রোজা ফারসি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে দিন। যেহেতু এই আমলটি দিনের শুরু থেকে শেষাংশ পর্যন্ত পালন করা হয় তাই একে রোজা বলা হয়।
আর আরবিতে এর নাম সাওম। যার শাব্দিক অর্থ কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা।
আহলান সাহলান মোবারক হো মাহে রমজান। রমজান মাসে রোজা রাখা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ বা অবশ্যকর্তব্য। মাহে রমজানে রোজা পালনকারী একজন মুসলমান সত্যিকারের খাঁটি ইবাদতকারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। রহমত ও বরকতের দিক দিয়ে রমজান মাস অন্য ১১ মাস থেকে ভিন্ন।
এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"রমজান মাসের প্রথমাংশে রহমত, দ্বিতীয়াংশে মাগফিরাত অর্থাৎ ক্ষমা আর তৃতীয়াংশে নাজাত তথা দোজখ থেকে মুক্তি।" (বুখারি)
রোজার নিয়ত:
--------------------------
মনের ইচ্ছা পোষণকেই নিয়ত বলে। চাই মুখে কিছু বলুক বা না বলুক। রোজার জন্য নিয়ত করা ফরজ। যদি কেউ মুখে বা মনে মনে রোজার নিয়ত না করে বা রোজার রাখার জন্য মনস্থির না করে পুরো দিন পানাহার থেকে বিরত থাকে তবে তা রোজা বলে গণ্য হবে না।। মাহে রমজানের রোজার নিয়ত রাতেই করে নেওয়া উচিত। তবে যদি না করে, তাহলে সূর্য সোজা মাথার ওপর আসার দেড় ঘণ্টা আগে অথবা দিনে ১১টার আগে নিয়ত করে নেবে। শর্ত হলো, কোনো কিছু খেতে বা পান করতে পারবে না। আরবি ভাষায়
নিয়ত জানা থাকলে ভালো, নতুবা বাংলায় নিয়ত করা চলে। মুখে নিয়তের শব্দ উচ্চারণ করা জরুরি নয়, কাজেই মাহে রমজানে রোজা রাখার জন্য নিয়ত করে রাতে মনে মনে শুধু বলতে হবে:
"নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম মিন শাহরি রামাদানাল মুবারাকি ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাক্কাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস সামীউল আলীম।"
অর্থাৎ (হে আল্লাহ) আপনার সন্তুষ্টির জন্য আগামীকাল রমজানের ফরজ রোজা রাখার নিয়ত করছি। আমার তরফ থেকে আপনি তা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাত।
ইফতার
-------------
আরবি ভাষায় ইফতারের দোয়া- আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন। এর বাংলা অর্থ- (হে আল্লাহ) আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য ও তোমারই ওপর ভরসা করে রোজা রেখেছিলাম এবং হে রাহমানির রাহিম তোমারই অনুগ্রহ দ্বারা ইফতার করছি।
তারাবির নামাজ:
---------------------------
প্রথমে একজন মুসলমান রোজার নিয়ত ও তারাবির নামাজ আদায় করার মধ্য দিয়ে রোজা পালন করে থাকেন। রমজান মাসে দিনের রোজা আর রাতে সম্মিলিতভাবে ইবাদতের একটি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাকে তারাবিহ’ বলা হয়। এটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা, একজন রোজাদারকে রমজান মাসে এশার নামাজের পরে বেতের তিন রাকাত নামাজের আগে ১০ সালামে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। তারাবির নামাজ একাকীও পড়া যেতে পারে। মসজিদে জামাতের সঙ্গে পবিত্র কোরআনের খতম তারাবিতে পড়ায় অশেষ সওয়াব রয়েছে। একাকী বা জামাতের সঙ্গে সূরা তারাবিও পড়া যেতে পারে।
সেহরি:
--------------------
সেহির মাহে রমজানের বরকতময় একটি পর্ব। সেহিরর বাহ্যিক বরকত হচ্ছে, রোজাদারের রোজা রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং মন প্রফুল্ল থাকে। আর সেহিররঅন্তর্নিহিত বরকত হচ্ছে, এ সময়ে আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয় এবং বান্দার দোয়া কবুল করা হয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
‘তোমরা সেহির খাও, এতে বরকত আছে।’ (মুসলিম)
সূর্যাস্তের পর থেকে সুবহে সাদেকের আগ পর্যন্ত সেহিরর শেষ ভাগ। তাই রাতের একটু শেষ ভাগেই সেহির খাওয়া সুন্নত। এতে অশেষ বরকত রয়েছে।
