somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের ফুটানি

১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রতন টাটার ব্যাপারে অনেক ঘটনা ইদানিং শুনছি, তবে দুইটা ঘটনা খুবই ভাল লেগেছে।
প্রথমটায় ব্রিটিশ কিং চার্লসও জড়িত।
চার্লস তখন প্রিন্স। রতন টাটার সম্মানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। রতন টাটা সেই অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। কেন? কারন উনার পোষা দুইটা কুকুর অসুস্থ ছিল। তিনি ওদের এই অবস্থায় ফেলে যেতে পারেননি।
কল্পনা করতে পারেন? সামান্য কুকুরের প্রতি ভালবাসা থেকে প্রিন্স চার্লসের নিমন্ত্রণ রক্ষা না করা!
এতে প্রিন্সের চোখে তাঁর সম্মান আরও বেড়ে যায়। তিনি বলেন "এই গুণাবলীই রতনকে রতন বানিয়েছে!"

দ্বিতীয় ঘটনা আগেও বলেছি। "টাটা ন্যানোর" পেছনের কাহিনী।
একদিন তিনি নিজের গাড়িতে শহরে ঘুরছিলেন। এমন সময়ে দেখেন একটি পরিবারের চার সদস্য স্কুটির উপর ভিজতে ভিজতে কোথাও যাচ্ছেন। তাঁর মনে হলো, এদের জন্য তাঁকেই কিছু করতে হবে।
মানসিকতাটা লক্ষ্য করুন। সরকার বা অন্য কারোর দিকে না তাকিয়ে নিজের সামর্থ্যে যা সম্ভব, সেটাই করা। আপনি দেশের শিক্ষার হার ও মান নিয়ে হতাশ? তাহলে আপনি বলেনতো, কয়টা মানুষকে বর্ণমালা শিখিয়েছেন? আপনার বাড়ির কাজের ছেলেটাকে কখনও স্কুলে পাঠিয়েছেন? আপনার বাড়িতে কাজ
করে এসএসসি/এইচএসসি পাশ করেছে কোন কাজের লোক?
এখন ওদেরকে কাজের লোক বলা যায় না, হেল্পিং হ্যান্ড বা সহায়তাকারী বলতে হয়। এতে নাকি ইজ্জত বাড়ে। অথচ প্রকৃত ইজ্জততো লেখাপড়ায় বাড়ে। সেটার ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা কি?
আমার ছেলের চাইতে আমার "হেল্পিং হ্যান্ডের" রেজাল্ট যদি ভাল হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত আমাদের সমাজে আমার ইজ্জত নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তখন ওর পড়ালেখা বন্ধ করে দিব। ঠিক না?
অথচ বিষয়টাকে কিন্তু উল্টোভাবেও দেখা যায়। আমার বরং গর্ব করার কথা একটা গরিব বাচ্চার জীবন আমি পাল্টে দিয়েছি। আমার ব্যাকগ্রাউন্ড ও নেটওয়ার্কের কারনে হয়তো আমার ছেলে বাজে রেজাল্ট করেও সমাজে বহুদূর যেতে পারবে, যে যুবকটার কিছুই নেই, ঐ ভাল রেজাল্টই ওর একমাত্র ভরসা, কেননা ওর পথটা আরও মসৃন করে দেই?
প্র্যাকটিক্যাল উদাহরণ দেই।
আমার দাদার আমলের একটা কাজের বুয়া ছিল, যার বিয়েও হয়েছিল আমাদেরই আরেক কাজের লোকের সাথে। ওদের বাচ্চাকাচ্চাদের জন্মও আমাদের বাড়িতে। সেই বাচ্চাগুলির বিয়ে শাদিও আমাদের দাদা দাদি আব্বু চাচারা দিয়েছেন।
তা ওদের পড়ালেখার ব্রেন ছিল না। হতেই পারে। সবাই পড়ুয়া হয়না। ওদের এক ভাইকে মিডল ইস্ট পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। বোনের বিয়ে দেয়া হয়েছিল রেলওয়ের এক কর্মচারীর সাথে। উপরি কামাই বলেন, বা ঘুষ বলেন, ওদের আয় রোজগার ভালই ছিল। তা বোনটা প্রথমেই যে কাজটা করে সেটা হচ্ছে এই টাকা নিজের বাচ্চাদের শিক্ষার পেছনে খরচ করে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত বানিয়েছে। ছেলেটা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে ও-এ লেভেল দিয়েছে। মেয়েটা সিএ হওয়ার জন্য পড়ছিল, এতদিনে হয়তো হয়েও গেছে। ওদের কথাবার্তায় কেউ কিছুতেই বুঝবে না এক পুরুষ আগেও ওরা কারোর বাড়ির "হেল্পিং হ্যান্ড" ছিল।
আমার বাবার দাদার ঘোড়ার যত্ন নিত যে লোকটা, ওর নাতি ৮০র দশকে আমেরিকায় এসে নিজের সংসার গুছিয়েছে। ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছে, লেখাপড়া করিয়েছে, এখন সবকটা ভাইবোন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, টাকা পয়সার দিক দিয়ে অনেক অনেক ভাল অবস্থানে আছে।
কথা হচ্ছে, ওদের উন্নতিতে কি আমরা ছোট হয়ে গেলাম? ওরা ওদের ভুবনে বেশ আছে, আমরাও আমাদের জগতে খুশি। পৃথিবীটা যে অনেক বড়, সেটাই আমরা ভুলে যাই।
তা এই কথার জের ধরে আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল।
