হাত তারপর এক সময় পুরোপুরি নিজেকেই- ভাবতে ভাবতেই উজিরোন তাকিয়ে দেখে চুলোর মুখটা এতোটাই সরম্ন যে ওর পা ঢুকবে না, মনে মনে উজিরোন চুুলোর ওপরে বিরক্ত হয় বুঝি। ভাত তখন হয়ে গেছে, বিরক্তি রেখে ভাতের মাড় গালতে শুরম্ন করে উজিরোন। তারপর গনগনে আগুন থেকে মেটে আলু তুলে পরিষ্কার করতে থাকে। কুপির আলোয় উজিরোনের কপালে বিন্দুু বিন্দুু ঘাম ফুটে ওঠে। সুনসান বাড়িটিকে কেমন যেন মনে হয় উজিরোনের, খানিকটা ভয়, খানিকটা একাকীত্ব, আর অসহায়তা উজিরোনকে কেমন যেন করে ফেলে। হঠা"ই উজিরোনের মনে পড়ে ওর দাদির কথা। ছোট বেলায় এরকম সন্ধ্যায় দাদির কাছে বসে কতো গল্প শুনেছে উজিরোন। তখনও ওর চোখটা যায়নি। সন্ধ্যে হলেই পৃথিবীটাকে মনে হতো ভুতের দখল করা রাজ্য। দাদির আশ্রয়কে তখন সবচেয়ে নিরাপদ মনে হতো। আজও এই বয়সে এসে হঠা"ই উজিরোনের দাদির কাছে যেতে ইচ্ছে করছে, মনে হচ্ছে, এখন যদি দাদি এসে ওকে জড়িয়ে ধরে রাখতো বুকের কাছে। দাদির শরীরে সাদা পাতার গন্ধ, পানের সঙ্গে সাদা পাতার গন্ধ মিলে এক ধরনের অাঁঠালো গন্ধের সৃৃষ্টি হতো। দাদির শরীর, কাপড়ে, চুলে সেই গন্ধ মাখামাখি হয়ে থাকতো।
উজিরোন সেই গন্ধকে মনে করতে চাইছিলো, কিন্তু ওর মনে হলো ওর খুুব কাছেই সেই গন্ধ রয়েছে। উজিরোনের ভয় করতে লাগলো। কিন্তু ওর ভয়ের ভেতর ঠিক দাদির মতো করেই যেন কেউ বলতে লাগলো, "ভয় কিয়ের, কুনও ভয় নাই। আয় তরে গফ্ কই। তর মনে নাই, ষুলো কলার গফের কতা? তাইলে হুন, তরে মনে করাইয়া দেই। ষুলো কলার এক কলা-র গফ। হেই যে এক চাষা আছিলো, বদ মিজাজি, সুময় না অসুময় নাই কচি বউডারে ধইরা খালি মারতো, খালি মারতো, মারতে মারতে চোকে-মুকে রক্ত উডাইয়া দিতো। বউডা পইরা পইরা মাইর খাইতে খাইতে একদিন মনে মনে ভাবলো, স্বামীরে ষোল কলার এক কলা দেহাইবো। রাইতে ভাত বাইড়া দেওনের সুময় কইলো, 'তুমি যে আমারে এতো মারো ধরো, তুমি জানো না মাইয়ারা ষোল কলা জানে? ষোল কলার এক কলাও যদি দেহাই তাইলেতো তোমারে টোকাইয়াও কুথাও পাওন যাইবো না'। স্বামীডা হাইস্যা উড়াইয়া দেয় বউডার কতা। বউডা মনে মনে মনে কয়, কাইলই তোমারে ষোল কলা দেহামু। তহন বুঝবা ঠ্যালা।