ইফতার: সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতে হবে। ইফতারের জন্য খেজুর ও পানির কথা হাদিস দ্বারা সমর্থিত। ইফতার নিজে করা এবং অন্যকে করানো সওয়াবের কাজ। যে ব্যক্তি অন্যকে ইফতার করাবে, তার সওয়াবের কোনো কমতি হবে না। ইফতারের ক্ষণটি দোয়া কবুলের সময়।
রোজাদারের জন্য আনন্দময় মুহূর্ত দুটি। একটি ইফতারের সময়, অন্যটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে: ‘রোজাদার যখন ইফতার করে, তার দোয়া প্রত্যাখ্যান করা হয় না।’
যেসব কারণে রোজা নষ্ট হয়:
------------------------------------------
১. নাক বা কানে ওষুধ প্রবেশ করালে।
২. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি করলে।
৩. কুলি করার সময় গলার মধ্যে পানি চলে গেলে।
৪. নারী স্পর্শ বা এ সংক্রান্ত কোনো কারণে বীর্য বের হলে।
৫. খাদ্য বা খাদ্য হিসেবে গণ্য নয় এমন কোনো বস্তু গিলে ফেললে।
৬. হুক্কা, বিড়ি, তামাক বা ইচ্ছাপূর্বক ধূমপান করলে এবং ধূপ ও আগরবাতি জ্বালিয়ে পরিকল্পিতভাবে তার ধোঁয়া গ্রহণ করলে রোজা ভঙ্গ
হয়ে যায়।
৭. নিয়ত ছাড়া রোজা রাখার পর ইচ্ছাপূর্বক রোজা ভঙ্গ করলে
৮. ভুলে খেয়ে ফেলার পর ইচ্ছা করে পুনরায় খাবার খেলে।
৯. সুবেহ সাদিকের পর খাবার খেলে।
১০. বুঝে হোক বা না বুঝে সূর্য ডোবার আগে ইফতার করলে।
১১. ইচ্ছা করে স্ত্রী সহবাস করলে।
যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয়:
-............------------------------
১. বিনা কারণে জিনিস চিবিয়ে বা লবণ কিংবা কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করা। যেমন টুথপেস্ট, মাজন, কয়লা ইত্যাদি দিয়ে দাঁত মাজা।
২. গোসল ফরজ অবস্থায় সারাদিন গোসল না করে থাকা।
৩. শরীরের কোথাও শিঙ্গা ব্যবহার করা বা রক্তদান করা।
৪. পরনিন্দা করা।
৫. ঝগড়া করা।
৬. রোজাদার নারী ঠোঁটে রঙিন কোনো বস্তু লাগালে যা মুখের ভেতর চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
৭. রোজা অবস্থায় দাঁত উঠানো বা দাঁতে ওষুধ ব্যবহার করা, তবে একান্ত প্রয়োজনে তা জায়েয।
যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় না কিংবা মাকরুহও হয় না:
------------------------------------------------------------
১. মিসওয়াক করলে।
২. মাথায় বা শরীরে তেল লাগালে।
৩. চোখে ওষুধ বা সুরমা লাগালে।
৪. গরমের কারণে পিপাসায় গোসল করলে।
৫. সুগন্ধি ব্যবহার করলে।
৬. ইনজেকশন বা টিকা দিলে।
৭. ভুলক্রমে পানাহার করলে
৮. ইচ্ছা ছাড়াই ধুলাবালি বা মাছি ইত্যাদি প্রবেশ করলে।
৯. কানে পানি প্রবেশ করলে
১০. দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বের হলে।
যেসব কারণে রোজা না রাখলেও ক্ষতি নেই:
----------------------------------------------------
১. কোনো অসুখের কারণে রোযা রাখার শক্তি হারিয়ে ফেললে অথবা অসুখ বৃদ্ধির ভয় হলে। তবে পরে তা কাযা করতে হবে।
২. গর্ভবতী স্ত্রী লোকের সন্তান বা নিজের প্রাণ নাশের আশঙ্কা হলে রোজা ভঙ্গ করা বৈধ তবে কাযা করে দিতে হবে।
৩. যেসব স্ত্রী লোক নিজের বা অপরের সন্তানকে দুধ পান করান রোজা রাখার ফলে যদি দুধ না আসে তবে রোজা না রাখার অনুমতি আছে কিন্তু পরে কাযা আদায় করতে হবে।
৪. শরিয়তসম্মত মুসাফির অবস্থায় রোযা না রাখার অনুমতি আছে। তবে রাখাই উত্তম।
৫. কেউ হত্যার হুমকি দিলে রোযা ভঙ্গের অনুমতি আছে। পরে এর কাযা করতে হবে।
৬. কোনো রোগীর ক্ষুধা বা পিপাসা এমন পর্যায়ে চলে গেল এবং কোনো দ্বীনদার মুসলিম চিকিৎসকের মতে রোজা ভঙ্গ না করলে তখন মৃত্যুর আশঙ্কা আছে। তবে রোযা ভঙ্গ করা ওয়াজিব। পরে তা কাযা করতে হবে।
৭. হায়েজ-নেফাসগ্রস্ত (বিশেষ সময়ে) নারীদের জন্য রোজা রাখা জায়েজ নয়। পরবর্তীতে কাযা করতে হবে।
মাহে রমজানে সহীহ শুদ্ধভাবে আবশ্যকীয় বিধিবিধান শরিয়তের মাসআলা অনুযায়ী রোজাদারদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা দরকার।
পূর্বে এখানে প্রকাশিত