একজন মানুষ কেন হিজড়া হয় শুরুতে তার বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যাটা জেনে নেয়া প্রয়োজন। আমরা জানি, এক্স এক্স প্যাটার্ন ডিম্বানুর সমন্বয়ে কন্যাশিশু আর এক্স ওয়াই প্যাটার্ন থেকে সৃষ্ট হয় ছেলে শিশু। ভ্রুণের পূর্ণতার স্তরগুলোতে ক্রোমোজোম প্যাটার্নের প্রভাবে ছেলে শিশুর মধ্যে অণ্ডকোষ আর কন্যাশিশুর মধ্য ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। অণ্ডকোষ থেকে নিসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিসৃত হয় এস্ট্রোজেন। ভ্রুণের বিকাশকালে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ফলে বেশকিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয় যেমন ‘এক্স এক্স ওয়াই’ অথবা ‘এক্স ওয়াই ওয়াই’। আর এর ফলেই বিভিন্ন গঠনের হিজড়া শিশুর জন্ম হয়।
হিজড়াদের শারীরিক গঠন কেমন তা নিয়ে রয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে নানারকমের জল্পনা-কল্পনা। হিজড়ারা মূলত অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মতোই একটি শারীরিক গঠনজনিত সমস্যায় আক্রান্ত। অন্য প্রতিবন্ধীদের সাথে তাদের পার্থক্য কেবল প্রতিবন্ধকতার স্থানটিতে। বৈশিষ্ট্যগতভাবে হিজড়ারা দু’ধরনের: নারী অথবা পুরুষ। নারী হিজড়ার মধ্যে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য থাকলেও স্ত্রীজননাঙ্গ না থাকায় তার শারীরিক গঠন অস্বাভাবিক। পুরুষ হিজড়াদের ক্ষেত্রেও তাই। তবে নারী-পুরুষ যাই হোক না কেন, অধিকাংশ হিজড়ারাই নিজেদেরকে নারী হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে।
পৃথিবীর সব দেশের মতো আমাদের দেশেও হিজড়াদের দেখতে পাওয়া যায়। একটি বেসরকারি পরিসংখ্যান মতে, দেশে এখন লক্ষাধিক হিজড়া রয়েছে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ এই হিজড়াদের সামাজিক মর্যাদার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। আমাদের সমাজে হিজড়ারা একজন মানুষ হিসেবে মর্যাদাতো দূরের কথা, কুকুর-বিড়ালের অধিকারও পায় না। হিজড়া হয়ে কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট পরিবারটি ওই শিশুটিকে আর তাদের সঙ্গে রাখতে চায় না। নানা লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হয়ে শিশুটি অবশেষে পূর্ণবয়স্ক হতে না হতেই যোগ দেয় ছিন্নমূল কোনো হিজড়াদের দলে। এরপর তার জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ যাতনা। আমাদের সমাজে এটাই হিজড়াদের স্বাভাবিক পরিণতি। এই সমাজ তাদেরকে কর্মসংস্থানের সুযোগ কিংবা সামাজিক স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নয় বলে হিজড়াদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে যায় মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে ভিক্ষা করা। এভাবে অন্যের অনুকম্পার ওপর বেঁচে থাকার এক অভিশপ্ত সংগ্রামে যুক্ত হয়ে পড়ে এরা। স্বাভাবিক শ্রমজীবীদের মতো উপার্জনের কাজে এদেরকে জড়িত হতে দেখা যায় না। হাটে-বাজারে চাঁদা কিংবা বিনামূল্যে ভোগ্যপণ্য সংগ্রহ করেই এরা জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অঙ্গভঙ্গি করে মনোরঞ্জনকারী হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে তারা নাচগানে অংশ নিয়ে থাকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিকৃত যৌনপেশাসহ নানারকম অপরাধের সাথেও জড়িয়ে পড়ে।
আমাদের দেশে অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সামাজিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার নানারকম উদ্যোগ নিলেও হিজড়াদেও কল্যাণে সামান্যও নেয়া হয় নি এ পর্যন্ত। অথচ মানুষ হিসেবে হিজড়ারাও মানবাধিকারের যোগ্য। জাতিসংঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার আওতায় প্রত্যেক মানুষই কিছু মৌলিক অধিকারের দাবিদার। যেমন- দাসত্ব থেকে মুক্তি, ভোট প্রদান, মত প্রকাশ, কাজ করা, মানসম্মত জীবন-যাপন, আইনের আশ্রয় ও নির্যাতন থেকে মুক্তি এবং বিবাহ ও পরিবার গঠনের মতো অধিকারগুলো। এসব অধিকারপরিপন্থী কর্মকাণ্ডকে প্রতিরোধের জন্যে রয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক সনদ ও চুক্তি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, হিজড়াদের জীবনে এসব অধিকারের যৎসামান্য প্রভাবও কখনো পড়তে দেখা যায় না। একারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, মানবাধিকারবঞ্চিত এই হিজড়ারা কি তাহলে ‘মানুষ’ নয়?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজে স্বীকৃত মানুষ হিসেবে বসবাস করার অধিকার পেলে হিজড়ারাও স্বাভাবিক মানুষের মতো সামাজিক সম্পদে পরিণত হতে পারে। হিজড়াদের রয়েছে পরিশ্রমের ক্ষমতা, যার সদ্ব্যবহার করে তারাও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। তবে দীর্ঘদিনের অবহেলিত এই শ্রেণীটিকে সমাজের মূলস্রোতের অন্তর্ভূক্ত করা খুব সহজ কাজ নয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর বেসরকারি সংস্থাগুলোর সহায়তার সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে হিজড়াদের কল্যাণে কাজ করলে তবেই কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব। এলক্ষ্যে সরকারের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ-