পরদিন বউডা ওর জমাইন্যা সমসত্দ স'ল দিয়া হাট থিইক্যা এক জোড়া ইলিশ মাছ আইন্যা রাইত পুহানোর আগেই চাষির জমিতে গাইড়া থুইয়া আসে। চাষা বিহান বেলা জমি চাষ করতে গিয়া জমিতে লাঙল দিতে না দিতেই জোড়া ইলিশ উইঠ্যা আসে। চাষার চোখ তো পারলে বাইর ওইয়া আসে। হ্যায় ইলিশ মাছ লইয়া দৌড়াইয়া বাড়ি আইস্যা বউরে কয়, 'ও বউ হুনছোস্, ৰ্যাতে লাঙল দিতেই আইজ জোড়া ইলিশ পাইছি। তুই আইজ দুইফরে ইলিশ ভাজবি, রানবি, দুইফরে তো খামুই, রাইতেও আইজ ইলিশ মাছ দিয়া কব্জি ডুবাইয়া ভাত খামু'। বউ কয়, 'ভালই হইলো, আইজ রান্ধনের কিছুই আছিলো না। তুমি আইজ তাড়াতাড়ি আইও। আমি অহনই রান্ধনের জুগাড় করতাছি'। চাষা জমিতে ফিইরা যায়, তার কি আর চাষে মন লয়, ক? আনা দিনের চাইয়া বেইল এট্টু ঘুরলেই ফিইরা আহে বাড়ি। আইস্যাই চিলস্নাইয়া বউরে কয়, 'ও বউ তুই ভাত বাইড়া দে, আমি ডুব দিয়া আসি'। চাষা নাইয়া ধুইয়া আইস্যা বসে ইলিশ মাছ দিয়া ভাত খাওনের লাইগ্যা। বউ আগে থাইক্যাই খাওন বাইড়া বইয়া ছিল। চাষা বাসনের ঢাকনি খুইল্যা দ্যাহে হুদা ডাইল আর আলু ভর্তা। চাষার মাথায় যায় আগুন ধইরা। চিলস্নাইয়া কয়, 'ওই মাগি তরে যে জোড়া ইলিশ আইন্যা দিলাম, হেগুলারে কি করছস? তর কুন্ নাগররে খাওয়াইছস? আইজ তরে আমি মাইরাই ফালামুু'। বইলাই বারিন্দার চালে গুইজা রাখা লাঠি দিয়া বউডারে মারতে আরম্ভ করে। বউডার চি"কারে পাড়া প্রতিবেশিরা আইস্যা মাইর দ্যাহে। বউডা কয়, 'আফনেরাই বিচার করেন আইজ, হ্যায় কয় হ্যায় নাকি জমি চাষ করতে গিইয়া জোড়া ইলিশ পাইছে। শুকনা জমির মইদ্যে ইলিশ মাছ পাওন যায় হুনছেন কোনও দিন আফনারা? হেই ইলিশ মাছ রান্দি নাই দেইহা আমারে ক্যামনে মারতাছে দ্যাহেন'।
বউয়ের এই কথা হুইন্যা চাষা আরও রাইগ্যা গিয়া কয়, 'বিহানে জমিতে লাঙল দিতেই দুইডা ইলিশ উঠলো, আইন্যা দিলাম মাগির হাতে, আর মাগি আমারে অহন ডাইল আর আলু বর্তা খাইতে কয়। ওর নাগর আছে, নাগরের লাইগ্যা ইলিশ মাছ রাইন্ধা থুইছে।' প্রতিবেশিরা চাষার কথা শুইন্যা কেউ কেউ হাসে, কেউ কেউ রাগ হয়। প্রায় দিনই বউডারে ধইরা খামাখাই মারে, আইজতো এক্কেবারে বেহুদা মাইর মারতাছে। জমি চাষ করতে গিয়া জোড়া ইলিশ ওঠে, এইডাতো পাগলের কথা। চাষা পাগল ওইয়া গ্যাছে। শালারে ধর, ধইরা শক্ত একটা মাইর দিয়া বাইন্ধা থুওন দরকার। যে কথা হেই কাম, হ লে মিইল্যা চাষারে ধইরা বেদম মাইর দেয় তারপর গরম্নর দড়ি দিয়া ঘরের খামের লগে বাইন্ধা থোয়। চাষা মাইর খাইয়া অজ্ঞানের মতোন ওইয়া গেছিলো। জ্ঞান ফিরলে দ্যাহে ঘরের সামনে কেউ নাই। ও পইরা আছে বারিন্দায় মাটির উপর। দিনের আলো তহনও আছে অল্প-সল্প। হেই আলোয় দেহা যায়, চাষার বউ অর সামনেই বইস্যা ইলিশ মাছ ভাজা আর রান্ধা দিয়া এক বাসন ভাত খাইতাছে। চাষার মাথায় আবার আগুন জ্বইলা ওডে, কিন্তু জ্বললে কি ওইবো প্রতিবেশির মাইর খাইয়া তারতো বারডা বাইজ্যা গ্যাছে। শইরলে বল নাই, আর হাত-পাও বান্ধা। হ্যায় কান্দো কান্দো ওইয়া কয় 'অ বউ অহন মাছ আইলো কুনহান থিইক্যা? আমারে মাইর খাওয়াইলি, পাগল বানাইলি, অহন তুই আবার মাছ দিয়া ভাত খাইতাছস যে?' বউ মুচ্কি মুুচ্কি হাসে আর কয়, 'বুঝলানি মিয়া, তোমারে কইছিলাম না, মাইয়ারা ষোল কলা জানে? আইজ এক কলা দেহাইলাম। আরও পোনারো কলা দ্যাখবানি? চাইলে তাও দেহাইতে পারি'। চাষায় কয়, ' না রে বউ, ষোল কলার এক কলা দেইখ্যাই আমার শিৰা হইয়া গ্যাছে, আর দেহান লাগবো না, তুই আমারে খুইল্যা দে, আমার ৰিদা লাগছে'। বউ কয়, 'খুইল্যাতো দিমুই, তার আগে কও আর কুনোও দিন আমার শইরলে হাত দিবা না'। চাষায় কয় 'দিমু না দিমু না, এই কসম খাইলাম'। চাষার দুই হাতে মাডি লাগছে বইল্যা বউডা নিজের হাতেই চাষার মুুখে ভাত তুইল্যা দেয়। এর পর থাইক্যা চাষায় এট্টু মাথা গরম করলেই বউ কয়, 'ষোল কলার পোনারো কলা কিন্তু এহনও বাকি আছে মিয়ার ব্যাডা' আর অমনিই চাষার সমসত্দ রাগ ঠান্ডা"- গল্প শেষ করেই দাদি কেমন ফিক ফিক করে হাসতে থাকেন।
উজিরোন চোখের সামনে দেখতে পায় ও নিজেও একদিন দবিরকে ষোল কলার এক কলা দেখিয়ে একেবারে জলের মতো ঠান্ডা করে ফেলেছে। দবির ওর সামনে বসে আছে চুপ করে, মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলছে। সোনামুখ করে খেয়ে নিচ্ছে দুরনত্দ ঝালের সেই মরিচ-রসুন বাটা। উজিরোনের ইচ্ছে হয় গল্পের সেই বউয়ের মতো দবিরের মুখে খাবারের গ্রাস তুলে দিতে, কিন্তু সাহস হয় না। বাইরের উঠোন থেকে ভেসে আসা জোরালো চি"কারে উজিরোনের হাতে ধরা পোড়া মেটে আলুটি পড়ে যায়। তাহলে এতোৰণ বুুঝি উজিরোন স্বপ্নই দেখছিলো? ষোল কলার এক কলা দেখানোর স্বপ্ন। দবিরের গলা শোনা যায়, এদিকেই আসছে। উজিরোন তাড়াতাড়ি আলুটির পোড়া খোসা ছাড়াতে শুরম্ন করে। খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ওর মনে হয়, ওর সব কিছুই অর্ধেক, এমনকি স্বপ্নগুলোও। এক চোখে দেখা স্বপ্নতো অর্ধেকই হবে, নাকি? ওর স্বপ্নগুলোও খেঁজুরের কাঁটার খোঁচায় জর্জরিত, উজিকানার মতো স্বপ্নরাও কানা। উজিকানা আবার দবিরের মার খাওয়ার জন্য অপেৰা করে, সঙ্গে সঙ্গে মেটে আলু ভর্তারও আয়োজন করতে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০