আমাদের দেশেই আমি দেখি লোকজন নিজের অতীত বা বর্তমানের দুরবস্থা লুকাতে চায়। স্টিভ জবস যেখানে নির্দ্বিধায় বলতেন যে তিনি একটা সময়ে হরেকৃষ্ণ টেম্পলে গিয়ে খাবার খেতেন (কাঙালি ভোজ) কারন তাঁর পকেটে পয়সা ছিল না, এবং বারাক ওবামা বলতেন উনার সিঙ্গেল মা "ফুড স্ট্যাম্প" দিয়ে উনাকে পেলেছেন, আমাদের দেশে এসব স্বীকার করলেই আমাদের জাত চলে যায়! বন্যার্তদের ছবি তোলা যাবেনা। কেন? কারন যে বন্যায় ত্রাণ নিচ্ছে, ওতো ফকির না। এখন দুর্ভাগ্যবশত ওর বাড়িঘর পানিতে ডুবেছে বলেই ওকে ত্রাণ নিতে হচ্ছে। তাই কারোর সাহায্য নেয়ার ছবি ফেসবুকে আপলোড হলে সমাজে ওর ইজ্জত যাবে।
এই সামাজিক লজ্জার ভয়েই লোকে ত্রাণ নিতে আসে না, চিকিৎসার সময়ে টাকা সাহায্য চায়না, চাকরি হারালে চাকরির জন্য বলে না, ইত্যাদি।
তো এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, বন্যা বা রোগটা কি ওর নিজের কর্মগুণে হয়েছে? না। তাহলে ওর লজ্জার কি আছে? আজকে কারোর দুঃসময়ে যদি আমরা হাসিতামাশা করি বা করুণা করি, তাহলে আমরাইতো অমানুষ। যে সমাজের ভয়ে উনারা এমনটা করেন, আমরাইতো সেই সমাজ। আমরা এমন কেন? একটা মানুষ বিপদে পড়লে কেন আমার ভয়ে মুখ ফুটে সাহায্য চাইবে না?
লজ্জাতো তাদের পাওয়া উচিত যারা ঘুষ খায়, দুর্নীতি করে, অন্যের জমি দখল করে, ব্যাংক ঋণ মেরে দেয়। ওদেরকে উল্টো আমরা সম্মান করি। সামনে দাঁড়ালে সেলফি তুলি। ফেসবুকে ছবি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করি আমারও সমাজে কদর আছে।
অন্য ট্র্যাকে চলে যাচ্ছি। টাটা ন্যানোর কাহিনীতে ফেরা যাক।
ন্যানো প্রজেক্ট ফেল করে। কেন জানেন? ওরা মার্কেটিং করেছিল "দুনিয়ার সবচেয়ে সস্তা গাড়ি" হিসেবে। আমাদের উপমহাদেশের লোকেরা গাড়িকে প্রেস্টিজের ইস্যু মনে করে। আপনার গাড়ি আছে মানে আপনি বড়লোক। সমাজ আপনাকে ইজ্জত করবে। আপনি যদি টাটা ন্যানো চালান, আপনিতো দুনিয়ার সবচেয়ে সস্তা গাড়ি চালালেন। আপনার ইজ্জত হলো কোথায়? লোকে ভিজতে ভিজতে স্কুটার চালাবে, অটো রিক্সায় চড়বে, তবু ন্যানো কিনবে না।
অথচ মার্কেটিং যদি করা হতো এইভাবে যে "স্মার্ট যুগে স্মার্ট মানুষেরা বেঢপ সাইজের গাড়ি না কিনে ন্যানো কিনে" কিংবা "সুন্দরী মেয়েরা ন্যানোর মালিকের প্রেমে পড়ছে, কারন লোকটা স্মার্ট" তাহলেই দেখতেন প্রজেক্ট হিট হয়ে যেত।
অদ্ভুত মানসিকতা?
আমাদের দেশেও কিন্তু তাই।
স্পৃহা ফাউন্ডেশন গরিব মানুষের সুবিধার জন্য ক্লিনিকের ব্যবস্থা করেছে। ভাল ডাক্তার সস্তায় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। ইচ্ছা ছিল বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেয়ার, কিন্তু মানুষের কারণেই সেটা বাতিল করা হয়েছে।
এমন না যে সব হাতুড়ে ডাক্তার যারা কোথাও কোন কাজ পায় না, ওদেরকে ধরে এনে আমরা বসিয়ে দিচ্ছি। এই সমস্ত ডাক্তারদের কাছেই রোগীরা পয়সা খরচ করে ক্লিনিকে লাইনে দাঁড়ায়। উনাদের অশেষ দয়া যে উনারা নিজের কর্মব্যস্ত দিনের একটা সময় সমাজের গরিব/নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য দেন।
কিন্তু দেখা গেল, আমাদের তাজিন (চেয়ারম্যান) ভাই, নিজের প্রেগন্যান্ট বৌয়ের চিকিৎসা এই ক্লিনিকে করালেও উনার ড্রাইভারই এই ক্লিনিকে নিজের বৌয়ের চিকিৎসা করায় না। ওরও প্রেস্টিজ আছে। ও একজন ড্রাইভার। ও কি "সস্তা/গরিবের ডাক্তারের" কাছে চিকিৎসা করাতে পারে?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় রিটেইল চেইন ওয়ালমার্টের মিশন স্টেটমেন্ট হচ্ছে save money, live better. আজকে ওয়ালমার্ট বিশ্বের একনম্বর রিটেইল জায়ান্ট।
আমাদের দেশে হয়তো এই প্রজেক্ট মার খেত।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১১:৫৯
৯৭০ বার পঠিত
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক সিস্টেম কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতনের পর ড. ইউনূসের সরকার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্কার কাজের প্রতিশ্রুতি দেন। নির্বাচন কমিশন ও ভোটের পদ্ধতি সংস্কারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

