হঠাৎ করেই আমার বাড়িতে সেদিন মিসির আলীর আগমন ঘটলো। রোগী আমি নিজে। গত কয়েকদিন ধরে আমার হাসি থামছে না, আমার বৌ ধরেই নিয়েছে হয় আমি পাগল হয়ে গেছি, নাহয় জ্বিনে ধরেছে।
একটা মানুষ টানা কতক্ষন হাসতে পারে? হাসতে হাসতেই মানুষ ক্লান্ত হয়, ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে গিয়ে হাসিটা থামায়।
কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটছে না।
আমি হেসেই যাচ্ছি। হাসতে হাসতে ক্লান্ত হচ্ছি, বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছি, এমনকি হেঁচকিও তুলছি, তারপরেও হাসি বন্ধ হচ্ছেনা।
আমার সামনে ট্র্যাজিক সিনেমা চালু করা হলো। টাইটানিক। বরফের হিমশৈলে জাহাজ ধাক্কা খেয়ে ফেটে গিয়ে মুহূর্তেই কয়েক হাজার মানুষ মারা গেল। রোজকে বাঁচাতে গিয়ে জ্যাক ডুবে গিয়ে অমর হয়ে গেল। বাড়ির সবাই কাঁদলো। আমি তখনও খিলখিল করে হাসছি।
কে যেন বিষে বিষ খয়ের বুদ্ধি দিল। বলল জায়েদ খানের সিনেমা ছেড়ে দিতে। ওর কান্নার অভিনয় দেখে সবাই হাসে, আমি এমনিতেও হাসছি। যদি কাজ হয়!
দেখা গেল উল্টোটা হলো। আমি হাসতে হাসতে তখনই প্রথম হেঁচকি তোলা শুরু করেছিলাম।
আমার অবস্থা দেখে সাথে সাথে সিনেমা বন্ধ করা হলো।
ডাক্তার দেখানো হলো। শরীরের সবকিছু পরীক্ষা করা হলো। ব্লাড প্রেশার মাপতে পারলো না। সেজন্য আমাকে বারবার রিল্যাক্সড হয়ে বসতে বলছিলেন। কিন্তু হাসির দমকে রিল্যাক্সড হবো কিভাবে?
ডাক্তার বলে দিলেন আমি উনার চিকিৎসার উর্দ্ধে।
বাড়ির সবাই ধরে নিয়েছে আমার উপর কোন প্রেতাত্মা ভর করেছে। কোন দুষ্টু জ্বিন। হয়তো সন্ধ্যাবেলায় খোলা চুলে বাইরে ছিলাম। অথবা, ইন্দোপাক গ্রোসারি থেকে ফ্রোজেন ফিশ কিনে বাড়ি ফেরার সময়ে কোন ভূতের লোভী নজরে পড়েছি।
তাই মিসির আলীকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে।
মিসির আলীর এতদিনে বয়স অনেকটুকু বেড়ে গেছে। রোগা হয়েছেন আরও বেশি। বয়সের ভারে সামান্য কুঁজো হয়েছেন। মাথার চুল সামান্য পাতলা হয়েছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমাও আছে। তবুও তাঁর ছোখের চাহনিতে বুদ্ধির মাত্রা এতটুকু কমেনি। সাথে কণ্ঠস্বরের গভীরতাও যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি এসে আমাকে বললেন, "কেমন আছো মঞ্জুর?"
আমি তখনও খিলখিল করে হাসছি। হাসির চোটে কথা বলতে পারছি না। ইশারায় বলতে বাধ্য হলাম, ভাল আছি। আপনি ভাল?
তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, "শুনলাম তোমার উপর নাকি প্রেতাত্মা ভর করেছে?"
আমি তখনও হাসছি। কথা বলতে পারছি না। ইশারায় বুঝালাম "ওসব প্রেতাত্মা ফ্ৰেতাত্মা সব গুজব। আপনি গুণী মানুষ, আমার বাড়িতে বহুদিন পর এসেছেন। কি খাবেন আগে সেটা বলেন।"
তিনি ইশারায় কথা বুঝলেন। বললেন, "আমার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হতে হবেনা। বিভিন্ন রোগের রোগী আমি, সবকিছু খেতেও পারি না। এক গ্লাস পানি হলে ভাল হয়।"
হাসতে হাসতেই ইশারায় বললাম, "শুধু পানি খেলে কি হবে? লোকে ছিঃছিঃ করবে। বলবে মিসির আলীকে শুধু পানি খাইয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করেছি? এ অসম্ভব! আপনাকে আজকে আমাদের সাথে লাঞ্চ করতেই হবে। আপাতত চিপস এন্ড ডিপস হলেও খান। একটু পরে আপনার জন্য আমি নিজে টামাহক স্টেক বানাবো। সাথে ল্যাম্ব চপস।"
তিনি বললেন, "আরে না, সত্যিই বলছি। এইসব খাবার আমার জন্য এখন বিষ! আপাতত পানি দাও।"
বৌকে ইশারায় বললাম পানি এনে দিতে। সে ছুটে গেল।
মিসির আলী কয়েকটা কার্ড খুলে বললেন, "তোমার ইএসপি পরীক্ষা হয়ে যাক। বলতো এই কার্ডে কি চিহ্ন আছে?"
আমি হাসতে হাসতে ইশারায় বললাম, "বললাম না, আমার উপর কোন প্রেতাত্মা ভর করেনি! ওসব কার্ড ফার্ডের পরীক্ষা করা লাগবে না।"
তিনি বললেন, "প্রেতাত্মা ভর না করলে তুমি ঠিক কি কারনে এমনভাবে হাসছো?"
আমার হাসির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। মিসির আলীর ভ্রু কুঞ্চনও। আগে তাও ইশারা ইঙ্গিত দিতে পারছিলাম। এখন সেটাও পারছি না। ওরে বাবুরে! হোহোহো! হাহাহা। হিহিহি!
তারপরে বহু কষ্টে নিজেকে সামলে ইশারায় আমার ফোন দেখালাম।
মিসির আলী ভরাট স্বরে জানতে চাইলেন, "মোবাইল ফোন? এনে দিব?"
মাথা হ্যা সূচক নাড়লাম।
তিনি এনে দিলেন। আমি লক খুলে ফেসবুকে ঢুকে একটা ভাইরাল পোস্ট খুঁজে বের করলাম।
ঢাবির শিবির নেতা সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছে "শিবির কখনই রগ কাটে নাই। হল দখলের রাজনীতি করে নাই।"
মিসির আলীর জন্য পানি নিয়ে আমার বৌ আমার ঘরে এসে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলো। আমরা দুইজনই খিলখিল করে হাসছি। মিসির আলীর হাসি আমার চেয়েও বহুগুন বেশি। হাসতে হাসতে তাঁর চোখের চশমা খুলে ফেলেছেন। হাসির দমকে আমার পিঠে কিল ঘুষি মারছেন। কিল খেয়ে আমিও হেসেই চলেছি। তিনি শিশুদের মতন মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। হাত পা ছুড়াছুড়ি করছেন। তবু তাঁর হাসি থামছে না। হাহাহাহা। হোহোহোহো! হিহিহিহি!
আমার বৌ ভয়ে আয়াতুল কুরসী পড়া শুরু করলো। এ কেমন কঠিন জ্বিনের আছর! মিসির আলীকেও কুপোকাত করে ফেলেছে! আর লোকে কিনা ভূতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে!