দক্ষিণের এই ছোট নীল জানালা টা দিয়ে কত কিছু দেখেছি, কত্ত কিছু! দেখেছি আব্বুরা আর চাচ্চুরা ঈদের নামাজ পড়ে আসছেন, আমাদের রিক্সাগুলো বাড়ির সামনে এসে থামলে দিদু কে দেখেছি ওই জানালা টা ধরে তাকিয়ে আছেন। দেখেছি দুষ্ট ছেলেদের দিদুর আম গাছে ঢিল মারতে। দেখেছি আমার ছোট ফুপ্পির শশুরবাড়ি চলে যাওয়া, সবাই মিলে কাঁদতে কাঁদতে দেখেছি আমার সেঝ চাচ্চুর লাশ টা নিয়ে আব্বুদের হেঁটে যাওয়া। এই ছোট জানালাটা কতদিনের, কত বছরের, কত যুগের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে! ঈদের দিন সকালে আমাদের সব ভাইবোনদের একটা নিরব প্রতিযোগিতা ছিল- আব্বুরা নামাজ থেকে আসার আগে কে কে রেডি হতে পারে। জানালা টা দিয়ে তাই সারাক্ষন পাহারা দিতাম ওনাদের আসার। সবার আম্মুরা সবাইকে রেডি করছেন, জামায় পা গলাচ্ছি তো পায়জামায় হাত, কি করব চোখ তো জানালায়!
‘দিদুবাড়ি’...... একটা বিশাল বাড়ি আর তারচেয়েও বিশাল আমাদের স্মৃতিগুলি। স্কয়ার ফিটে কোনদিন মেপে দেখিনি বাড়িটা আসলে কত বড় ছিল। কিন্তু একেক সময় মনে হত আমাদের দিদুবাড়ির মত এত সুন্দর আর এত বড় জায়গা মনে হয় পৃথিবী তে আর নেই। যে কোন শর্তের বিনিময়ে আমাদের ‘দিদুবাড়ী’ যেতেই হত। দিদু বাড়িতে যাওয়ার জন্য টিকিট কাটা, সেই টিকিট বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমানো, ট্রেনে কি জামা পরব সেটা রেডি করা, ট্রেনের জানালা দিয়ে শীতলক্ষ্যার পানিতে ফেলবার জন্য কাগজের নৌকা বানানো- এসব পাগলামিতে উন্মত্ত হয়ে উঠতাম প্রতিবার দিদুবাড়ী যাবার আগে। জানিনা কি কারনে করতাম সেসব পাগলামি! ভৈরব কিংবা আখাউড়া পর্যন্ত গেলেই আমরা ভাইবোনরা একজন আরেকজন কে জিজ্ঞেস করতাম, ‘গন্ধ পাও দিদুবাড়ির?’ কি উদ্ভট প্রশ্ন! অথচ বিজ্ঞের মত আমরাই জবাব দিতাম, ‘হ্যাঁ, পাই, দিদুর পানের গন্ধ পাই, দিদুর পশ্চিম দিকের ঘর থেকে আচারের গন্ধ পাই, আর দিদুর নতুন ঝাড়া লেপতোশকের ওম ওম গন্ধ পাই’।
ছোট একটা উঠান, তিনধাপ সিঁড়ি বেয়ে লম্বা বারান্দা টা, পুরানো ধুসর কাঠের সেই গেইটটা, দিদুর চিনামাটির তেতুলের আর তালমিছরির বয়মগুলো, পূর্ব দিকের চাপকল টা আর সেই রহস্যময় উঁচু বাথরুম টা কিংবা পাকের ঘরের পিছের বড় অড়বড়ি গাছ টা- যেটাই দেখতাম মনে মনে বলতাম, ‘তোর জন্যই তো আসি রে বারবার, তোরাই তো আমার দিদুবাড়ি’! কিন্তু জানিনা কেন, সব কিছুর স্মৃতি কে ছাপিয়ে সেই নীল দরজা আর জানালা গুলো আমার প্রানে এমন বেঁধে গেল কেন! সকালে হলে দিদু যখন সবগুলো নীল দরজা খুলে দিতেন মনে হত ‘এ কোন সূর্য উঠলো আজ? কোন পৃথিবীর আলো এসে লাগলো আমার চোখে মুখে?
দিদুর চলে যাবার পর যেন মৃত আগ্নেয়গিরি হয়ে গেল আমাদের ‘দিদুবাড়ী’ টা। সব স্মৃতি, সবগুলো জায়গা, প্রতিটা আনাচে-কানাচে দগদগ করে জ্বলছে কিন্তু প্রচণ্ড উত্তাপের আর ভালবাসার সেই কিংবদন্তি ‘দিদু’ তো নেই, কোথাও নেই! সেই নীল জানালা টা ধরে দাঁড়িয়ে নেই, উত্তরের ঘরে ছোট পিঁড়ি তে মাথা দিয়ে শুয়েও নেই আমার দিদু, কোথাও নেই! তারপর সেই অনন্ত শুণ্যতা টা ঠিক কিভাবে কাটিয়ে উঠলাম তাও মনে নেই, মনে রাখিনি। এরপরেও কয়েকবার গিয়েছি ‘দিদুবাড়ি’ তে। চাচাত বোনের বিয়েতে, ছোট চাচ্চুর দাওয়াতে; কিন্তু আমি জানি, আমি দেখেছি আমরা প্রত্যেকটা ভাইবোন, আমার আব্বু-আম্মু আমরা সবাই মনে মনে, চুরি চুরি চোখে খুজেছি আমার দিদু কে- রিক্সা থেকে নেমে সবাই তাকিয়েছি সেই নীল জানালাটার দিকে, উত্তরের খাবার ঘরের বিছানা তে, বার বার ব্যর্থ হয়েছে আমাদের এতগুলু চোখ। হাজার চিৎকার আর হই-হুল্লড়ে একটা কণ্ঠ কোথাও শুনিনি- “কিরে তরা খাইতেনা?” কিংবা “মাহাবুউউব, দ্যাখ্ আইয়া...”, কেউ শুনিনি।
তারপরেও বাড়িটা ছিল, স্মৃতি পাহাড় জমে ছিল বাড়িটা কে ঘিরে। ছোট চাচ্চু ঢাকায় আসলেই জিজ্ঞেস করতাম, “চাচ্চু, দিদুর বড় ট্রাংকটা আছে? আতা গাছটা কি মরে গেছে? সাক্কার মা (আমাদের একজন ভাড়াটিয়া) কি এখনও আছে? পাগল করে ফেলতাম চাচ্চু কে।
তারপর একদিন গল্পের দরজায় বাস্তবতা কড়া নাড়ল। অনেক জোরেই যেন নড়ে উঠলো আমাদের স্মৃতিময় ‘দিদুবাড়ি’টা। বড় বড় মানুষগুলো সিদ্ধান্ত নিলেন সেখানে একটা বড় আবাস হবে, মানুষের (স্বপ্নের না !!!)। বড় বড় ঘর হবে, বড় বড় গাড়ী আসবে, বড় একটা চলন্ত সিঁড়ি থাকবে। সবাই খুশি, ভীষণ খুশি। চকচকে চোখে সবাই শুধু বড় বাড়ীর বড় বড় স্বপ্নের কথা বলে! হঠাৎ করে টের পেলাম আমার চারপাশের বড় মানুষগুলো গালিভারের মত বিশাল হয়ে গেল আমার সামনে। আর আমি লিলিপুটের মত পিটপিট করে চেয়ে চেয়ে কিছুই বুঝলাম না ওদের কথা। বুঝলাম না এত বড় ‘দিদুবাড়ি’র কি হবে তাহলে? এর চেয়ে বড় বাড়ি দিয়ে ওঁরা কি করবে? স্মৃতিগুলো চাবুকের মত বিঁধে বিঁধে বিদায় নিচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করে বলি আমার ‘দিদুবাড়ি’টা আমাকে দিয়ে দেন! আমার নীল জানালা, আমার কলের পাড়, আমার অড়বড়ই গাছটা, আমার দাদার পুরানো গন্ধের বইয়ের আলমারিটা............। চিৎকার করতে পারিনি, কিন্তু কাঁদতে পেরেছি। নতুন ইট, বালির দৈত্তকায় স্তূপের ভিড়ে আমার এত বড় ‘দিদুবাড়ি’টাকে ছোট হয়ে যেতে দেখে কেঁদেছি। আস্তে আস্তে একটা প্রকাণ্ড স্বপ্নের প্রাসাদ কে মৃত্যুবরণ করতে দেখে কেঁদেছি।
আর সবার কাছে ইনিয়ে-বিনিয়ে চেয়েছি একটা নীল জানালা, সেই নীল জানালা...............
আলোচিত ব্লগ
আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”
একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?
যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন
হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই
হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই
আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন
তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন
নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।