WW3 WARNING ☣️- ব্রিটেন, আমেরিকা,রাশিয়া,ইউক্রেন

লিখেছেন সরকার পায়েল, ২০ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩৮

এই প্রথম রাশিয়ায় ব্রিটেনের স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ইউক্রেনের
এই প্রথমবারের মতো রাশিয়ার অভ্যন্তরে যুক্তরাজ্যের তৈরি দূরপাল্লার স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইউক্রেন। বুধবার (২০ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে আমি.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১১

কে আমি?.....

Jean-Paul Charles Aymard Sartre (আমরা সংক্ষেপে বলি- জ্যা পল সাত্রে) নাম ভুলে যাওয়া একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম, জার্মানীর অর্ধ অধিকৃত ফরাসীদের নিয়ে।

'হিটলারের সৈন্যরা প্যারিস দখল করে নিয়েছে। কয়েকশো মাইল দূরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হচ্ছে না!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৮


বেশ কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক আওয়ামী লীগ কে নিষিদ্ধ করার জন্য সমাজের একটি বৃহৎ অংশ দাবী জানিয়ে আসছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি কে অনেকে দায়ী করছে কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পকে আধুনিকায়নের চেষ্টা

লিখেছেন জটিল ভাই, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)


(ছবি নেট হতে)

বনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×