১. পরিণত বয়সে পৌঁছার আগেই চিকিৎসার মাধ্যমে হিজড়া শিশুকে স্বাভাবিক কোনো সেক্সে পরিণত করা সম্ভব। এমনকি পরিণত বয়সে পৌঁছার পরও হিজড়া থেকে স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হবার রেকর্ড রয়েছে। ভারতের ‘অমলা’ নামের একজন নারী এভাবে চিকিৎসার মাধ্যমে পরিণত বয়সে হিজড়া থেকে পূর্ণ নারিত্ব অর্জন করেছিলেন। সুতরাং, জন্মের পরপরই হিজড়া শিশুদেও সরকারি উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত।
২. বিভিন্ন সামাজিক অধিকার যেমন পরিবারে সম্মানের সঙ্গে বসবাসের অধিকার, চাকুরির অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হিজড়ারা। অথচ এসব অধিকার রক্ষা ও বলবৎ করার দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্রের। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযাযী রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু হিজড়াদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয় নি এখন পর্যন্ত। অতিসত্বর হিজড়াদের জন্যে এই অধিকারগুলো সুনিশ্চিত করা দরকার।
৩. ভোটার তালিকায় হিজড়াদের অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন। ভারতে শবনম মৌসি নামের একজন হিজড়া লোকসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সুতরাং, সুযোগ পেলে তারা যে সমাজে অবদান রাখতে পারবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। আশার কথা এই যে, এবারের ভোটার তালিকায় হিজড়াদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে তাদের লিঙ্গ নির্ধারণে সমস্যার তৈরি হয়েছে। হিজড়ারা যেহেতু নারীও নয় পুরুষও নয়, একারণেই তাদের লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণে এই জটিলতা। এই সমস্যার সমাধানকল্পে তাদেরকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে।
৪. উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয় হিজড়াদের। অথচ এটি তাদের প্রাপ্য। অন্যান্য ধর্মের পারিবারিক আইনে হিজড়াদের সম্পর্কে কোনো কথা না থাকলেও ইসলামি আইনে তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত বিধান রাখা হয়েছে। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে হিজড়াদের অংশ স্বীকার করে ইসলাম। যেসব হিজড়ার মাঝে পুরুষালি স্বভাবের প্রাধান্য থাকে তাদেরকে পুরুষ আর যাদের মাঝে নারী স্বভাবের প্রাধান্য তাদেরকে নারী হিসেবে বিবেচনা করে সম্পত্তি বণ্টনের বিধান দিয়েছে ইসলাম। আর যেসব হিজড়ার মাঝে নারী-পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্যই সমভাবে বিদ্যমান, তাদেরকে নারী হিসেবে সম্পত্তি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। হিজড়াদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি প্রদানের ব্যাপারে সরকার এই নীতি অনুসরণ করে আইন প্রণয়ন করতে পারে।
৫. যে অধিকারটির ব্যাপারে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দিতে পারে সেটি হলো হিজড়াদের বিবাহের অধিকার। হিজড়াদের বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা নেই বলে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সাথে তাদের বিবাহ স্বীকৃত নয়। আমাদের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৭৭ নং ধারার আওতায় হিজড়াদের যৌনতাকে ‘সডোমি’ অর্থাৎ অস্বাভাবিক ও অনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, স্বাভাবিক মানুষের মতোই এদের রয়েছে যৌনচাহিদা। তাদের এই চাহিদার স্বীকৃতি না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্নরকম যৌন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে হিজড়ারা।
এই সমস্যার সমাধানে ভারতের দিল্লি− হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ গত ০২ জুলাই ২০০৯ তারিখে সমাকামিতাকে বৈধ ঘোষণা করে এক রায় ঘোষণা করেছে। ফলে হিজড়াদের নিজেদের মাঝে যৌন সম্পর্ক কিংবা বিবাহের বৈধতা এসেছে এই রায়ের আওতায়। আমাদের দেশের অনেক মানবাধিকারকর্মী এই রায়কে বাংলাদেশের হিজড়াদের জন্যে একটা উল্লেখযোগ্য নমুনা হিসেবে পেশ করছেন। কিন্তু, মুসলিমপ্রধান এই দেশে ঢালাওভাবে সমকামিতাকে বৈধ করা বাস্তবিক হবে না। হিজড়াদের যৌনতার স্বীকৃতি প্রদানে হিজড়াদের নিজেদের মাঝে বিবাহের স্বীকৃতি প্রদান করা যেতে পারে আমাদের দেশে। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে যেহেতু হিজড়ারা নারী-পুরুষ দু’ভাগে বিভক্ত সুতরাং এই দু’ধরনের হিজড়াদের মাঝে বিবাহের বৈধতা দেয়া যেতে পারে।
হিজড়াদেরকে সমাজের মূলস্রোতের অন্তর্ভূক্ত করবার দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে আমাদের দেশে। সাম্প্রতিক সময়ে হিজড়াদের জীবন নিয়ে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি এবং ফিল্ম নির্মিত হয়েছে। মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর সেটি করতে হলে হিজড়াদের যাবতীয় অধিকারের সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নির্ধারিত করে রাখতে হবে সরকারের। হিজড়াদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ১০:৪৩